দীপাবলি কালীপূজাতে সিলেট গিয়েছিলাম। কবি রাতুল রাহা’র আমন্ত্রণে, এই একটু আড্ডাবাজি আর হৈ-হুল্লোড় করতে আরকি! যেদিন গিয়েছি সেদিন রাতেই কিছু পানাহারের ব্যবস্থা ছিল। আপ্যায়নের হোস্ট ছিলেন রাতুল রাহা। আর সম্পূর্ণ লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছিল সৌরভ। সৌরভ হচ্ছে রাতুলের পরিচিত। তো সারারাত আড্ডা চললো। প্রত্যেকের অনুরোধের গান বাজানো হলো সাউন্ড সিস্টেমে। সেসব গানের কোনো কোনোটিতে আবার আমরা সবাই মিলে হালকা নেচেও নিলাম। হৈ-হুল্লোড় শেষে ভোরের দিকে অন্য সবাই যে-যার মতন ঘুমিয়ে গেল। আমার তো ঘুম আসছে না।
সকল নিস্তব্ধতার বুক চিরে দূর থেকে আযানের সুর ভেসে এলো। ভোরের আলো ফুটতে দেখলাম। দূরের কোনো পূজামণ্ডপ থেকে ঘণ্টাধ্বনি এবং উলুধ্বনির আওয়াজ পেলাম। তাই একটু বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভোরের আকাশ উপভোগ করলাম। কিছু পাখির কিচিরমিচির পেলাম। আর একইসাথে কার্তিকের হালকা হিমেল বাতাসে দূরের দিগন্তে কুয়াশার ল্যান্ডস্কেপ আমাকে মুগ্ধ করে দিল। যেহেতু সবাই ঘুমিয়ে গেছে, তাই ভাবলাম এই ভোরবেলা একা একা কী করা যেতে পারে? হাতের কাছে হাতড়ে বেশ কিছু বই পেলাম। সেসবের মধ্য থেকে হাসান আজিজুল হক স্যারের লেখা ‘আগুনপাখি’ এবং ‘পাতালে হাসপাতালে’ এই দুইটা বই উল্টেপাল্টে দেখলাম।
এর আগে কখনো তাঁর লেখা আমার পড়া হয় নাই। তবে তাঁর লেখা বইগুলো সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা শুনেছি। তাছাড়া সংবাদপত্র মারফত বেশ কিছুদিন আগে তাঁর অসুস্থতার খবরও পেয়েছিলাম। তাই ভাবলাম, এই সাতসকালে অন্য সবাই যেহেতু ঘুমে, এই ফাঁকে ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পের বইটা পাঠ করে দেখা যাক। বইটা খুলতেই দেখলাম ৫টা গল্প আছে। ‘মধ্যরাতের কাব্যি’, ‘সরল হিংসা’, ‘সাক্ষাৎকার’, ‘পাতালে হাসপাতালে’ এবং ‘খনন’। ধীরেধীরে তাঁর শব্দের গাঁথুনিতে হারিয়ে গেলাম। ষাটের দশকের সেই বর্ণানাধর্মী লেখা। প্রত্যেকটা গল্পে তিনি তাঁর সহজাত প্রজ্ঞায় চিত্রকল্পগুলোকে বাস্তব করে তুলেছেন। প্রথম তিনটা গল্পের বিস্তার একটু ছোটই ছিল। আসলে বলতে গেলে প্রথম তিনটা গল্প আমি পড়েছি ঠিক। তাঁর ভাষার ব্যবহারে মুগ্ধও হয়েছি। কিন্তু সেই সব গল্পের মূল টেক্সট এখন আর আমার মনে নাই। হয়তো টেক্সটের সাথে আমি নিজেকে সেরকমভাবে রিলেট করতে পারিনি।
এরপর বইয়ের চতুর্থ গল্পের সাথে আমার মোলাকাত হলো। এই গল্পের নাম ‘পাতালে হাসপাতালে’। এই গল্পের বিস্তার একটু বেশি। এইটাকে ছোটগল্প বলা যায় না। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এইটা ছোটগল্প কিন্তু বিস্তারের দিক থেকে বড় গল্প। এবং এই ‘পাতালে হাসপাতালে’ নামটার মাঝেই কেমন যেন বাস্তবতার প্রখর ছোঁয়া আছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি হাসপাতালগুলোকে পাতাললোক বলা হলে, এর নামের স্বার্থকতা মোটেই ক্ষুন্ন হয় না। বলা যেতে পারে এই বিশেষণই একমাত্র বিশেষণ; যা সরকারি হাসপাতালকে যথার্থ চিত্রের সাথে পরিচয় ঘটায়। বাংলাদেশের যেসব মানুষ একবার হলেও সরকারি হাসপাতালে গিয়েছে, সে জানে হাসপাতালের ভয়াবহ অবস্থাটা কেমন! আর এই কোভিড-১৯ এর কল্যাণে কমবেশি আমরা সবাই সরকারি হাসপাতালের চিত্রের সাথে পরিচিত হয়েছি।
গল্পটা শুরু হয় মূলত একটা সরকারি হাসপাতালের জরুরি-বিভাগ থেকে। একজন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার নিজের কর্মক্ষেত্রে কর্তব্যরত আছেন। আর সেই সময় পায়ের সমস্যা নিয়ে একজন গরিব কৃষক জরুরি-বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে এসেছেন। গরিব কৃষকের হাত ধরে গল্প এগিয়ে যায়। ‘চিকিৎসাসেবা’ কথাটা না বলে শুধু ‘চিকিৎসা’ কথাটা বলাই মনে হয় এইক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। কেননা আমাদের দেশে তো আর চিকিৎসাকে সেবা বলার মতন চিত্র কোথাও তেমন একটা দেখা যায় না। সেবা তো আমরা সেই অর্থে পাই না। যেখানে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা পাওয়া তো দূরের কথা একটা বেড পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার, যেখানে সৌভাগ্যবানরাই কেবল হাসাপাতালে সিট পায়, যেখানে সিট পেতে গেলে ওয়ার্ডবয়কে ঘুষ খাওয়াতে হয়, সেখানে চিকিৎসা আর যাই কিছু হোক না কেন সেবা হতে পারে না।
গরিব কৃষক জমিরুদ্দি গ্রাম্য-প্রতিবেশীর সহায়তায় হাসপাতালে আসে। চাষাবাদ করতে গিয়ে তার পায়ে কাঁটা ফুটেছিল। সেই কাঁটার অবশিষ্টাংশ বের করতে সে প্রথমে সাহায্য নিয়েছিল একজন নাপিতের। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। পায়ে পচন ধরে গেছে। সেই পা নিয়ে সে গিয়েছে সরকারি হাসপাতালে। আর সেই হাসপাতালের জরুরি-বিভাগের কর্তব্যরত কর্মকর্তা তাকে দেখে বলছে, “হাসপাতালে মরার শখ হয়েছে”। তো এই একটা কথা দিয়েই আমরা বুঝতে পারি লেখকের প্রগাঢ় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে। লেখকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যে তুখোড়, তা এই গল্পের প্রত্যেক অনুচ্ছেদ এবং চিত্রকল্পে বোঝা যায়।
হাসান আজিজুল হক সাহেব এই গল্পে বাঙলার মানুষের চিরাচরিত ছবিই এঁকেছেন। এইদেশের অশিক্ষিত মানুষেরা নিজেদের স্বাস্থ্য এবং অধিকার সম্পর্কে যে কত বেশি অসচেতন, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই গল্প। জমিরুদ্দি যদি ঠিক সময়ে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিত তাহলে তাকে আর এত কষ্টভোগ করতে হতো না। অথচ আমাদের বাংলাদেশের মানুষ তো এমনই। দাঁত থাকতে বাঙালি দাঁতের গুরুত্ব বোঝে না।
এছাড়া লেখক এইখানে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। চিকিৎসাকে সেবার মতন করে আপনি তখনই পাবেন, যখন সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত আসন থাকবে, পর্যাপ্ত মেডিকেল অফিসার থাকবে, পর্যাপ্ত নার্স, মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট এবং ঔষধ থাকবে। অথচ আমাদের দেশে তো সেরকম কিছুই নেই। সেই ৮০'র দশকে লেখা এই গল্পের চিত্র ৩০ বছরেও একটুও পরিবর্তন হয়নি। এখনো আমাদের হাসপাতালগুলোতে কর্মীর অভাব আমরা কাটাতে পারিনি। কোভিড-১৯ এর কল্যাণে এই ব্যাপারটা আমরা আরো ভালোভাবে জেনেছি। আর যখন কর্মীসংখ্যা কম, তখন আপনি হাসপাতালে গিয়ে সেইসব কর্মীর কাছে এমপ্যাথির আশা করতে পারেন না। অপরদিকে বোতনস্কেল এবং কাজের চাপকে তুলনা করলে আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি, মেডিকেল অফিসার থেকে ওয়ার্ডবয় সকলেই কেন এরকম কসাইয়ের মতন ব্যবহার করে। একজন ওয়ার্ডবয়ের বেতন হয়তো বর্তমানে সর্বসাকুল্যে ১০/১৫ হাজার টাকা। আবার এই ওয়ার্ডবয় হিসেবে চাকরিতে ঢুকতে গিয়ে হয়তো লোকটাকে ঘুষ দিতে হয়েছে লাখ-লাখ টাকা। তো সিস্টেম যদি এরকমই হয় তবে এই দুর্মূল্যের বাজারে ওয়ার্ডবয় থেকে মেডিকেল অফিসার সবাই যে দূর্নীতিগ্রস্থই হবে তা আর নতুন করে আমাদের বলতে হয় না।
চিকিৎসকেরা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি বেশি মনোযোগী হবে। ওয়ার্ডবয়েরা আর নার্সেরা ঘুষ খেয়ে রোগীদের জন্য হাসপাতালে সিটের ব্যবস্থা করবে। অসংখ্য রোগীর চাপে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা রোগীদের সেবা দেয়াই বন্ধ করে দিবে।আর অশিক্ষিত মূর্খ বাঙালি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে কোনোদিনই সচেতন হতে পারবে না। অধিকার তো দূরে থাকুক অশিক্ষা আর কুসংস্কারে নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতিও কোনোদিন সচেতন হতে পারবে না। আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করতেই থাকবে। এমনই একটা ঘূণে ধরা সমাজের ছবি হাসান আজিজুল হক এঁকেছেন তাঁর ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পে।
এই বছরই জুলাই মাসে আমার দিদা করোনায় আক্রান্ত হন। তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শেষ পর্যন্ত আমরা আর তাঁকে করোনার বিষাক্ত ছোবল থেকে বাঁচাতে পারিনি। দিদাকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করার সুবাদে আমি চাক্ষুষ এই সকল অসঙ্গতি দেখেছিলাম। যদিও মেডিকেল অফিসারেরা যথেষ্ট এমপ্যাথি দেখিয়েছে। তবে কর্মী সংকট দেখেছি। দেখেছি সরকারি হাসপাতালে সিট পেতে গেলে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়। যেদিন দিদাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, সেদিন রাতে তো তাকে স্রেফ মেঝেতেই একটা ফোমের গদি পেতে থাকতে হয়েছিল। একজন ৮০ বছরের করোনাক্রান্ত বৃদ্ধাকে মেঝেতে রাত কাটাতে হয়েছে। এরপর ভালো সিট পাওয়ার জন্য আমার মামা আবার কোনো এক ওয়ার্ডবয়কে ঘুষও দিয়েছিল। ঘুষের কারণেই হোক বা অন্য কারণে পরেরদিন দিদা বেড পেয়েছিলেন। কিন্তু বেড পেলেও অক্সিজেনের সরবরাহ পর্যাপ্ত ছিল না। যেকোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে দ্রুত করার জন্য ও রিপোর্ট দ্রুত পাওয়ার আশায় আমার মামা ঘুষ দিচ্ছিল দালালচক্রকে। এবং এরকম পাতাললোকের মতন পরিস্থিতি দেখে আমি মনে মনে নিষ্ঠুরভাবে ভেবেছিলাম, এর চেয়ে বরং মৃত্যুই সুন্দর। দিদা কিন্তু বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নাই। গ্রাম-বাঙলায় অতীতকালে একটা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। গ্রামের মানুষ ভাবতো, হাসপতালে গেলে আর কেউ বেঁচে ফেরে না। দিদার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল।
‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পটা পড়তে পড়তে আমি পুরোনো স্মৃতি থেকে এসবকিছুর সাথেই নিজেকে রিলেট করতে পারছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা এবং গল্পের অভিজ্ঞতা অনেকটা মিলে গিয়েছিল। এইজন্যই হয়তো আমি এখনও গল্পের টেক্সটটা ভুলিনি। একটা অসম্ভব বাস্তবতার আয়নার সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক সাহেব। আমি গল্পটা পড়তে পড়তে আফসোস করতে থাকলাম। কেন আগে তাঁকে পাঠ করিনি? তিনি আজ আর নাই দুনিয়াতে। সকল মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে চলে গেছেন। অথচ তাঁর পর্যবেক্ষণের নিরিখে আঁকা কতগুলো বাস্তবতার পালক তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন। হয়তো সেই বাস্তবতার সামনে দাঁড়ালে সংঘাত হবে। হয়তো অন্তর্দ্বন্দ্বে দগ্ধ হতে হবে আমাদের। তবু তো আমরা নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে পারবো। আমরা আমাদের বিগত দিনের বাস্তবতাকে চিনতে পারবো। দেশভাগের মতন ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে পাওয়া এই লেখকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে আঁকা প্রত্যেকটা অভিজ্ঞতার সাথে নিজেদের পরিচয় ঘটাতে পারো। তিনি তো আমাদের সাথে আমাদের মাঝে রিয়ালিস্টিক হয়েই থেকে যাবেন।
পাতালে হাসপাতালে: একটা অসম্ভব বাস্তবতার আয়না
অসীম নন্দন
অসীম নন্দন
মন্তব্য