কেষ্টর বাবা মারা যাবার পর থেকেই আমায় এই রোগে ধরেছে, আমি নিজে একে রোগ মনে করিনা, বাড়ির সবাই মনে করে, কেষ্ট, কেষ্টর বউ, কেষ্টর ছেলে, ছেলের বউ, এমন কি নাতি আর নাতনিও, যাদের কোলে-পিঠে করে মানুষ করলুম, মনে করে লোকটার, মানে কেষ্টর বাপের, অভাব আমি এই রোগ দিয়ে পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করছি । এরা কেউ আমাকে বুঝতেই পারে না, নিজেদের যুক্তি দিয়ে আমায় যাচাই করে, এই যে তালিবানরা বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি বোমা মেরে উড়িয়ে দিলে, তাকে কি রোগ বলা যাবে, তালিবানদের আগেও তো আফগানিস্তানে মুসলমানরা আছে, কই তারা তো মূর্তিটা নষ্ট করেনি, লোকে এখন বলছে ওটা তালিবানদের রোগ, আমাদের দেশে যখন তুর্কি আফগান আরব রাজারা এলো, তখন তারাও এখানকার কতো মূর্তির নাক মুখ পা ভেঙে দিয়েছিল, এখন এদেশে তাদের বংশধররা রয়েছে, কই তারা তো ভাঙাভাঙি করে না, আগেকার লোকগুলোর কি রোগ ছিল, নাকি এখনকার বংশধরদের রোগ নেই, এই কিছুদিন আগে বাংলাদেশে দুর্গা কালীর মূর্তি ভাঙলে লোকেরা, যারা ভাঙলে তাদের কি রোগে ধরেছিল, তারা কি বংশধর নয়, তারাও তো বংশধর, এদেশের বংশধরদের সঙ্গে ওদেশের বংশধরদের তফাত আছে নাকি, আমি বাবা ওসব রোগটোগ বুঝিনে, ওদের কি কেউ কাছের মানুষ মনের মানুষ মারা যাবার অভাবে ভুগছে, কেষ্ট যেমন আমাকে বলে, প্রায়ই বলে, যে, ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে, ওর বাবার উপস্হিত না থাকার অভাব, আমি নাকি আমার খাই-খাই রোগ দিয়ে পুষিয়ে নিই, সত্যিই, আমার সবসময় বড্ডো খেতে ইচ্ছে করে, মনে হয় পেট ভরেনি, সকালের খাবার পরও সামনে যা পাই খেয়ে নিই, রান্নাঘরে ঢুকে আরেকবার ভাত বেড়ে খেয়ে নিই, আমি পুরো ভাতই খেয়ে নিই, এমন নয় যে ফেলে ছড়িয়ে উঠে পড়ি, তা ওদের পছন্দ হয় না, বলে সকালে অতো খেলে, তারপরও তোমার খাই-খাই বাই, টেবিলের ওপর থেকে ফলগুলো খেয়ে নিলে, বললেই তো হতো ধুয়ে কেটে সবাই মিলে খেতুম, কী বোকা, সবাই মিলে কেন খাবো, ফলগুলো আমায় ডাকছিল, খাবার জিনিস আমায় ডাকে তাই খাই, তোদের ডাকে না বলে তোরা খাস না, তোদের ঘড়িগুলো ডাকে, সকালে আটটা বাজলে খাবি, দুপুরে দেড়টা বাজলে খাবি, চারটে বাজলে চা-চানাচুর খাবি, দশটা বাজলে আবার রাত্তিরের খাবার খাবি, তোরা বিশ্বাস করতে চাস না খাবার জিনিস আমায় ডাকে, রান্নাঘরের তাকে রাখা বিস্কুট আমায় ডাকে, দুটো বিস্কুটের মাঝে যে গোলাপি মিষ্টি মাখানো থাকে তা চাটতে আমার ভাল্লাগে, হলেই বা আমার ছেষট্টি বছর বয়স, নিমকির জার আমায় ডাকে, তা আমি কী করব, তোরা ঘড়ির ডাক শুনতে পাস, আমি খাবারের ডাক শুনতে পাই, তোরা ভাবিস কেষ্টর বাপ খাবারের ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে না, সে স্বর্গে চলে গেছে, স্বর্গে গেলেই বা, স্বর্গ থেকে নেমে এসে আমাকে ইশারায় বলে যে তিলের নাড়ু রাখা আছে, বয়ামে, কেষ্টর ছেলের বউ লুকিয়ে রেখেছে, নারকেলের নাড়ু লোকানো আছে টিনের ডিবেতে, তোমার নাতবউ বাপের বাড়ি থেকে এনেছে, আমি ঠিক ওনার ফিসফিস শুনতে পাই, আর তোরা যখন সামনে থাকিস না তখন লুকিয়ে খেয়ে নিই, তোরা বকাঝকা করিস, যেমন