নারীঃ আমি ভোরবেলা দাঁড়িয়েছিলুম বারান্দায়
আর তুমি সূর্যের আলোর নীচে মুখ রেখে বলেছিলে
প্রেমিকঃ পৃথিবীর যন্ত্রণার উত্তরণ হোক
অশিল্পের অন্ধকার থেকে
১০ই নভেম্বর। ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম ফেবুতে ৪ বছর আগের কবি জয় গোস্বামীর জন্মদিনের একটি শুভেচ্ছা বার্তা ফিরে এসছে। সেইসাথে স্ক্রল করতে করতে উঠে আসতেছে আরও একটি ছবি। আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগের ঢাকার সেই উত্তাল রাজপথে উন্মুক্ত শরীরের বুকে আর পিঠে এক আশ্চর্য কবিতা নিয়ে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে গেছিল বন্দুকের নলের সামনে, সেই শহিদ নূর হোসেনের ছবি। লিখা ছিল, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। ঘুম-ভাঙ্গা চোখে সেই ছবি ক’টা দেখতে দেখতেই মনে হচ্ছিল, কী অদ্ভুত যে আজও ওটা দারুণ ভাবেই প্রাসঙ্গিক। আজকের দিনের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর সেইদিনের ৩৪ বছর আগের সেই পরিস্থিতি হয়তো পুরোপুরি এক নয়। কথিত গণতন্ত্রের মানস-কন্যা আর তাঁর দলই এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। কিন্তু কীভাবে, সে অন্য কথা। তবে, এরপরও কি আমরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, যেই গণতন্ত্রের আশায় নূর হোসেন প্রাণ দিয়েছিলেন সে’দিন, সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি কি আজও পেয়েছে গণতন্ত্র? আজও কি স্বৈরাচারের রাহুর কবলে পড়ে হাঁসফাঁস করছি না আমরা? মুহুর্মুহু নাভিশ্বাস উঠছে না মানুষের! হ্যাঁ, এই স্বৈরাচার দ্রব্যমূল্যের স্বৈরাচার, এই স্বৈরাচার দুর্নীতির স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িক স্বৈরাচার, বিচারহীনতার স্বৈরাচার, কণ্ঠরোধের স্বৈরাচার। যেই বন্দুকের নল সে’দিন তাক করা হয়েছিল নূর হোসেনদের দিকে, সেই নলগুলো তো আজও তাক করা আছে আজকের নূর হোসেনদের দিকেও, একটু অন্যভাবে। সে’দিন ঢাকার অলিতে-গলিতে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছিলেন যেই ২৬ বছরের তরুণ, সে-ই আজ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা এখনও আছেন ক্ষুধার যে বন্দুক তাক করা আছে যুগের পর যুগ, সেইসব নলের মুখেই, অসহায় অবস্থানে। তাঁদের কোনও পরিবর্তন হয়নি। আর আছে মহামারীর থাবা। পৃথিবীর যন্ত্রণার করুণ প্রকাশ। যে’সব যন্ত্রণা থেকে উত্তরণ চেয়েছিলেন আরও এক প্রেমিক, এরও এক যুগ আগে, ১৯৭৫ এর এই নভেম্বরেই যিনি চলে গিয়েছিলেন আমাদের ছেড়ে। গতকাল রাতে যার কবিতা পড়ছিলাম নিবিষ্ট মনে। জানছিলাম একটু একটু করে। নারী, কবি সুরাইয়া খানম যারে অভিহিত করেছিলেন, বাংলা কবিতার ‘আহত ও ক্ষুধার্ত সিংহ’ হিসেবে। ষাটের দশক থেকে যিনি জেগে উঠছিলেন অশিল্পের অন্ধকার থেকে শিল্পের ঊষার দিকে। মাত্র ২৯ বছর বয়সে(হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে),— এতো তাড়াতাড়ি তিনি কেন চলে গিয়েছিলেন সে প্রশ্ন অবশ্য অবান্তর। কেননা, শারীরিক অসুস্থতায় মানুষের মৃত্যুকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কিছু নেই। তবে, আফসোস রয়ে যায়, যদি আরও ক’টা বছর বাঁচতেন, বাংলা কবিতা হয়তো আরও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেত।
