অনাকাঙ্ক্ষিত মায়া-১
লেপের ওমে শীতকালটা ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। এক রাতে কি এক অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। সুরক্ষা মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে ঘর আলোকিত করে প্রথমে ওয়াশরুমে গেলাম, ভারমুক্ত হলাম এবং তারপর একগ্লাস ঈষদুষ্ণ জল পান করলাম। অস্বস্তির ভাবটা কেটে গেলো। বরং এক ধরনের আরামবোধ করলাম। কিছুক্ষন ফেসবুকের মেসেঞ্জারে টেক্সট চ্যাট করে আবার শুয়ে পড়লাম। সকালে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গার পর কোন অস্বস্তি-বিষয়ক চিন্তা মাথায় আসার আগেই আমি ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম সারাদিনের দায়িত্ব-কর্তব্য বিষয়ে। কিন্তু পরদিন আবারও সেই অস্বস্তি। এবারের মাত্রাটা আরো বেশি। মনে হলো অস্বস্তির কারণ ওই লেপে। পুরনো লেপ! কতোরকমের পোকামাকড়ের আবাসস্থল হয়ে উঠতে পারে। পুরনো লেপ বাতিল করে নতুন লেপ ঠাই পেলো আমার শীতনিবারণের জন্য। সেই রাত আরামেই কাটলো। কিন্তু পরদিন রাতে আবার অস্বস্তি। এবার মনে হল অস্বস্তি আমার তোষকজুড়ে। কি আর করা! ওটাকেও বাতিল করে নতুন তোষকে শয্যা নিলাম। কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না। মধ্যরাতে মশারির ধার বেয়ে পিলপিল করে হেটে চলা অস্বস্তি আমাকে আতংকিত করে তুললো। এবারে মশারি বদল। ততোদিনে সারা ঘরে বিভিন্ন কিছুতে ছড়িয়ে পরেছে জ্যান্ত অস্বস্তির হাত-পা। এবার সিদ্ধান্ত নেবার পালা। হয় ঘর-বাড়ি থেকে ওদের সবংশে নির্মূল করো, অথবা নিজেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাও। কি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাই! অতএব গ্যাসপাউডারের সাহায্যে নিজে একরাত ঘরছাড়া থেকে ওদের সবংশে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফিরে এসে দেখি, শুধু ওরা নয়, যতো প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো সারা ঘর জুড়ে সকলই নিহত হয়েছে।
অনাকাঙ্ক্ষিত মায়া-২
ওদের কেন আমি ভয় পাই তার কারণ সম্ভবত, ওদের গায়ের রঙ অনেকটা আমার মতো আর ওদের রক্তের রঙও লাল। কিন্তু এই সাদৃশ্য ভয় আর চাপা আতঙ্ক কেন তৈরি করলো এটা ভেবে আমি নিজেও অবাক হই। হতে পারে আমার ধারণা ছিলো ওরা ঠিক আমার মতো নয়, ওদের সাথে আমার কোন মিল থাকতেই পারেনা। এমনও হতে পারে ওদের আমি এতোটাই হীনচোখে দেখি যে ওদের সাথে আমার সাদৃশ্য আমি কিছুতেই মানতে পারিনা। এইসব কারন তো আমার মধ্যে ওদের জন্য ঘৃনাও তৈরি করেছে। ঘৃনার সাথে এটাও মনে হয়েছে বা হয়, যে, ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারে। অগ্রীম ডিফেন্স হিসেবে, ওদের পরাস্ত করতে নাও পারতে পারি, এই আশংকাই হয়তো ওই ভয়ের কারণ। আর ভয় ও ঘৃনার সমন্বয় হলে যা হয় আর কি! ওদের জন্য আমি নিধনযজ্ঞ শুরু করতে চাইলাম। কিন্তু গুরুজনেরা বললেন ওদের মেরে ফেলা ভালো নয়। তাড়িয়ে দাও। কিন্তু তাড়ানো কি এতোই সহজ! যতোই তাড়াতে চাই, ওরা কেবল জায়গা বদল করে আর আমার দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। আমিও ভুলে যাই ওদের কথা। আবার একসময়, আমার নিবিষ্ট চিত্তে কোন কাজের অথবা ভাবনার সময়, ওরা সশব্দে ডেকে ওঠে। আমি আবার আতংকিত হই। এভাবে ভুলে যাওয়া আর ফিরে আসার চক্রে ঘুরেফিরে কিছুকাল পার হয়েও যায়। কিন্তু এক সকালে ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই দেখি উপর থেকে নিচে কিছু পরে গেলো। ভাল করে তাকিয়ে দেখি ওদেরই একজন। আমার অজান্তেই দরজার এমন ভাঁজে ওর অবস্থান ছিল যে দরজা লাগাতেই ও তার ভেতরে আটকে যায় আর ফের দরজা খুলতেই ওর সদ্যমৃত শরীরের টাটকা রক্ত লেগে যায় আমার দরজায়, আর ওর নিথর দেহের পতন হয়। কিন্তু ঘরে কেউ নেই যে ওর মৃতশরীর সরিয়ে ফেলবে। অগত্যা আমাকেই ওকে সরিয়ে ফেলার কাজ করতে হলো। সারাদিনের ব্যাস্ততায় ভুলে গেলাম এইসব বৃত্তান্ত। দিনশেষে বিশ্রামকালে চোখ বন্ধ করে শুনছিলাম হালকা মিউজিক। হঠাত সশব্দে সেই শব্দ, টিক টিক টিক।
অনাকাঙ্ক্ষিত মায়া
অমিতা চক্রবর্ত্তী
অমিতা চক্রবর্ত্তী
মন্তব্য