গতোকাল রাতে দশ বছর আগে শ্যামলীতে একটুর জন্য গাড়িচাপা পড়তে গিয়েও না পড়ার ঘটনাটি স্বপ্নে দেখলাম। বাস্তবের ঘটনায় আমি মরিনি, মরেছি স্বপ্নে। গতো সপ্তাহে একটা নেড়িকুকুরকে চাপা পড়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম। কিন্তু নিজে বাঁচতে চাইনি। স্বপ্নে মৃত্যুদৃশ্য দেখাটা আত্মঘৃণা আচ্ছাদিত আকাঙ্ক্ষার ফলাফল কিনা সে ভাবনাটা ভেতরে ভেতরে বেশ আনন্দ দিচ্ছে। লক্ষ্য করেছি, মৃত্যুচিন্তার ভাবনা আমাকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলে। যেনো, সমগ্র পৃথিবীর সামনে নিজের জীবনকে হেয় করে আমি আনন্দচিত্তে স্তিমিত পায়ে হেঁটে চলেছি। এতে মর্ষকামীতার প্রচ্ছন্ন কিংবা বলিষ্ঠ ছায়া আছে সেই তর্ক উঠলে তাতে শক্তভাবে দ্বিমত জানাবার স্পৃহা বা কনভিকশন কোনটাই আমি রাখিনা বিলক্ষণ জানি। কিন্তু সম্ভবত আমার সম্পর্কে যা দ্বিতীয় কেউ জানেনা কিংবা জেনে থাকলেও আমাকে কখনো বুঝতে দেয়নি তা হলো- আমার কনভিকশনের অনেকাংশই সংশয় ও আমার মস্তিষ্ক যতোটুকু ধারণ করতে পারে ততো ধরণের সম্ভবপরতাকে মরতে না দেওয়ায় ব্যাপৃত। অগুনতি আপাত কেজো ও তুচ্ছ ভাবনা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা; তাকে পলায়নপরতা নাম দেওয়া যেতেই পারে; বোধকরি দেওয়াটা সহজও বটে, কিন্তু এর বিপ্রতীপে আরেক সম্ভবপরতার উপস্থিতিকে আমি নাকোচ করতে রাজি নই। মাই ডাউট এজ ওয়েল এজ মাই উইলিংনেস ডাজ নট এলাউ মি টু গো টু দ্যাট কনভেনশনাল ডিরেকশন। তাই প্রয়োজনে সিম্বলিকভাবে মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দিতে আমি সিদ্ধহস্ত। সেই প্রশান্ত দুর্বিনীত ভঙ্গি আমাকে ভালোবাসা ও ঘৃণা উভয় থেকেই দূরবর্তী রাখে।
প্রাত্যহিকতা আমাকে দিনে দিনে ডিভাইনিটির দিকে প্রলুব্ধ করছে; আরেক অর্থে বলা যায় নির্বোধে রূপান্তরিত করছে। খালি চোখের পার্থিবতা, সূখের অন্বেষণ, গতিময় অন্ধ পরিতৃপ্তি- এই ত্রয়ের যোগফলে নির্মিত যাপিত জীবন আমার কাছে শৈশবের জমা করে রাখা খুচরা পয়সাগুলো দিয়ে পোড়া রুটি কেনা। শোয়েবকে কথাটা বলতেই বেশ ক্ষেপে উঠেছিলো। তার প্র্যাকটিকালিটির দিকে প্রোথিত মনন অনভ্যস্ত কোন সম্ভবপরতার দিকে মনোযোগ দিতে অপারগ। পরশুদিন ফার্নিচার সম্পর্কে জানতে চেয়ে ফোন দিয়েছিলো।
সন্ধ্যা হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দৃশ্যমানতায় অপটু, দানে প্রডিগাল ও ইশারায় কাতর রাস্তা- স্তম্ভ হিসেবে স্মৃতিতে সঞ্চারিত থাকবার সকল বৈশিষ্ট্যই রাস্তাটির আছে, কিন্তু যথার্থ প্রেষণার অভাবে হতে পারেনি। বন্ধু নিখিলের বহুকাল পুরনো একটি কথা পুনরায় ভাবালো- সাড়া দিতে না পারলে স্বর্গকেও স্বর্গ মনে হবেনা।
সংবেদনের বিযুক্তি কতোটা বিদীর্ণ করে তা আমরা কতোটুকু জানি? সালমানের সুইসাইড নোট দেখেছিলাম। আত্মহত্যার ধরণ খুবই বিশেষত্বহীন, সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি পেঁচিয়ে। কিন্তু সুইসাইড নোটটা মনে রাখার মতো। আশেপাশের লোকজনের চোখ এড়িয়ে অনেকদূর পড়ে ফেলেছিলাম। সত্যি বলতে, সালমানের মৃত্যুর চাইতেও তার রেখে যাওয়া সুইসাইড নোটের কথাটা আমাকে বেশী ভাবিয়েছিলো। একটা লাইন ছিলো এরকম-
অন্তর্লোকের প্রবাহ চাপা থাকলে ভেতরে ভেতরে তা সহিংস হয়ে ওঠে।
প্রণব জীবনকে ভীষণ ভালোবাসে। এক ধরণের আত্মাহুতির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চারপাশের সাথে সংযুক্ত থাকতে চায়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে একটু টোকা দিয়ে দেখলে ওর নিশ্চেতনাবোধ সাড়ম্বরে জেগে ওঠে। প্রণবকে দেখে উপলব্ধি হয় যারা ভদ্রস্থ শব্দ ব্যবহারকে শাস্ত্রীয় রীতিতে নিয়ে গেছেন তাদের উপলব্ধি হবার কথা নয় যে সমান্তরালে প্রফ্যানিটিও জমা হতে থাকে। ভাঙ্গবার বাসনা কখনো গড়ে উঠলে তা প্রিজুডিসের সমান্তরালেই গড়ে ওঠে। ঈশ্বর থাকবেন, তার বিরোধী থাকবেনা? ভাষায় সে অনির্বচনীয়, অস্তিত্বে অমোচনীয়।
শোয়েব, সালমান, প্রণব – ওরা একেকটি নাম হতে পারে; স্বতন্ত্র আখ্যানের উত্তরাধিকারী রেখে যাওয়াটাও তাদের ভবিতব্যই, কিন্তু, কিন্তু, একটি স্বচ্ছ ও সুতীব্র সংশয়ের মাঝে আজীবন ঘুরপাক খাওয়া ওদের স্বনির্মিত পরিতৃপ্তির সিংহাসনকে সর্বদা টলমলে করে রাখতে পারে। এ কথাই বারবার ওদের সকলকে বোঝাতে চেয়েছি। যতোভাবে পারি। অসূয়াক্রান্ত হয়ে তাদের সিংহাসনকে ভূপাতিত করতে নয়, বরং নিজেকে বাঁচাতে চাইছি আমি; তাদের মৃত্যুকে বিলম্বিত করে।
ডিভাইনিটির গ্রাস থেকে সরে আসতে চাইবার আকুতির অতিরিক্ত কিছু পেয়ে গেলে; ক্ষণিক পরিতৃপ্তির বিচ্যুতি আমাকে ডিভাইনিটির ঘনিষ্ঠতর করে তোলে।
তখন নিভৃতে সন্ধ্যা হয়।
যাত্রানাস্তি
প্রমিথ রায়হান
প্রমিথ রায়হান
মন্তব্য