.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

দীপ শেখর চক্রবর্তীর ছোটগল্প: ভ্রাতৃদ্বিতীয়া

লিটলম্যাগ বিন্দুর ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যার প্রচ্ছদ
উৎসব শেষের পথগুলো এমন নির্জন হয়ে পড়ে। নিভে যাওয়া আলো, এদিক ওদিক ভাঙা মণ্ডপের সঙ্গে মিলেমিশে যায় হেমন্তের সন্ধের মায়া। এমন সন্ধেগুলো খুব বিপজ্জনক তাদের জন্য, যাদের আঁকড়ে ধরার আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে। ছোটোবেলা থেকেই ভাইফোঁটার আগের সন্ধেতে মামাবাড়ি যাই। পথটি বেশি নয়, আমার ছোটো শহরের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত। আমাদের ছোটো শহরে কালীপুজোর বিরাট আয়োজন। সেসব মিটতে মিটতে ভাইফোঁটাও অতিক্রম হয়ে যায়। তবে এবার প্রশাসনের বিশেষ নির্দেশে ভাইফোঁটার আগের রাতেই সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে হচ্ছে। খুলে ফেলতে হচ্ছে মণ্ডপ। কেন, কেউই সেভাবে বলতে পারছে না। প্রশাসনের নির্দেশ, অমান্য করার জায়গা নেই। তবে মানুষের মন থেকে উৎসব সেভাবে মোছেনি। শুধু খুলে ফেলতে হচ্ছে বাইরের আনন্দটুকু।

প্রশাসনের এমন নির্দেশের পেছনে কী কারণ, সেই নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানারকম ভাবনা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একপক্ষ বলছে, সরকার পাখিদের বাঁচাতেই এমন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। 
আর একপক্ষ বলছে, সরকারের আসল উদ্দেশ্য নিজেদের পরিশ্রম কমিয়ে আনা। অলস প্রশাসন।
অপর এক পক্ষ, যারা কথায় কথায় হিন্দু ধর্মের প্রতি আক্রমণের আতঙ্কে ভোগে, এই সকল তত্ত্বই খারিজ করেছে।

তবে বিষয়টা এই সমস্ত নয়। আরও বড়ো কারণ নিশ্চিত আছে। নইলে সরকার হঠাৎ এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে কেন বাধ্য হবে? এই নিয়ে বিরোধীপক্ষ সরব। তবে সরকার তার কোনও সঠিক কারণ এখনও বলেনি। সকলেই যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তবে আমি মনে মনে বুঝতে পারি, গোপনে কোনও ভয়ানক খবর পেয়েছে ওরা। আতঙ্ক ওদের নেতা মন্ত্রীদের চোখে-মুখে।

মামাবাড়ির জায়গাটি আমাদের ছোটো শহরটির একেবারে শেষ প্রান্তে। এটিই শহরের পশ্চিম সীমানা। তারপর দীর্ঘ এক কবরখানা, কাঁটাতার এবং যতদূর চোখ যায় মরুভূমি। বিরাট এক প্রেতের মতো শুয়ে আছে মরুভূমিটা। যেদিকে তাকানো যায়, শুধুই শূন্যতা। বলা হয়, এই মরুভূমির কোনও শেষ নেই। অনন্তকাল ধরে হেঁটেও কোনও মানুষ নাকি পার হতে পারেনি ওকে। যারা পার হতে চেয়েছিল, কেউ ফেরেনি। তাই, এদিকে কোনও নিরাপত্তারক্ষী নেই। প্রকৃতিই যেন এক নিরাপত্তারক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানে।
তিতু আমার বড়োমামার ছেলে। ঝুমি ছোটোমামার মেয়ে। আমার দুই মামা। বড়ো মামা সরকারি চাকরি করে। তার কাজ সরকারের বিভিন্ন নিন্দুকদের চিহ্নিত এবং নাম নথিভুক্ত করা। সেই অনুসারে সরকার তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করে। যদিও সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে বড়োমামার কোনও যোগাযোগ নেই। শোনা যায়, ছাত্রাবস্থায় মামা বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল। তবে সেসব এখন অতীত। বামপন্থী রাজনীতির ছিটেফোঁটাও কোথাও নেই। ছোটোমামা ব্যবসায়ী। ভালো জাতের শকুন বিক্রিই ছোটোমামার নেশা এবং পেশা। আমাদের এই শহরে এখন প্রত্যেক বাড়িতেই ছোটো বড়ো শকুন রাখার চল আছে।
একটি বাড়িতে ভালো মানের শকুন রাখার বেশ কতকগুলো সুবিধে যে রয়েছে, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

