আত্মরূপের দূরবর্তীতা
মাঝরাতে ঝড় হলো। আবরার স্বপ্নে তলিয়ে ছিলো। স্বপ্নে সে দেখছিলো একটি প্রাচীন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই ঝড় শুরু হবে। সে আশ্রয় খুঁজতে দরজাটির সামনে চলে এসেছে। পোশাক-আশাক নিরুপদ্রব রবে এই চাওয়ায়।
সান্ধ্যকালীন কোলাহল নির্জনতা আকাঙ্ক্ষী। আবরার জানে। পরিপ্রেক্ষিতে তার বিপর্যস্ততাসমূহ। নিশাতের প্রতি প্রেমের সমান্তরালে দণ্ডায়মান তার অব্যক্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে পাগল, ফলে স্থির। বড় প্রেক্ষাপটে তাই দিশাহীন। দিকচিহ্নহীন সময় ধারাবাহিক চাপে প্রেরণাবর্জিত। আবরার চা খায়। চারিদিকে চায়। নৈসর্গিক বিচ্ছিন্নতা প্রতিমুহূর্তে ধেয়ে আসে। যোগাযোগ স্থাপনে অক্ষম, তাই সৃজনীশক্তি অপেক্ষমান। কবে প্রস্ফুটিত হবে এই আশায়। নিশাতের সাধারণ বাক্যাবলিও আবরারকে অবিরাম টন্ট করে।
‘এভাবে আর চলেনা, বুঝছো? আমি একেবারেই ভালো নাই। তোমার কাছে আসি, তুমিও গুম হয়ে থাকো। আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই।’
আবরার শাব্দিকভাবে নিরুত্তর। ভাবে, ক্রমশ পরিণতির দিকে পৌঁছে যাচ্ছে কি? সূক্ষ্ণ শাব্দিকতা কেজো সত্যের কাছে পরাভূত হবে এ তো জানা কথা। সম্ভাব্য ডিলিংসের বিষয়টা তাকে এতো ভোগাচ্ছে কেনো?
প্রবল শব্দে একটি বাইক সদর্পে নিজেকে জানান দিয়ে রাস্তা উড়িয়ে চলে গেলো।
ফনা তুলে সময় দাঁড়িয়ে আছে, তুমি সাড়া দাও
সোহেলের সাথে তার দেখা হলো। চারদিন পর। সোহেল তাকে কৌতূহলী চোখে দেখে। আবরার জিজ্ঞাসু হয়-
‘কই ছিলি এই কয়দিন? কালকে বিকালেও ফোন করছিলাম, ধরোসনাই।’
‘বাবা আসছে তিনদিনের জন্য। কিছু টেস্ট-ফেস্ট করতে দিছে। মেরুদণ্ডের ব্যথাটা বহুত প্যারা দিতেছে বুড়া লোকটারে।’
‘চাপাবাজি যে করোস এতো, ঠিকঠাক কবে করতে শিখবি? সামান্য কয়টা মিছা কথা কইতে জিহ্বা এতোবার জড়ায়ে যায়, চাকরি-বাকরি করিস কেমনে?’
না, সত্যি বলতেছি তো।’ অপ্রস্তুত সোহেল প্রসঙ্গান্তরে যেতে চায়।
আবরার অনুভব করে- একটা নিশ্চিত ফলাফলের দিকে সে ধাবমান, জানে। কিন্তু একে কীভাবে বরণ করা যায়? অন্তর্গত যে কোন পরিণতি জোর করে মেনে নেওয়ার প্রতি তার বরাবরের অনীহা। কিন্তু সময়ের কৌতুক বারবার তাকেই বেছে নেয়। কিছু সময় তো সে প্রত্যাশা করতেই পারে জীবনের কাছ থেকে। মন ভাসিয়ে নেওয়া রুচিস্নিগ্ধ(!) পোয়েটিক ফর্মের গদ্য- ঝুঁকিহীন ব্যায়ামের স্বস্তি ও তৃপ্তি। বারবার পরাস্ত হচ্ছে অনাড়ম্বর গদ্যের কাছে।
‘পরশুদিন দুপুরে আসিস।’ গম্ভীর শীতল সেই স্বরে সোহেল আরো অপ্রতিভ। সে মিইয়ে যায়।
আবরার মাথা ঝাঁকায়। নিঃশ্বাস কেবল অনিবার্য প্রয়োজনের একটি প্রতিক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ততায় সাড়া দিতে পারা ক্রমশ সম্ভবপরতাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে।
দোদুল্যমান নার্সিসাস বিদ্ধ করে, বিদ্ধ হয়
আবারো সন্ধ্যা। নিশাত কমনীয়তা প্রত্যাশী। আবরার প্রাত্যহিক অনুভূতির দাসানুদাস মাত্র। ফলে, অনুরণনহীন। নিশাত ফেটে পড়ে-
‘কী পাইছো তুমি আমাকে? আমি কষ্ট করে এতোদূরে আসবো, একটা কথাও বলবানা। আমি তো মানুষ একটা, নাকি? এভাবে তো মানুষ পোষা কুত্তাকেও ট্রিট করেনা। তোমার আজকে বলতেই হবে……’-নিশাত অন্তহীন মেইলট্রেইন।
আবরার স্মৃতিমুখর হয়। অনেক কিছুর সাথে সাথে স্মৃতিসমূহের বিস্তৃতিও ক্ষয়িষ্ণু। দূরবর্তী সময়কার কিছুই তার আর মনে পড়েনা। একটা সাম্প্রতিক ইমেজ ফের আবির্ভূত হয়ে তাকে পর্যুদস্ত করে। আবরার প্রতিরোধহীন। নিশ্চল। বীতস্পৃহ। নিশাত গড়পড়তা প্রেমিকার চিরাচরিত টেকনিকটাই শেষমেষ ব্যবহার করে। হাতের কাছে ভারি স্তনের সংস্পর্শ আবরারের জৈবিকতা কে উস্কে দিতে চায়। কিন্তু ওটা প্রাণহীন।
এটা তার কষ্টকল্পনাতেও ছিলোনা। নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কষে চড় লাগায় নিশাত। ‘খানকির পোলা তুই থাক তোর কবিস্বভাব নিয়া। আমার সাথে আর কখনো দেখা করবিনা। চ্যাট বেশী খাড়া হইলে খানকিপাড়ায় যাইস। নিজেরে শুধরায়ে যাইস। ভোন্দাগিরি কইরা পয়সা নষ্ট করিস না।’
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ধাতস্থ হবার পর দুপুরের সেই স্থির চিত্রটি আবরারকে গ্রাস করে। বিছানার চাদর ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। সোহেলের স্বর ধীর ও আর্দ্র হয়ে আসছে। আবরার উপগত এবং স্থিরতাবর্জিত। সে দ্রুততর হচ্ছে। রোদ ক্রমশ ক্ষীণতর হচ্ছে। গাছগুলো বাতাস পেয়ে একটু একটু দুলতে শুরু করেছে। জৈবতা অবশ্যম্ভাবী। ফলে তার ফলিত রূপটি কল্পিত সৌন্দর্যের চাইতে পিছিয়ে থাকে। আবরারের চোখজোড়া নিবদ্ধ। সে বিদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়। ওখানে কমনীয়তার সিনট্যাক্স নেই।
দিকচিহ্নহীন
প্রমিথ রায়হান
প্রমিথ রায়হান
মন্তব্য