প্রতিটি মুহূর্ত এসে ভেঙে পড়ে অতীতের জলে
২১ শে জুন, ১৯৯১। শুক্রবার, সকাল সাড়ে সাতটা। ৫৮/এফ পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় দাঁত মাজতে মাজতেই বেসিনের উপর মুখ থুবড়ে পড়লেন এক কবি। ব্রাশ ফেলে এক হাতে বুক আরেক হাতে বেসিন আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন হয়তো। কিন্তু নিজের সাথে সাথে ভেঙে পড়লো বেসিনও। অথচ ১০ দিন পেটের আলসারে ভুগে কিছুটা সুস্থ হয়ে গতকাল রাতেই ফিরেছিলেন হলি ফ্যামিলি হাস্পাতাল থেকে। কিন্তু ফিরতে পারলেন না আর সকালের এই কার্ডিয়াক এর্যেস্ট থেকে। মাত্র ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে গেলেন আমাদের, চিরতরে। অবশ্য, ঠিক সেই সময়ে এই ঘটনার কোনও রেশই আমার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। পৌঁছানোর কোনও কারণও ছিল না। কেননা, মাত্র ১১ বছরের কিশোর তখন আমি। তবে, হ্যাঁ, একটা বিশেষ কারণে মনে আছে সেই ভোর বেলাটার কথা। বাসায় কি কারণে যেন রাগ করে সারারাত বাইরে কাটিয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিলাম। তাও আবার ঘুমিয়েছি একেবারে ময়মনসিংহ শহরের রেলওয়ে কলোনিতে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে অন্বেষার যে মাঠ, সেই মাঠের ছোট্ট একটা গ্যালারিতে। যার গায়ে সাদা গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল, ‘অন্বেষাই আমাদের অহংকার’। আর সেই অহংকারের সকাল হতে-না-হতেই এলাকার এক বড় ভাই, আমাদের সকলের শরীফ ভাই, যার কাজই ছিল প্রতিদিন ভোরবেলা হাঁটতে বের হওয়া এক সুন্দরী আপুর পেছনে গোলাপ হাতে প্রেমের অফার নিয়ে ঘোরা, সেই তিনিই বিফল গোলাপ হাতে নিয়ে এসে আমাকে আবিষ্কার করলেন, শুয়ে আছি। কানে ধরে ওঠালেন। জেরা করলেন। চোখ লালচে, কথা ঘুম-জড়ানো। তারপর ধরে নিয়ে গেলেন বাসায় আম্মার কাছে। আমি তখন আব্বার মারের ভয়ে অস্থির। আশ্চর্য যে আব্বা তখন কিছুই না-বলে ব্যাগ হাতে বাজারে চলে গেলেন। পরদিন ২২শে জুন, শনিবার। যথারীতি স্কুলে যেতে হলো। সেদিন টিফিন পিরিয়ডের পর সরোজিত্ স্যারের ক্লাশ। খুব ভয় পেতাম ওই স্যারকে। তাঁর মুখেই শুনলাম, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মারা গেছেন। আরও অনেক কিছুই বললেন আমাদের। যার কিছুই বুঝিনি সেদিন। কেবল স্কুল পালিয়ে কীভাবে নদের পাড়ে খেলতে যাবো, সেই সুযোগ খুঁজেছি।
সুযোগ পেয়েও গিয়েছিলাম। স্যারের মন খারাপ থাকায় বেশিক্ষণ ক্লাশ নেননি। বন্ধু ওয়াজিদ, মানিক, ওয়াহিদ আর মিলন সহ আমরা কয়েকজন পালিয়ে গেলাম নারকেল বাগানে। নীচে পেয়ারা উপরে নারকেল। পাশেই ব্রহ্মপুত্র। বেড়া ভেঙে ঢুকে গেলাম সবাই। রুদ্রের কথা মনেই রইলো না। তবে এর কিছুদিন পর থেকেই টিভিতে একটা গান খুব প্রচার হতে লাগলো, ‘আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে..।’ তখন টিভি বলতে কেবল বিটিভি। কথার দারুণ আবেদন আর সুরের জন্যই হয়তো খুব জনপ্রিয় হয়েছিল গানটি। আমার তো মুখস্ত-প্রায় ছিল। টিভিতে অভিনয়ের সাথে সাথে হাত উঁচিয়ে যে শিল্পীটি গানটা গাইতেন, দীর্ঘদিন আমি তাঁকেই এর রচয়িতা বলে ভেবে রেখেছিলাম। এমন কি তাঁকেই ভাবতাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। হ্যাঁ, রুদ্রের কবিতার সাথে, তাঁর ছবির সাথে আমার পরিচয় হয়েছে অনেক পরে। অনেক বছর পর, আমারই এক কাজিন যখন তার ছেলের নাম রাখে রুদ্র, তখনও খুব অবাক হয়েছিলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না রুদ্র ওর প্রিয় হলো কবে। জীবনেও তারে কবিতা পড়তে দেখিনি। তাও আবার রুদ্রের কবিতা। ওর জন্মই তো ১৯৯০ সালে। যে বছর রুদ্র মারা যান তার আগের বছর। আর তার ছেলে তো আরও ১৮ বছর পর। তাহলে? হ্যাঁ, তাহলে এটুকু বুঝতে পারা যায়, কবিতার সাথে তেমন সম্পর্কিত নয় এমন মানুষকেও রুদ্র কতোটাইনা প্রভাবিত করতে পারেন! তাঁর কবিতা তাঁর গান সাধারণ মানুষকেও অভাবিতরকম স্পর্শ করে যায়!
