আমার কিছু বলার আছে
বলতে গেলে একটা উঁচু টুলের দরকার
ভালাে গলার দরকার
আমার উঁচু টুল নেই
আমার ভালাে গলা নেই
টুল ধার চেয়েছি কেউ দেয়নি
ভাঙা গলা ঠিক করার চেষ্টা করেছি পারিনি
অথচ আমাকে বলতে হবে বলার আছে
আমি বলব
আমি বলব বিরুদ্ধে সবার বিরুদ্ধে সব কিছুর বিরুদ্ধে গাছের পাতা গজানাের বিরুদ্ধে ঝরে পড়ার বিরুদ্ধে যৌবনের বিরুদ্ধে বার্ধক্যের বিরুদ্ধে সূর্যের বিরুদ্ধে অন্ধকারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে মরে যাওয়ার বিরুদ্ধে সাহিত্যের বিরুদ্ধে রাজনীতির বিরুদ্ধে ধুতির বিরুদ্ধে প্যান্টের বিরুদ্ধে চুলের বিরুদ্ধে টাকের বিরুদ্ধে সাদার বিরুদ্ধে কালাের বিরুদ্ধে মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিরুদ্ধে পেন্সিলের বিরুদ্ধে কলমের বিরুদ্ধে পেরেকের বিরুদ্ধে স্ত্রুর বিরুদ্ধে হাতের বিরুদ্ধে পায়ের বিরুদ্ধে সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যের বিরুদ্ধে ফুলের বিরুদ্ধে কাটার বিরুদ্ধে জলের বিরুদ্ধে মরুভূমির বিরুদ্ধে মার বিরুদ্ধে বাবার বিরুদ্ধে স্ত্রীর বিরুদ্ধে মেয়ের বিরুদ্ধে তােমার বিরুদ্ধে আমার বিরুদ্ধে সকলের বিরুদ্ধে
আমি বলব
আমার কিছু বলার আছে
জানি আমার টুল নেই
জানি আমার গলা নেই
জানি বলতে গেলে আমার পাঁচ ফুট দেহ দেড় ফুট হয়ে যায়
জানি আমার হাত হারিয়ে যায়
জানি কাপড়ে আমার পা জড়িয়ে যায়
জানি আমার চুল ঝরে যায়
জানি আমার জিভ নাড়াতে পারি না
জানি আমার দাঁত আলগা হয়ে যায়
তবু আমাকে বলতে হবে
আমি বলব
আমার কিছু বলার আছে
আর এই তার উপযুক্ত সময়
এখন রাস্তায় অনেক লােক
এদের মধ্যে বুড়াে আছে বুড়ি আছে যুবক আছে যুবতী আছে কিশাের আছে কিশােরী আছে বালক আছে বালিকা আছে
কেউ নীল জামা পরে কেউ সাদা জামা কেউ হলদে জামা কেউ কালো জামা কেউ লাল জামা কেউ গােলাপি জামা কেউ ধুতি পরে কেউ প্যান্ট কেউ ফুলশার্ট কেউ হাফশার্ট কেউ পাঞ্জাবি কেউ ফতুয়া
কারও মাথায় চুল কারও টাক কারও দাড়ি আছে গোঁফ আছে কারও দাড়ি নেই গোঁফ আছে কারও দাড়ি নেই গোঁফ নেই
কারও পায়ে জুতাে কারও নেই কারও বুট কারও স্যান্ডেল চটি কারও পাম্পসু কেউ হেঁটে যাচ্ছে কেউ দাঁড়িয়ে কেউ গাড়িতে উঠছে কেউ নেমে পড়ছে কেউ হাসছে কেউ চুপ করে আছে
এখন এই সময়
এই তার উপযুক্ত সময়
কেশে গলাটা পরিষ্কার করলাম
বন্ধুগণ
কেউ তাকাল না
বন্ধুগণ
কেউ তাকাল না
বন্ধুগণ
কেউ তাকাল না
বন্ধুগণ
কেউ তাকাল না
আমি বােধহয় দেড় ফুট হয়ে গেছি আমার হাত হারিয়ে গেছে কাপড়ে আমার পা জড়িয়ে গেছে আমার চুল ঝরে গেছে জিভ আটকে গেছে দাঁত আলগা হয়ে গেছে
তাহলে কী করব এখন
অথচ আমাকে বলতে হবে
আমার কিছু বলার আছে
অবশ্য আমি লিখতে পারি লিখে সব বলতে পারি লিখে রাস্তায় পড়তে
পারি
ছাপিয়ে বিলি করতে পারি
রাস্তার দেয়ালে আঁটতে পারি
আমি লিখব
লিখেই সব বলব
আর আমার লেখার কোনও অসুবিধে নেই
আমার কাগজ আছে
আমার কলম আছে
আমার টেবিল আছে
ফেরার পথে একটা লােক ধাক্কা দিল
কিছু বললাম না
ফেরার পথে একটা লােক গায়ে পানের পিক ফেলল
কিছু বললাম না
ফেরার পথে একদল মেয়ে আঙুল দেখিয়ে হাসতে হাসতে গেল
কিছু বললাম না
আমি লিখব লিখেই সব বলব আর আমার লেখার কোনও অসুবিধে নেই
আমার কাগজ আছে আমার কলম আছে আমার টেবিল আছে
ফেরার পথে কিছু খেয়ে নিলাম
ভাতে কাঁকর ছিল
কিছু বললাম না
ডাল পােড়া ছিল
কিছু বললাম না
মাছটা পচা ছিল
কিছু বললাম না
ভাতের দাম বেশি নিল
কিছু বললাম না
আমি লিখব লিখেই সব বলব আর আমার লেখার কোনও অসুবিধে নেই।
আমার কাগজ আছে আমার কলম আছে আমার টেবিল আছে
ঘরে ফিরে দেখি জানলা খােলা
কিছু বললাম না
দেখি ইটের টুকরাে
কিছু বললাম না
দেখি ভাঙা গেলাস
কিছু বললাম না
দেখি বিছানাটা ভেজা
কিছু বললাম না
আমি লিখব লিখেই সব বলব আর আমার লেখার কোনও অসুবিধে নেই।
আমার কাগজ আছে আমার কলম আছে আমার টেবিল আছে
তবে এখন নয়
আর একটু পরে
আর একটু রাত হােক
মানুষ ঘরে ফিরে যাক বিছানায় ফিরে যাক চারদিক শান্ত হােক রাস্তা ফাঁকা হােক
আমি ততক্ষণ শুয়ে থাকি বিছানায় শুয়ে থাকি ভেজা বিছানায় শুয়ে থাকি
শুয়ে ভাবতে থাকি বাইরে রাত্রি বাড়ুক ঘরে রাত্রি বাড়ুক
আমি ততক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকি ততক্ষণ ভেজা বিছানায় শুয়ে থাকি
ততক্ষণ শুয়ে ভাবতে থাকি
পাশে টেবিল পড়ে আছে
টেবিলে ড্রয়ার আছে
ড্রয়ারে কাগজ আছে
ড্রয়ারে কলম আছে
আমার এখন শুধু উঠে বসা উঠে লিখতে শুরু করা
তবে এখন নয় আর একটু পরে আর একটু রাত হােক
আমি শুয়ে রইলাম ভেজা বিছানায় শুয়ে রইলাম শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম
তারপর রাত্রি হল
চোখে ঘুম এলেও তাড়িয়ে দিলাম
মানুষ ফিরে গেছে ঘরে ফিরে গেছে চারদিক শান্ত হয়েছে রাস্তা ফাঁকা হয়েছে
আকাশে ফর্সা চাদ থমকে আছে ঘর ভরে গেছে আলােয় ভরে গেছে
আমি এবার উঠব
উঠে আলাে জ্বালব
আমি লিখব লিখেই সব বলব
আমি বলব
আমার কিছু বলার আছে
আমি এতকাল পারিনি আজ পারব পারতে হবে
আমি উঠব এবার উঠব
উঠতে গিয়ে দেখি শরীরটা শােলা হয়ে গেল উঠতে গিয়ে দেখি বালিশ মাথা থেকে সরে গেল কাঁথা পিঠ থেকে সরে গেল উঠতে গিয়ে দেখি তক্তপোশ দু'ভাগ হয়ে গেল উঠতে গিয়ে দেখি টেবিল দু'ভাগ হয়ে গেল
বালিশ কাঁথা সরে গিয়ে শূন্যে ভাসতে লাগল তক্তপােশ দু’ভাগ হয়ে শূন্যে ভাসতে লাগল তার পায়া খসে পড়ল শূন্যে ভাসতে লাগল টেবিল দু'ভাগ হয়ে শূন্যে ভাসতে লাগল তার পায়া খসে পড়ল শূন্যে ভাসতে লাগল ড্রয়ার খুলে পড়ল শূন্যে ভাসতে লাগল কাগজগুলো ড্রয়ার থেকে বেরিয়ে পড়ল শূন্যে ভাসতে লাগল কলম ড্রয়ার থেকে লাফিয়ে পড়ল শূন্যে ভাসতে লাগল
ওদের ধরতে গিয়ে আমার ডান হাত খসে গেল
ওদের ধরতে গিয়ে আমার বাঁ হাত খসে গেল
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আমার দু’পা খসে গেল
ঘাড় ঘােরাতে গিয়ে আমার মাথা খসে গেল
সব আলাদা হয়ে গেল
সব শুন্যে উঠে গেল
সব ভাসতে লাগল
ঘরে চাঁদের ফর্সা আলাে ছিল
সব ঘুরতে লাগল
ঘরে চাদের ফর্সা আলাে ছিল
সব ঘরময় ঘুরতে লাগল
বালিশ কাঁথা ঘুরতে লাগল তক্তপােশ দু’ভাগ হয়ে ঘুরতে লাগল টেবিল দু’ভাগ হয়ে ঘুরতে লাগল তক্তপােশের চারটে পা চারদিকে ঘুরতে লাগল টেবিলের চারটে পা চারদিকে ঘুরতে লাগল ড্রয়ার ঘুরতে লাগল কাগজ ঘুরতে লাগল কলম ঘুরতে লাগল আমার দু’হাত দু’দিকে ঘুরতে লাগল আমার দু’পা দু’দিকে ঘুরতে লাগল আমার মাথা ঘুরতে লাগল আমার ধড় ঘুরতে লাগল
ঘরে চাদের ফর্সা আলাে ছিল
সব ঘরময় ভাসতে লাগল
সব ঘরময় ঘুরতে লাগল
(এই দশক; প্রথম সংকলন, ফাল্গুন ১৩৭২)
[পরিচিতি: উনিশ শতকের শুরু দিকে ইউরোপে জন্ম নেয় বাস্তববাদী শিল্পরীতি কিংবা রিয়ালিজমের। তার স্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল বাংলাতেও। রবীন্দ্রনাথ কিংবা বঙ্কিম স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর তৈরি করতে পারলেও উনিশ কিংবা বিশ শতকের অধিকাংশ কথাসাহিত্যেই রয়ে গিয়েছিল রিয়ালিজমের ছাপ। তাই প্রচলিত বাস্তববাদী রীতিকে পাশে সরিয়ে রেখেই নতুন ভঙ্গির অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। জন্ম নিয়েছিল শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। যার শ্লোগান ছিলো, গল্পে এখন যারা কাহিনি খুঁজবে তাদের গুলি করা হবে। এই আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী রমানাথ রায়।
১৯৪০ সালের ৩ জানুয়ারি কলকাতা শহরে জন্ম রমানাথ রায়ের। পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের যশোরে। অল্প বয়স থেকেই লিটলম্যাগের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল তাঁর। প্রায় গোড়ার দিক থেকেই প্রচলিত সাহিত্যের পথে হাঁটেননি তিনি। শুরু করেন বিকল্পের অনুসন্ধান। বাস্তবের সঙ্গে ফ্যান্টাসি মিশিয়ে নতুন ধারার সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করালেন তিনি। গল্পের ধারার সঙ্গে মিলেমিশে গেল বিষয়বস্তু।
না, সেখানে কোনো নির্ধারিত প্লট নেই। তাঁর বিশ্বাস প্লট সবসময়ই নির্মিত হয় কার্য-কারণের ওপর ভর করে। সুতরাং কোথাও যেন বেঁধে দেওয়া হয় তার পরিণতিকে। ঠিক সেই জায়গাটাতেই বিবর্তন আনলেন রমানাথ রায়। স্বতঃস্ফূর্ত লেখনীর মাধ্যমে একটা দর্শনকেই তুলে আনলেন তিনি। যেন ক্যালাইডোস্কোপের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া কিছু মুহূর্ত। তাদের সুনির্দিষ্ট পরিণতি নেই কোনো। যার শেষে রয়েছে শুধু বিস্ময়। কোথাও কোথাও স্বাভাবিক যুক্তি কিংবা বাস্তবতার সঙ্গে তার সংঘাত লাগতে বাধ্য।
‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী’ ছাড়াও ‘কাঁকন’, ‘অন্যায় করিনি’, ‘ভালোবাসা চাই’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তাছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘প্রিয় গল্প’, ‘দু’ঘণ্টার ভালোবাসা’। বাংলা সাহিত্যে অনস্বীকার্য অবদানের জন্য পেয়েছেন বিদ্যাসাগর পুরস্কার, বঙ্কিম স্মৃতি পুরস্কার। শেষ বয়সেও লেখালিখির সঙ্গে এতটুকু সম্পর্কছিন্ন হয়নি তাঁর।
১৫ই মার্চ ২০২১, সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ উত্তর কলকাতার নিজের বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।]
বলার আছে
রমানাথ রায়
রমানাথ রায়
এই মহান লেখককে প্রণাম।
উত্তরমুছুনহ্যাঁ, রমানাথ রায়ের এখনও বলার আছে। কারণ আমরা শুনতে চাই।
উত্তরমুছুনখুব যত্ন করে রমানাথ বাবুর লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিন্দুকে ধন্যবাদ। কেবল একটি কথা এখানে যোগ করতে চাই। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস 'ছবির সঙ্গে দেখা'-কে বাংলা সাহিত্যের প্রথম অ্যান্টি নভেল বলা হয়ে থাকে।