ওই তালিবানদের পৃথিবীর লোকে বকাঝকা করলে, বাংলাদেশে যারা দেবী-দেবতার মূর্তি ভাঙলে তাদের বকাঝকা করলে, কিন্তু তারা তো কোনো ইশারা পেয়েছিল, আরবি ভাষায় লেখা বইয়ের ইশারা, সরকম ইশারা কেষ্টর বাপ আমায় করে, তখন আমি কী খাবো কী খাবো করতে থাকি, কিছু খেতে না পেলে মন খারাপ হয়ে যায়, তোরা সব লুকিয়ে রাখা আরম্ভ করেছিস, তালাচাবি দিয়ে রাখা আরম্ভ করেছিস, আমি কি আর জানিনে, তোরা ভাবছিস বুড়িটা আগেকার কালের, অতো বুঝবে না, আমি সব বুঝি, এখন তোদের পাল্লায় পড়ে আমি যখন আমার সামনে কোনো খাবার জিনিস দেখতে পাই না তখন রান্নাঘর থেকে চিনি খাই, তাও তোরা তালা বন্ধ করে রাখা আরম্ভ করলি, কেষ্টর বাবা রোজ আপিস ফেরত আমার জন্য হয় রসমুণ্ডি, নয় মোয়া, নয় রসগোল্লা, নয় মুড়কি, নয় সন্দেশ কিনে আনতো, আমি পরের দিন বিকেল পর্যন্ত খেতুম, তোদেরও দিতুম, কেষ্টর বাপ তোদের মতন কিপটে ছিল না, কতো কি আনতো খাবার জন্যে, আমার পছন্দের ফল, আমার পছন্দের মিষ্টি, আর তোরা, আমাকে তোদের মতন করেই খেতে দিস, বুঝতেই পারিস না যে কেষ্টর বাপের ভাগের খাওয়াটাও আমাকে খেতে হয়, ওই করেই তো কেষ্টর বাপকে বাঁচিয়ে রেখেছি আমার মধ্যে, তা তোদের পছন্দ হলো না, তোরা আমার ডবল খাওয়া বন্ধ করে দিলি, আমি আর কী করব, আমি এখন মুখ চোকাই, মুখে কিছু না থাকলেও খাবার ভান করি, তাও কেষ্টর পছন্দ হল না, ওর বন্ধুবান্ধব নাকি হাসাহাসি করে, আমার খাইখাই বাই দেখে, আমি কী করেছি বলো, আমি ওর বন্ধুদের জন্যে বৈঠকখানা ঘরে মিষ্টি সিঙাড়া দেখে তুলে খেয়ে ফেলি, কেষ্ট নাকি তাতে অপমানিত বোধ করতে লাগল, যারা আসে তারাও নাকি ওর মাকে দেখে অবাক হয়, কোথায় কেষ্ট বন্ধুদের বোঝাবে যে আমার মা ঘড়ির নির্দেশে চলে না, স্বর্গীয় বাবার ইশারায় চলে, তা নয়, কেষ্ট এখন বৈঠকখানা ঘরে বিছানা পেতে, খাটের সঙ্গে আমার পায়ে শেকল বেঁধে রেখেছে, যাতে সারাক্ষণ নজরে-নজরে রাখা যায়, ওদের ঘড়ি যখন বলে, ওরা তখন খায়, তখন আমার খাবার নিয়ে আসে কেষ্টর বউ কিংবা কেষ্টর ছেলের বউ, আমি রাগ দেখালেও ওদের কিছু যায় আসে না, বলেছে, ডাক্তার দেখাবে, তা ডাক্তার এসে বলে গেল আমার খাই খাই রোগে ধরেছে, এ সারানো যাবে না, উনি যেমন শেকলবাঁধা আছেন, তেমনই থাকুন, এখানেই বেডপ্যান রেখে দিন, আর দুজন সেবিকা নিয়োগ করুন যারা ওনার পেচ্ছাপ-পায়খানা পেলে বেডপ্যানে করাতে পারবেন, এ কেমনতর ডাক্তার বুঝিনে, একজন সুস্হ সবল মানুষকে হাসপাতালের রোগির মতন চোপোরঘণ্টা বিছানায় শুইয়ে রেখেছে, তাও সময়ে অসময়ে ওষুধের বড়ি খাওয়ালে খেতুম মাঝে-সাজে, রোগিদের যেমন বেদানা আপেল দ্যায় তেমন দিলে খেতুম, কিন্তু সেবিকারা সারাদিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর হাসি পেলে পেছন ফিরে হাসে. বলি যে, এই তোরা আমার পায়ের শেকলের তালা খুলে দে দিকিনি, আমার কাছেও লুকোনো টাকাকড়ি আছে, তোদের দিয়ে দেবো, তা ওরা শুনবেনে, আমি এই খাওয়াশেকল বাঁধা অবস্হায় সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকি আর মুখ চোকাই...
খাওয়াশেকল
মলয় রায়চৌধুরী
মলয় রায়চৌধুরী
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন