এসএসসি পাশ করলে সাইকেল কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারলেন না আব্বা। প্রতিশ্রুতি ভাঙার মানুষ অবশ্য তিনি নন। কিন্তু যখন সাইকেল কেনার প্রস্তুতিপর্ব চলছে, তখন বড়মামা এসে গরম ভাতে জল ঢেলে দিলেন। তিনি তখনও ফতেয়াবাদেই থাকতেন। অফিস থেকে বাড়ি যাবার পথে মাঝেমধ্যে আমাদের দেখতে আসতেন। সাইকেলের কথা শুনে তিনি বিস্ময়াহত হয়ে নিষেধ করলেন। তাঁর বক্তব্য শহরে কত রকমের গাড়ি চলে, এখানে সাইকেল চালালে দুর্ঘটনা নির্ঘাত ঘটবেই। ভীত হয়ে আব্বা আম্মা মত পরিবর্তন করলেন। আমি এসএসসি পাশের কোন পুরষ্কারই পেলাম না। অথচ পরে বড়মামা যখন শহরবাসী হলেন এবং তাঁর পুত্র বেড়ে উঠল, তিনি নিজেই তাকে সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন স্কুলে পড়া অবস্থাতেই। তাঁর এই দ্বৈত আচরণ আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারিনি। সেই ক্ষোভ মেটাতে বুড়ো বয়সে সাইকেল কিনেও ছিলাম। কিন্তু বড়মামার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত করার জন্যে আমি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ডান হাঁটুর প্যাটেলা বিসর্জন দিতে বাধ্য হলাম। সে আরেক গল্প, পরে বলা যাবে।
কলেজ জীবনের সূচনা একটি বদ্ধ-শ্বাসরুদ্ধ-সমরশাসনের ভেতর। তবে, এখন মনে হয়, সেসময় অন্তত সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, নাস্তিক্যবাদ এসব নিয়ে প্রকাশ্যে যে আলোচনা করা যেত, সে অবস্থার চেয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশ অনেক বেশী মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকেছে। আমরা ক্লাসের ফাঁকে সময় পেলে বোটানি বিল্ডিংয়ের সামনে ঘাসে ঢাকা চত্বরে দাঁড়িয়ে মার্কস এঙ্গেলস নিয়ে কথা বলেছি। বিভিন্ন মতাদর্শের বন্ধুদের সাথে চিন্তার বিনিময় ও তর্কে লিপ্ত হয়েছি। যেমন সক্রেটিস তাঁর শিষ্যদের সাথে প্রশ্ন করতেন, যুক্তি দিয়ে প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাসকে নস্যাৎ করতেন, আমরাও সেই সতের বছর বয়সে নিজেদের ভেতরে আবিষ্কার করতে শিখেছিলাম সেই যুক্তির আলো এবং জ্ঞানের তেজ। ভোরবেলা ক্যাম্পাসে ঢুকতেই দেখতাম আর্টস বিল্ডিংয়ের পাহাড়ের দেওয়ালের মাথায় দাঁড়িয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বক্তব্য রাখছেন আবদেল মান্নান। তখন ততটা ভাল করে বুঝতাম না, পরে জেনেছি তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বলতেন। আরও বক্তা থাকলেও এই একজনই যেন স্মৃতিতে চিরকালের বক্তা রয়ে গেলেন। আজকের লালন ভক্ত সুফীবাদী আবদেল মান্নান সেদিন ছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তীর ভরা তুনীরের মতো।
চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হবার পরে একদিন আব্বা রসায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম স্যারের কাছে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানা গেল, স্যারের মেয়েও আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছে। প্রথম দিনেই সম্ভবত আমাদের বাংলা ক্লাস নিতে এলেন জামালউদ্দিন স্যার। এসেই রোল নম্বর ধরে হাজিরা নিতে লাগলেন। স্যারের বিচিত্র উচ্চারণে পনের হয়ে গেল “ফঁদরঅ”। আর এই রোল নম্বর যে ব্যক্তি ধারণ করে, সে কেমন এক বিদঘুটে ঘড়ঘড় উচ্চারণে জবাব দেয় “ইয়েস স্যার”। দুই বছরের শিক্ষাকালে স্যার কি পড়িয়েছিলেন তা মনে নেই। হয়ত রবিঠাকুরের হৈমন্তী তিনি পড়াতেন। তা আমাদের মনে রাখতে বয়েই গেছে। আমরা তার পরদিন থেকে উৎকন্ঠায় উদগ্রীব হয়ে বসে থাকতাম, কখন স্যারের সেই মহান উচ্চারণে রোল নং “ফঁদরঅ” আসবে। আর তা বলার সাথে সাথে শিষ্ট-দুষ্ট সকল ছাত্রই কোরাসে উচ্চারণ করে উঠতাম “ইয়েস স্যার”। যতদূর মনে আছে, শেষদিন পর্যন্ত জামাল স্যার জানতে পারেননি কেন তাঁর ফঁদরঅ ডাকার সাথে সবাই এমন করে চেঁচায়। হয়ত ভাবতেন আবদুল্লাহিল বাকীকে ভেঙাতে আমরা এমন করি। বাকী ছিল আমাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক নেতা। পরবর্তীতে মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আমরা যখন আন্দোলনে লিপ্ত হই, বাকী ছিল সর্বাগ্রে। আজকাল ভালবাসা দিবস খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এই দিবস ঘিরে ব্যবসা বাণিজ্যেরও বেশ বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু ১৯৮৩ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্যে ছিল একটি কালো দিবস। স্বৈরাচারী এরশাদের মন্ত্রী মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলো ছাত্রেরা। পরে এরশাদ সরকার ছাত্রদের এই শোকদিবস ও প্রতিবাদের দিবসকে ভুলিয়ে দেবার জন্যে শফিক রেহমানের হাত দিয়ে আমাদের সমাজে উপহার দেন পশ্চিমা পুঁজিবাদী সংস্কৃতির তথাকথিত ভালবাসা দিবস তথা ভ্যালেনটাইনস ডে। ভ্যালেন্টাইন ছিলেন সেকালের দেবদেবীর পূজারী রোমান সাম্রাজ্যের খ্রিষ্টিয় সন্ত, যাকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল খ্রিষ্টধর্ম পালনের জন্যে। সে অর্থে এইদিন শোকেরই হবার কথা। কিন্তু ভ্যালেনটাইন মৃত্যুর দিনে রেখে গিয়েছিল অন্ধ ছাত্রী জুলিয়ার জন্যে ভালবাসার একটি পত্র। এ কারণেই অথবা খ্রিষ্টকে ভালবেসে জীবন উৎসর্গ করার কারণে, পরে ৪৯৮ সালে তৎকালীন পোপ ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সন্ত ভ্যালেনটাইনের সম্মানে ভালবাসা দিবস ঘোষণা করেন।
