বিসর্গের স্বপ্ন
বিপুল বিশ্বাশ
খুব ভাের বেলা ওঠে বিসর্গ। এ বাড়িতে এই প্রথম কেউ এত ভােরে উঠলাে। এখনাে। সূর্য ওঠেনি কোনাে বাড়ির মােরগও ওঠেনি। বিসর্গ উঠে পড়লাে। জামা প্যান্ট পরে হাঁটতে শুরু করলাে। গ্রামের এই পথটা এখনাে অন্ধকার। এখান থেকে বেশ খানিকটা হাঁটলে পাকা রাস্তা। বিসর্গ হাঁটতে থাকে। দু’পাশের বাগান রাস্তাটিকে আরাে অন্ধকার করে রেখেছে। শহরের পাকা রাস্তায় তার পায়ের স্পর্শ পড়লে ভােরের এক টুকরাে আলাে তার মুখে স্পর্শ করে। বিসর্গ পাকা রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকে। আরাে কিছুক্ষণ হাটার পর সে উপস্থিত হয় একটি দরজার সামনে। সে দরজায় আঘাত করতে থাকে।
— এই চন্দ্রবিন্দু বাড়ি আছিস? ঘুমাচ্ছিস না-কি? দরজাটা খােল আমি বিসর্গ। আরাে। কিছুক্ষণ দরজায় শব্দ করার পর চন্দ্রবিন্দু দুহাতে ঘুম মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে আসে। চন্দ্রবিন্দুর বুকটা ধুকধুক করতে থাকে।
— এই কী ব্যাপার? এত ভােরে? কী হয়েছে রে?
— ভাল আছিস? আমি একটু কাজে আসলাম বুঝলি?
— কাজ?
বিসর্গ প্যান্টের পকেট থেকে একটা কালাে রঙের ছােটো খাতা বের করে। সঙ্গে কলম।
— আচ্ছা চন্দ্রবিন্দু রাতে তুই কী স্বপ্ন দেখেছিস বলতাে?
— মানে?
— শােন্ এই যে খাতাটা দেখছিস এখানে আমি তাের এবং তােদের স্বপ্নগুলাে লিখে রাখবাে।
— ফাজলামাে করিস না। কী জন্যে এসেছিস বল । আমার এমনিতেই মেজাজ খারাপ। এত ভােরে আমি উঠি না। তুই এখন যা তাে। আমি ঘুমাবাে।
— চন্দ্রবিন্দু— দেখ তুই বল তুই কী স্বপ্ন দেখেছিস? আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখন লিখবাে না— শুধু শুনেই চলে যাবাে।
— বিসর্গ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস— তুই তাে অন্য সময় আসতে পারতিস তাই না ? তুই কী শুরু করেছিস এই সব?
— চন্দ্রবিন্দু প্লিজ.... তুই স্বপ্নের কথাটা বল— দেখ আমি শুনেই চলে যাবাে। চন্দ্রবিন্দু কিছুক্ষণ থামে। বিসর্গের চোখের দিকে তাকায়। সূর্যের সামান্য আলােয় বিসর্গের চোখ দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। চন্দ্রবিন্দু কী এক আবেগে যেন তার স্বপ্নটি বলার জয় তৈরী হয়ে যায়।
— আমি স্বপ্ন দেখেছি আমি আকাশে ভাসছি।
‘ধন্যবাদ’ এই বলে বিসর্গ সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। বিসর্গ সরাসরি বাড়ি চলে আসে। ওর ঘরে ঢুকে সে তার খাতা খােলে। এই কালাে খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠা শাদা। তারপর তার একটি পৃষ্ঠায় চন্দ্রবিন্দুর নাম লিখে একটা বড় ড্যাশ দিয়ে তার স্বপ্নটা লিখে রাখে। এবার সে বিছানায় শুয়ে পড়ে এবং একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন বিসর্গ সূর্য উঠার আগেই উঠে পড়ে। জামা প্যান্ট পরে সেই গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাে। রাস্তার দু’পাশের গাছগুলাে রাস্তাটিকে আরাে বেশি অন্ধকার করে রেখেছে। আজ তার মনে হচ্ছে সে যেন হাঁটছে না— কেউ তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে যখন শহরের পাকা রাস্তায় এসে উপস্থিত হয় তখন চারপাশে সামান্য ভােরের ছােঁয়া। বিসর্গ পাকা রাস্তা বরাবর হাঁটতে থাকে। আরাে কিছুক্ষণ হাটার পর সে উপস্থিত হয় একটা দরজার সামনে। সে দরজায় শব্দ করতে থাকে।
— এই অনুস্বার বাড়ি আছিস? ঘুমাচ্ছিস না-কি? দরজা খােল। আমি বিসর্গ।
বিসর্গ কিছুক্ষণ থামে তারপর আবার শব্দ করতে থাকে। শব্দ শুনে অনুস্বারের মা বেরিয়ে আসে।
— কী হয়েছে বিসর্গ, এত ভােরে? কী হয়েছে?
— না না কিছু না— অনুস্বার উঠেছে?
— না- ওতাে সকাল দশটার আগে ওঠে না। তুমি এগারোটার দিকে এসো।
‘আচ্ছা’ এই বলে বিসর্গ চলে যেতে থাকে। সামান্য এগোতেই পিছন থেকে সে অনুস্বারের ডাক শুনতে পায়। বিসর্গ থামে, পিছনে তাকায়। বিসর্গ আসার আগেই অনুস্বার এগিয়ে আসে।
— বিসর্গ তাের জন্যে আমার ঘুম হয়নি তুই জানিস?
— আমার জন্যে? কেন?
— তুই যে চন্দ্রবিন্দুর বাড়ি গেছিস তা শুনেছি। তুই যে আমার বাড়ি আসবি তাও। যেই ঘুম আসে সেই মনে হচ্ছে তুই দরজায় শব্দ করছিস— এটা ভেবেই আমার বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। এই ভাের বেলা যখনই একটু ঘুম এসেছে তখনই আমার ঘুমটা ভেঙে দিলি?
— আমি দুঃখিত অনুস্বার তুই রাতে যে স্বপ্নটা দেখেছিস সেটা বল— আমি শুনেই চলে যাবাে।
— আমি কিন্তু স্বপ্নে কী দেখেছি তা বলতে আসিনি। আমি এসেছি রাগে-ক্ষোভে। তুই এই সব কী শুরু করেছিস বলতাে? তুই বাড়ি বাড়ি গিয়ে এইভাবে মানুষজনকে ডিস্টার্ব করছিস। যাই হােক আমি কোনাে স্বপ্ন দেখিনি তুই এখন যা।
— প্লিজ অনুস্বার তাের স্বপ্নটা বল। আমি কথা দিচ্ছি আমি আর তাের দরজায় আসবাে না । অনুস্বার বুঝতে পারে বিসর্গের কণ্ঠস্বর কেমন যেন বদলে গেছে। সে ওর চোখের দিকে তাকায়। সূর্যের সামান্য আলােয় বিসর্গের চোখ দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। অনুস্বার কী এক আবেগে যেন তার স্বপ্নটা বলার জন্যে তৈরী হয়ে যায়।
— আমি স্বপ্ন দেখেছি আমি সােনার খনি পেয়েছি।
‘ধন্যবাদ’ এই বলে বিসর্গ সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। বিসর্গ সরাসরি বাড়ি চলে আসে। ঘরে ঢুকে সে তার খাতা খােলে। তারপর একটা শাদা পৃষ্ঠায় অনুস্বারের নাম লিখে একটা বড় ড্যাশ দিয়ে অনুস্বারের স্বপ্নটা লিখে রাখে। এবার সে বিছানায় শুয়ে পড়ে এবং একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন বিসর্গ সূর্য উঠার আগেই উঠে পড়ে। জামা প্যান্ট পরে সেই গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাে। রাস্তার দু’পাশের গাছগুলাে রাস্তাটিকে আরাে বেশি অন্ধকার করে রেখেছে। সে যেন কী এক আবেগে এগিয়ে চলেছে। পায়ের স্পর্শ মাটির ওপর পড়লেও মনে হচ্ছে তার পা যেন কোথাও পড়ছে না। গ্রামের পথ শেষ হলে সে শহরের রাস্তায় পৌছে যায়। আরাে কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে আজ অন্য একটি দরজার সামনে উপস্থিত হয়। দরজায় যখনই সে শব্দ করতে যাবে তখনই দরজাটা খুলে যায়। তারপর বিসর্গ শুনতে পায়।
— আমি স্বপ্নে দেখেছি একটা লম্বা ফর্সা ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।
এই কথাটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। বিসর্গ যেন হঠাৎ আবিষ্কার করে তার গায়ের রঙটা কালাে এবং সে খুব একটা লম্বা নয়। কিন্তু দরজাটা দ্রুত বন্ধ হওয়ার কারণে তাকে ধন্যবাদ দিতে পারে না। বিসর্গ সরাসরি বাড়ি ফিরে আসে। ঘরে ঢুকে সেই খাতার একটা পষ্ঠায় ‘ঝ’ এর নাম লিখে একটা বড় ড্যাশ দিয়ে তার স্বপ্নটা লিখে রাখে। এবার সে বিছানায় শুয়ে পড়ে এবং ঘুমিয়ে পড়ে।
