চট্টগ্রাম কলেজে পড়তে এসে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পেলাম। এক ক্লাস শেষ করে পরের ক্লাস করার জন্যে এক বিল্ডিং খেকে আরেক বিল্ডিংয়ে ছোটা, ক্লাস করকে মন না চাইলে কমনরুমে গিয়ে ক্যারম দাবা খেলা। অনেকে অবশ্য টেবিল টেনিস খেলতে পছন্দ করে, কিন্তু গতিবিদ্যার সাথে আমার সমূহ বিরোধ। আমার ব্যালেন্স বোধ এবং দৌড়ঝাপে ভীষণ দুর্বলতা। আমি তাই বসে বসে বুদ্ধি খাটিয়ে যা খেলা যায়, তা বেশ ভাল পারি। ক্যারম খেলাতেও আমার অবস্থা শোচনীয় থাকত। পাশে ক্যান্টনে বসে চা-সিঙ্গাড়া অনেকেই খায়, কিন্তু বাসার খুব কাছে কলেজ হওয়ায় আমার হাতে কোন টাকা পয়সা দেওয়া হতে না। সবচেয়ে মজা পেতাম বোটানি বিল্ডিংয়ের সামনের চত্বরে দাঁড়িয়ে বা বসে দর্শন, সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে আলাপ করতে। আমার সাথে পাপ্পু, কিশোয়ার সহ অনেকেই এই আড্ডায় শরিক হতো। নিজেদের অনেকটা সক্রেটিস টাইপ মনে হতো তখন। একবার মধ্যাহ্নবিরতির পরে ফিজিক্স ক্লাস ছিল ফিজিক্স গ্যালারিতে। আমি এবং তানভীর দিবারাশ সেরে ক্লাসে গিয়ে দেখি কেউ নেই। বাতেআরও অনেক সময় আছে। তাই, বইখাতা টেবিলে রেখে দুজনে চলে যাই কমনরুমে। আমি বসে বসে আড্ডা দিলাম। তানভীরসম্ভবত টেবিল টেনিস খেলেছে। যখন ক্লাসে ফিরে আসি তখন ক্লাস ভরে গেছে। আমরা পছন্দের জায়গামত বসে গেলাম। দেখি, ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে তাকিয়ে সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। তাকিয়ে দেখি, লেখা আছে — “নুরীর মূল্য ১ টাকা”। আমরা সেকালেএক টিভি এক চ্যানেলের যুগে বাস করছি। সম্ভবত সকালসন্ধ্যা নামে একটি ধারাবাহিক নাটক সারা বাংলাদেশের ঘরে ঘরেসকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। তারই একটি চরিত্রের নাম ছিল নুরী। আমরা আমাদের সতীর্থ একটি মেয়ের লম্বা চুল ওচেহারার মিলের কারণে আড়ালে নুরী বলে ডাকতাম। এখন কে বা কারা বোর্ডে এসব লিখেছে আমি তো দেখিনি। ক্লাস নিতেএসেছিলেন যতদূর মনে পড়ে সুধীর স্যার। এর দশ মিনিট পরেই হঠাৎ মোজাম্মেল স্যার এসে হাজির। এমনিতে কাল আবলুসরং, তেমনি তাঁর হোঁৎকা শরীর, আর তার সাথেই কাল মিলিয়ে জাঁদরেল চেহারা। স্যার সুধীর স্যারকে কি যেন বললেন, তারপরআমাদের একে একে ক্লাস খেকে বেরিয়ে আসতে বলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে যাবার সময় প্রথমেধরলেন জয়কে, তারপর তানভীরকে। তানভীরকে ধরার সাথে সাথে আমার হৃৎপিণ্ড লাফাতে লাগল ভয়ে। কিন্তু ভাবলাম, আমি তো কিছু করিনি, আমাকে ধরবে কেন! আবার ভাবলাম, তানভীরকে তবে কেন ধরল! এমন সময় আমি দরজার কাছেপৌঁছালে মোজাম্মেল স্যার হুঙ্কার দিয়ে বললেন “এই তুই দাঁড়া”, আর সাথে সাথে খামচে ধরলেন শার্ট। এভাবে আমাদেরপাঁচজনের দলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন রশিদ স্যার। কেঁডা রশিদ নামে স্যারবিখ্যাত। আবার রশিদ স্যার আব্বার বেশ ঘনিষ্ট। এখন আমার পরিচয় পেলে আমারে কি ভাববেন, আর আব্বাকে কি বলবেনএসব সাত পাঁচ ভাবছি। দেখি ষোল কলা পূর্ণ করার জন্যে মোজাম্মেল স্যারের আমন্ত্রণে কেমিস্ট্রির সিরাজ স্যারও এসে হাজির।জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার প্রস্তুতি চলছে, কিন্তু মোজাম্মেল স্যার আবার কোথাও গিয়েছেন। এর মধ্যে আমাদের মধ্যে তানভীরকেএবং আমাকে দেখে সিরাজ স্যার চিনতে পেরেছেন। স্যার খুব বিস্মিত হয়েছেন, এটা টের পেলাম। রশিদ স্যারের গম্ভীর দৃষ্টিরসামনে আমরা যেন ইঁদুরের মতো ইতিউতি করছি। সিরাজ স্যার বললেন, বলে ফেল তোমরা কি কি করেছ। কিন্তু আমি জানি না, কি অপরাধে আমাকে ধরা হলো। আমি বললাম, আমি বই রেখে কমন রুমে চলে যাই। এর বেশি কিছু জানি না। স্যারের বক্তব্যেটের পেলাম, বই রেখে যাওয়াটাই আমার কাল হয়েছে। এমন সময় মোজাম্মেল স্যার সাইখকে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে (টেনে হিঁচড়ে) নিয়ে এলো। সাইখ বেশ নাটকীয় কায়দায় বললো “সত্যি কথা বলবো স্যার?” এই কথা শুনে সিরাজ স্যার বললেন “ সত্য কথানা বললে এখনি টিসি দিয়ে দেবো। তখন সাইখ বললো ‘আমি দেখেছি, এটা মুরাদ লিখেছে’। যাই হোক, েতে অবডশ্যআমাদের মুক্তি মিলল না। সেদিনের মতো মুলতবি রেখে রোল নম্বর টুকে নিলেন স্যারেরা। বিকেলে তুষার ভদ্র স্যারের কাছেপড়তে গিয়ে আমরা আমাদের নির্দোশিতার কথা বললাম। স্যারের আবার অপছন্দ হল শাহেদ। কারণ সাহেদ পা চেগিয়ে হাঁটে।আসলে সাহেদ হল জয়ার স্পোর্টসম্যান। তার পা দুটো একটু চ্যাগানো, কোন সন্দেহ নেই। ের পরে অবশ্য আমাদের আর ডাকাহয়নি, কারণ আসামী ধরা পড়েছিল। কিন্তু বেশ কদিন আত্মারাম খাঁচা ছাড়া ছিল। পরে জানা গেল, বেশ কিছু দিন ধরে স্যারেরানজর রাখছিলেন, কারা ব্ল্যাক বোর্ডে অশ্লীল ছবি ও কথা আঁকা-লেখার কাজ করে যাচ্ছে। আর সে কাড়নেই মোজাম্মেল স্যারআমাদের গতিবিধি লক্ষ করেছিলেন। যাক, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম এই বিপদ থেকে। তবে তাই বলে ক্লাসে বাঁদরামি কোন অংশেইকমেনি। অনেকেই ইংরেজি ম্যাদামের প্রেমে পড়ে নিয়মিত ক্লাসে ডগুকে নানারকম শব্দ করে ডিস্টার্ব করতে লাগলো। রেহানাম্যাডাম নামে আরেকজন ম্যাডামও বেশ আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এর মধ্যে আবার ফিজিক্সে পিএইচডি করে এসে যোগদিয়েছেন ফাতেমা নার্গিস ম্যাডাম। ছেলেপেলে অবাই ম্যাডামের থুতনির ঘামে মজে গেল। ম্যাদামের ক্লাসে ঢুকলেই নানারকমঅদ্ভুত শব্দ শোনা যেতে লাগলো । বিশেষ করে রোল কল রাড় সময়। ম্যাডামও যার নাম ডাকার সময় বেশি শোর ওঠে তারনামের পাশে সটার চিহ্ন বসাতে থাকলেন। এমন করে এক সময় একেক জন্মের নামের পাশে তিন চার্টই লাল তারা শোভা বর্ধনকরতে লাগল। অন্য স্যারেরা বিশেষ করে তুষার স্যার ও সুধীর স্যার এসব স্টার দেখে মুচকি হাসতেন। স্যারেরা দেখতেন এসবস্টারধারী ছেলেগুলো তাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়ে। এরা যে ভাল এবং মেধাবী, সে