সমৃদ্ধির কথায় মনে এলো, হাসান আজিজুল হক একবার এক সাক্ষাৎকারে বাংলা কবিতা গত একশ বছরে কতদূর এগিয়েছে এই প্রসঙ্গে বলছিলেন তাঁর হতাশার কথা, আক্ষেপের কথা। এডোরেবলি তিনি দায়ী করছিলেন বুদ্ধদেব বসুকে। বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার-এর অনুবাদ নাকি নির্ঘাত সর্বনাশ করেছে বাংলা কবিতার নিজস্ব উন্মেষের। এরপর নাকি বাংলার কবিরা ওঁর থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেননি; আজও না। কেন যেন কথাটায় পুরোপুরি সায় দিতে চাইলো না আমার মন। তথাপি, এতো বড়ো মাপের একজন কথাসাহিত্যিকের অবলোকিত বিচার বলে কথা। যথেষ্ট অভিনিবিষ্ট না হয়ে তো মন্তব্য করার কথা নয়। তাহলে কি আমি নিজে কবিতা লিখি বলে, কবিতার প্রতি কাব্য জগতের প্রতি নিষ্কলুষ ভালোবাসার করণেই কি অন্ধ হয়ে আছি। দেখতে পাচ্ছি না যেই ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলছেন, সেইটাকে। ছুঁতে পারছি না কিছুতে! কিন্তু আবার আমরা এওতো জেনেছি অরুণ মিত্রের পর বিশিষ্ট ফরাসিবিদ চিন্ময় গুহও আমাদের জানিয়েছেন সেটা, বুদ্ধদেবের বোদলেয়ার আসলে বোদল্যের। বোদল্যের-এর অনেক কবিতাই মূল ফরাসি থেকে অনেকটা পথ দূরে সরে সরে গেছে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে। এর সম্ভাব্য কারণ হয়তো তিনি ফরাসি জানতেন না। ইংরেজি থেকে নামাতে গিয়েই এমন দশা হয়ে গেছে। সে অবশ্য অন্য কথা। কিন্তু বোদল্যের কী প্রভাব ফেললেন তখনকার বাঙালি কবিদের উপর? আর ফেললেইবা কি,— যুগে যুগে, শতকে শতকে বিশ্ব কবিতার ইতিহাস তো এমনই আমরা জেনেছি। এক সময় গত শতাব্দীর শুরুর দিকে এলিয়ট, এজরা পাউন্ডরা হন্যে হয়ে ফরাসি কবিতার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আবার কী আশ্চর্য যে সেই ফরাসি কবিদের গুরু, অর্থাৎ আধুনিক ফরাসি কবিতার জনক বলা হয় ইংরেজি ভাষার কবি আমেরিকার এডগার এলান পো-কেই। তাঁদের ভাষায় তিনি এদ্গার পো। পো’র কবিতা ভাবনা থেকেই আলোক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়েছে আধুনিক ফরাসি কবিতায়। তাহলে এই যে দেয়া-নেয়া, এতে তো কবিতার ইতিহাস—সমৃদ্ধ হওয়ারই ইতিহাস। আর আমাদের আবুল হাসান তাঁর কলমে বাংলা কবিতাকে কতোটা সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন—এই জিজ্ঞাসার উত্তর আমরা খুঁজতে চাইবো তাঁর কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে।
অশিল্পের অন্ধকার থেকে আমি জাগলাম শিল্পের ঊষায়একটি কবিতার খোঁজে, কুমারীর পায়ের পাতার মতো নরোমকবিতার খোঁজেএই আমার জাগরণ!(অগ্রন্থিত কবিতা/রৌদ্রের রঙঃ ১৯৭৯ তে প্রকাশিত)
হ্যাঁ, আবুল হাসানের অগ্রন্থিত এই কবিতাটির পাঠের মাধ্যমে আমরা আজ ছুঁতে চাইবো তাঁর ষাটের দশক থেকে হয়ে উঠতে চাওয়া এক মৌলিক স্বরকেই। কবিতার খোঁজে তাঁর এই জাগরণ স্পর্শ করতে চাইবো। কুমারীর পায়ের পাতার মতো নরোম সে’সব কবিতা যে তাঁর পূর্বসূরিদের হাত ধরে এসে বাঁধতে চেয়েছে নিজস্ব ঘর মাত্র এক দশকেই, তা আমরা হয়তো টের পাবো তাঁর কাব্যের প্রতিটি পরতে পরতে হানা দিয়ে। আমরা দেখতে পাবো খুব প্রচ্ছন্নভাবেই রয়েছেন এক নারী। সখ্যতা। প্রেম। মানুষের প্রতি ভালোবাসা। মাতৃভূমি। আর তীব্র আবেগ।
উদিত দুঃখের দেশে
অবশ্য, কবি মাত্রই নিঃসঙ্গতায় পীড়িত। আবুল হাসানও কি তাই? তাঁর প্রথম কবিতাবই ‘রাজা যায় রাজা আসে’র কবিতাগুলোয় স্পষ্টতই টের পাওয়া যায় তা। যদিও জেনেছি বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন অনেকটাই উড়নচণ্ডী, আড্ডাবাজ আর ভবঘুরে। ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ফাইনাল শেষ না-করেই ছেড়ে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকতা করেছেন বেশ ক’টি পত্রিকায়। জনশ্রুতি রয়েছে —
বন্ধু নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই গড়ে উঠেছিল গভীর বন্ধুত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় শেষ দিকে আবুল হাসানের প্রেম গড়ে উঠেছিল ইংরেজি বিভাগের লেকচারার সুরাইয়া খানমের সঙ্গে। সেই প্রেমকে বলা যায় এক অপার মুগ্ধতা। প্রেমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ক্যামব্রিজ পড়ুয়া সুরাইয়া খানম। সুরাইয়া খানম চেয়েছিলেন আবুল হাসানকে খানিকটা বশে আনতে। উড়নচণ্ডী জীবনযাপনে খানিকটা লাগাম টানতে। আর তাই সুরাইয়া খানম সহ্য করতে পারতেন না নির্মলেন্দু গুণকেও। তখন আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণের বন্ধুত্বে কিছুটা চিঁড় ধরেছিল। আর তাই বন্ধুকে অভিমানের ছলে লিখেছিলেন, ‘তুমি কি ভুলেই গেলে সেই সব দিনের কথা, যখন শীতের কুয়াশার মধ্যরাত্রির বাতাসকে আমরা সাক্ষী রেখে ঢাকা শহরের অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। আমরা তখন কি সুখী ছিলাম না? সেই সুখের কারণেই কি তুমি আবার ফিরে আসতে পারো না? যতই ভালোবাসার পেছনে ধাবমান আমাদের ছায়া এর-ওর সঙ্গে ঘুরুক, তুমি জানো আর আমিও জানি— একসময় আমরাই আমাদের প্রেমিক ছিলাম।’ এমন কি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডাক্তাররা আশা ছাড়লেও সুরাইয়া খানম নাকি আশা ছাড়তে পারেননি।
নির্মলদা আছেন কিন্তু সুরাইয়া খানম আজ আর নেই। ২০০৬ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। শুনেছি, কবির মৃত্যুর পর দেশে আর মন বসাতে পারছিলেন না। পরে অ্যামেরিকার অ্যারিজোনায় চলে যান পড়াতে। সেখানেই বিয়ে করে থিতু হন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আবুল হাসানকে উৎসর্গ করে তাঁরও একটি কবিতাবই প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৭৬ সালে, ‘নাচের শব্দ’। আর, কবি আবুল হাসানের মাত্র তিনটি কবিতাবই প্রকাশ হতে পেরেছিল তাঁর জীবদ্দশায়। ‘রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২)’, ‘যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪)’ এবং ‘পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)।’ আর ছিল একটি গল্প সংকলন আর একটি কাব্য নাটক। পরবর্তীতে বন্ধু মুহম্মদ নূরুল হুদা সহ কয়েকজন মিলে সম্পাদনা করে ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা’ প্রকাশ করেন ১৯৮৫ সালে। আর আজ আমাদের হাতে রয়েছে তাঁর রচনা সমগ্র। একসাথে এক বইয়েই সব। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে মজিবর রহমান খোকা বইটি প্রকাশ করেন ১৯৯৪ সালে। যার ভূমিকা লিখে দিয়েছেন কবি শামসুর রাহমান। বলেছেন, ‘একজন সত্যিকারের কবিই তো যীশু খৃষ্টের মতো সকল মানুষের হয়ে দুঃখ পান। তিনি যৌবনের বিষণ্ণতা, নৈঃসঙ্গ্য আর দীর্ঘশ্বাসের কবি। তাঁর শিল্প-সৌন্দর্যের বোধ যেমন তীক্ষ্ণ তেমনি তীব্র মানুষের প্রতি তাঁর মমতা, জীবনের প্রতি ভালোবাসা।’ তাঁর প্রথম কবিতাবইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে, ২য় কবিতাটি (বনভূমির ছায়া) পড়তে পড়তে শেষ দিকে এসে আমরা এক আত্ম-আবিস্কারের বিস্ময়ে উপনীত হই। বুঝতে পারি, পিকনিকে যেতে থাকা এক দল মানুষের বহমান জলের দিকে তাকিয়ে আচমকা নিজেদের প্রকৃত চেহারা দেখতে পেয়ে যাওয়াই কবিতাটির মূল ঘটনা। শাশ্বত সত্যের উন্মোচন। কী সেই সত্য? সেই সত্য এই যে— মানুষ ভয়াবহ নিঃসঙ্গ, একা আর অসহায়। আর এর ঠিক পরের পরের কবিতাটিও তো কিংবদন্তির মতোই হয়ে আছে বাংলা কবিতার ইতিহাসে। সেই অমোঘ উচ্চারণ—অবশেষে জেনেছি মানুষ একা।
হঠাৎ জলের নীচে পরস্পর আমরা দেখলুমআমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ।আমরা হঠাৎ কী রকম অসহায় আর একা হয়ে গেলাম।আমাদের আর পিকনিকে যাওয়া হলো না,লোকালয়ের কয়েকটি মানুষ আমরাকেউই আর আমাদের এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, অসহায়বোধআর মৃত্যুবোধ নিয়ে বনভূমির দিকে যেতে সাহস পেলাম না!(বনভূমির ছায়া/রাজা যায় রাজা আসে)
অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনদিন।(পাখি হয়ে যায় প্রাণ/ রাজা যায় রাজা আসে)
বেদনার বিষবাষ্প
আস্তে আস্তে তাঁর কবিতা, তীব্র আবেগ সহ নীতিগতভাবে প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ঘোষণাপত্রই হয়ে উঠেছিল তখন, ’৭৫ থেকে প্রায় ’৯০ পর্যন্ত সময়টায়। দারুণভাবে লিরিকাল এই কবিতাগুলো আবৃত্তির জন্য যথাযথ মনে হতে থাকে। বলা যেতে পারে নান্দনিকভাবেই এক ধরনের স্পষ্টভাষীতা রয়েছে তাঁর। হ্যাঁ, এটা অনস্বীকার্য যে তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে পূর্বসূরি যে কবির নাম উঠে আসে বারবার, তিনি জীবনানন্দ দাশ। প্রথম দুই কাবিতাবইয়ে প্রখরভাবেই তাঁকে উপস্থিত দেখতে পাই আমরা। দেখতে পাই, ‘অনেক হাত থাকে যারা অন্ধকার থেকেই পরম আলো কুড়ায়, আলোও কেমন মিশে যায় বুকের পাশে সহজে / আবার কারো বা হাতের ভাঁজে অন্ধকার ছিন্ন পাখার মতো বাজে ঠিক যেমন স্রোতের তোড়ে জলে ফেনা গরজে!’ কিংবা, ‘একে একে সব গেছে, কিছু নেই, কিচ্ছুটি নেই, / তবু কিছু কষ্টে সৃষ্টে ধরে আছে এখনো মানুষ! / এখনো পেঁচার ডাকে কেউ কেউ লক্ষ্মীর আগমন টের পায়!’ বিষণ্ণতা আর নিঃসঙ্গতার ভেতর দিয়েই আমরা আশার আলো দেখতে চাই, শৈশব থেকে বড় হতে হতে যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি, সেই ভালোবাসা, পাখি, প্রকৃতি, প্রেম, অন্ধকার, আলো ও মানুষ। আমরা তাঁর ঠিকানা জানতে চাই। ফিরে যেতে চাই বন্ধুত্বের কাছে। জীবনের কাছে। বড় হতে হতে পৃথিবীতে যে বেদনার বিষবাষ্প ছড়িয়ে গেছে আজ, তা আমাদের দম বন্ধ করে দিচ্ছে, আমাদের ফুসফুসে সেই বিষের প্রতিক্রিয়ায় নির্মল শ্বাস নিতে পারছি না। হাত বাড়ালেই যে হাতের সাথে লেগে যায় হাত, সেই হাতে অদ্ভুত অন্ধকার বাজে। অথচ আমরা তো আলো চেয়েছি চিরকাল। তাহলে এই যে সময়, এই সময়-পৃথিবীর যে দেখা আমরা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে, তা তো জীবনানন্দের উত্তরসূরি হিসেবেই।
কিন্তু আমি রক্তের কী মাতৃভাষা এখনও জানিনা!বেদনার কী মাতৃভাষা এখনও জানিনা!শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ,আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!(মাতৃভাষা/রাজা যায় রাজা আসে)
বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ, খাঁ, খল,তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতির তাও কিরাজনীতি?(অসভ্য দর্শন/রাজা যায় রাজা আসে)
অধঃপতনের ধুম
সেই ১৯৭২ সালেই, স্বাধীন বাংলাদেশে যে রাজনীতির শুরু হচ্ছিল, তাকে পছন্দ করতে পারেননি হাসান। তাই বন্ধু নির্মলেন্দু গুণকে উৎসর্গ করে লিখেছেন তাঁর কবিতা ‘অসভ্য দর্শন’। অসভ্য রাজনীতি দর্শন। ফুল, গাছ, দালান, জন্ম, শরীর, তারুণ্য, ক্ষুধা সব কিছু নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটায় মানুষের স্বপ্নের এমন মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া, তাঁর স্পর্শকাতর কবিমন নিতে পারছিল না। তাই তিনি লিখলেন, ‘আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি / জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি..।’ মামুনুর রশীদকে লিখলেন, ‘একটা কিছু মারাত্মক ঘটেছে কোথাও / নইলে ডাইনীর মতোন কেন কোমর বাঁকানো / একটি চাঁদ উঠবে জোছনায় /..কেন এতো রক্তপাত হবে? গুপ্তহত্যা হবে?’ —তাহলে আজকের দিনেরও এই যে গুম-খুন, এ-তো নতুন কিছু নয়, এর শুরু তবে সেই শুরুতেই হয়ে আছে এই দেশে। কবিতায় কবির সরল প্রশ্নেই আমাদের বোধগম্য হয় তা। একেবারেই কোনও আড়াল ছাড়া কথা বলেন তিনি। স্পষ্ট তাঁর উচ্চারণ। আবিদ, মনোয়ার, শেহাব, সুকান্ত আর মাশুককে প্রশ্ন করেন, ‘আমি কার কাছে যাবো? কোন দিকে যাবো? / অধঃপতনের ধুম সবদিকে, সভ্যতার সেয়ানা গুণ্ডার মতো / মতবাদ, রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে..।’ তিনি চোখ মেলেই দেখতে পাচ্ছেন, সবদিকে সাজানো রয়েছে শুধু শাণিত দুর্দিন, বন্যা, অবরোধ, আহত বাতাস। রফিক আজাদকে লিখলেন,
বুনো আগুনের ছেঁড়া দহনেই করেছি মাতম শুধু,পাপের মোড়কে দু’হাত ঢুকিয়ে পাখিদের আর তরুবীথিদের সাথে চারিয়ে দিয়েছি নৃশংস ডম্বরুমাটিতে মর্মে হায়রে এ কোন দহনের হলো শুরু।(অগ্নি দহন বুনো দহন/রাজা যায় রাজা আসে)
আর এভাবেই যেন স্ব-সময়কে, আপন ইতিহাসকে সত্তার মধ্যে ধারণ করে করে সাময়িকের ভেতর দিয়েই আতিসাময়িক হয়ে উঠতে চেয়েছে আবুল হাসানের কবিতা। বোধ, বুদ্ধি আর মননের সামগ্রিকতায় হয়ে উঠেছে উদ্দীপিত। তাঁর জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসে বয়ে গেছে কবিতা। তাঁর কবিতার সরলতা, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে-পড়া আবেগ সহজেই পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। প্রথম পাঠেই পাঠক অভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর তিনটি কবিতাবইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি ক্রমশ পরিণতির দিকেই এগুচ্ছিলেন। তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাগুলো পড়লে তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমার চোয়ালে রক্ত হে অর্জুন আমি জানতাম, আমি ঠিকই জানতামআমি শিশু হত্যা থামাতে পারবো না, যুবতী হত্যাও নয়!ভ্রূণহত্যা! সেতো আরো সাঙ্ঘাতিক, আমি জানতাম হে অর্জুনমানুষ জন্ম চায় না, মানুষের মৃত্যুই আজ ধ্রুব!(কুরুক্ষেত্রে আলাপ/ যে তুমি হরণ করো)
মুহূর্তে কোথাও যেন খুলে গেল খুনের দরোজা;তুমি ভালো আছো?পৃথিবীতে আজ বড় অবিশ্বাস!(তুমি ভালো আছো/ যে তুমি হরণ করো)
১৯৬৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার বলছিলেন, ‘ক্ষমতা যে একটি বিরাট প্রলোভন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই,.. আমরা ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করেছি, কিন্তু আমাদের যাতনা বাড়ছে, দুঃখবোধ বাড়ছে, কিন্তু এই পরিস্থিতি অবসানের কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং প্রতিদিনই আমরা আরও নতুন নতুন যন্ত্রণা আর বেদনার জন্ম দিয়ে চলেছি।’—এই যে কথাগুলো এতো বছর আগে সিঙ্গার বলে গেলেন, তা কি আজও প্রাসঙ্গিক নয় আমাদের জন্য! আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে যে উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে তা দৃশ্যমান ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে আমাদের মূল্যবোধ আর নৈতিক অবস্থানটাও কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! কোনও কবি, শিল্পি বা লেখকের চোখই এটা ফাঁকি দিতে পারে না। যেমন পারেনি আবুল হাসানেরও। সরাসরি আর তীব্র ভাবেই সমালোচনার আঙুল তুলেছিলেন তিনি ক্ষমতার দিকে, রাজনীতির দিকে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে। আমাদের সমস্ত দুঃখবোধ সত্ত্বেও, জীবন আমাদের স্বর্গীয় আনন্দ না-দেয়া সত্ত্বেও, জীবনকালে পৃথিবীতেই আমারা স্বর্গ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা করি, মনে করি এই একটা জায়গা আছে থাকবার জন্য। মানুষ হিসেবে যে মহত্তম জিনিসটি উপহার হিসেবে পেয়েছি আমরা, তা হলো স্বাধীন ইচ্ছা, কিন্তু এই স্বাধীন ইচ্ছের ব্যবহারেও কি আমরা সীমাবদ্ধ নই এই দেশে কিংবা পৃথিবীতেও!