ছোটোমামার কোনও দলীয় রাজনীতির প্রতিই কোনওপ্রকার মোহ নেই। বরং ভালো ব্যবসা করে বিদেশ যাওয়াই তার লক্ষ্য। বিদেশের প্রতি এক অদ্ভুত মোহ আছে ওর। এমনকী পাত্রী খোঁজার সময় ছোটমামা দুটি বিষয়ের ওপর সবথেকে বেশি জোর দিয়েছিল—
এক, পাত্রীকে বিদেশীদের মতো ফর্সা হতে হবে।
দুই, পাত্রীর অতি অবশ্যই থাকতে হবে একটি আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট।
অবশেষে কথামামীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে ছোটোমামার দুটি ইচ্ছেই পূরণ হয়। বিগত কয়েক বছরে শকুনের ব্যবসাটা এতটাই ফুলে ফেঁপে উঠেছে যে, ছোটোমামার বিদেশ যাত্রার আর খুব একটা দেরি নেই। ঝুমির এবার ক্লাস টেন। স্কুল ফাইনাল পাশের পরেই হয়ত ওরা পাকাপাকি বিদেশে চলে যেতে পারবে। টাকায় কী না হয়! বড়োমামার এমন কোনও উদ্দেশ্য নেই। নিজের কাজ যতটা নীরবতার সঙ্গে মামা করে, তার থেকেও বেশি নীরব ব্যক্তিগত সংসারে। কোনওকিছুতেই মামার ভেতর থেকে একটা কিছু বেরিয়ে আসতে পারে না। দীর্ঘদিন চাকরি করার ফল এটা হতে পারে। মামার চাকরি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সবসময় নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলেও, নীরবতাই যে মানুষের সবথেকে বড় আত্মরক্ষার উপায়, এটা বড়োমামা শিখে গেছে সেই ছাত্রাবস্থাতেই। বড়োমামীরও অভ্যেস হয়ে গেছে এই নীরবতার আবহাওয়ায়। ফলে তার মুখ থেকেও বেশি কিছু বেরোয় না সারাদিন। বাড়ির মধ্যে সবথেকে বেশি কথা বলে
কথামামী এবং শকুনেরা।

কথামামী আমার থেকে বছর আটের বড়ো। আগেই বলেছি, বিদেশীদের মতো কটা গায়ের রঙ। চোখদুটোও কিছুটা নীলাভ। যদিও ওর বাবা মা দুজনেই এদেশীয়। কোন জাদুবলে যে কথামামীর এমন রঙ, কেউ বলতে পারে না। তবে জাদু আছে বটে কথামামীর। বিয়ের সময় যখন আমি সদ্য কিশোর, তখন থেকেই ও আমার কাছে এক অদ্ভুত রূপকথা। একগুচ্ছ শকুনের খাঁচার সামনে প্রথম যখন ঐ রূপ নিয়ে এসেছিল, আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। ওর রূপ যেন এক ভয়ঙ্কর গোপনীয়তা। মনে পড়ে, বিয়ের পর প্রথম যখন আমাদের বাড়িতে থেকেছিল মামা-মামী, তখন ছাদের এক গোপন ফাঁক থেকে ওর স্নান দেখেছিলাম। আশ্চর্য হাতির দাঁতের রঙের স্ফীত বুক, চুলের ওপর থেকে জল এমনভাবে প্রবাহিত হয়েছিল উরু দিয়ে, মনে হয়েছিল সাক্ষাৎ জলপ্রপাত। বেশিক্ষণ সে স্নানদৃশ্যের সামনে থাকতে পারিনি। আমার ঘেমে যাওয়া মুখের মধ্যে লেগে গিয়েছিল ছাদের ঝুল এবং মাকড়শা।
সেই ঝুল আর মাকড়শা হয়ত তারপর থেকে আর পরিষ্কার করতে পারিনি। কথামামীই কি চেয়েছিল আমার মুখ থেকে ঐ ঝুল আর মাকড়শা পরিষ্কার হয়ে যাক?

পৌঁছলাম মামাবাড়িতে একটু সন্ধে করেই। মা সকালেই পৌঁছেছে। দূর থেকেই শকুনদের চিৎকার আর বিষ্ঠার গন্ধ পাওয়া যায়। দিদা তখনও ঠাকুরঘরে। দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময় দিদা থাকে ঠাকুরের কাছে। এই ঠাকুরঘর, এক আশ্চর্য নিষিদ্ধ জায়গা মামাবাড়িতে, কারুরই প্রবেশের অধিকার নেই। কেউ ভুল করে ঢুকে পড়লে, সেদিন দিদার নাওয়া খাওয়া বন্ধ। গোটা দিন গঙ্গার জল ছিটিয়ে ঠাকুরঘরকে কলঙ্কমুক্ত করতে কেটে যাবে। মা বসে আছে দাদুর সঙ্গে। জীবনে বিরাশিটি যুদ্ধ লড়েছে দাদু। বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান), ভারতের হয়ে যুদ্ধ করেছে। একশো আশি বছরের চেহারাটি এখনও সমস্তরকম রোগমুক্ত। মাথার সামনে মুখোমুখি ঝুলে আছে দুটো রাইফেল। এক মাথা শাদা চুল হলেও, যথেষ্ট শক্তপোক্ত দাদুকে দেখলে মনে হয় আরও একটা যুদ্ধ হয়ত দাদুর মধ্যে অবশিষ্ট আছে।

ভাইফোঁটার আগের দিন রাতের বেলা আমাদের লুকোচুরি খেলার একটা পুরোনো রীতি আছে। এই খেলায় অংশ নিই আমি, তিতু, ঝুমি এবং কথামামী। বড়োমামাকে কালকের আগে দেখতে পাওয়া যাবে না। নিজের ঘরের সমস্ত জানলা দরজা কড়াভাবে এঁটে বড়োমামা ভেতরে বসে থাকে। বড়োমামীকেও বেশিক্ষণ পাওয়া যায় না। দিদা যতক্ষণ ঠাকুরঘরের বাইরে থাকে, ততক্ষণ কাটে রান্নাবান্না নিয়ে। মেয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে দিদা ফিরে যায় আবার রান্নায়। সারাদিন এত রান্না কার জন্য হয়, বুঝতে পারি না। দিদা বলে ঠাকুরের জন্য।
ঠাকুর, সে যেমন মানুষের থেকে বড়ো, তেমনই তার খিদেও মানুষের অধিক। ছোটোমামা বাড়ি ফেরে অনেক রাতে। মাঝে মাঝে লোক এসে শকুন নিয়ে যায়। ছোটোমামা কখন যে ঘরে ফেরে তা কেউই জানে না। যেন অদৃশ্য এক আত্মা হয়ে ফেরে। শুধু জানে কথামামী। ওকে এসব জেনে রাখতে হয়।

লুকোচুরি খেলার রীতিটা আমরা কেউ অতিক্রম করে যেতে পারি না। যদিও, এই খেলায় আমার আর বিশেষ মন নেই। পারিবারিক একটা নিয়মের মতো করেই এই খেলাটা আমাদের খেলে যেতে হবে। মামাবাড়িতে লুকোনোর জায়গার কোনও অভাব নেই। শকুনের খাঁচাগুলোর পেছনের জায়গাগুলো এত অন্ধকার, নাক কান বন্ধ করে ওখানে পড়ে থাকলেই হল। এছাড়াও কথামামীর ঘরে এমন অনেক গুপ্ত জায়গা আছে, যা লুকোনোর জন্য আদর্শ। দাদুর খাটের তলায় এবং সবথেকে বিপজ্জনক, দিদার ঠাকুরঘরে। এই জায়গায় লুকোনোর সাহস গোটা মামাবাড়িতে দুজন মাত্র করেছিল। আগের বছর ঠাকুরঘরের কোণায় যখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঝুমি ও আমি লুকিয়ে আছি, তখন ধীরে ধীরে আমার মুখ থেকে মাকড়শার ঝুল সরিয়ে দিচ্ছিল ও। আমরা ধরা পড়িনি তিতুর কাছে, কথামামির কাছে, এমনকী দিদার কাছেও। ফলে ঠাকুরঘরে আর গঙ্গাজল ছেটাতে হয়নি দিদাকে।
আরেকবার খেলার নিয়ম না মেনেই আমি ও কথামামী চলে গেছিলাম কবরখানার ওদিকটায় লুকোতে। আমাদের মাথাতেই ছিল না, লুকোচুরি খেলার পরিসরটা কেবলমাত্র মামাবাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দীর্ঘ মরুভূমিটাকে দেখে গা ছমছম করছিল আমার। তখনই প্রথম জানতে পারি এর কোনও শেষ নেই, সীমা নেই। যারা শেষ দেখতে গেছিল, তারাও হারিয়ে গেছে, কেউ ফেরেনি। এক বিরাট তৃষ্ণা যেন শুয়ে আছে কাঁটাতারের ওপারে আর এদিকে আমি ও কথামামী। কাঁটাতার, কিছু বিষণ্ণ কাঁটাতার। মাথার ওপরে কিছু শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। সে কি ছোটোমামারই শকুন? তবুও, কেউ খুঁজে পায়নি আমাদের। ঝুমি বুক ফুলিয়ে বলেছিল— কোথায় লুকোও, কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যায় না! খেলাটায় এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠেছি আমি যে, আসল মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও কেন যে নিয়ম করে খেলতে হয়! আসলে এই খেলাটি ছাড়া ভাইফোঁটার আগের দিন রাতে আমাদের তেমন বিশেষ কিছু করার নেই। ফলে এই খেলাটা আমাদের সময়টা কাটাতে সাহায্য করে। মায়ের জাদুর কিছু কিছু পেয়েছে ঝুমিও। অমন ফর্সা রঙ, নীলাভ চোখ। শুধু কথা অত বলে না। গভীর মুখে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখের ঐ আশ্চর্য বিষাদ আমাকে মরুভূমিটার কথা মনে করায়। তল খুঁজে পাই না কিছুতেই।
রাতের বেলা টানা বিছানা পাতা হয়। পাশাপাশি আমি, তিতু, ঝুমি এবং কথামামী। ঝুমির পাশে শুতে আমার ভয় লাগে। তিতুকে তাই মাঝখানে দিই। তিতু বোকাসোকা ছেলে। ওবাড়ি গেলে সারাদিন আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। কিছুক্ষণ গল্প করার পর ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর ছোটোমামা এলে মশারি খুলে কখন চলে যায় কথামামী, কেউই প্রায় টের পায় না। তিতুকে মাঝখানে রেখে আমি ও ঝুমি শুয়ে থাকি। বুঝি, আমার মুখ ভরে উঠছে মাকড়শার জালে আর ঝুমির হাত তিতুকে অতিক্রম করে সেই ঝুল পরিষ্কার করতে আসে। জানি না, এটা স্বপ্ন, না বাস্তব! প্রতিবার ভাইফোঁটার আগের দিন কেন এই একই স্বপ্ন আমাকে দেখতে হয়? এ এক অদ্ভুত অভিশাপ। আমি সারা মুখ জুড়ে মাকড়শার হেঁটে বেড়ানো অনুভব করি। এও অনুভব করি, ঝুমির নরম সদ্য কিশোরী হাত আমার মুখের ওপর থেকে ঝুল সরিয়ে নিচ্ছে। এভাবে আরও আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছি আমি। এই স্পষ্ট হতে পারাকে, আমি ভয় করি।
গোটা রাত বিছানায় ঘুমোতে যায় না দিদা। ঠাকুর ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে। কথামামীর কাছেই শুনেছি, রাতের বেলা ঠাকুরঘরের ভেতর থেকে অলৌকিক এক আলো দেখতে পাওয়ার কথা। দিদার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আরও এক ভারী কণ্ঠ শোনা যায়। কথা মামি বাঁকা এসে বলে- ভগবান, ভগবান, সকলেই ভগবানের সন্তান। আমার মনে হয় এসবই কথা মামির বানানো গল্প। যদিও এ বিষয়ে দাদু কোনওদিন কিছুই বলেনি। নিজের একশো আশি বছরের শক্ত চেহারাটা বিছানায় লাগিয়ে শুয়ে থাকে দাদু। 
হয়ত মৃত্যু দাদুকে ভুলেই গেছে। 