কয়েকদিনের মধ্যেই বিসর্গ কিছু পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়। যখনই সে ভাের বেলায় বের হতে গেছে তার মা তাকে বাইরে যেতে বাধা দিয়েছে এবং বলেছে— ‘আমি যেন আর না শুনি যে তুই অন্য মানুষের বাড়ি গিয়ে ভাের বেলা তাদেরকে জ্বালাতন করছিস।’ রাস্তায় কেউ কেউ তাকে বলেছে— ‘কি বিসর্গ— স্বপ্নের সন্ধানে যাচ্ছ বুঝি? তা আমি গত রাতে কী স্বপ্ন দেখেছি সেটা লিখবে না?’ রাস্তায় যাওয়ার সময় আরাে কেউ কেউ বলেছে- ঐ দ্যাখ্ পাগলটা যাচ্ছে মাথাটা একদম গেছে। বিসর্গ সব শােনে, কোনাে মন্তব্য করে না। একদিন মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভাের বেলা সে আবার বেরিয়ে পড়ে। সে এসে উপস্থিত হয় চন্দ্রবিন্দুর দরজার সামনে। দরজায় শব্দ করতে থাকে। তখনই তার চোখ যায় দরজায় লেখা— দরজায় শব্দ করা নিষেধ। বিসর্গ আর দরজায় শব্দ করে না। সে বাড়ি ফিরে আসে এবং তার নিজের ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সে অনুস্বারের বাড়ির দরজায় গিয়ে দেখে সেই একই কথা লেখা— দরজায় শব্দ করা নিষেধ। সে বাড়ি ফিরে আসে এবং তার নিজের ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন ভােরে সে ‘ঝ’ এর বাড়িতে একই লেখা দেখে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ে। বিসর্গ ভাবে এবার সে স্বপ্নের মধ্যে তাদের বাড়ি যাবে এবং তাদের স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করবে। সে প্রথমে স্বপ্নের মধ্যে চন্দ্রবিন্দুর বাড়ি গেল। চন্দ্রবিন্দুর দরজায় শব্দ করলাে। চন্দ্রবিন্দু বাইরে বেরিয়ে এসে তাকে যাচ্ছেতাই বকাবকি করলাে এবং এক প্রকার তাড়িয়েই দিলাে। বিসর্গ এবার স্বপ্নের মধ্যে অনুস্বারের বাড়ি গেল এবং অনুস্বারও দরজায় শব্দ শুনে বাইরে এসে বিসর্গকে বকাবকি করলাে এবং তাকে তাড়িয়ে দিলাে। এবার সে স্বপ্নের মধ্যে ‘ঝ’ এর বাড়ি গেল। ‘ঝ’ বাইরে এসে তাকে বকাবকি করলাে, অপমান করলাে এবং তাড়িয়ে দিলাে। স্বপ্নের মধ্যেই বিসর্গ বাড়ি ফিরে আসে এবং স্বপ্নের মধ্যেই সে তিনটি চিঠি লেখে। চন্দ্রবিন্দুকে লেখে— তুই আকাশে ভাসবি ক্যান? এই দেশ ছেড়ে কোথায় যাবি তুই? অনস্বারকে লেখে— তুই সােনার খনি দিয়ে কি করবি? তাের তাে টাকা-পয়সার অভাব নেই তাের। সােনার খনির দরকার কি? ঋ-কে লেখে— তুমি যদি ফর্সা ও লম্বা ছেলেকে বিয়ে করতে চাও তবে অন্যান্য মেয়ের সাথে তুমি আলাদা কোথায়? তিনটি চিঠি লিখে বিসর্গ স্বপ্নের মধ্যে একটি স্বপ্নের ডাকঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর চিঠি তিনটি ডাকবাক্সে ফেলে। স্বপ্নের মধ্যে সে বাড়ি ফিরে আসে কিন্তু তার নিজের ঘরটা খুঁজে পায় না। তার মা-বাবার ঘর আছে কিন্তু তার স্বপ্নের ঘরটা নেই। এবার সে স্বপ্নের মধ্যে ঐ একই জায়গায় একটি স্বপ্নের ঘর তৈরী করে এবং ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানায় গিয়ে সে স্বপ্নের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে।
রচনা: ৩১.০৫.২০১৩ শুক্রবার
সুন্দর গল্প। বিশ্বাশ কি বিশ্বাস হবে, নাকি বিশ্বাশ-ই?
উত্তরমুছুনলেখক এই বানানই লিখেনঃ বিপুল বিশ্বাশ৷
মুছুন