মেঘের প্লাবনে দাঁড়াও
আবার, জীবনকে চরম অর্থহীন করার চেয়ে, একটু হলেও মূল্য প্রদান করে, আমাদের এই বেঁচে থাকাটাকেও আমরা সেই মূল্যের অন্তর্গত করে নিতে পারি হয়তো। এই ভাবনায় এসে আমাদের মনে হতে থাকে কবি আবুল হাসানের কবিতা কি কেবলই নিঃসঙ্গতার কথা বলে, দুঃখ বেদনার কথা বলে, অধঃপতনের নিঃশ্বাস ছাড়ে? সময়ের টানাপোড়েনের কথাই বলে শুধু? তাহলে কি হতাশার ছবি ছাড়া আর কিছু পাবার নেই পাঠকের! অবশ্য আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে মাত্র এক দশকই সময় পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম কবিতাবই মাতৃভূমির মতোই অসহায় মা-কে উৎসর্গ করে দারুণ এক ব্যাপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল তখনই। আর ২য় বইটি (যে তুমি হরণ করো) উদ্বাস্তু-উন্মুল যৌবন সঙ্গী, বন্ধু নির্মলেন্দু গুণ-কে। এখানেও সেই একই স্বর আরও গাঢ় হয়ে আওয়াজ তুলেছিল। আরও একটু গম্ভীরতায়। দুঃখ দিয়েই শুরু করেছিলেন এই বই। বলেছিলেন, দুখের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখবেন না নিজের ভিতর। সময়ের অস্থিরতায় আলোড়িত হয়েছে এর বহু কবিতা। কিন্তু আবার কিছু কিছু কবিতায় আস্তে আস্তে তাঁর স্বর পাল্টেও গেছে কিছুটা। অধঃপতন থেকে উঠে দাঁড়াবার কথা শোনা যায় সেখানে। হতাশার পাশাপাশি আশার কথাও বলেন তিনি। বলেন স্থিতির কথা। বলেন, আমরা আসবো ঠিকই আসবো, অপেক্ষায় থেকো। বলেন, রৌদ্র উঠলে পৌঁছে যাবো, আপাততঃ এই মেঘের প্লাবনে দাঁড়াও।
একটি নারীর উড়াল কণ্ঠ বুকের ভিতর খুঁড়তে খুঁড়তে মন্ত্র দিলোস্থিতি হোক, স্থিতি হোক, হৃদয়ে আবার স্থিতি হোক!শ্যাওলা জুড়ে সবুজ দিঘির ঘাটলা ওদের জনবসতি স্থিতি হোক!একা থাকার কপাল জুড়ে কলহ নয় স্থিতি চাই স্থিতি হোক!(স্থিতি হোক/যে তুমি হরণ করো)
বেঁচে থাকতে হলে আজ কিছু চাই। কিছুই কি চাই?গেরস্থালী নয়তো শূন্যতা? নয়তো সন্ন্যাস? নয় নীলাঞ্জনশ্যাম নারী(এই ভাবে বেঁচে থাকো, এই ভাবে চতুর্দিক/যে তুমি হরণ করো)
আবার... শরীর জুড়ে শীতল জলের শস্যগন্ধ, শস্যযূথী, শস্যকুসুম! শস্যমাখা কলস তাতে লিখেই ফেলি শস্যকণ্ঠ, শস্যবৃক্ষ, শস্যদীঘি, শস্যদৃশ্য।—এই রকম শস্য পর্ব শেষে বইটি শেষ হয় এক কবির ভাসমান মৃতদেহের গল্পে। সেই কবিতায় তাঁকে বলতে শোনা যায়, ..আর জানোই তো কবিরা কাঁদলেও তাঁর অশ্রু থেকে মৃত্যু ঝরে পড়ে। তাঁদের অশ্রুর মূলে মর্মর ঝরঝর করে আজও ঝরে যায় ফের তাঁরই স্বদেশ।
হাসপাতালে, অসুস্থ অবস্থায় তাঁর ৩য় বই ‘পৃথক পালঙ্ক’র কবিতাগুলো বাছাই করেন তিনি নিজেই। উৎসর্গ করেন প্রেমময়ী সুরাইয়া খানম-কে। যেই বইয়ের কবিতাগুলোয় তিনি সুন্দর আর অসুন্দর-কে একই বিষয়ের মধ্যে যৌথ হিসেবে আবিষ্কার করেন। আমাদের জানান যে সৃষ্টি এত সৌন্দর্যপ্রধান! সৌন্দর্য এমন ভীরু, এমন কুৎসিত! সাপ, খেলনা, নর্তকী, নদী ও নারী, বনভূমি, ফুল, সমুদয় বস্তু, শিল্পকলা যেমন সুন্দর তারা, তেমনই কুৎসিত। মনে পড়ে, আবু সায়ীদ আইয়ুব পড়ে আমরা জেনেছিলাম, মহৎ শিল্প এনে দেয় পরম প্রশান্তি আর পরম বিষাদবোধের মধ্য দিয়ে প্রসারিত এক জীবনবোধ। আর প্রতিটি শিল্পে, প্রতিটি