সারারাত সেভাবে ঘুম আসে না। সকালে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ডাকাডাকিতে উঠতে হল। ভাইফোঁটার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ঠাকুরের আশীর্বাদসহ চন্দন, ধানদুব্বো নিয়ে প্রস্তুত দিদার থালা। পাঞ্জাবি- পাজামা পরে প্রস্তুত তিতু, কথামামীমা পরেছে লাল পাড় সাদা শাড়ি। মা আর দিদার পরনেও তাই। দাদু পরেছে একটা খাটো কুর্তা আর যুদ্ধের পাজামা। এমন একটা দিনে যুদ্ধের পাজামা পরার পেছনে কী যুক্তি, তা কেবল দাদুই বলতে পারবে। তবে সে প্রশ্ন করার সাহস এ বাড়িতে কারুর নেই। আসন পাতা হলে এল বড়োমামা। আসার পর এই প্রথম দেখলাম তাকে। আরও রোগা হয়ে গেছে। চোখের তলায় গভীর কালো দাগ। ছোটোমামা ঠিক ততটাই উজ্জ্বল। নতুন ধুতি, পাঞ্জাবি। চেহারায় প্রতিপত্তির ছাপ স্পষ্ট। দিদাই সব সাজালো, সাহায্য করল মা আর দুই মামী। বড়মামী আগের থেকেও চুপ করে গেছে। ওর চোখেমুখে সবসময় আশ্চর্য এক আতঙ্ক থাকে। তিতুকে জিজ্ঞেস করলে, এসব কিছুরই উত্তর পাওয়া যায় না।

স্নান সেরে পাজামা পাঞ্জাবিটা গলিয়ে বসে পড়লাম আসনে। পাশে এসে বসল তিতু। কিন্তু ঝুমির দেখা নেই। কোথায় গেল মেয়েটা? কথামামী খুঁজে দেখতে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে বলল, কোথাও তো পেলাম না। বাইরে যায়নি তো? জিজ্ঞেস করল বড়োমামা। বহুক্ষণ পর ওকে কথা বলতে শুনলাম। দাদু দূরে বসে রাগ দেখাতে লাগল ঝুমির ওপরে। দাদুর মেজাজটাই অনেকটা ওরকম। মা দাদুকে শান্ত করে বাথরুমের দিকে গেল। বহুক্ষণ ধরে পাওয়া গেল না ঝুমিকে। এবার সত্যিই চিন্তিত হয়ে উঠল গোটা বাড়ি। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে কোথায় চলে গেল সকাল সকাল? ছোটোমামা গেল শকুনদের খাঁচার দিকটায় খুঁজতে। এদিকে মুখে কিছু না বললেও স্পষ্ট বোঝা যায়, বড়োমামার ভেতরে ভেতরে আসলে কী চলছে। অন্য একটা কিছুর আশঙ্কা করছে বড়োমামা। কিছুক্ষণ পর নিজের ঘরে ঢুকে  গেল।

দিদাই শেষ অবধি খুঁজে পেল ঝুমিকে। ঠাকুরঘরের একটি কোণে ঝুল মাকড়শা মুখে মেখে ঘুমিয়ে আছে ঝুমি। অনেক ডাকার পর জেগে উঠল। ওর রাতের টেপজামাটির বোতাম ওপর থেকে খোলা। দুটো কিশোরী স্তন বেরিয়ে আছে ফুলের মতো। সেই ফুলের রঙ আমার চেনা। মনে আছে সেই কত বছর আগে স্নানঘরে এমনই এক রঙ আমি দেখেছিলাম। কথামামীমার স্তনদুটির মতো, তবে অপুষ্ট। পুরুষের হাতের ছোঁয়ায় পরিণত হয়ে ওঠেনি এখনও। ওর ওপর শকুনের ধারালো দাঁতের ঠোকর পড়েনি। দুটি উজ্জ্বল স্তন, ফুলের মতো গন্ধ ছড়াচ্ছে ঠাকুরঘরে। এখন ঠাকুরঘরে শুধুমাত্র আমি, দিদা, ঝুমি আর কথামামী। বাকিরা বিভিন্ন দিকে খুঁজতে গেছে। ঝুমিকে এমন দেখে কথামামী একবার তাকালো আমার মুখের দিকে, তারপর ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দিদা ঝুমির জামা ঠিক করে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর ধীরে ধীরে উঠল মেঝে থেকে। প্রায় সমস্ত লজ্জার মাথা খেয়ে এই দৃশ্য থেকে যেন চোখ ফেরাতে পারছি না। ঝুমির দুটি বুক নয়, যেন এতক্ষণ আমার চোখের সামনে এক কবরস্থান, তারপর কাঁটাতার। সেই কাঁটাতারের ওপারে মরুভূমিটি। যার কোনও শেষ নেই। কেউ যেখান থেকে ফিরে আসতে পারেনি কখনও। আমি এই দৃশ্যের কাছে অসহায়, স্তব্ধ হয়ে আছি।
দিদা ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে নির্দেশ দিয়ে গেল। তার কণ্ঠ গম্ভীর, তবে রূঢ় নয়—
স্নান করে কাপড় পরে নাও। ফোঁটার লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে।


ভ্রাতৃদ্বিতীয়া
দীপ শেখর চক্রবর্তী

মন্তব্য

BLOGGER: 1
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,306,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: দীপ শেখর চক্রবর্তীর ছোটগল্প: ভ্রাতৃদ্বিতীয়া
দীপ শেখর চক্রবর্তীর ছোটগল্প: ভ্রাতৃদ্বিতীয়া
বিন্দু। বাংলা ভাষার লিটল ম্যাগাজিন।
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEghF7V22_CeVIhZifdyzjTk1-yJbzICmbyO7_K_3v-vdJ15GEGP2Ak_tlTuwdJ63BszOrbNg4VPTdKBVEQNm-BJl2bRl5cSly1wFXXg9S-wueFgC9sUv9vwVvyVXYxn6ntfpJ3tsOKBhjI6yKhRXoKrxw_RtxPeGfLC96YPmUicaB3SQI6yxjHSI_qB=w320-h180
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEghF7V22_CeVIhZifdyzjTk1-yJbzICmbyO7_K_3v-vdJ15GEGP2Ak_tlTuwdJ63BszOrbNg4VPTdKBVEQNm-BJl2bRl5cSly1wFXXg9S-wueFgC9sUv9vwVvyVXYxn6ntfpJ3tsOKBhjI6yKhRXoKrxw_RtxPeGfLC96YPmUicaB3SQI6yxjHSI_qB=s72-w320-c-h180
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/12/Deep-Sekhar-chakraborty-short-story.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/12/Deep-Sekhar-chakraborty-short-story.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy