বাতাস ও প্রেত
কী এক অলীক বিভ্রম। এই মাথা, মেঝের উপরে, নিজের জায়গা বুঝে নেয় দুইখানা কাঁটাতারের মাঝে, আর এরকমই থেকে যায়, নড়েনা-চড়েনা।
সে এক আগন্তুক মাথা শুধু কথা কয়, আমি তার বুঝি না কিছুই। এইখানে এই মেঝেতে কোনো আওয়াজই পৌঁছায় না ঠিকমত। আমি থাকি সর্বদা পথের ওপারে, চেয়ে চেয়ে দেখি যত শব্দ বাতাস বয়ে আনে, কত শব্দ সে দূরে ঠেলে দেবে। সে এক মাথা শুধু কথা কয়, আমি তার কিছুই শুনি না। সব কথা শুধু বাতাসেই মিলায়ে যায়।
ওগো বিশাল বিষণ্ণ বাতাস, কতবার আমি চেয়েছি তোমার মরণ। আমার একমাত্র টুপিটাও তুমি ছিনিয়ে নিয়ে গেছ। এখন আর আমার কিছু নেই, ঘৃণা ছাড়া, এবং সে ছাড়িয়ে যাবে তোমারও আয়ু।
চিরকাল একা
কোথা হতে আসে ধোঁয়া? চিমনি, নাকি আমাদের পাইপ? আমি খুঁজে খুঁজে বেছেছি এ ঘরের তীক্ষ্ণতম কোণা, একা হবো বলে। আর পথের ওপারে জানালা সর্বক্ষণ খোলা। ও কি আসবে?
সেই পথে যখন আমাদের বাহু মিলেমিশে সেতুর স্বরুপ, তখন কেউ তাকালো না উপরে আর সবকটা বাড়ি বেঁকে গেলো। যখন বাড়ির ছাদেরা ঠোকর খায়, ভুলেও মুখ খুলো না তুমি। প্রতি কান্নায় রুহু কেঁপে ওঠে তোমার, চিমনিরা নিভে যায়। কি অন্ধকার!
অস্পষ্ট প্রাণীরা
সে এক বিশাল লজ্জায় আমার মাথা উঁচু হয়ে থাকে। সব দুর্বহ জঞ্জাল ছেড়েছুড়ে হয়েছি নির্ভার। এখন আমার আছে কেবলই অপেক্ষা। তোমারও অপেক্ষা আছে, কিজানি কিসের! অন্তত কিছু যেন ঘটে। জানলা হতে প্রতিটি চোখ জ্বলজ্বল করে; আমাদের শত্রুদের সমূহ আক্রোশ পা পিছিয়ে জমে আছে দরোজার মুখে। কিন্তু যদি কিছুই না ঘটে...
আপাতত আমি হাঁটি দুইখানা ফুটপাথের মাঝে। আমি একা। সাথে এক বাতাস, সে শুধু প্রতি ঝাপ্টায় মুখ ভ্যাঙচায়। কোথায় পালাবো বলো, রাত্রির গভীরতা ছাড়া?
কিন্তু ওইখানে পড়ে আছে টেবিল ও ল্যাম্প, আমার অপেক্ষায়। বাকিসব আক্রোশে মরে আছে দরোজার মুখে।
হিংসা
মগজে তার জাঁকালো দৃশ্যের সমাহার, আর আমার মগজ থেকে তুমিও পালালে। তার আছে পৃথিবীর নক্ষত্র–প্রাণীরা, ব্যবহার্য দাস ও রমণী। সমুদ্র দোলায় তারে, সাগর আমারে, তবুও সে হয়েছে সব দৃশ্যের অধিকারী। আলতো স্পর্শে সে তুলে ধরে সব, সবকিছু তার দিকে ধায়। আর আমার মাথার ভারে নষ্ট হয় নাজুক ডালপালা। নিয়তি, যদি চেয়েছিলে আমিও পালাব এখান থেকে, আমাকে তবে ডানা দিলেও পারতে।
তারার তলে
আমি একাই বুঝি চাবি খুইয়ে বসে আছি, আর আমারে ঘিরে প্রত্যেকে গলায় বিশাল চাবি ঝুলিয়ে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসে।
আমিই শুধু, যার কোথাও কোনো প্রবেশাধিকার নেই। একে একে সব্বাই মিলিয়ে গেছে নিজেদের একান্ত দরোজার আড়ালে, আরো দুখী করে ফেলে গেছে শ্রান্ত রাজপথ। কেউ নেই। আমি বৃথা কড়া নাড়ি প্রতিটি দরোজায়।
ওপাশ জানলা থেকে তেড়ে আসে অজস্র গালি। আমি ফিরে যাই।
তারপর, শহর থেকে খুব-বেশি-নয় দূরে, নদী আর জঙ্গলের কিনারার কাছে এসে আমি পেয়ে গেলাম একটি দরোজা। একটা সাদামাটা দুয়ার যাতে নেই কোনো তালা। আমি ভিতরে ঢুকে এলাম আর, যেই রাত্রির কোনো জানলা নেই, তবু সুবিশাল পরদা আছে টানা, তার তলে; নদী আর জঙ্গলের মাঝামাঝি, যারা আমায় ঢেকে রেখেছিলো, আমি ঘুমোনোর জায়গা পেলাম।
(কবি পরিচিতিঃ পিয়ের রেভার্দি একজন ফরাসি কবি। তার কবিতা তার সময়ের কিউবিস্ট, স্যুরিয়ালিস্ট, দাদাইস্ট বিভিন্ন শিল্প আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় পরিণত হলেও তিনি নিজে কখনো কোনো ‘ইজম’-এর গণ্ডিতে আটকা থাকেননি। সারাজীবন খোঁজ করে গেছেন তার, যাকে তিনি বলেছেন “বাস্তবতার নিগূঢ় সারল্য।”
১৯১০ সালে তিনি প্যারিসে এসে পৌঁছান। সেখানেই পরিচয় হয় লুই আরাগঁ, আঁদ্রে ব্রেতো, ত্রিস্তাঁ জাঁরা, গীয়ম অ্যাপোলোনিয়র প্রমুখের সাথে। তার কবিতাগুলো ছোট্ট, পরিমিত, এবং মগজে তীক্ষ্ণ সব দৃশ্যের সঞ্চার করে। স্যুরিয়ালিজমের প্রথম ইশতেহারে আঁদ্রে ব্রেতো রেভার্দিকে তাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি বলে দাবি করেন। লুই আরাগঁ তাকে মেনে নেন বুজুর্গ এবং অনুসরণীয় কবি হিসেবে।
তবে রেভার্দির নিঃসঙ্গ সাধুস্বভাব তাকে পরবর্তীতে প্যারিসের কোলাহলময় সাহিত্যজগৎ থেকে সরিয়ে আনে। ১৯২৬ সালে বন্ধুদের সামনে তিনি তাঁর একাধিক পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেন। শেষ বয়সে ক্যাথোলিক চার্চের অনুগামী হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে প্যারিস হতে দূরে নিরিবিল বসবাস করেন।)
পিয়ের রেভার্দি’র একগুচ্ছ কবিতা
বাঙলায়ন: মাহীন হক
বাঙলায়ন: মাহীন হক
মুগ্ধ করেছে কবিতাগুলো। মনেই হয়নি অনুবাদ পড়ছি।
উত্তরমুছুনঝরঝরে, প্রাঞ্জল অনুবাদ। ভালোবাসা।
উত্তরমুছুন