কাব্যে লুকিয়ে থাকে প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতায় লব্ধ জীবনের গূঢ় সত্য। কিন্তু কেবল সত্যের উপর ভিত্তি করেই কি কোনও কবিতা মহৎ হয়ে উঠতে পারে? কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠতে পারে? নারী-পুরুষ রোমান্টিকতা বা দ্বন্দ্বই হোক, দারিদ্রের বঞ্চনা বা শ্রেণি-সংগ্রামই হোক বা ব্যাক্তি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়াই হোক, বা জীবনের অ্যাবসার্ড দিকই হোক—শুধু সত্যটুকু দিয়ে শিল্পকর্ম হয় না। সত্যকে মহৎ শিল্পকর্ম করে তুলতে হলে তার জন্য যথাযথ কাঠামোও গড়ে তোলা চাই। সেইরকমই এক অনন্য কাঠামোর ভেতর দিয়ে গড়ে উঠছিল আবুল হাসানের কবিতা। যার ভেতর থেকে একেকটি সত্য ঠিকরে বেরিয়ে আসে আলোর ছটায়, আমাদের আবাক করে দেয়।
ইঁদুরের তবু পালাবার পথ রয়েছে গর্তআমাদের তাও নেই হে ময়ূর মনে করে নিওআমরা এখন কুষ্ঠরোগীর চেয়েও কাতর(অনেকদিন পর ভালোবাসার কবিতা/পৃথক পালঙ্ক)
মিলনই মৌলিক
কবিতা পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যে একটা প্রশ্ন আসে মনে। কেন কবিতার কাছে যাই আমরা? কেন পড়ি কবিতা? সে কি তবে এই জন্যে যে, মানুষ মাত্রই কখনও কখনও বেদনাবোধে আক্রান্ত হই আমরা। সেই বেদনা কি আমাদের আত্মার বেদনা, আমাদের আত্ম’র বিষাদ-বোধ? জীবনানন্দ যেমন চিহ্নিত করতে চেয়েছেন একে, মাথার ভেতরে এক বোধ কাজ করে লিখে। কবিতা, আমাদের সেই বেদনায় প্রগাঢ় প্রশান্তি এনে দেয়, পৌঁছে দিতে চায় জীবনবোধেরই এক ব্যাপ্তির দিকে? সচেতন মনের অগোচরে, চিরকালই হয়তো আমরা মিলতে চাই কোনও মৌলিক মহাবিশ্বের সাথে, মহাসময়ের সাথে। আমাদের সেই চাওয়াটাই হয়তো মিলতে থাকে কবিতার সাথে। কবি-কণ্ঠের সাথে। যেহেতু বেশির ভাগ কবিই লিখে থাকেন তাঁদের ভিতরকার বিশেষ কোনও অভিপ্রায়ে কিংবা বলা যায় এক অন্তর্গত শক্তির তাড়নায়, যার মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট পথে চালিত হই আমরা। কেননা সব সময়ই আমরা প্রচুর টুকরো টুকরো বিষয় নিয়ে বেঁচে থাকি, নিজের ভেতরে তাদের বহন করি। কবিতায় ভাষার নিপুণ গাঁথুনি, শিল্প আর সংবেদন আমাদের তাই পৌঁছে দেয় এক গভীর অন্তর্দৃষ্টির উন্মেষে। অন্তর্চেতনায় ছাপ ফেলে, আমাদের ভাবনাকে, জীবন-জিজ্ঞাসাকে উসকে দেয় জীবনেরই দিকে।
উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন, ‘এখানে শিল্পীর কোনও গুরুত্ব নেই, কেবলমাত্র তিনি যা সৃষ্টি করবেন তা-ই গুরুত্বপূর্ণ।’ কবির সেই সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এক মৌলিক মিলনের আকাঙ্ক্ষা পাঠকের হৃদয়ে প্রতিনিয়তই পাক খেয়ে খেয়ে একটা শূন্য সময়েরও সৃষ্টি করে। পঙক্তির পর পঙক্তিতে যা মুহুর্মুহু ভরে উঠতে চায়। আমাদের ভেতর দিকের মুখ বেরিয়ে আসতে চায় বাইরের দিকেও। শুধুমাত্র ব্যক্তিচেতনা আর অন্তর্বেদনা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। বাইরের সাথে, বহির্বিশ্বের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতেও উৎকণ্ঠিত হই।
