দুইটি কবিতা
অমিতরূপ চক্রবর্তী
দাঁত
টেবিলের ওপর তোমার আমার দু’পাটি আঙুল। সুযোগ পেলেই এ অন্যকে খেয়ে ফেলবে। এখন নিজেদের অর্ধে শান্ত হয়ে আছে। তোমার আমার মুখমণ্ডল, গলার পেশী নিজেরা নিজেদের মতো জীবন্ত হয়ে উঠে কথা বলছে, হাসছে। চকিতে দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের আপাত সুন্দর দাঁত। গার্ডওয়ালের ওপারে সমুদ্র যেভাবে ঢেউ তুলে, ঢেউ ভেঙে নিজে কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই উচ্ছ্বসিত হয়- তেমন। ভেসে আসা জাহাজের দেহাংশের মতো কত বিষয়ে আমরা তখন কথা বলছি। তোমার স্তনের ওপরে একটা কালো সুতির গোলাপ কেমন নিরুদ্বিগ্ন হয়ে ফুটে আছে। টেবিলের ওপরে আমাদের দু’পাটি আঙুল। যেন আমাদের সঙ্গে ওদের কোনো যোগ নেই। যেন স্বতন্ত্র, স্বাধীন কোনো দেশ। আলাদা শাসক। আলাদা ব্যবস্থা। সীমানায় ঘন পাইনের বন। অতঃপর জলরাশি। তোমার চোখের সঙ্গে কখনো আমার চোখের সংঘাত হচ্ছে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে একেকবার আমার চোখের মণি। ফের সংঘাত হচ্ছে। ফের আবার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এটুকু বাদ দিলে আমাদের মুখের পেশী, গলার পেশী যে যার মতো জীবন্ত। তারা উল্কাপাত ভরা আকাশ মাথায় রেখে সীমিত আয়ুর যে কোনো মানুষের মতো কথা বলছে, হাসছে। দাঁতের শক্তি প্রদর্শন করছে
কখনো এভাবে যখন আমরা মিলিত হয়েছি, বাইরে দোল-খাওয়া সরু সুতোর বৃষ্টি ছিল। আমাদের পরপারে অবশিষ্ট পৃথিবীর আভা। বার্থডে টুপির মতো টুপি পরা দরদালান। দিন পরবর্তী দিন বা তারো পরবর্তী দিনগুলি বয়ে যাবার মতো প্রশস্ত সব রাস্তা। পাতলা টিনের তৈরি সব যানবাহন- তাদের কপট রাগ, বয়েসের আভিজাত্য। ঠিক যেন তুমি আমি। অ্যাতো বিভাজ্যতার পরেও যারা নিজেদের ভাবি কত না নিয়ন্ত্রিত, কত না সুশৃঙ্খল। সত্যিই কি তাই? তুমি মুখ ঘুরিয়ে যখন বাইরের পূর্ণ শূন্যতার দিকে চেয়ে থাক, আমি তখন দেখি তোমার গলার মূলে গ্রন্থির মতো একটা পুরনো জড়ুল। পুরনো? হবে হয়তো। অনেক দিনের পুরনো। অনেক যুগ, যুগাবসানের। বৃষ্টি ধরে গেলে ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের দৃশ্যটা অনেকটা যেন মানুষের মুত্রত্যাগের দৃশ্য। সভ্যতার গায়ে যেন পেচ্ছাপ করছে। কেন? সে কি আলাদা বা ভিন্নতর বা বলা ভাল অন্য অবয়বের কোনো সভ্যতায় বিশ্বাস করে? ক্ষিদে নেই, যুদ্ধ নেই, নিধন নেই- তেমন? ইঁদুর- ধরা কলের মতো সংসারও কি থাকবে সেখানে? যে সংসার তোমাকে আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়? আমি হয়তো এইসব ভাবি, অথচ টেবিলে তোমার আঙুলের নিকটে আমারই আঙুলগুলো কী শান্ত! যেন স্থির হয়ে জ্বলা মোমের শিখা
এখনো নিজের অর্ধে কেমন সৈন্যবাহিনী সাজিয়ে চুপ করে আছে
বীণা
অসুখের পর তুমি একটা চেয়ারে বসেছিলে। কেমন একটা পেট ফুলে ওঠা ব্যাঙের মতো লাগছিল তোমাকে। ঘরে যেসব আলো প্রতিদিন আজ্ঞাবহ অথবা হতবাক হয়ে জ্বলে, তেমনই জ্বলছিল। তোমার পেছনে যে চিকচিক করা বহুদূর বিস্তৃত ক্রমোচ্চ বালিয়ারি- তুমি আঙুল ঘুরিয়ে বোঝালে সেটাই আসলে তোমার অসুখ। তোমার অস্পষ্ট ফুলের ছাপ দেওয়া যে পোশাক, তাকে আমার পিচ্ছিল ব্যাঙের চামড়ার মতোই মনে হয়েছিল। আমি কাপ থেকে কয়েকটি তরল সপ্তাহের মতো চা খেতে খেতে তোমার কথা শুনছিলাম। কখনো আমার মনে হচ্ছিল, যেন আমি সেইসব মানুষের সম্প্রদায় থেকে তোমাকে দেখতে এসেছি, যারা মুখের বদলে কেবলই মাংসের দ্যুতি দেখতে আসে। হতেও পারে। আমি কি নিজের বিষয়ে নিঃসংশয়? কেউ কি নিজের বিষয়ে নিঃসংশয়? তুমিও কি তোমার বিষয়ে নিঃসংশয়? তোমার গন্ধ, ভাবনার সীমানা আগলে রাখা যে সদাসর্বদা সশস্ত্র দেওয়াল, তার ওপারে হয়তো আকাশে একটা যেমন তেমন, গায়ে ঢেউ আসা চাঁদ। রাস্তায় আগুনের হলকা থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে ছুটতে থাকা জীবজন্তুর মতো গাড়িঘোড়া। হাতে হাতে চলমান বিনিময়। নিরুদ্বিগ্ন পাতার মতো সকল পুরুষাঙ্গ আর অসংখ্য হিরণ্ময় যোনি। তুমি অসুখের পর একটা বেপথু ব্যাঙের মতো চেয়ারে বসে হয়তো নিজেই নিজের শূন্যতায় এগিয়ে ভাবছ এ কেমন বাঁক অথবা সমাপতন? দৈন্যে কেন কূট দৃষ্টির সামনে আসতেই হয়?
তোমার সমুখ থেকে অদৃশ্য হবার আগে দেখি তোমার অন্য একটি দরজার ওপারে কী সমুজ্জ্বল আলো। ওই আলোর মধ্যে নিশ্চয়ই তোমার নিকটস্থ যারা, একমাত্র তারাই যেতে পারে। এই যে তোমাকে দেখলাম, তা আসলে প্রকৃত তুমিই নও। প্রকৃত তুমি থাক ছটফট করা এক খাঁচার ভেতরে, একটি উষ্ণ গোল আত্মার ভেতরে। দাঁত দিয়ে শেকল কাটার চেষ্টা করা এক ভয়ালদর্শন প্রাণির ভেতরে। পাতলা স্লিপার আর একজোড়া জুতোর ভেতরে। লাবণ্যহীনতায় ভুগছে যে বারান্দা, তার কণ্ঠার ভেতরে। অপ্রকৃত তুমি আমার পেছন পেছন আসো নেমে যাওয়া সিঁড়ি পর্যন্ত। তখন আমার মনে হয়, এই সিঁড়ি যতটা নামার তার থেকেও যেন আরো আরো বেশীই কোথাও নেমে গেছে। আমি নেমে যেতে যেতে দেখি ব্যবচ্ছেদ করার আগে যেমন, তেমনই একটি ব্যাঙ দরজা অধিকার করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাইরে তখন সগর্জনে চলছে বিনিময়। প্রাণ বাঁচিয়ে ছুটে যাচ্ছে গাড়িঘোড়া। কিছুটা মেঘ নিজের চারপাশে জড়ো করে একটা যেমন-তেমন, গায়ে ঢেউ আসা চাঁদ নজরে পড়ার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে সামান্য নেমে আসা চিরস্থির আকাশে ভেসে আছে। নিরুদ্বিগ্ন পাতার মতো পুরুষাঙ্গ আর অসংখ্য হিরণ্ময় যোনি অতীতমানে নামিয়ে রাখছে আরো একটা উল্লসিত দিন। আমি জানি, প্রকৃত যে তুমি- তুমিও এর কম বা অধিক নও। নিজের সীমানায় ঝাউগাছের নীচে পরিষ্কার বালুর মতো তুমিও খাদকের আগে আগে খাদ্য হয়ে ছুটতেই ভালবাসো
কে বলতে পারে। তুমি কি তোমার বিষয়ে নিঃসংশয়? আমিই কি আমার বিষয়ে নিঃসংশয়?
বাহ, বেশ ভালো লাগলো!
উত্তরমুছুন