জন্ম মৃত্যু জন্মান্তরে আমি এক বসন্ত কেঁচো
বসন্তে সকল ভূ-বিদ্যা অর্জন করে আমি কেঁচো হই, মাটি খুঁড়ে— মাটি ফুঁড়ে— মাটি খেয়ে— মাটি ত্যাগে... মাটির ভেতরে মরে গিয়ে বারবার নিজেই বানাই নিজেরই সমাধী : এ-ই জনম আমার ঋতু থেকে ঋতুতে...
গাঢ়, ঘন বসন্ত আসে; আর এ-ই বসন্ত শুরুর বাতাস আমাকে ভোগায় ভীষণ জ্বরে! তবুও এ জ্বরের ঘোর, এ আবহাওয়া আমার ভালো লাগে খুব। সাপ-সরু পথের এপাশে ওপাশে মেহগনির মেরুন, সোনালীহলুদ, হালকা সবুজ কিংবা ঈষৎ রক্তাভ পাতা। এসব যেন পৃথিবীর আর সব অবহেলা : বিরহী আঁখির ঝরনা অথবা বিধবার ঋতু যেমন বিরামহীন ঝরে— তেমনি ক্রমশ ঝরে পড়া পাতায় পাতায় ঢেকে যাওয়া পথের সমস্ত শরীর; প্রিয় বসন্ত—বনদেবীর রূপ।
এ সময় পাড়ার গেরস্তিনী মহিলারা নিজেদের পাতা কুড়োনোর স্থান ভাগ করে নেয়। মাঝে মাঝে ওদের বেধে যাওয়া বাওয়াল : তুমুল ঝগড়া, তুমুল খিস্তি কাটাকাটি, চুল ছেঁড়াছেঁড়ি চলে ! মহিলাদের এসব খিস্তি ও কলহ ভীষণ উপভোগ্য আমার কাছে।
ঝোপের ভেতর খুকসি গাছে টুনাটুনির তুলোর বাসা, ওদের কী মধুর ডাক মাখা সঙ্গম আর ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ওড়াউড়ি। বড়ইয়ের গায়ে মাংস বাড়ে, স্তন বোটার মতো বড়ই; এই গুটিগুটি ফলের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন বয়সী নারীর সহজ স্তনবৃন্ত কল্পনা করা যায়। কল্পনার কেঁচো মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে কেমন দারুণ জমির উর্বরতা বাড়ায়!
বিকেলের নেশাগ্রস্ত ছাদ— মুকুল, মৌমাছি ও ম ম গন্ধ ভরতি আম গাছের চূড়া; দোয়েল, চড়ুই, ফিঙে, শালিক, কাক-বকের কিচিরমিচির আর অদ্ভুৎ একটি রহস্যময় সুন্দর আমাকে ডাকে!
তবুও আসপাশের এ-ই সৌন্দর্য, প্যাঁচাল-ক্যাঁচাল ভুলে আমার অধিকাংশ আগ্রহ ছাদ থেকে সাঁতরে চলে যায় সামনের বাড়ির উঠোনে! দোরগোড়ায় বসে একটি বৃদ্ধা, সদ্য ষোড়শীর তেল চুপচুপে ঘনচুলে সরু চিরুনি বুলায়। ঋতুমতী কিশোরীর গৌরী মুখ নরম রোদে ঝলমল করে। আমার ভীষণ তীক্ষ্ণ চোখ যতটা পারে ঢুকে যায় এ-ই দৃশ্যের সূক্ষ্ম অভ্যন্তরে, আমার চোখের ভেতর তাঁর চোখ-ঠোঁট রাঙা হাসে; আর ছাদ ও উঠোনের এরকম রসায়নে মজে চুল আঁচড়ুনির বটে যাওয়া রসিক আঙুলেরা ছোট ছোট চিমটি কাটে যুবতীর কোমল ত্বকে। লীলা অভিজ্ঞ সখির এমন ব্যাঙ্গ ইশারায় আরেকবার আমাকে গিলে লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে...
এ স্বর্গের ভেতর আমাদের বসবাস... এরকম মধুমাস, নাতিশীতোষ্ণ হাওয়া লাগে গায়ে— এমন কে আছে, যে না চায় এ ঋতুতে মরে যেতে...
ব্ল্যাক শার্কের শাবকটি
শরৎ আকাশে মেঘেদের পাশ দিয়ে একটি কালো হেলিকপ্টার ওড়ে। কিন্তু ওকে আমার কাছে কোনো হেলিকপ্টার নয় বরং একটি ব্ল্যাক শার্কের শাবক বলে মনে হয়। মনে হয় এ-ই আকাশটিকে খোলা সমুদ্র। আর এই শাবক শার্কটি একা একা কী আনন্দে সাঁতরে বেড়াচ্ছে এই সমুদ্রে। ওর মনে কোনোকিছুর ভয় নেই, কোনো আক্রমণের শঙ্কা নেই, খাদ্যাভাব ও দুশ্চিন্তা নেই। কী আনন্দ, কী আনন্দে ভেসে বেড়ায় সকল শাবক মন। আহা! কী জীবন ওদের...
ছাদে একা দাঁড়িয়ে ওকে দেখতে দেখতে ভাবি, আমিও কী ব্ল্যাক শার্কের শাবক কোনও!
কিন্তু নিজেকে ওর মতো ভেবেও পরক্ষণেই চোখের সামনের আয়না আমাকে বুঝিয়ে দ্যায়, এতদিন ধরে নিজেকে শাবক বলতে বলতে সে-ই কব্বে কুড়ি পার হয়ে তেইশ-চব্বিশে ঠেকেছে বয়স, এখনো ওভাবে টের পাইনি।
কবিতার মতো গদ্য।
উত্তরমুছুনএমন কে আছে, যে না চায় এ ঋতুতে মরে যেতে...
উত্তরমুছুন