একটি মানুষ খুন কোরে এই তো এলাম আমিপ্রার্থনা ঘরে,দ্যাখো শরীরে আমার কি মধুর আতরের ঘ্রানকি মোহন স্বর্গীয় শোভা সারা অবয়ব জুড়ে,আহা, ঈশ্বরই সব মঙ্গল করেন![মাংশের মুখোশ/খুটিনাটি খুনসুটি ও অন্যান্য কবিতা]
কথা ছিল, রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত
ক’দিন আগেই বন্ধু জহিরুল আবেদিন জুয়েলের সাথে ফেবুতে মত বিনিময় হচ্ছিল। বলছিলেন, ‘এই দেশে কবিতার পাঠকের চাইতে কবির সংখ্যা বেশি।..আজকাল কবিতার বই কেউ কিনে পড়ে না।’ মানতে পারছিলাম না তার কথা। আবার সে একজন প্রকাশকও (ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ)। বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে তার। সাথে যোগ দিয়েছিলেন মণি মোহম্মদ রুহুল আমিনও (অগ্রদূত)। ভাবছিলাম কেন এমন হবে? কবি এনামূল হক পলাশ মন্তব্য করলেন, ‘এখনকার কবিতার দুর্বোধ্যতাই এর জন্য দায়ী।’ কিন্তু দুর্বোধ্যতার এই অভিযোগ তো নতুন নয়। ৫০/৬০ বছর আগেও ছিল এই অপবাদ। আমার তো মনে হয় যতদিন কবিতা থাকবে ততদিন এই অভিযোগও থাকবে সাথে। অবশ্য যুগে যুগে আনুপাতিক হারে কবিতার পাঠক এমনই ছিল। খুব জনপ্রিয় হলেও, যুগের ক্রেইজ না থাকলে প্রকাশিত কবিতার বই যে হট-কেকের মতো অল্প ক’দিনেই বিক্রি হয়ে যাবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণও নেই। ভাবছিলাম কবিতাকে, কবিতার বইকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আছে একজন প্রকাশকের। তবে, এটাও ঠিক যে শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারির বইমেলা কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে আমাদের প্রকাশনা শিল্প। প্রকাশিত বইগুলোও তেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বইয়ের দোকানগুলোয়। প্রচার এবং বিলি বাবস্থাপনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছি আমরা। না, এটাই একমাত্র কারণ ভেবে স্বস্তি পাওয়া যায় না। কবিতাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়া কেবলমাত্র কবি বা প্রকাশকের দায় হয়ে থাকবে কেন? প্রকাশক তার ব্যবসায়িক স্বার্থে তা করবেনই। কিন্তু আমাদের যে জাতীয় কবিতা পরিষদ রয়েছে, তার কাজ কী? মানুষ কবিতা পড়তে ভালোবাসে। তারে কবিতার আরও কাছে নিয়ে আসতে হবে কবিতারই স্বার্থে। মানুষকে আধুনিক কবিতার উপযোগী পাঠক হিসেবে গড়েও তুলতে হবে। হ্যাঁ, আমাদের জাতীয় কবিতা পরিষদের জন্ম হয়েছিল তৎকালীন স্বৈরাচার আয়োজিত এশিয় কবিতা উৎসবকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা কবিতা উৎসব করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এরপর?
যারা এর স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রথম, তাঁরা পরবর্তীতে কি চেয়েছিলেন? কিংবা যদি চলে যাই একেবারে শুরুতে, জানতে চাই এর জন্ম-বৃত্তান্ত? সরাসরি রুদ্রের ভাষায়—
১৯৮৭ সালের ১৪ই জানুয়ারি। বসার ঘরে আমি আর তসলিমা নাসরিন আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কের কীভাবে ইতি টানা যায়, এই নিয়ে শান্ত আলাপে মগ্ন। অনেকদিন থেকেই সম্পর্কটি ভালো যাচ্ছে না আমাদের। কেচ্ছা কেলেংকারি না ঘটিয়ে সুস্থভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় কিনা আমরা তারই পথ খুঁজছিলাম।কলিংবেল বেজে উঠলো। বন্ধু মোহন রায়হান এবং অনুজ কবি তারিক সুজাত হৈ হৈ করে ঘরে ঢুকলো। মোহনের সাথে মতাদর্শগত কারণে অতীতে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিলো সম্প্রতি আমরা উভয়ে তা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। কুশল বিনিময়ের পর ‘এশীয় কবিতা উৎসবে’র প্রসঙ্গ তুললো মোহন। খামার থেকে সপ্তাহ খানেক আগে ঢাকা ফিরেই আমি এ খবর পেয়েছি। খোঁজ নিয়েছি কারা কারা যোগ দিচ্ছে। এশিয় উৎসবের বিকল্প কিছু একটা করার চিন্তা মাথায় এলেও কবিতা-লিখিয়ে সব তরুনের মনোভাব তখনো জানতে পারিনি।তিন জনেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এশিয় কবিতা উৎসবকে চ্যালেঞ্জ কোরে আমরা জাতীয় কবিতা উৎসব করবো। সারা দেশ থেকে কবিরা ঢাকা এসে উৎসবে যোগ দেবে। ঠিক হলো ১৫ তারিখ সকাল দশটায় টিএসসি তে তরুনদের নিয়ে বোসে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। রাত এগারোটার পর মোহন ও তারিক চলে যাওয়ার সময় আমার ব্যক্তিগত সমস্যাটিও ওরা সাথে কোরে নিয়ে গেল। মাথায় এখন একটি চিন্তা—জাতীয় কবিতা উৎসব।
এই কবিতা উৎসবটি এখনও আয়োজিত হচ্ছে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, ১ ও ২ তারিখে। সারা দেশ থেকে এখনও কবিরা আসেন কবিতা পড়তে। আসছেন দেশের বাইরে থেকেও। কিন্তু ওই পর্যন্তই? এই উৎসবটুকুতে এদেশের কবি, কবিতা আর পাঠকেরা বাস্তবে কতটুকু কাছে আসতে পেরেছেন পরস্পরের, এতো বছরেও, এই প্রশ্নটা রয়েই যায়। মোহন-রুদ্ররা আরও কিছু ভেবেছিলেন একে নিয়ে। তাদের সেই ভাবনার পথে তখনই পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছিলেন উঁচু সারির অনেকেই। এমনকি স্বৈরাচারের পতনের পর সৈয়দ শামসুল হকই প্রশ্ন তোলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। ‘কবিতা পরিষদ প্রয়োজন নেই’— এর পক্ষে সৈয়দ হক যে ক’জনের নাম সেদিন উল্লেখ করেছিলেন তাঁরা কেউই কবিতা পরিষদ গঠন করেননি। রুদ্র তখন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন,
এরশাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে যে স্বৈরাচারের পতন ঘটেনি তা আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। হয়তো আরও দেখতে হবে। স্বৈরাচারের সমস্ত যন্তর-মন্তর এখনো বহাল তবিয়তেই বিরাজ করছে। সংগঠিত থাকার কারণে কবিরা যেটুকু সামাজিক মর্যাদা এবং গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন, ইতিমধ্যেই তাতে কালিমা লেগেছে। আর ইতিহাসের বিচার? সে ইতিহাসই সময় মতো করবে।
রুদ্র আরও লিখেছিলেন,
কবিতা পরিষদকে ঢেলে সাজিয়ে প্রকৃত কবিদের এখানে স্থান কোরে দিতে হবে। এখন কবিতা পরিষদ হবে পেশাভিত্তিক সংগঠন। প্রকৃত কবি যারা, যারা লিখেছেন, যারা লিখছেন, যারা পরীক্ষিত এবং যারা লিখে যাবেন, কেবল তারাই হতে পারবেন কবিতা পরিষদের সদস্য। আর বাৎসরিক যে উৎসব সেখানে যোগ দিতে পারবেন সকলেই—একটি কবিতা যিনি লিখেছেন, তিনিও। আমাদের পত্রিকাগুলো লেখকের সম্মানী নিয়ে নানারকম তালবাহানা করে, কেউ কেউ সম্মানীই দিতে চায় না। প্রচুর লেখক আছেন যারা প্রকাশকের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা আদায় করতে পারছেন না। দেশে বইয়ের কোনো ভালো বিপনন ব্যবস্থা নেই, নেই কোনও উল্লেখ করার মতো সাহিত্যের কাগজ। বেতার ও টিভিতে লেখকদের অংশগ্রহনের কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই জাতীয় গ্রন্থনীতি, সারাদেশে লেখকদের বসার মতো একটা ৮’ X ৮’ ঘরও নেই। আর এইসব কাজ কখনো ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব নয়। তার জন্য মিলিত সাংগঠনিক প্রচেষ্টা দরকার। একজন লেখক যাতে তার পুরোটা সময় লেখার জন্য দিতে পারে—কবিতা পরিষদ এখন এসব জরুরি বিষয় নিয়ে কাজ করবে।
সেদিন পক্ষে বিপক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়েছিল। জিতেছিল ‘পরিষদ থাকবে।’ থেকেছে। তবে তা কতোটা ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পেরেছে গত ৩৫ বছরে, এই প্রশ্নও রয়ে গেছে। ২০১৩ সালে তৎকালীন কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আসলাম সানি বলেছিলেন,
আসলে কবিতা পরিষদ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বা সেবামূলক কোনও সংগঠন নয়। এর জন্ম রাজনৈতিক বিরূপ পরিস্থিতিতে, তাই এর চরিত্র একটু প্রতিবাদী। কবিরা সাধারণত সাংগঠনিক হয় না বা হতে পারে না। তাহলে কবিদের সৃজনসত্তাই বিলুপ্ত হবে। কারণ সৃষ্টিশীল মানুষ মানে কবি। একজন কবি নিজেই একটি সংগঠন বা ইনস্টিটিউশন। সংগঠন করলে তার মৌলিক চিন্তাশীলতার জায়গায় বিপত্তি ঘটবে। তখন সে আর লিখতে পারবে না। তারপরও সমাজের আর দশজন মানুষের মতই সে লিখেই তার দায়িত্ব শেষ করে না, কবিও রাজপথে নামে, মিছিলে-শ্লোগানে অংশ নেয়, প্রতিবাদ করে, লড়াই করে। এখানে কবিতা পরিষদ আরো কিছু ভূমিকা রাখতে পারতো, কিন্তু সেদিক থেকে গত দুয়েকটি নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এটা আমি স্বীকার করছি। আমার স্বপ্ন বা প্রতিজ্ঞা হচ্ছে আগামীতে কবিতার উৎকর্ষ সাধনের জন্য কাজ করা, নিয়মিত কবিতার আসর, আলোচনা, জেলা পর্যায়ে কবিতার কর্মশালার আয়োজন, নিয়মিত প্রকাশনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের বাস্তবায়নের ইচ্ছা রয়েছে। চেষ্টাও করছি। প্রায় সব জেলাতেই এখন জাতীয় কবিতা পরিষদের কার্যক্রম রয়েছে। রয়েছে জেলা ভিত্তিক কমিটিও।
ফেসবুকে একটা পেজ আছে জাতীয় কবিতা পরিষদের নামে। ইংরেজিতে এর সংক্ষেপিত ইতিহাস লিখা আছে ওখানে। কিন্তু কোথাও ওই জন্ম-বৃত্তান্তটি নেই। যদিও শুরুর, সেই ১৪ই জানুয়ারির একজন, কবি তারিক সুজাতই আজ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। তারপরও মনে হয় কোথাও যেন সেই তালটি আর নেই। রুদ্রের সেই ক্ষোভের কথাটা এখনও খাটে। আমরা হয়তো ভোমরা ঘরে ঢুকে যেতে পারে এই ভয়ে আমাদের অন্তর্দৃষ্টির দ্বার রুদ্ধ রেখেছি। দেখতে পাচ্ছি না আজকের স্বৈরাচারী যন্তর-মন্তর-কে। অথবা হয়তো চাইছি না দেখতে। সেদিনের সেই কবিরাই যেন আজ বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা আর শেখ হাসিনা’র বাইরে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। অথচ বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছি আমরা। আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাবার পথ রুদ্ধ করে আছে যেই সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, যেই আর্থ-সামাজিক অনিশ্চয়তা, যেই দুর্মূল্যের বাজার অর্থনীতি, যেই বিপরীত-মত-দমন নীতি, যেই কণ্ঠরোধ, যেই ধ্বংস-প্রায় শিক্ষা ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রের যেই দুর্নীতি, যেই বিদ্ধস্ত আইন বিচার ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যেই সংখ্যালঘু অত্যাচার, সাম্প্রদায়িকতা, যেই নারী নির্যাতন, গুম-খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দলীয়করণ আর যেই অসুস্থ রাজনৈতিক আগ্রাসন—এর কোনোটাই আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা কেবল কথিত গণতন্ত্রের মোয়া গলাধঃকরণ করে আয়েশ করে শুয়ে জাবর কাটছি আর স্বপ্ন দেখছি দেশ উন্নয়নের গণতন্ত্রের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার দিকে। এবং কিছুক্ষণ পরপর তৃপ্তির ঢেঁকুর ছাড়ছি। আহ্! হয়তো এইজন্যেই দেশের এমন পরিস্থিতিতেও আমাদের বিগত (২০২০) কবিতা উৎসবটির শ্লোগান বাছাই করা হয়েছিল ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’। নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের স্বাধীনতার অমর কাব্যেরই কবি। কিন্তু এই সময়ে এসে এই শ্লোগান সময়োপযোগী তো নয়ই বরং রাষ্ট্রের উপর নির্লজ্জ তৈল মর্দনেরই প্রকাশ। কবিতা পরিষদের কাজ তা হতে পারে না কিছুতে। অন্তত কবি তারিক সুজাতের কাছ থেকে এরকম আশা করা যায়নি।
বিভিন্ন বয়সের কিছু তরুন আমরা চাইছি মৌলিক বৃক্ষ জন্মাক। আমরা মাটিতে বীজ বুনছি। হোক সে ঘাস তবু কিছু মৌলিক বৃক্ষ জন্ম নিক। স্বর্ণলতার চাষ বন্ধ হোক।[সাক্ষাৎকার গ্রহণে বিপ্লব মাহমুদ; দেশ বাংলা, ১৯৮৬]
দুঃখিতা আমার, তুমি জেগে আছো বালিয়াড়ি-নদী
স্বর্ণলতার চাষ বন্ধ হয়নি। বরং ছড়িয়ে গেছে সমস্ত দিকে। গ্রাস করে নিচ্ছে বৃক্ষদের। আমরা দেখতে পাই আমাদের এই সোনার বাংলায় একজন অখ্যাত আইনজীবীর অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে গাড়ী চালাতে গিয়ে ভুল করে একটি রিক্সা আর তার আরোহীকে চাপা দিয়ে পালালে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দু’দিনের মধ্যে তাকে দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকেও প্রেফতার করে সংবাদ সম্মেলনে ফলাও করে প্রকাশ করে তা। কিন্তু এর কিছুদিন পরই যখন এক বিখ্যাত বিচারপতির প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে একজন অবসর প্রাপ্ত বিজিবি সদস্যকে চাপা দেয় তখন মাস পেরুলেও তাকে প্রেফতার করে না পুলিশ। এমনকি মামলাই গ্রহণ করে না। গুরুতর জখম হওয়া সেই লোকের একটি পা কেটে ফেলতে হয়। অন্য পাও ভেঙে অচল। আমাদের কানে এখনও বাজে কক্সবাজারের সেই একরামের মেয়ে দুটির আর্তনাদ, ‘বাবা তুমি কান্না করতেছ যে..।’ কাশিমপুরের জেলে নির্মম নির্যাতনে লেখক মুস্তাক আহমেদের মৃত্যুর কথাও আমরা ভুলিনি। তাঁর অপরাধ ছিল, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সরকারের কার্যকলাপের সমালোচনা। তাহলে, এ দেশের কবিরা কি এইসব ঘটনার বাইরের কেউ? এগুলোর কিছুই স্পর্শ করে না তাদের?
‘আমাদের স্বপ্নগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে কাক ও শকুন।’ — কারা তাহলে এইসব কাক ও শকুন?
‘আমাদের কৃষকেরা শূন্য পাকস্থলী আর বুকে ক্ষয়াকাশ নিয়ে মাঠে যায়। আমাদের নারীরা ক্ষুধায় পীড়িত। হাড্ডিসার। লাবণ্যহীন। আমাদের শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যহীন। আমাদের শিশুরা অপুষ্ট, বীভৎস-করুন। আমাদের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, আকালমৃত্যু আর দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্রে ডুবে আছে। পৃথিবীর যুদ্ধবাজ লোকেদের জটিল পরিচালনায়, ষড়যন্ত্রে আর নির্মমতায় আমরা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকা পড়েছি। কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা! কী বীভৎস এই ভালোবাসাহীনতা!! কী নির্মম এই স্বপ্নহীনতা!!!’
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সূচিপত্র পত্রিকায় রুদ্রের একটি দশ প্রশ্নের ছোট্ট সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। সেখানে একটা প্রশ্ন ছিল এইরকম, ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কবিদের ভূমিকা কী হতে পারে?’ এই প্রশ্নটিই যদি আরও দু’তিনটে শব্দ সংযোজিত করে ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যবোধের এমন পরিস্থিতিতে কবিদের ভূমিকা কী হওয়া দরকার?’ বলে কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালকেই জিজ্ঞেস করা হয়, কী উত্তর করবেন তিনি, জানতে কৌতূহল হয়। শুধু কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালই কেন, সমস্ত অগ্রজ কবিগণের কাছেই যদি জানতে চাই? যারা আজ জাতীয় কবিতা পরিষদ চালাচ্ছেন কিংবা কোনও-না-কোনও ভাবে সংযুক্ত আছেন এর সাথে। কী উত্তর করবেন তাঁরা? আমরা জানি যে প্রত্যেক কবির ও কবিতার মর্মে কালের ছায়াপাত ঘটে এবং সুদূর অতীত থেকে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ অনুভব করা যায়। জায়মান সাংস্কৃতিক-সামাজিক চেতনার কোনও কোনও বিষয়কে কবিতায় ধারণ করে তার দ্যুতি বিকিরণ করে। যার নেপথ্য শিল্পী হলেন কবি—তারই এক মনন-মানচিত্রের রেখাঙ্কন। রুদ্র সেইরকমই রেখাঙ্কন করে গেছেন তাঁর কবিতায় তাঁর গানে, গদ্যে, কাব্যনাট্যে। স্ব-সময়ের বিষাক্ত বিষাদ ও যন্ত্রণার মুহূর্তগুলি বাস্তবের বিকৃতি ও হাহাকারের ভেতর দিয়ে সবসময়ই অতিক্রম করে যেতে চেয়েছে স্বপ্নের পৃথিবীর দিকে, ভবিষ্যতের দিকে। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমরা নৈরাশ্য, গ্লানি আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পৌঁছে যেতে পারি একেবারে মূল অস্তিত্বের বেদনায়। খুঁজে পেতে পারি আমাদের আসল পরিচয়। সমষ্টিগত পরিচয়। বুঝতে পারি জাতিসত্তায় আমরা অনার্য সন্তান। আমরা শোষণ, শঠতা, অকালমৃত্যু আর ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি পেতে চাই।
এই ব্রহ্মাণ্ডের ভেতর একটি বিন্দুর মতো আমি একা। আমার অন্তর রক্তাক্ত। আমার মস্তিষ্ক জর্জরিত। আমার শরীর লাবণ্যহীন। আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রিত। আমার জিভ কাটা। তবু এক নোতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমাকে কাতর করে। আমাকে তাড়ায়…[ভূমিকাঃ স্বীকারোক্তি/মানুষের মানচিত্র]
তাঁর কবিতা যেন মানুষের সেই চিত্রই প্রকাশ করে, যে কিনা হন্যে হয়ে নিরন্তর খুঁজে চলেছে এই পৃথিবীতে তার যে অবস্থান। তার আদি এবং অন্ত। সমকালীন বাস্তবতায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনচিন্তার মাধ্যমে জানতে চাইছে জীবনের অর্থময়তা। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বোধগম্য হতে থাকে স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ, আশা আর নিরাশার মেলবন্ধনে মানুষের জীবন কীকরে বয়ে চলে। চলতে চলতে এগিয়ে যায়। নানান বাঁক বদলের পর পৌঁছুতে থাকে তার অভীষ্টের দিকে। বোধগম্য হয় প্রবহমান জীবনের যে প্রাপ্তি এবং প্রাপ্তিহীনতা— এগিয়ে যেতে হয় দুটোকেই সহজ গ্রহণে আগলে নিয়ে। তাঁর কবিতায় প্রতিনিয়তই তিনি মূর্তকে অমূর্তের দিকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন সহজ ভাষাগত প্রঞ্জলতায়। কেননা, আমরা এও জানি যে কবিতা ও জীবনের মাঝখানে ফাটল থাকলে সে কবিতা জনবিরোধীই হয়, পাঠক-প্রিয়তা পায় না। কবিতা প্রকৃতপক্ষে কার জন্যে? মানুষের জন্যেই তো। আর তাই কবিতা কতটুকু জীবনের কাছে, কতটুকু জীবন-যন্ত্রণার কাছে আসতে পেরেছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রতীয়মান হতে থাকে। আমরা স্মরণ করতে পারি প্রথম সময়ের দৃঢ় ও প্রত্যয়ী তাঁর সেইসব উচ্চারণ, ‘ছোট গল্প ও কবিতার বিভেদ ঘুচিয়ে আমি এক ধরনের নতুন রচনা উপহার দিতে চাই, যা সহজে পাঠক-শ্রোতার কাছে পৌঁছুবে। আধুনিক কবিতার তথাগত দুর্বোধ্যতা হটিয়ে আমি কবিতাকে লোকপ্রিয় করতে চাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর মানুষের কাছে তাঁর সত্যিকার ব্যক্তিক ও জাতীয় পরিচয় তুলে ধরতে চাই।’ হ্যাঁ, তুলে ধরেছেন তিনি। পাঠকের কাছে তা পৌঁছেওছে। অল্প সময়ের জীবনে অনেক লেখাই লিখেছেন তিনি। অনেকরকম নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে নিয়ে গেছেন নিজেকে। ‘মানুষের মানচিত্র’, ‘মৌলিক মুখোশ’, ‘গল্প’ আর তাঁর রচিত গানগুলো এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কবিতা বিষয়েও শুরু থেকেই তাঁর ধারণা ছিল স্পষ্ট। বলেছিলেন, যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সাথে সমকালকে অতিক্রম করার যোগ্যতাও রাখে তাকেই কবিতা বলা যেতে পারে। কারণ, মানুষ তাঁর স্বপ্ন বা স্মৃতিকে অন্য একটি আয়নায় প্রতিফলিত দেখতে চায়, সে আয়নাটি অন্য একটি মানুষের আয়না। যে স্বপ্নের প্রস্তুতি মানুষের মধ্যে বেড়ে উঠছে বা যে স্মৃতির কষ্ট তাকে অন্তরে ক্লান্ত করে কিংবা তাকে উদাসীন করে তোলে, তার ছবিগুলোই সে কবিতায় দেখতে পায়। আর এ কারণেই মানুষ কবিতার কাছে যায়। কবিতা পড়ে।
সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখিযে-রকম আকাশ পৃথিবী দ্যাখে পৃথিবী আকাশ,একবার অন্ধকারে, একবার আলোর ছায়ায়একবার কুয়াশা-কাতর চোখে, একবার গোধুলির ক্লান্ত রোদে—সারারাত স্বপ্ন দেখি— সারাদিন স্বপ্ন দেখি।[হে আমার বিষণ্ণ সুন্দর/উপদ্রুত উপকূল]
তাই বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়েও আজ মনেই হয় খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এই কবিকে পুনঃপাঠের। কবির স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
১৭/১২/২০২১
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
ঋতো আহমেদ
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
ঋতো আহমেদ
চমৎকার একটি প্রবন্ধ।
উত্তরমুছুন