আট
একবার এক বনে এক আশ্চর্য প্রাণী আবিষ্কৃত হল। কী যেন নাড়ায়, আর খালি টুক-টাক শব্দ করে। এই অদ্ভুত প্রাণী দেখে তো সারা বনে সোরগোল পড়ে গেল। সবাই দেখার জন্যই শুধু মেলা দূর থেকে ছুটে আসল। সজারু বলল, আমার ধারণা এ নতুন এক প্রাণি, অন্য কোনো বন থেকে পালাই আসছে। হরিণ হাসল শুনে, প্রানি যদি হবে, তবে, লেজ কই। পা কই। আমাদের মতোন ছুটবে কীভাবে। খরগোশও একমত হলো তাতে, বটেই তো: ছুটতে না পারলে বাঁচবে কীভাবে, মানুষ আসলে! গণ্ডারেরও যুক্তি আছে, ঠিক কথাই। দেখ্, দেখ্, মুখই নাই। মুখ না থাকলে খাবে কীভাবে? খাইলে তো বাঁচবে? বলে, অই আবিষ্কৃত প্রাণি দিকে তাকিয়ে একচোট হাসলো। তার সাথে সাথে হেসে নিলো, বানর, হনুমান, সাপ, বাঘ, সিংহ এবং গাধাও। শুধু মাঝখানে শেয়াল বসে আছে বেশ গম্ভীরভাবে। তার মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ। সে উঠে হাতের লাঠিটা দিয়ে খোঁচা দিলো প্রাণিটার পেটে। প্রানিটা উল্টে গেল। সাথে সাথে তার টুক-টাক আওয়াজও কিছুটা কমে গেল। আবার বেশ সাবধানে আরেকটা খোঁচা দিল। আবার আগের মতোন হয়ে গেল। দেখে, শেয়াল বানরকে হুকুম দিল, অই পাহাড়ের যে হাতিটা, গতকাল মানুষের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে, এক্ষুনি ডেকে আনো তাকে। সুর্য তখনো হেলেনি, তার আগেই ছুটে এল সেই হাতি। তার গলায় এখনো সেই মানুষের ঘণ্টা, রয়ে গেছে। তার থেকে টুংটাং শব্দ বেরুচ্ছে। ভিড় ঠেলে, সেই প্রাণীর কাছে গেল হাতি, হাঁফাতে হাঁফাতে। তারপর দেরি না করেই পাড়া দিয়ে গুঁড়ো দিল প্রাণিটাকে। সাথে সাথেই সেই টুক-টাক শব্দটা থেমে গেল। সবাই যেন স্বস্তি পেল তাতে। শুধু শেয়ালের চোখেই প্রশ্ন, কী ছিলরে এটা। হাতির চোখে মুখে এখনো, ছুটে আসার ছাপ। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল। এটারে মানুষেরা ঘড়ি বলে। হাতে বেঁধে রাখে। দেখে দেখে ছুটে। আমাদেরও ছুটায় মারে। ময়দানে ঘিরে ঘিরে সার্কাস সার্কাস খেলে।
দশ
বয়স্কের জীবনে মেলা সঞ্চয়। জায়গা-জমি-দালান, দালানে বৌ-কন্যা-পুত্র। কোনো কিছুরই অভাব ছিলনা। কিন্তু তারপরেও তার কিছুটা দুঃখবোধ ছিল। থাকার কারণ এই যে, তার সকল পুত্রই অপব্যয়প্রবণ। তারা একদিনেই গোয়ালের সকল গরু বেচে দিয়ে বলি খেলা বসাতে পারে। তাহাদের কোনোরূপ বিশ্বাস নাই। তাই বয়স্কেরও ভয়ের সীমা নাই। এদিকে জীবনও অাইলের কাছকাছি। তাই অনেক ভাবনা শেষে, বয়স্ক নিজেই গোয়ালভরা গরু, ফসলভর্তি জমি, মানুষ ভরতি ঘর-দালান বেচে দিয়ে ঘোড় দৌড়-বলিখেলা ইত্যাদি শেষে অইদিনই মরে গেলেন। উল্লেখ্য, মৃত্যুপূর্বে বয়স্কের কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তাই ছিল না। শুধু একবার হাই তুলেছিলেন দেখেছি।