ব্যাপারে স্যারদের কোন সন্দেহ নেই। এসব মৃদুমশকরা তো তবু সহনীয়, এমন অনেক অসহনীয় কাজও আমার বন্ধুরা করতো, তার ফিরিস্তিও কম লম্বা হবে না। আমাদেরঅংকের আনোয়ার হোসেন স্যার কলেজে ময়নার বাপ এবং দুলাভাই এই দুই নামেই খ্যাত ছিলেন। শোনা যায়, কোন একছাত্রীকে বিয়ে করার পরিণাম হিসেবে সারা কলেজ জুড়ে তাঁর এই দুলাভাই নাম জুটেছে। আমাদের বন্ধু ধীমান যেমন বল্যে থাকেমুরগী পেলে মুরগী ভক্ষণ! জানি না ময়নার বাপ কেন বলতো। হয়তো স্যারের মেয়ের নাম ময়না রেখেছিলেন। তবে আমরাপূর্বসুরীদের কাছ থেকে এসব নাম অবলীলায় গ্রহণ করেছিলাম এবং তাঁর আসল নাম অনেকেই বলতে পারবে না। দুষ্টামিতেধীমান যেন সকলকে ছাড়িয়ে গেল। অন্যরাও কম যায় না। রফিকও বেশ দুষ্ট। তবে তার কিছু কাজ বেকায়দা রকমের ঘটে গিয়েছিল। আমি জানি না, গ্যালারিতে সে কোন ছেলেটি প্রস্রাব করে দেয়, কেউ একের পর এক মার্বেল পেছনের সারি থেকেছাড়তে থাকে, যা সারা গ্যালারিময় টুকটাক টুকটাক থেকে টুংটাং টুংটাং সুর তুলে নামতে থাকে স্যার ম্যাডামদের পায়ের কাছে।যেন এক বিকল্প উপায়ে শিক্ষকের পদধূলি গ্রহণের আয়োজন। পচা ডিম ছুড়েও আমারাটা অবশ্যই বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ঘটনা।আমাদের অনেকেই এটা অনুমোদন করতে পারিনি মন থেকে।
কেবল বাঁদরামিই করিনি এই কলেজ জীবনে। আমি বিজ্ঞান এবং আবু হেনা মানবিক বিভাগে পড়লেও আমাদের বন্ধুত্ব সেইআগের মতোই অটুট ছিল। আগের মতো বলতে, সম্ভবত নবম শ্রেণী থেকেই আমি, আবু হেনা মোরশেদ জামান এবং মাসুদজামান একটি ত্রয়ী বন্ধুত্বের নিগড়ে একত্র হয়ে নানান উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতার পাঠ গ্রহণ করেছি। সেই সম্পর্ক এবংআমরা সবুজ সংগঠনের ফলশ্রুতিতে আমার বাসায় আয়োজন করেছিলাম সারাদিন ব্যাপী সাহিত্য প্রতিযোগিতার। যার মধ্যেসৃজনশীলতার পাশাপাশি বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা এবং নির্ধারিত বক্তৃতা ইত্যাদির ব্যবস্থাও হয়। বিচারক ডেরে পুরষ্কারও দেবারব্যবস্থা করেছিলাম। তখনও স্কুলের গণ্ডী পেরুইনি। এখন কলেজে এসে তো আর বসে থাকা যায় না। আমরা গঠন করলামএকটি সংগঠন যার নাম দিলাম ‘প্রতীতি’। আমরা সপ্তাহে ১ দিন কলেজের ভুগোল বিভাগের গ্যালারিতে সভা করতাম। বিজ্ঞানবিভাগের ছাত্র বেশি ছিল না। অধিকাংশই ছিল মানবিক বিভাগের ছাত্র এবং তারা আবু হেনার অনুরক্ত ভক্ত। পরে অবশ্য আবুহেনার কিছু কিছু সিদ্ধান্তে সম্মত হতে না পেরে এবং আমার সাংগঠনিক আগ্রহ কমে যাওয়ায় আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম।আবু হেনা এর মধ্যে অনেক খ্যাতিমান হয়ে গিয়েছে। তার লেখা নিয়মিত সাপ্তাহিকীতে প্রকাশিত হয়। সবসময় একদল ভক্তগোছের বন্ধু নিয়ে বেশ আহ্লাদে দিন যাপন করে। মাঝে মাঝে একটু বুকটা চিন চিন করে উঠতো, আগের সেইসব দিনগুলোরজন্যে। বেশ নিঃসঙ্গ লাগতে থাকে। এসব অবশ্য সবকিছুই আমার মনগড়া ভাবনা। কারণ, অপরপক্ষের সাথে এ বিষয়ে কোনকথা কোনদিন হয়নি, এমনকি এখনও না। আবার অন্যদিকে নতুন নতুন বন্ধুর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি প্রাইভেট পড়ার গ্রুপ, সাহিত্যমোদী গ্রুপ, রাজনীতিপ্রিয় গ্রুপের নানাজনের সাথে।
বাসার খুব কাছে কলেজ হওয়ায় সকালে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম প্যারেড মাঠে। এটা আসলে চট্টগ্রাম কলেজের মাঠ, কলেজের একেবারে উত্তর প্রান্তে। তবে কোন আদ্যিকালে এখানে হয়তো সেনারা প্যারেড করতো। তাই এর নাম আজীবন প্যারেডময়দান নামেই অভিহিত হবে। প্যারেড ময়দানের দক্ষিণ পাশে পশ্চিমে শেরে বাংলা হল এবং পূর্বে সোহরাওয়ার্দী হল।সোহরাওয়ার্দী হলের দক্ষিণে একটি ছোট হিন্দু হোস্টেলও ছিল। সোহরাওয়ার্দী হলের হল সুপার ছিলেন অংকের সাত্তার স্যার।সাত্তার স্যার হোস্টেল সাথে লাগানো কোয়ার্টারে সপরিবারে থাকতেন। আমি কেন যেন তানভীরের বাবার কাছে প্রাইভেট পড়লামনা, যদিও সবাই তাহের স্যারের ভক্ত। তাহের স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার সূত্রে অনেকেই তানভীরের খুব ঘনিষ্ট হয়ে পড়ে।কলেজ জীবনের শুরুতে তানভীর ও আমার যে ঘনিষ্ট হাঁটাচলা, তার মধ্যে ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে অনেক রকম বন্ধু। সেদিকথেকেও আমার নিঃসঙ্গ হওয়ার ঘটনা ঘটে। যাই হোক, আমি প্রাইভেট পড়ি সাত্তার স্যারের কাছে। স্যার কোন ব্যাচকেই আধঘন্টাবা চল্লিশ মিনিটের বেশি পড়াতেন না। তাই অনেক ছেলেমেয়ের ভীড় জমে যেত স্যারের কোয়ার্টারের সামনে। মাঝে মাঝে স্যারভুল করে ২/৩টা ব্যাচকে একই সময়ে আসতে বলে দিতেন। তখন একেক দলকে ১৫/২০ মিনিট করে পড়াতেন। স্যার তখনতাড়াহুড় করে এমনভাবে কথা বলতেন যে মুখে ফেনা উঠে যেত। কলমের খোঁচায় ছিঁড়ে যেত খাতার পৃষ্ঠার কাগজ। আমি লেখারযন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্যে স্যারের পাশে বসে আমার খাতাটা স্যারকে অংক করার জন্যে এগিয়ে দিতাম। এতে করে আমারখাতাটা স্যারে কলমের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত। স্যারের বাসার সামনে আমাদের আড্ডা এবং শীতের সকালে রোদপোহানো আজ বড় মধুর স্মৃতি হয়ে আছে।
আমাদের এক বন্ধু এসে একদিন জানতে চাইল, অমুক মেয়েকে আমি পছন্দ করি কিনা। আমি বিস্মিত হই। পরে টের পেলাম, বিভিন্ন সময়ে ক্লাসে ও ক্লাসের বাইরে কথাবার্তা বলতে দেখে তার মনে এমন ধারণা হয়েছে। আমি বলেছিলাম পছন্দ করি বটে, তবে যে অর্থে সে জানতে চায় সে অর্থে নয়। তার কিছুদিন পরে তাদের প্রেমমগ্ন জুটিকে এদিক সেদিক আড়াল খুঁজে আলাপরতদেখে পুরো ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করি। আর মনে মনে টের পাই, আমার মনের ম্যাচুরিটি তখনও বন্ধুদের সমান পর্যায়ে পৌঁছেনি।
আরেক বন্ধু এর মধ্যে একটি মেয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করলো। সেই মেয়ে কারে চড়ে কলেজে আসাযাওয়া করতো।দেখি, বন্ধুটি সেই মেয়ের গাড়ির পিছু নিয়ে সাইকেল চালিয়ে অনুসরণ করতো। এভাবে সে মেয়েটির বাসা পর্যন্ত আবিষ্কার করতেপেরেছিল, কিন্তু তাকে প্রেম নিবেদন করতে পারেনি। অগত্যা একদিন সে তার প্রেমের কেবলা পরিবর্তন করল। আমরা বিকেলেবন্ধুটির আন্দরকিল্লার বাসায় তাসের আড্ডায় বসা শুরু করলাম। তাদের বাসার পাশের বিল্ডিংয়ে এক মেয়ে বেশ কিছুদিনেরজন্যে বেড়াতে এসেছে। তার নাম খায়রুন্নেছা। সে কোন এক মাদ্রাসা ছাত্রী ছিল। আমার সেই বন্ধুটি তার প্রেমের পড়ে গেল। প্রেমযেন রাস্তার ম্যানহোলের মতো, আর তাতে এই বন্ধুটি দেখিবামাত্রই পড়ে যেতে বাধ্য। তো আমরা দল বেঁধে সে বিল্ডিংয়ের দিকেতাকিয়ে থাকতাম। রাজকন্যাকে একটু দেখা দিলেই বন্ধুকে ডাকাডাকি শুরু করতাম। তারপর আমরা সরে এলে তারা চেয়েথাকতো একে অপরের দিকে দীর্ঘক্ষণ। কথা নয়, ইশারার বিনিময় হতো। সেযুগে এ কাজকে টাঙ্কি মারা বলতো। আমাদের এইবন্ধু টাঙ্কি মেরে অবশ্য সফল হতে পারেনি। মেয়ের বাবা খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়। আর সেই বিয়েতে বর গাদাবন্দুকহাতে প্রহরীসহ বরযাত্রী নিয়ে বিয়েতে এসেছিল যাতে আমার বন্ধুটি কোনরকম বিপত্তি ঘটাতে না পারে। কিন্তু তারা জানতো না, ততদিনে আমার বন্ধু প্রেমের কেবলা অন্য নারীর দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে।
এই বন্ধু আবার খাতায় কবিতা লিখতো। আমিও কবিতা লিখি জেনে, মাঝে মাঝে সে তার লেখা পড়তে দিতো। এর মধ্যে ক্লাসেরকেউ কেউ আমাকে কবি হিসেবে চিন্তা করতো, তবে খুব বেশি লোক তা জানতো না। একদিন কেমিস্ট্রি ক্লাস চলছে কেমিস্ট্রিবিভাগের নিচ তলায় একটি লম্বা হলে। আমি মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনছি। কিন্তু ঠিক পেছনে বসে আমার এই অস্থিরবন্ধু পেছন থেকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছে তার সদ্য লেখা কবিতা পড়ার জন্যে। আমি পেছনে ফিরে খাতাটা নিয়ে যেই পড়া শুরুকরেছি, অমনি স্যার হনহন করে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। ভয় পেয়ে আমি খাতা ফেরত দিয়ে দিলাম। কিন্তু স্যার ঠিকইআমার কাছে এসে থামলেন। আমার খাতা হাতে নিয়ে খোলা পৃষ্ঠায় লেকচার শুনে লেখা সমীকরণ দেখলেন।তারপর খাতাটাউল্টে পাল্টে দেখতে গিয়ে দেখেন, খাতার পেছনে অনেকগুলো কবিতা লেখা রয়েছে। তিনি খাতা বাজেয়াপ্ত করে বাকি ক্লাস শেষকরলেন। এদিকে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। আর স্যার সেই খাতা নিয়ে চলে গেলেন বিভাগীয় প্রধানের রুমে। আমি ওবন্ধুরা অনেক অনুমত করলাম, কিন্তু বিধি বাম। অনেক অপেক্ষার পর স্যার আমাকে ভেতরে ডাকলেন। ভেতরে ঢুকে দেখিচৌধুরী মনজুরুল হক স্যার আমার কবিতা পড়ছেন এবং সিরাজ স্যার সহ অন্যরা খুব মন দিয়ে শুনছেন। আমি ভয়ে কম্পমান।সিরাজ স্যার বললেন ভালই তো লিখেছে। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন “ও, তুমি?”
০৫-১-২০২২, রাত ৭:৫০, বনানী, ঢাকা
কোরাকাগজের খেরোখাতা (পর্ব ২০)
জিললুর রহমান
জিললুর রহমান
মন্তব্য