সমীপ
এই যে প্রত্যহ নিজের ভেতরের দিকে হেঁটে চলেছি, আলো জ্বলা জনপদগুলি সরে গিয়ে অশরীরী ধানখেত আর আকাশে নশ্বর একটি লাল তারা ফুটে উঠছে অপ্রাকৃত ফুলের মতন- তুমি সেসময় শুধু আমার সাঁকোর প্রান্তে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা উই-এ ভরা মূর্তিটাকেই দেখতে পাও। এই মূর্তিটি তুমি যদি ডাকো, তৎক্ষণাৎ সাড়া দেয়। হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসে তোমার ভেতরে। পাথরের মধ্য দিয়ে হাত গলিয়ে স্পর্শ করে তোমার ফেরিঘাট দিয়ে ঘেরা মধ্যবয়েসি স্তন। অথবা তোমার অফিসঘরের মতো চিবুক। এগুলো আসলে এক একটা রেলিং, খাদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য। অথবা কোনও ডর্মিটরির খাবারের ঘণ্টা- তেমন। যাতে সব সুশৃঙ্খল থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে এক সমুদ্র বাথরুম পায় বা চাঁদ মসিলিপ্ত হলে খাঁজকাটা কাম আসে। তারপর নিপুণ এক ঘুম এবং রোদ ঝলমল করে উঠতে না উঠতেই বাহ্যের বেগ। এসবই শৃঙ্খলতার চিহ্ন। কালোর ছোপ ফিকে হয়ে গ্যাছে এমন ঠোঁটের মতো ভাল থাকার চিহ্ন। তবুও কি আড়ালে নিজের ভেতরের দিকে হাঁটতে থাকি না? একসময় দেখি ঘন জিজ্ঞাসার জংগল শুরু হয়েছে। রাস্তা বলতে শুধু কতগুলি অমানুষিক পদচ্ছাপ। কখনও গোলাবর্ষী ট্যাঙ্কার গেছে- তার ছাপ। আমি ভাবি হয়তো- বা এ কারণেই যে সবই অ- ব্যক্তিগত। সবই রাষ্ট্র নামক বা সমাজ নামক বা গোষ্ঠী নামক এক ঠিকাদারের অধীনে। যেমন কফির কাপে ভাসমান ফেনা কফির অধীনে। সবই নির্ভর করে শুধু চুমুকের ওপরে। উষ্ণ হাসাহাসির ওপরে, কণ্ঠমণির নড়াচড়ার ওপরে। ‘অ্যাই’- এমন একটি শব্দ ব্যবহারের ওপরে
একটা শীতল মশা দেওয়ালে বসে আছে। আমি ওকে উড়িয়ে দিতে গিয়ে ভাবি এ হয়তো আমার কাজ নয়। মশা, সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ, শিশ্নের খোলস- সবার জন্যেই আলাদা আলাদা ঈশ্বর আছেন। তাঁদের হাতের সংখ্যার বৈচিত্র আছে। আছে শস্ত্রেরও বৈচিত্র। জিজ্ঞাসার জংগল কখনও মৃদু হয়ে ন্যাড়া মাঠের ওপর দিয়ে চলে। দূরে দূরে ধোঁয়া ওঠা লোকবসতির আলো দেখা যায়। দেখা যায় মাশরুমের মতো বিবর্ণ কুয়াশা। মশাটি আমাকে টের পায় হয়তো কিন্তু তবুও ও ওর নিজস্ব ঈশ্বরের ওপর আস্থা রেখে স্থির হয়ে থাকে। আমারও ভয়ের নীলবর্ণ ঈশ্বর আমাকে ফিসফিস করে বলে ‘ওকে ঘাঁটিও না।‘ আমি চকিতে তাকিয়ে দেখি সেই ঈশ্বরের মুখাবয়বে অবিকল তুমি চেয়ে আছ। সেই স্বচ্ছ কাচের মতো দৃষ্টি। দূরে দূরে বরফ পড়েছে মাটিতে। বরফ পড়ারও নিশ্চয়ই ঈশ্বর আছে। হয়তো টকটকে যুবাপুরুষের মতো তাঁর চেহারা। পিঠের শেষে অদ্ভুত সুন্দর পেখম। এই পেখম কার কথায় ইন্দ্রধনুর মতো ছড়িয়ে যায়? কফির ফেনা কার নির্দেশ মতো নিজেকে টিকিয়ে রাখে কাপের গায়ে? আঃ, দ্যাখো পায়ের পেশীতে অন্য পায়ের চাপ দিলে কী অপূর্ব আরাম। কত কাগজের নৌকো, নিশান চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অগভীর জল, নুড়িপাথরগুলিও পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। কারও হাত থেকে খুলে ছুড়ে ফেলা কবেকার আঙুলটিও দেখা যায়। সে এখন সন্তানবতী। স্ত্রী কুকুরের মতো তার ঝুলে পড়া তিন জোড়া বোঁটা এবং ফুলদানির মতো কী সুন্দর আনন্দিত হয়ে একটি উঠে থাকা লেজ । ভেতরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আবারও, আবারও জিজ্ঞাসার জংগল ঘন আর আর্দ্র হয়ে ওঠে
স্বপ্ন
আবছা, স্পষ্ট ভাল-মন্দের পর আমাদের চতুর্ভুজ শরীর নীরব নিস্পন্দ মোম হয়ে শুধু জ্বলতেই থাকে, শুধু জ্বলতেই থাকে। কাছেই অযূত সম্ভাবনার জানালা। মোমের কিছুটা আলো সেই জানালা দিয়ে বহির্জগতে যায়। বহির্জগত কথাটা শুনলে এখনও আমাদের কণ্ঠা ফটোট্রপিক চলনের মতো বেঁকে যায়। ছোট ছোট ঢেউয়ে ভর করে শিহরণ আসে। আমাদের কঙ্কাল তাসের বসতের মতো ভেঙে যায়। বহির্জগত– পাউডার মাখা আশ্চর্য সব বাড়ি! নর্তকের মতো সব তরুণ, স্বল্প মেদের গাছ। রামধনুর মতো অসংখ্য রাস্তা। নির্লোম বাহু বা বগলের উন্মুক্ত চিত্রপট। ভাসমান যোনি, স্তনের পসরা, চাঁদের প্রান্ত তোলা হাসি। সব, সবকিছু যেন গলা পর্যন্ত। তারপর আর নেই। জৈবধর্ম অবধি তারা বা সে-সব পৌঁছয়ইনি। তাই শুভ্র, সুন্দর। আমাদের চতুর্ভুজ শরীরের একটি বাহু জ্বলতে জ্বলতে ভেঙে পড়ে। এমন প্রতিদিনই পড়ে। শেষ বাহুটি ছাই হবার পর আমরা ঘুমের গুমোটে পৌঁছাই। ঠোঁটের এককোণ দিয়ে লালা চুঁইয়ে পড়ে। নক্ষত্রময় উরু যেমন-তেমন ভাবে মনিবহীন ওড়নার মতো পড়ে থাকে। ব্রহ্মাণ্ড দিয়ে ট্রেন যায়। গমগম করে ওঠে ডোরাকাটা কংক্রিটের স্টেশন। ভেন্ডারদের দিগন্ত অবধি চলে যাওয়া পথ, ময়লা অন্তর্বাস অবধি চলে যাওয়া পথ
এও এক চলমানতা আমাদের। কাপ-ডিশের মতো পর পর একই মূল্যের ভোরগুলি এসব জানে। একই রঙের কাপড়ের ভাঁজের মতো প্রতিটি সন্ধি জানে। ধরো যেন একটা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি দিয়ে হাঁটছি। পদক্ষেপ ফুরিয়ে যাচ্ছে অথচ তৃণভূমি ফুরোচ্ছেই না– আমাদের ভাল-মন্দকে এভাবে বোঝানো যায়। আমি কখনও ভাবি আমরা স্বপ্নের ভেতরে আছি। চারপাশের দৃশ্যমান সবকিছু স্বপ্নের ভেতরে আছে। তোমার মাংসল পেট, প্রায় আকারহীন দুটো ঘোড়ার মতো পা, আমার লাবণ্য ছাড়া মুখ, নোনা চোখ– সব, সবকিছু। এমনকি বাথরুমের শেষে স্থির হয়ে থাকা পিঙ্গল তারাটি পর্যন্ত। এই যে কোনও কোনওদিন ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে দুজন অপরিচিতকে পাই এবং দ্রুত হাতে একে অন্যের ত্বক মাংস হাড়ের বাঁধন খুলতে থাকি– এও ভীষণ ভীষণ উত্তপ্ত এক স্বপ্ন। বাস্তব এমন নয়। বাস্তবের কিছু নোট লেখা আছে আমাদের নিজস্ব একাকীত্বের গায়ে। যেমন বলা যায়, কতগুলি সাধারণ টিপের পাতা বা আয়নার ভেসে ওঠা শ্যামকান্তি কিছু ব্রণ অথবা আনাজের জঠরে শুধু শুকনো কিছু পালংয়ের আঁটি পড়ে আছে বা ঘরের গরম দেওয়াল থেকে সরু সরু ধোঁয়া বেরচ্ছে কিম্বা আমার চোখের নীচে কালচে এক জাহাজবন্দরের দাগ
আমাদের দ্বিতীয় আরেকটি বাহু জ্বলছে। কথা শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে পড়বে হয়তো
পাম
মাঝে মাঝে নিজেদের বুকের বালিতে আমরা মুখ গুঁজে রাখি। স্পষ্ট কোনও কারণ নেই অথবা স্পষ্ট কোনও উদ্বন্ধনও নেই। তবুও এও যেন অপরিহার্য এক কাজ- সেভাবেই নিজেদের বুকের বালিতে মুখ গুঁজে রাখি। কানে, চোখে, নাসারন্ধ্রে বালি ঢুকে যায় তাই তখন কিছু আর আমাদের স্পর্শ করে না। শুধু আমরা বুঝি আমাদের অতি পরিচিত খাদগুলো। পক্ষীশাবকের মতো আমাদেরই দিকে তাকিয়ে রয়েছে হৃৎস্পন্দন। অথবা মধ্যবয়সি জ্যাট্রোফার দল, পাথরের গায়ে পুরনো চিঠির মতো মস। এবং আমাদের গায়ের শুকনো পাতার মতো ঘ্রাণ। ‘বেটার টু ডাই অ্যাওয়ে’ আমরা কখনও ভাবিনি। বরং ভেবেছি পালংয়ের একটা ঝোল যদি পরের দিন হয় তবে মন্দ হয় না। সবুজ ভ্যালির মতো মনে হবে আঙুলে বিঘ্নিত ভাত। আমরা কোনওদিন তেমন কোনো সবুজ ভ্যালিতে যাইইনি। এ অন্যের কাছাকাছি আছি ফাঁকা শ্মশানে নিঃশ্বাসশীল মরদেহ পাহারা দেবার মতো। ধরো, এই যে আমাদের ঘিরে প্রাইমার করা জানালাগুলো অথবা গ্রীক দেবদেবীদের মতো দরজা, এরাও কী আশ্চর্যভাবে আমাদেরই মতো আমাদেরই কাছাকাছি আছে। কখনও মনে হয় তোমাকে বলি- দ্যাখো তো একটি ট্রাম আমাদের পিছু নিয়েছে কি না এবং তারপরেই থমকে যাই, এভাবে ট্রামের কথা ভাবছি কেন? একটা দেয়ালে ওঠার চেষ্টা করা পোকার দৃশ্যের ওপর দিয়ে কেন ওভারল্যাপিং হয়ে আসছে একটি জংধরা নিঃশব্দ ট্রাম? আবারও বালিতে মাথা গুঁজি। যেন অন্য লেন ধরে শুরু থেকে আবারও হাঁটতে হবে। দেখি তুমিও ঠায় মাথা গুঁজে আছ। অথচ তোমার ঘাড়ে ব্যথা। ঠিক সেখানে, যেখানে দু- একটা পাকা চুল উঠে দাঁড়াচ্ছে
কোথায় যেন বাজনা বাজছে। কারও গালে সাদা আলপনা দেওয়া নতুন বৌ এল বোধহয়। আজ থেকে ওদের অভিন্ন এবং কিছুটা ময়লা জীবন শুরু হল। আমৃত্যু একজনের আরোহণ এবং আরেকজনের অবতরণ শুরু হল। লিলিথের মতো প্রতিদ্বন্দিতা সবাই কি পারে? সবাই নিচ্ছিদ্র ছায়ায় থাকতে ভালোবাসে। বিরোধের চেয়ে স্ববিরোধ ভালোবাসে। গায়ে তেল মেখে মাংসে কুদানো লোক যেমন রৌদ্রকরোজ্জ্বল ছাদে ওঠে, ঝুঁকে দেখে নীচের বহমান অলিগলি। কারও মেটে রঙের ব্লাউজ, যার থাকার কোনও মানেই হয় না অথবা নতনেত্র দরজার চটের পর্দা যেন ঠিক ভক্তপ্রাণ ঈশ্বর। নাকের কুহরে বালি ঢুকে বহুদূর, বহুদূর চলে যায়। জেলিফিশের মতো মস্তিষ্ক অবধি। কেননা বুঝতে পারি সেই বালি ফুঁড়ে কাঁকড়া বা ঌ- কারের মতো সরীসৃপ বেরোল। এবার চাঁদের জন্য, ঠাণ্ডা চন্দনের মতো নিষ্পাপ জ্যোৎস্নার জন্য ওরা অপেক্ষা করবে। আমি যেখানে মানে ঘাড়ের যে অংশটি দেখতে পাই না, সেখানেও তোমারই মতো দু- একটা সাদা চুল ফুটে উঠছে বোধহয়। আমার আঙুলের চতুষ্কোণে দেখা যায় পেছনের অপসৃয়মান রাস্তা পাটভাঙা পোশাকের মতো। কোনওদিনের রোমহর্ষক সব গাছপালা। এদের মধ্যে কয়েকটি আবার অল্প কথার পাম। অন্য একটি বাড়ির দ্বিপদ চেহারা। নক্ষত্র হয়ে যাওয়া কোনও আর্তি বা ব্রণ। তুমি হয়তো অন্য কিছু ভাবো। যুক্তি তো তেমনই বলে। যেমন হয়তো ভাবো উড়ন্ত কোনো রেখা, অনেকটা বিস্মৃত নদীর মতো। সেই নদীর দু-পারে ঝিকমিক করা সব বালি, বালিয়ারি। যাতে স্বর্ণাভ ঘাস জন্মেছে। টইটম্বুর নিয়নের মতো গোধূলি। এম্ব্রডারি করা একটি প্রজাপতি বসে আছে তাদের কোনও একটির মাথায় বা শীষে
এইমাত্র তার একটি প্রান্ত ছিঁড়ে গেল
তিনটি কবিতা
অমিতরূপ চক্রবর্তী
অমিতরূপ চক্রবর্তী
খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন