প্রতিদিনই আরিফের ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায়। প্রথম প্রথম বিছানায় এপাশওপাশ করেই কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে এখন তা করে না। স্নানটান করে খালি পেটেই ছয়তলা থেকে নেমে পড়ে। গলির মুখে কলিমের দোকানে দুইকাপ চা খায়। তারপর সারাদিন রাস্তায় রাস্তা ঘুরে, হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায়। দুপুরে ফুটপাতের কোনো দোকানো চা সিংগারা খায়, কখনো বাটারবন।
আরিফ তার নয় নাম্বার চাকরি ছেড়েছে সাতমাস আগে। তারপর আর চাকরি পাচ্ছে না। সে বিচিত্র কারণে চাকরি ছাড়ে। যেমন প্রথম চাকরি ছেড়েছে একমাস তেরোদিনের মাথায়, কারণ তাকে টাই পরে, শার্ট ইন করে অফিসে যেতে বলা হয়েছিলো। আর শেষ চাকরি ছেড়েছে মাথামোটা মহিলা এমডি তাকে পেছনে বসে ডিরেকশান দিতো বলে। সে যখন কোনো ডিজাইন করে তখন পেছনে বসে কেউ ডিরেকশান দিলে কাজ করতে পারে না, তার মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। ওই চাকরি সে ছেড়েছে ছয়দিনের মাথায়। মাঝে ছিলো দুইটা অফডে।
আরিফ ঘড়ি দেখলো, সকাল সাতটা ছয়। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। একটা দুইটা বাস রাস্তায়। আজকে হরতাল। আরিফ হাঁটতে হাঁটতে টেকনিক্যালের মোড় পার হচ্ছে এমন সময় পোড়ালাল রঙের পুরনো একটা ডাবলডেকার এসে তার পাশে থামলো। সে কিছু না ভেবেই সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ডাবলডেকারে উঠে পড়লো। তেমন লোকজন নেই। দোতলা বলতে গেলে প্রায়ই ফাঁকা। সেই পুরনো দিনের মতো আরিফ সামনের সিটে গিয়ে আরাম করে বসলো। সামনে জানলার কাচ নেই। বাস চলছে আর হুহু করে হাওয়া আসছে। বাতাসে চুল উড়লে আরিফের ভালো লাগে। আর ডাবলডেকারে উঠলেই তার মনে হয় হাতির পিঠে চড়ছে। তার ছোটোবেলার স্মৃতি এইরকম, হাতির পিঠের চড়লে যেমন একটা দুলুনি আছে, এই দোতলা বাসে চড়লেও সেইরকম একটা দুলুনি অনুভূত হয়।
আরিফদের গ্রামের বাড়ির সামনে একটা মাঠের মতো ফাঁকা জায়গা ছিলো। ওখানে প্রতিবছর বসতো সার্কাস-পার্টি। কেমন রাজপ্রাসাদের মতো তাঁবু খাটিয়ে বসতো সার্কাস। তিনদিন তিনরাত চলতো। রাতদিন নানা গানবাজনা হতো। সেই সার্কাসের হাতি অফটাইমে মাহুত পিঠে নিয়ে আসতো তাদের গেটে। ওদের বাগান থেকে কলাগাছ কেটে এনে দেয়া হতো আর হাতি দুই কামড়ে একটা কলাগাছ খেয়ে ফেলতো। একবার সার্কাসেরই একটা হাতি ছুটে গিয়ে তরমুজ খেতে ঢুকে পড়লো, তরমুজ ক্ষেত তছনছ করলো, আর গোটাদশেক তরমুজ গিলে ফেললো। একটা তরমুজের সাইজ মনে হয় বেশ বড় ছিলো ওটা গলায় আটকে গেলো। মাহুত যখন আরিফদের গেটে হাতিটাকে নিয়ে গেলে হাতির চোখে পানি। আরিফের ছোটোচাচা একটা কলাগাছ নিয়ে এলো। হাতি যেই শূঁড় তোলে হা করলো সঙ্গে সঙ্গে কলাগাছটা হাতির মুখে ঢুকিয়ে একটা ঠেলা দিলো আর তরমুজটা ভিতরে চলে গেলো। সেইদিন মাহুতের কোমর জড়িয়ে ধরে হাতির পিঠে চড়েছিলো আরিফ। আজ সেইদিনের স্মৃতি আবারও মনে পড়ে গেলো।
নতুন নতুন ঢাকায় এসে সে নিয়মিত ডাবলডেকারের দোতলার সামনের সিটে বসে শহরের এমাথা ওমাথা ঘুরে বেড়াতো। তখন ভাড়াও ছিলো কম, যানযটও তেমন ছিলো না। সে গাবতলি থেকে উঠে গুলিস্তান যেতো। একই বাসে আবার গাবতলি। এইভাবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাসে ঘুরে বেড়াতো মাঝে মাঝে। তার মনে হতো হাতির পিঠে চড়ছে। ভাবলো আজকেও সারাদিন এই বাসে ঘুরে বেড়াবে।
আরিফের মনে পড়ে যায় অনেক আগে মুখস্ত করা মেঘদূতের শ্লোক। এইটা খুব সম্ভব দ্বিতীয় শ্লোক,
তস্মিন্নদ্রৌ কতিচিদবলাবিপ্রযুক্তঃ স কামী
নীত্বা মাসাঙ্ক কনকবলযভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ
এইসবের মানে কী? কামের প্রবল তৃষ্ণায় প্রিয়তম নারী বিরহে বন্দী যক্ষের শরীর হয়ে আছে পাটকাঠির মতো শীর্ণ, পলকা। আর তার শীর্ণ হাত গলে সোনার বালা খসে পড়েছে। তখন পুরুষেরাও বালা পরতো। বলয় মানে তো বালা জাতীয় কিছু। তারপর,
আষাঢস্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীডাপরিণতগজপ্রেক্ষণীযং দদর্শ।
এতোক্ষণে আরিফের মনে হলো এই শ্লোক মাথায় আসার কারণ এইখানে হাতির কথা আছে শেষ লাইনে, আষাঢ়ের প্রথমদিনে পর্বতের মাথায় হাতির মতো মেঘ খেলা করছে এইসব কথা মনে হয় শেষ লাইনে আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে তার ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে রূপবতী মেয়েটির কথা মনে পড়ে, যাকে সে মেঘদূত পড়ে শুনিয়েছিলো। এবং তার নাম দিয়েছিলো অলকানন্দা। আরিফ যখন মেঘদূতের শ্লোক এবং বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ পড়ে শোনাতো আর ব্যাখ্যা করতো তখন মেয়েটি আরিফের চোখের ভিতর অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকতো, সেই চোখে কাম আর বিস্ময়ের অবিমিশ্র একটা রূপ পরিলক্ষিত হতো। মেয়েটা আরিফের নাম দিয়েছিলো মেঘদূত। আর আরিফ মনে মনে তাকে বলেছিলো, মেঘদূত তোমার দিকেই তাড়িত, সে আসলে যক্ষের ইচ্ছের রূপ—মানে মেঘদূতই বিরহী যক্ষ।
হাতি যেমন একটা মৃদুমন্দ ছন্দে হাঁটে, যে তালে হাঁটার সময় নিতম্ব-শ্রোণিদল দোলে—মেয়েটিও ওইভাবে, ওমন ললিত তালে হাঁটতো। তাই আরিফ তার আরো একটি নাম দিয়েছিলো গজগামিনী। পরে মেয়েটি গজগামিনী নামে একটা লিথোগ্রাফ করে তাকে দিয়েছিলো; ছবিতে ছিলো গভীর বনের মধ্যে একটা হাতি, আর হাতির পিঠে একটা পরীর মতো মেয়ে, কোথাও যাচ্ছে। খুব সুন্দর ছবিটা। ছবিটার মধ্যে একটা স›ধ্যা স›ধ্যা ব্যাপার আছে, ছবির মেয়েটা বুঝি অভিসারে যাচ্ছে, তার ভারি নিতম্ব দৃশ্যমান, স্তনপাশও খানিকটা দেখা যায়। হাতির পা ডুবে যাচ্ছে যেনো বনজ্যোৎস্নার গুল্মে।
সারাদিন আকাশে মেঘ মেঘ একটা ব্যাপার। মাঝখানে একবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও হয়ে গেলো। আরিফ একই বাসে ঘুরছে সকাল থেকে। সকালের দিকে একবার রমনাপার্কের জনহীন ফুটপাথে দেখলো একটা মেয়ে একটা ছেলের গলা জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে। দেখে ভাবলো ভালোই ছেলেমেয়েরা সাহসী হচ্ছে। তার মনে পড়ে গেলো এমনই কতো চুম্বনের স্মৃতি। স›ধ্যার বৃষ্টির ভিতর বকুলবনের রাস্তায় যে মেয়েটি তাকে প্রথম চুমু খেয়েছিলো—সে এখন কোথায়? কিংবা গভীর নীল কুয়াশার ভিতর সমুদ্রের ঢেউয়ের পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে... কতো ভাবনা তার মাথার ভিতর ঘুরে ঘুরে হারিয়ে যাচ্ছে, কতো স্মৃতি! প্রেম ও পরশ্রীকাতরতার স্মৃতি, হেরে যাওয়ার স্মৃতি কতো কী! কতো যাত্রী উঠছে, নামছে। মাঝে