সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেমন চলমান ছিল, তেমনি রাজনৈতিক বক্তৃতাও নিত্য চলতো চট্টগ্রাম কলেজে। আবার তার ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষকদের বাসায় বাসায় অর্থাৎ গুরুগৃহে চলতো ব্যাচে ব্যাচে অর্থের বিনিময়ে পাঠ প্রক্রিয়া। আমি এই পাঠ প্রক্রিয়ায় নিজেকে বারবার ছিটকে পড়তে দেখলাম। এত ছোটাছুটি আমার পোষায় না। আমি দেখি, কেবল দৌড়াচ্ছি এক গুরুগৃহ থেকে অন্য গুরুগৃহে। কিন্তু নিজের একান্তে পাঠের অবসর নেই। একসময় পিতৃদেবকে একথা জানাতে বাধ্য হলাম। তখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো কেমিস্ট্রির ডেমন্সট্রেটর মান্নান স্যারের বাসায়। আব্বার সাথে স্যারের বেশ ঘনিষ্টতা টের পেলাম। স্যার আমাকে সাধারণ গণিত, ঐচ্ছিক গণিত, স্ট্যাটিক্স, ডাইনামিক্স, পদার্থবিদ্যাসহ রসায়ন পড়াতেন। পড়াতেন বললে ভুল হবে, পড়তে বসিয়ে দিয়ে স্যার চলে যেতেন বাজারে। বাজার থেকে ফিরে আমার পড়া নিতেন এবং ভুলভ্রান্তি শুধরে দিতেন। আমি সকাল সাতটায় স্যারের বাসায় ঢুকতাম, কিন্তু বের হবার কোন সময়সীমা ছিল না। এর ফলে টেক্সট বই পড়া শেষ করে টেস্ট পেপার শেষ করা সবই খুব সুন্দরভাবে চলতে লাগলো। এদিকে কলেজের ক্লাসগুলো অনেকটা বিনোদনের কাজে ব্যবহার হতো বটে। তবে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌল্লা স্যারের ক্লাস আমার খুব প্রিয় ছিল। স্যার যখন খেয়াপারের তরণী পড়াতেন সুর করে করে— বলতেন “আবু বক / রুসমান / ওম রালী / হায় দার” —— তারপর বলতেন ছন্দের ব্যাখ্যা “হেঁটে হেঁটে থেমে আর থেমে থেমে হেঁটে”— তখন ছন্দের এই দোলায় মুগ্ধ হয়ে কোন মগ্ন চৈতন্যে যেন নিমগ্ন হতাম। তখন হরলাল রায়ের বই আমাকে আর ছন্দ বিষয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারায় খুঁজতে লাগলাম ছন্দ বিষয়ক বই। পরে যদিও শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’ এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ আমার ছন্দশিক্ষায় পুষ্টি যুগিয়েছে, তবে ছন্দের মায়া আমার কান ও মনে চিরস্থায়ীভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সিরাজদ্দৌল্লা স্যার।
আমাদের এতো ব্যস্ততার মধ্যেও সেলিম ও এমরানের সাথে যে স্কুলজীবন থেকে চলমান ত্রিচক্র সম্মিলন তা অটুট রয়ে গেল। স্যারদের বাসায় পড়া এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের অবসরে আমাদের আড্ডা ও ঘোরাঘুরি চলতো। আমার মনে পড়ে এসএসসি পরীক্ষার পরে আমি যখন বসে আছি, গল্প কবিতা পড়ে দিন কাটছে, সেলিম তখন শুরু করেছে সীসার ব্যবসা। চট্টগ্রাম থেকে থলে ভরে সীসা নিয়ে বাসে চড়ে ঢাকায় গিয়ে বিক্রি করতো। তার এই ঢাকা যাওয়া আসা আমার কাছে অভিযান তুল্য। কারণ, অভিভাবক ছাড়া শহরের বাইরে দূরযাত্রা তখনও আমার ভাগ্যে জোটেনি। কাজ ছিল কেবল এমরানের বাসার সামনে পাঁচলাইশ জাতিসংঘ পার্কে বিকেলের আড্ডা আর সেলিমের দেওয়ানজিপুকুর পাড়ের বাসায় আড্ডা দেওয়া।
ওখানেও একটা আড্ডার পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। সেলিমের সাথে ঘনিষ্টতা সেই নবম শ্রেণী থেকেই, সম্ভবত দত্ত স্যারের কাছে পড়ার কারণে। সেলিমের সাইকেলের সামনে পেছনে বসে আমি ও এমরান বোঁ বোঁ করে ঘুরে বেড়াতাম চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামে নানান অলিগলিতে। একদিন সেলিমের সাথে ঢাকা বেড়াতে যাবার প্রস্তাব করলাম। এমরানও রাজি। এমরানসহ যাব শুনে আমার বাসা থেকে অনুমতি পেলাম। কিন্তু শেষমুহূর্তে এমরান বাস স্ট্যান্ডে এসে জানালো তার অনুমতি মেলেনি, সে যাবে না। অগত্যা দু’জনেই রওনা দিলাম। আমি জানতাম না, সেলিম ঢাকায় কোথায় থাকে। জীবনে প্রথম ঢাকায় যাচ্ছি এক অনিশ্চয়তার ভেতরে। কোন অভিভাবক নেই, কেবল সমবয়সী এক বন্ধু। সেলিমের ঈঙ্গিতে আমরা যাত্রাবাড়ি নেমে রিকশাযোগে গেলাম পোস্তগোলা নামে এক জায়গাঁর উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম, কোন হোটেল কিংবা নিদেনপক্ষে কোন আত্মীয়ের বাসায় সে যাবে। কিন্তু না, রিকশা পৌঁছে থেমে গেল একটা খালের পাড়ে। সেলিমের পিছু পিছু নেমে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে আমরা নিজেদের দেখতে পেলাম একটা ঘিন্জি বস্তি এলাকায়, তখন বিকেল ফুরিয়ে আসছে। সেলিমের ডাকাডাকিতে তার কাঙ্ক্ষিত ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। আমাকে সাথে দেখে একটু বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা ও ঘাড় চুলকালেন। তার গ্যান্জি ও লুঙ্গির ফাঁক দিয়ে কেশভরা ভুড়ি বেশ প্রকট। কাঁচাপাকা দাড়ি। বিড়ি টানতে টানতে বললেন, ঠিক আছে তোমরা তবে মসজিদেই থেকে যাও। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, প্রথমটায় যতটা নোংরা মনে হচ্ছিল, পাড়াটা ততো নোংরা নয়। কোথাও টিন কোথাও ছনের ছাউনির বেড়ার ঘরগুলোর সামনে ও আশেপাশে বেশ নিকোনো পরিপাটি মাটির চত্বর। ভদ্রলোকের নাম আজ মনে নেই। তিনি তার ঘরে আমাদের বসালেন এবং চা-নাস্তা দিলেন। আমরা জামাকাপড় ছেড়ে একমাত্র চাপকলে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। তারপর আলাপ আড্ডায় সন্ধ্যা নেমে এলে রাতের আহার শেষে আমাদের ঘুমানোর জন্যে পাড়ার সবচেয়ে পরিপাটি ঘরটি অর্থাৎ মসজিদে বিছানা পাতা হলো। একরাত থাকার পরে সেলিম আমাকে বাসাবো এলাকায় সরকারী কোয়ার্টারে তার পরিচিত এক ভদ্রলোকের বাসায় নিয়ে গেল। তিনি একা থাকতেন। আমি এখানে রইলাম বটে, কিন্তু সেলিম রয়ে গেল পোস্তগোলার বস্তিতে। অগত্যা নিজেই একা একা ঢাকা শহর ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। হাতে সামান্য ক’টা টাকা, তার ওপর অচেনা ঢাকা। বুকের ভেতর চাপা আতঙ্ক নিয়ে একা অনভিজ্ঞ আমি কিছুটা হেঁটে কিছুটা বাসে চড়ে ঢাকা দেখতে বের হই। গুলিস্তানের কামান, স্টেডিয়াম মার্কেট, বায়তুল মোকাররম, শহীদ মিনার, নজরুলের কবর, শিশুপার্ক ইত্যাদি দেখলাম। তখন আসলে বেড়ানোর সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। কারণ, সেলিম আমার সাথে নেই। এভাবে একা ঘুরতে হবে জানলে তো আসতামই না। শিশুপার্কে টিকেট করে ঢুকলাম। এটা বাংলাদেশের প্রথম শিশুপার্ক, খুব বেশিদিন হয়নি এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগে আমি কখনও শিশুপার্ক দেখিনি। তাই রাইডগুলোর চারপাশে ঘুরঘুর করছি। কিন্তু আমি তো আর শিশু না, তাই কোন রাইডে চড়ার চিন্তা করছি না। এমন সময় দেখি আমার সামনে দণ্ডায়মান আমারই এক স্যার। স্যার আমাকে দেখে রাইডে চড়ার প্রস্তাব দিলেন। বুঝলাম, স্যারেরও খুব চড়তে ইচ্ছে করছে, কিন্তু বয়স্ক লোক, তাই সংকোচ হচ্ছে। আমি সবিনয়ে না করে দিলে স্যার আমাকে নিয়ে কিছুক্ষণ বাদাম চিবোলেন, তারপর বিদায় দিলেন। এদিকে চট্টগ্রামে এমরান ঢাকায় যায়নি শোনার পর আমার মা মারাত্মক শঙ্কিত ও উৎকন্ঠিত হন। কিন্তু সেকালে খবর নেবার কোন সুযোগ ছিল না। আমি যার বাসায় থাকতাম সম্ভবত তাঁর নাম বাবুল ভাই ছিল। কোন সরকারী অফিসে ছোট চাকরি করে রাতে ফিরতেন। রাতের বেলা গোসল করে ভেজা জামাকাপড় রান্নাঘর গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে তার ওপর টাঙানো দড়িতে শুকোতে দিতেন। তখনও আমাদের বাসায় স্টোভের চুলা। এভাবে গ্যাস জ্বলতে দেখা আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। তারচেয়েও খুব খারাপ লাগলো যখন দেখতে পাই সারারাত গ্যাস জ্বলে জামা শুকানোর কাজে ব্যস্ত। সেবার বাসায় ফিরে এসে মায়ের অশ্রুসিক্ত চোখ আর বাবার রক্তচক্ষু দেখে আমার ভ্রমণের নেশা যেন চিরতরে ছুটে গেল। তারপরও সেলিম ও এমরানে সাথে এই সখ্য আজীবনের। সেলিমের পিতৃবিয়োগ ঘটে কলেজের প্রথম বর্ষের শেষদিকে। ঘরের বড় ছেলে, সাত ভাইবোনের দায়িত্ব তার মাথার ওপর। সেলিম পড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। সীসার ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং মনোযোগ দুই-ই অনেক বেড়েছে তার। তবু আমার ও এমরানের চাপে পড়ে পড়ালেখাও সে কিছু কিছু করলো। কিন্তু এইচএসসি পাশের পরে তাকে আর কোথাও ভর্তি হতে দেখলাম না। সে ক্রমশ সীসা থেকে গাড়ি এবং গাড়ি থেকে ইন্ডাস্ট্রি — এরকম নানান ব্যবসায় জড়িয়ে এখন অনেক অফিস ও অর্থের মালিক, আর আমি রয়ে গেলাম কলম পেষার মাষ্টার।
কলেজে আমাদের স্বাভাবিক জীবন হঠাৎ ভিন্নরকম হয়ে গেল একটি সকালে। সেদিনও সবার সাথে আলাপ আড্ডায় মেতে ছিলাম। হঠাৎ কোথাও থেকে একটা কর্কশ বাঁশিতে হুইসেল বেজে উঠলো। যেন কেউ নির্দেশ দিল “ঝাঁপিয়ে পড়ো”। তারপর সে কি ত্রাহি মধুসুদন কাণ্ড। কোথা থেকে এত সশস্ত্র তরুণ সংঘবদ্ধ হয়ে পুরো ক্যাম্পস দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো কে জানে! আমরা যে যেখানে পারি আশ্রয় নিলাম। দশ মিনিটের মধ্যেই উৎসবমুখর কলেজ ক্যাম্পাসে নেমে এলো কবরের নীরবতা। এ শুধু একটু ঘটনামাত্র নয়, এটাই ছিল ছাত্রশিবিরের কলেজ দখল। তার পর থেকে চট্টগ্রাম কলেজে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর পরে ধীরে ধীরে মহসিন কলেজও তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এলে আন্দরকিল্লা থেকে চকবাজার পর্যন্ত মেস লজিং ইত্যাদির মাধ্যমে পুরো এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং একটি ভয়াবহ এলাকায় পরিণত হয়। দেওয়ানজি পুকুর পাড়েও সেলিমদের বাসার আগেই তারা গড়ে তোলে ঘাঁটি। এরমধ্যে আমাদের এইচ এস সি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। লিখিত পরীক্ষার পরে ব্যবহারিক শুরু হচ্ছে, এমন সময় এক রাতে সোহরাওয়ার্দি হলে নিহত হয় আমাদের বন্ধু শাহাদাত। আমার বিকেলে হাঁটাহাঁটির ফাঁকে মাঝে মাঝেই হলে গিয়ে যাদের সাথে আড্ডা দিয়ে আসতাম তাদের মধ্যে শাহাদাতও ছিল। কিন্তু সে যে রাজনীতি করতো তা জানতাম না। তার নিহত হবার পরে জানা গেল সে ছাত্র ইউনিয়ন করতো। একটা থমথমে পরিবেশে আমরা ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ করলাম।
০৩-২-২০২২, সকাল ৫.৪০, বাংলামটর, ঢাকা
কোরাকাগজের খেরোখাতা (পর্ব ২১)
জিললুর রহমান
জিললুর রহমান
মন্তব্য