বারো
তখন মানুষ চাইলেই তার হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়া পা খানাকে খুলে হাতে নিয়ে হাওয়ার নীচে জিরায় নিতে পারতো। যতক্ষণ ইচ্ছা। অথবা দুচোখের একটাকে বাসায় রেখে দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারতো। পাঁচ-সাতদিনের জন্য। মানে যখন যেইটা ইচ্ছা আর কি। এইরকম এক সময়ে এক ক্লান্ত মানুষ, যিনি হৃদয়ে খুব ব্যথা পাইছেন, ভাবলেন হৃদপিণ্ডটারে একদিন ফুল বাগান দেখায় আনি। তার আগে একটু গোসল করায় নি। সুগন্ধ সাবান দিয়া। গোসল করাইলেন। তারপর এনে রাখলেন রোদে। রোদ পোহানোর জন্য। তারপর নিজেও গোসলখানায় ঢুকলেন। নিজেও সুগন্ধ সাবান মাখলেন। যখন বেরুলেন, দেখলেন, তার হৃদপিণ্ডখানা নিয়া জনৈক ময়ুর পালাচ্ছে।। হৃদপিণ্ডহীন মানুষ ভয় পাইলো। ভীত মানুষ ভয় নিয়াই ময়ুরের পিছনে ছুট লাগাইল। হৃদপিণ্ডের জন্য। এখনো ছুটছে।
তেরো
একবার এক লোক ভাবলেন, তিনি মারা যাবেন। তাই তিনি অই এলাকার সবচে বাঘ উপদ্রুত এলাকায় গিয়ে রাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। এইভাবে তিনরাত পার হওয়ার পর বাঘের বদলে এক দঙ্গল শেয়াল এসে তাকে জীবিত খেয়ে গেলে। ভদ্রলোক অইখানেই মারা গেলেন। সেই থেকে যেইখানে তিনি মারা যান, অইখানে প্রতি রাতে একটা বাঘ এসে মৃত লোকের আত্মার সাথে কেঁদে যান। আর এলাকাবাসী শুধু শুনে শুনে বিষণ্ন হন।
চৌদ্দ
তিনি দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরতেছিলেন। বাসে। বসে বসে তার নিজের পারিবারিক ছবির অ্যালবাম দেখতেছিলেন। দেখেন আর কাঁদেন। কাঁদেন আর দেখেন। তার পাশে যে যুবা ছেলেটি, চোখে সানগ্লাস পড়া, বয়স্কের এই অবস্থা দেখে কৌতুহলী হইল। বয়স্ককে বল্ল, যদি অনুমতি দেন, ছবিগুলা আমিও দেখি। বয়স্ক অনুমতি দিলেন। যুবাও দেখতে লাগল। সব ছবিই প্রায়ই একই জনের। বিভিন্ন বয়সের। বিভিন্ন সময়ের। যুবা জিজ্ঞেস করল, উনি কি আপনার ওয়াইফ? বয়স্ক হাসলেন, একটু লজ্বাও। বললেন, জ্বি। বেঁচে নাই উনি, না? জ্বি। বয়স্ক আবেগ চেপে বল্লেন। এইভাবে, ছবি দেখতে দেখতে, দেখাইতে দেখাইতে বয়স্ক বাস থেকে নেমে গেলেন। সরিষা ক্ষেতের আল বেয়ে যাইতে যাইতে এক থোকা ফুল নিয়া নিলেন। এইভাবে, অনেকক্ষণ হাটঁতে হাঁটতে যখন ঘরে পৌছাঁইলেন, বয়স্কের সেই ছবির ওয়াইফ, তার বউ এসে তারে জড়াইয়া ধরলেন। বয়স্কও। তার এক ফাঁকে বয়স্ক বউয়ের খোঁপায় ফুল গুঁজে দিলেন। তারপর মোবাইল ক্যামেরায় কয়েকখানা ছবি তুলে নিলেন। হাসতে হাসতে।আমরা জানি, এইখানের কোনো একটা ছবি বয়স্ক পরে তার অ্যালবামে গুঁজে রাখবেন।
ষোল
রুহানার মাথায় জোড়া শিঙ। রুহানার তার একটিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, দেখো দেখো কী সুন্দর একখানা মান্দারফুল গাছ! হাওয়ায় ভাসিতেছে ! রুহানাও তাকাইল এবং যারপরনাই মুগ্ধ হইল। বলিল, এ ফুল কি ছিঁড়া যাইবে না? অবশ্যই যাইবে, রুহানা প্রত্যুত্তর করিল; তবে আমাদের উড়িতে জানিতে হইবে। কেমনে আমরা উড়িতে পারিব? রুহানা হাসিল এবং সাথে সাথে তার জোড়াশিঙ খুলিয়া ফেলে দিল। য়ুহানা তার লম্বা লেজ। পরে, দুইজনেই উড়া শুরু করিয়া দিল, মান্দারবৃক্ষের পিছু পিছু। অার সেই থেকে পৃথিবীতে অনবরত পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। হয়েই যাচ্ছে। এইখানে, অইখানে।
সতেরো
হয়না অনেক সময়, কারো কারো জন্ম থেকেই একটা পা ছোট। লোকটারও তেমন। তাই খুঁড়িয়ে হাটঁতো। একবার এক মুচি বললো, জুতার হিলটা বাড়িয়ে নিন। কেউ বুঝবে না। কেউ বুঝেও না। লোকটা দারুণ পার হয়ে যায় সকল রাস্তা। ওভারব্রিজও। খুব স্বাভাবিক। শুধু হাঁটার সময় সে সবার পায়ের জুতার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাঁ পাশেরটা একটু উচুঁ মনে হচ্ছে না?
আঠারো
অন্যান্যরা যে কারণে আত্মহত্যা করেন, তিনিও সে কারণেই পাঁচতলার ছাদে উঠে এলেন। কার্নিশে এসে দাঁড়ালেন। লাফ দিবেন, এসময় নীচে দেখলেন: যে লোকটি হন্তদন্ত বাসে উঠে গেছেন এ মাত্র, তারই কিছু একটা পড়ে গেছে। রাস্তায়। আত্মহত্যাকামী ভাবলেন, টাকা-পয়সা হয়তো। হতে পারে লোকটির এটাই শেষ সম্বল। অথবা দূরের বন্ধুকে লেখা চিঠি। ডাকে ফেলবেন বলে বেরিয়েছেন। ভাবতে ভাবতেই দ্রুত নেমে এলেন। দেখলেন, ফেলে যাওয়া বস্তুটি একটা ছবি। পেছনে লেখা: মেহেরুন (১৯৮১-১৯৯৯)। কার ছবি এটা! ভদ্রলোকের মেয়ে, বৌ নাকি একমাত্র বোন? সেও কি আত্মহত্যা করেছে? যেই হোক নিশ্চয় তার সাথে গাঢ় অতীত মেখে আছে লোকটার। ভেবে বিচলিত হলেন আত্মহত্যাকামী ভদ্রলোক। ভাবলেন, ছবি হারানো লোকটি নিশ্চয় ছবি খুঁজতে ফেরত আসবেন। ভেবে, দাঁড়িয়ে থাকলেন ফুটপাতের উপর। আর একটু পর পর হাতঘড়ি দেখছেন।তার তাড়া। তিনি ছবিটা দিয়েই আবার ছাদে উঠে যাবেন।
একগুচ্ছ গল্প
রাজীব দত্ত
রাজীব দত্ত
একই রচনায় একই শব্দের বানান তিন রকম কেন? প্রাণী/প্রাণি/প্রানি
উত্তরমুছুনঅন্যরকম,মনোহর
উত্তরমুছুন