যতদূর থাকো ফের দেখা হবে। কেননা মানুষযদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।মিলে যায়—পৃথিবী আকাশ আলো একদিন মেলে!(এপিটাফ/পৃথক পালঙ্ক)
ফিরে আসি মনোমন্থনে
কে কবি? এই প্রশ্নের উত্তরে মিলান কুণ্ডেরা তাঁর নোট বুকে লিখে রেখেছিলেন, সেই মানুষটি কবি, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য যার মা তাকে এমন এক পৃথিবীর পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, যে পৃথিবীতে সে প্রবেশ করতে পারছে না। নান্দনিক বা মনস্তাত্ত্বিক নয়, সংজ্ঞাটি সমাজতাত্ত্বিক। কারণ, কবি সমাজের বাইরের কেউ নন। পরিপার্শ্বই তাকে সংবেদনশীল করে তোলে। আত্মার অপরিমেয় অসীমতায় নয়, সে অবাক হয় ব্যক্তিমানুষ আর তার পরিচয়ের অনিশ্চয়তায়। তার কাছে মনে হতে থাকে জীবন একটা ফাঁদ। কারণ, আমরা জন্ম নিতে চাই কিনা সেটা জানতে না চেয়েই আমাদের জন্ম দেয়া হয়েছে। এমন একটা শরীরে আমাদের বন্দী রাখা হয়েছে, যে শরীরটি আমরা নিজেরা পছন্দ করে নিইনি। এবং আমাদের জন্য আবার মৃত্যুও অনিবার্য করে রাখা হয়েছে। ভেবে দেখলে, যার পুরোটাই আসলে অদ্ভুত। এই অদ্ভুত পৃথিবীতে প্রবেশ করতে না পারার যন্ত্রণা থেকে, নিজের অস্তিত্বের পরিচয়হীনতা থেকে তার কণ্ঠ উচ্চকিত হয়ে ওঠে বলেই সে কবি। তার কণ্ঠ প্রকৃতপক্ষে মানব অস্তিত্বের সারসত্তারই অনুসন্ধান।
এই রকম অনুসন্ধানের, ১৯৬৮ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা অগ্রন্থিত কবিতাগুলো একত্রিত করে প্রকাশিত হয় ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা’। আরও প্রায় দুটো মৌলিক বই হয়ে যাওয়ার মতো কবিতা ছিল সেখানে। কিন্তু, সেগুলো নিয়ে ফিরে আসবো অন্য দিন, অন্য কোনও মনোমন্থনে।
চলে গেলে—তবু কিছু থাকবে আমারঃ আমি রেখে যাবোআমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।(অপরূপ বাগান/পৃথক পালঙ্ক)আমাকে গ্রহণ করতে হবে সব মানুষের উত্থান পতনজয় পরাজয় বোধ, পিছু ফেরা সামনে তাকানো—আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন, জয়শ্রী জীবন!(জলসত্তা/পৃথক পালঙ্ক)
কৃতজ্ঞতাঃ আহমাদ ইশতিয়াক, দীপেন ভট্টাচার্য, এমদাদ রহমান, শাহাদুজ্জামান।
ফিরে আসি মনোমন্থনে
ঋতো আহমেদ
ঋতো আহমেদ
চঞ্চল নাঈম : আপনার এই লেখা পড়ে দারুণ ভাবে সমৃদ্ধ হয়েছি। আপনার উপস্থাপনের রঙটা অসাধারণ এবং লেখাটিতে ভেরিসেশন আছে। এই লেখাটি পাঠককে নিরন্তর আকর্ষণ করবে।
উত্তরমুছুনচঞ্চল নাঈম : আপনার এই লেখা পড়ে দারুণ ভাবে সমৃদ্ধ হয়েছি। আপনার উপস্থাপনের ঢঙটা অসাধারণ এবং লেখাটিতে ভেরিসেশন আছে। এই লেখাটি পাঠককে নিরন্তর আকর্ষণ করবে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ নাঈম ভাই।
মুছুনকী চমৎকার প্রবন্ধ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ভাই।
মুছুনপ্রশংসনীয়
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ।
মুছুনশ্রদ্ধা কবির প্রতি
উত্তরমুছুনধন্যবাদ শিশির ভাই।
মুছুনঅসাধারণ। ঝরঝরে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ফেরদৌস। শুভকামনা।
মুছুনপড়তে পড়তে কোথায় যেন ডুবে গেছিলাম, চমৎকার লাগলো লেখাটি।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুন