ঘুম। গভীর এক ঘুম। নিভু ছায়াঘুমের ভেতর স্বপ্ন। উৎপলকে কে যেন ডাকছে?
: কে?
: তাড়াতাড়ি চলে আসো এই মৃত্যু শহরে।
শ্মশানের কাছে জমে উঠবে পঞ্চাশ মিনিটের ভার্টিকাল ইমেজ।
: কে আসবে?
এলোমেলো সাপের হিসহিস শীতল শব্দ।ভিজে যাওয়া ঘাসের বুকে হাড়গোড়।
: কে ডাকছে?
একটা লম্বা শরীর নিয়ে ডেইলি ধান্দার ভেতর ফিনকি দিয়ে পেচ্ছাপের ফুটনোট। রক্ত অতিক্রম করে মাংসের গভীরে ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে ফুসফুসের সামনে উলঙ্গ মেয়েমানষের দল নৃত্য করে।
: আচ্ছা আমি তাহলে কে? কে ঐ নিশিতা? কে? কে?
উৎপল জেগে গেল। বেসিনের সামনে শরীরটা টেনে নিয়ে চোখে মুখে জলের ছিঁটে দিয়েও বুঝতে পারলো না নিশিতা কে?
স্বপ্নের কিছুটা মনে আছে উৎপলের। নিশিতা বেসামাল হতে হতে খোলা এক প্রান্তরের কাছে দাঁড়িয়েছে। রিনরিনে হাসি।চাঁদের আলোয় শরীর ভাসছে। মাংসের ঘ্রাণ, লাল মরিচের ঘ্রাণ, মদের ঘ্রাণ...
বড্ড শীত। হাড়ের ভেতর শীত। রক্তে অদৃশ্য অসুখের আগুন খেলা।
নিশাতা। তার কিছু গল্প থাকতে পারে। খোলা চুলে সামনে দাঁড়িয়েছে। মেয়ে মানুষের ঘ্রাণ আর মুঠো ভর্তি নুন। হঠাৎই অদৃশ্য হলো নিশিতা। হলুদ ব্লাউজ ছুঁয়ে বেঁচে থাকে শিল্পীর ইজেল।
সকালের আলোয় বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছে উৎপল। শুধু খাওয়ার ইচ্ছে জাগছে।
সকালের শীতটা আশ্চর্য রকমের ঝাপটা দিচ্ছে বুকের পাঁজরে। গলায় মাফলার পেছিয়ে ঘুর পথে বের হলো। মৃত এক বাড়িতে যাবে উৎপল। পথে দেখতে পেল আলতো রোদের মাঝে এক বাবার কোলে মাথা রেখে ছোট শিশু চলছে।তার গালে আলতো টোকা দিল উৎপল। নতুন একটা জমিতে উঁচু পাঁচিল উঠেছে। সূর্যকে আটকানোর দারুণ ব্যবস্থা। শিশুটি মিটিমিটি হাসছে। জলের ভেতর হারিয়ে গেছে জল।
মৃত সেই বাড়িতে পৌঁছে উৎপল দেখতে পেল অনেক মটর সাইকেল। ভ্যানে পাটকাঠি, বাঁশ, দড়ি। কেউ আনছে মাটির কলস, খই। খুব যত্ন করে স্নান করানো হচ্ছে। খুব সাবধানে। সকালের বিভ্রমে যেন ব্যথা না লাগে।
একজন চিৎকার করে বলছে, গরম জল নিয়ে আয়। সে নিজের হাতে বুনছে কুরুশ কাটার জীবন।
উৎপলকে এখানে খুব একটা চেনে না কেউ। গীতার শ্লোক পাঠ সবে শেষ হয়েছে। আর এখন শুরু হয়েছে নাম কীর্তন।
সুন্দর করে স্নান করানোর পর মুছিয়ে দেওয়া হলো। তারপর জামা লুঙ্গি পড়ানো হলো। খাটিয়ায় শোয়ানো হলো। ফুলের মাত্রা ছবি হতে চায়। কান্নাকাটির শব্দ বেড়ে গেছে। বুঝতে পারছে এখনই নিয়ে যাবে। শ্মশানের দিকে যাত্রা করবে। ঠিক তাই। খাটিয়ায় শোয়ানো হলো। খাটিয়া ধরেছে অনেকে। এগিয়ে চলেছে খাটিয়া। পিছনে অনেক মানুষ। গোবর জল, খই, পয়সা ছিটিয়ে সামনে চলেছে কয়েকজন। ট্রাকের ওপর অনেক মানুষ। মাঝখানে মৃতদেহ। ছুঁয়ে আছে অসংখ্য হাত। আগের মতো রোদ্দুর নেই এখানে। নিচেও অনেকে ট্রাক ধরে রেখেছে। যেতে দেবে না। অনেকে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। বারবার চুমু দিতে ইচ্ছা করে গালে কপালে। একটা সময় ট্রাক চলে সামনে। সে কেঁদেছিল কিনা বুঝতে পারে না হাতের আঙুল।
হাঁটতে হাঁটতে উৎপল মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। মাংসের ছাল ছাড়ানো হচ্ছে ছুরি দিয়ে। লিচুতলার নিচে মাংসের দোকানের সামনে কয়েকজন লোক কিনবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। উৎপল সাড়ে সাতশো গ্রাম খাসির পায়ের কাছের মাংসের অর্ডার দেয়। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে আসে আস্তানায়।
মাংস, মাল, মেয়ে মানুষ, মিউজিক... এগুলো হলে ভালো হয়। বাসায় এসে ফায়ার প্লেস বানালো। শহরে শূন্য হচ্ছে লোক। ঝাল ঝাল করে রান্না করছে উৎপল। আর রেডি করছে মালের। রাতের বিলাসে জোছনা ও জোনাকিরা বুকের জল বেঁচে দিয়ে কিনে আনলো অসুখ।
এমন সময় শরীরের গন্ধ নাকে আসলো। স্বপ্নে শরীরের ঘ্রাণ এসেছিল নাকে। ছায়ামূর্তি কাছে আসছে। ধীরে ধীরে বাস্তব হচ্ছে তার শরীর। টসটসে মাই দেখে টাশকি লাগার অবস্থা উৎপলের।
: আমার নাম নিশিতা।
প্লেটে গরম মাংসের ঝোল, মাংসের টুকরো। সামনে গ্লাসের সামনে মাল। আর চোখের সামনে নিশিতা। উৎপলের গান শোনা যায়, নিশিতার মৃদুতালে নাচ। আজ এ শহরে গোলাপ ফোটে। পাথরগুলো ভেঙে যায়। জোছনা হাবুডুবু খেতে থাকে শিশির ঘোরে। গ্লাসে মিশে যাচ্ছে চোখের রেখা।
শীতের অভুক্ত শরীরে শরীরের ঘ্রাণ, মাংসের ঘ্রাণ। নগ্ন গভীর নাভির নিচে নেমে যাচ্ছে ঠোঁট। কতোদিন নোনা স্বাদ নেয়নি এই ঠোঁট... মেয়েটির চোখে উঠে এলো শেষ ছবির ক্যানভাস। মুহূর্তে সামনে এসে গেলো খোলা প্রান্তর আর রিনরিনে চিকন হাসির শব্দ। নিশিতার চোখটা বাদামী হয়ে যাচ্ছে আর বুক থেকে বের হচ্ছে নোনতা ঘ্রাণ।
নোনা গল্প
অভিজিৎ বসু
অভিজিৎ বসু
মন্তব্য