আমার এই দিবসটিকে তাই উদযাপনে কিছুটা অস্বস্তি ছিল সব সময়। ১৯৮৩-র পরেও কলেজের আঙ্গিনায় মিছিল ছিলো, ঘাম রক্ত ঝরেছিল পথে; কোন্ কুখ্যাত শিক্ষানীতির নামে দুয়ো দিতে দিতে কতোদিন ফাটিয়ে দিয়েছি গলা; পায়ের নলার মজ্জা শুকিয়ে গিয়েছে সেই মিছিলে মিছিলে। জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহার লাল হয়ে ওঠা জামা অগ্নিশিখাসম জ্বলে উঠেছিল। ট্রাক উঠে গেলে সেলিম-দেলোয়ারের গায়ে — আমরা থামিনি, বাষ্পরুদ্ধস্বরে বলেছি দেবো না যেতে এমনি বৃথা সে লাল। মধ্য ফেব্রুয়ারি কাঞ্চন, আইয়ুব, ফারুক, মোজাম্মেল উড়ে গেলে অনন্ত ইথারে; আমাদের লাল গোলাপের শুভেচ্ছা জানাতে আসে সন্ত ভ্যালেন্টিন। তারপর থেকে বছরে বছরে দেলোয়ার, সেলিম, তাজুল, ময়েজউদ্দিন, স্বপনকুমার, নেত্রকোনার তিতাস, কোনো এক রিকশাওয়ালা, ফুটপাতের দোকানদার চুয়াডাঙ্গার ফজলু, রাজশাহী থেকে আশরাফ, সিরাজ ও আব্দুল আজিজ— এরকম কতো নাম না জানা ভাঁটফুল ঘাসফুল দলিত হয়েছে আর গুলিতে হয়েছে ঝাঁঝরা।
আরও পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের উপর হঠাৎ টেস্ট পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়, যা আমাদের আগের ব্যাচগুলোকে দিতে হতো না। তাই আমরা টেস্ট পরীক্ষা বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। নেতৃত্বে ছিল বাকী। কলেজের সকল দুয়ারে পাহারা বসিয়ে অতি আগ্রহী বন্ধুদের কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দেওয়ার যাবতীয় নীলনকশা এবং উদ্বুদ্ধকরণে ছিল বাকীর ভূমিকা। তবে অন্যরাও কেউ কম যেত না। চট্টগ্রাম কলেজ ছেড়ে আমরা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পরে জানতে পেরেছিলাম, বাকী সিটি কলেজে গ্রাজুয়েশনে ভর্তি হয় এবং সেখানেও সে অবিসংবাদিত নেতা। কয়েক বছর আগে বেশ অসুস্থ অবস্থায় বাকী এসেছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমার কর্মস্থলে। তারও বছরখানেক পরে সে পৃথিবীর আলো ত্যাগ করে।
চট্টগ্রাম কলেজের মনে রাখা শিক্ষকদের মধ্যে রসায়নের ডেমোনেস্ট্রেটর মোতালেব স্যারের কথা বলতেই হয়। স্যার প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁর উচ্চতার জন্যে। লম্বায় আমার চেয়েও একহাত উঁচু। এই দীর্ঘ শরীরের দীর্ঘ বাহু দিয়ে তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে লিখতে বুঝাতে চাইতেন রসায়নের নানান বিক্রিয়া। স্যার কেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে শরীরের সাথে অসমন্জস্য সাইকেল চালাতেন গুঁজো হয়ে। এসব হয়তো বিশেষ দ্রষ্টব্য হতে পারতো, কিন্তু আমাদের মন আকৃষ্ট হলো স্যারের মুদ্রাদোষের প্রতি। স্যার প্রায় ২/৩ মিনিট পর পর বলতে থাকেন “তাহলে হচ্ছে কী”। প্রথম দিকে রসায়নের বিক্রিয়ার কোন এক পর্যায়ে ‘তাহলে হচ্ছে কি’ শুনতে বেশ মানিয়ে যায়। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় অতিক্রান্ত হলে টের পাই, এটা বিক্রিয়ার ব্যাখ্যা জন্যে বলা নয়, বরং স্বভাবদোষে ক্রমাগত উচ্চারিত হচ্ছে ‘তাহলে হচ্ছে কি’, ‘তাহলে হচ্ছে কি’! ছাত্ররা টের পেতেই গুনগুন কথা শুরু হয় যা একসময় শোরগোলে পরিণত হয়। পরদিন থেকে আমরা ক্রিকেট খেলায় যেমন ঘর করে করে রান গণনা করে তেমন করে গুনতে শুরু করি কতবার স্যার ‘তাহলে হচ্ছে কি’ বলেন। এভাবে কোনদিন তিনি কোয়ার্টার সেঞ্চুরি করেন, কোনদিন হাফ সেঞ্চুরি করেন। যেদিন কোন কারণে সেঞ্চুরি করে ফেলেন সেদিন সারা ক্লাস জুড়ে যে হৈচৈ উল্লাস ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, মোতালেব স্যার কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ছেলেপিলেরা চিৎকার চেঁচামেচি তো করেই, কেউ কেউ জোরে শিস দিয়ে ওঠে ক্লাসের ভেতরেই। কিছুদিন এভাবে যাবার পরে স্যার এই অত্যাচার থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঘোষণা দিলেন, রোল কল করার পরে যাদের ক্লাস ভাল লাগে না, তারা ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ক্লাসে থাকলে ডিসটার্ব করা যাবে না। প্রথমে ইতস্তত করলেও রাজীব, ধীমান, রফিক সহ বেশ ক’জন বেরিয়ে গেলে আমরা প্রায় অধিকাংশ ছাত্রই একে একে বেরিয়ে পড়ি। সামনের দুই সারিতে বসা ছাত্রীগণ এবং কিছু তথাকথিত আঁতেল গোছের ছাত্র ক্লাসে থেকে যায়। বেরিয়ে আসার পরে বেশ একটা স্বাধীন স্বাধীন ভাব জাগে মনে। কিন্তু যখন ব্যাপারটা প্রাত্যহিকে পরিণত হলো, আমাদের এই স্বাধীনতা পানসে লাগতে থাকল। এরমধ্যে বান্দরের দল খুঁজে পেল একটা মোট লোহার নল কেমিস্ট্রি লেকচার গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এসেছে। তদন্ত করে দেখা গেল স্যারের টেবিলে থাকা বেসিনের সাথে তার সংযোগ। আমাদের মধ্যে কে প্রথম জানিনা, সেই নলের মুখে মুখ লাগিয়ে জোর গলায় “ঊ-ঊ-ঊ” ধ্বনিতে আওয়াজ দিলো, যা গিয়ে বেসিনের ফুটা দিয়ে গোঁঙ্গানোর শব্দে উচ্চারিত হয়। এভাবে স্যারের ক্লাসে বাইরে থেকেও ডিসটার্ব করার সুযোগ পেয়ে ব্যাপক আনন্দ হলো। তবে কিছুদিন পরে আমরা পুনরায় ক্লাসে থেকে যাওয়া শুরু করলাম এবং নিয়মিত স্যারের স্কোর গণনা করতাম একদম শেষদিন পর্যন্ত। আজ ভাল মানুষ স্যারটির জন্যে খুব মায়া হয়। অংকের সবিতা ম্যাডাম দৈর্ঘের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রস্থেও নিজেকে প্রশস্ত করেছিলেন। তাই তিনি যখন ব্ল্যাক বোর্ডে অংক কষতেন, তখন গ্যালারিতে ছাত্ররা কি করছে তা দেখা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তিনি বোর্ডে লেখা শুরু করলেই আমাদের নানারকম কার্যক্রম শুরু হয়ে যেত। একসময় ক্লাসে বসে থাকার ধৈর্য হারিয়ে ফেলি আমরা। যেহেতু মেইন বিল্ডিংয়ে ম্যাডাম যে গ্যালারিতে ক্লাস নিতেন, তার দরজা ছিল একেবারে পেছনেই, আমরা ম্যাডাম বোর্ডের দিকে ফিরলেই গ্যালারীর পেছন দিকে বসে থাকা একেক সারির ছাত্ররা হুড়মুড় করে বেরিয়ে যেতাম। ম্যাডাম হৈহুল্লোড়ের শব্দে ধীরে ধীরে ছাত্রদের দিকে ফিরতে ফিরতে সবকিছু শুনশান—সবাই শান্তশিষ্ট হয়ে বসে আছে দেখে নিশ্চিন্তে বোর্ডে অংক কষতে ব্যস্ত হয়ে যান। এভাবেই রোল কল শেষ হলে ১৫ মিনিটের মধ্যেই ক্লাসের জুয়েল ছাত্ররা বাইরে বেরিয়ে পড়তো।
২৮-১১-২০২১; সন্ধ্যা ৬.২৬; উত্তরা, ঢাকা
কোরাকাগজের খেরোখাতা (পর্ব ১৯)
জিললুর রহমান
জিললুর রহমান
মন্তব্য