মাঝে খেয়াল করছে মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছে। দুপুরে খায়নি কিছু, বাস থেকে নামতেই ইচ্ছে করেনি। তবে আজকে তার বুকের বামপাশে জ্বলুনিটা কম। অন্যদিন বেশি জ্বলতো। কেন কে জানে। রুমকি বলে ডাক্তার দেখাও, নিশ্চয়ই গ্যাস্টিক এর সমস্যা। বলে বলে সে ক্লান্ত। আর বলে না। রুমকি সারাদিন অফিসে থাকে। চারুলতাও তার সঙ্গে। ওদের অফিসে ডেকেয়ার আছে ওখানে দিয়ে দেয়। চারুলতার বয়স কতো হলো, মনে করার চেষ্টা করে আরিফ। একবছর তো পার হয়েছেই। নাম রাখার ইচ্ছা ছিলো দুর্গা। কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক কারণে রাখা গেলো না। মুসলমানরা নামের মাঝেও হিন্দু-মুসলমান বিভাগ করে ফেলে। তাদের কাছে বাঙলা নাম মানেই হিন্দু নাম। অবশ্য দুর্গা নামটা একটু বেশি বেশি হিন্দু। একেবারে হিন্দুদের প্রধান দেবীর নাম। সে ভেবেছিলো পথের পাঁচালি। ছেলে হলে অপু নাম রাখবে। আর মেয়ে হলে দুর্গা। যাইহোক রাখা গেলো না। তাই চারুলতাই রেখে দিলো, এটা বাঙলা নাম হিশেবে চালিয়ে দেয়া যায়। তার মনে হলো চারুলতা বড় হয়ে একদিন কারো মশারির ছাদে জরির সুতোয় নকশা বুনে দেবে।
স›ধ্যা নেমে এলো ঝুপ করে। আরিফ টের পেলো না। একই বাসে এইটা কতোনম্বর চক্কর মনে করতে পারলো না একবার চেষ্টা করেও, তাই আ মনে করার চেষ্টাও করলো না। রাস্তায় মানুষ ও বাস, গাড়ি বাড়ছে; বাসের ভিতর বাড়ছে ভিড়। মাথায় ঘুরছে একটা গল্পের প্লট, সেটাও হাতি বিষয়ক। শিশুপার্কের সামনে যানজটে আটকে পড়লো বাস। হঠাৎ খোলা জানলা দিয়ে বেশ কয়েকটা আগুনের গোলা এসে পড়লো বাসের ভিতর, মুহূর্তেই বাসের ভিতর সমস্ত আগুন ধরে গেলো। মনে হয় পেট্রোলবোমা। আরো কয়েকটা এসে পড়লো। আরিফের গায়েও ধরে গেলো আগুন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আরিফের শরীরে কোনো জ্বলুনি নেই। তার শার্ট পিঠ থেকে পুড়িয়ে মাথার দিকে উঠে যাচ্ছে আগুন, চুল পুড়ছে পটপট করে। তার খেয়াল নেই সেদিকে; বাসের ভিতর হুড়োহুড়ি, গগনবিদারি চিৎকার তার কানে বাজছে না। সে কেবল অবাকবিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বাসের ভিতর অনতিদূর সামনে একটা অতি রূপবতী মেয়ের দিকে, সে দেহ থেকে খুলে ফেলছে একটা আগুনের শাড়ি। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারছে না, আগুন জ্বলছে তার ব্লাউজে, পুড়ছে তার অলকচূর্ণ, নদীর মতো চুল। তারপর সবকিছু ছাপিয়ে শুনলো ছোটোবেলায় শোনা ভয়ানক বৃংহতি। বৃংহতি মানে হাতির ডাক, ছোটোবেলায় পড়া একথায় প্রকাশ; ঘোড়ার ডাক হ্রেষা, বাঘের ডাক গর্জন, বীরের ডাক ওঙ্কার ইত্যাদি।
হঠাৎ সব নীরব হয়ে গেলো, আরিফ আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। শুধু দেখছে পাচ্ছে হলুদ রোদের বন্যা চারপাশে, মৃদুমন্দ হাওয়া লাগছে আঙুলে। রোদ নয়, যেনো বা সূর্যমুখীর বন। আর সে বসে আছে একটা হাতির পিঠে। হাতির দুপাশে গজিয়ে উঠছে ঝলমলে ডানা। সূর্যমুখীর বন ছেড়ে হাতি উড়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে, একটু পরেই মেঘের প্রান্তর। আরিফের মাথার ভিতর ঘনীভূত হচ্ছে কালীদাসের শ্লোক।
আ জার্নি বাই এলিফ্যান্ট
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মন্তব্য