উৎপলকুমার বসু : শাশ্বত সম্ভাবনার বিন্যাস
চঞ্চল নাঈম
দক্ষিণে হাওয়া বয়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে হাওয়ার বাঁক। বাঁকে মধ্যে উৎপলকুমার বসুর বাক্যচিন্তা নিরিবিলি উপলব্ধির ঘুম অতিক্রম করে। উৎপলকুমার বসু ৩ আগস্ট, ১৯৩৭ সালে ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন।কিন্তু অল্প বয়সে তাঁর মা মারা যাওয়ায়, ছেলেবেলার অধিকাংশ সময় কেটেছে কুচবিহারের দিনহাটায়, মাসির কাছে। দিনহাটার রূপকার কমল গুহ মহাশয়কে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর উৎপলকুমার বসু আবার কলকাতায় চলে যান। সেই সাথে ছাত্র থাকার সময় থেকে লেখালেখির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
তবে আলোক সরকার, কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রকাশ কর্মকার এবং ভূমেন্দ্র গুহের মতো কবিবন্ধু সঙ্গে যুক্তভাবে তিনি এক সময় সম্পাদনা করেছেন কবিতা ও কবিতাবিষয়ক ভাবনার পত্রিকা ‘দরগারো’। কিন্তু প্রথম দিকে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৩ অক্টোবর, ২০১৫ সালে কলকাতায়। হাংরি আন্দোলনের কবিতাচিন্তায় নিজেকে যুক্ত করেন আর পাশাপাশি নিজস্ব চৈতন্যের ধারণায় কবিতা লিখতে থাকেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’(১৯৬১) প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ বারংবার হৃদপানিতে খেলা করে। সমসাময়িক কবিতা থেকে তাঁর কবিতার প্রকাশভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন। হাংরি আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে উৎপলকুমার বসুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। সেই কারণেই যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপনা থেকে তিনি সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। তবে, কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন বটে কিন্তু কবিতার জন্য কোন পরিস্থিতিতে আপোষ-রফায় স্বাক্ষর করেননি। তাইতো, তিনি এক সাক্ষাৎকারে কবিতা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, আকাদেমিয়ার থেকে কবিতা অনেক বেশী অরগ্যানিক। বিশেষত, আমি এবং আরও হাতে গোনা কয়েকজন এই অরগ্যানিক ব্যাপার স্যাপারগুলোকে ছুঁতে চেয়েছি। একই সাক্ষাৎকারে তিনি প্রেম বা কাম সস্পর্কে দৃষ্টিপাত করেন। মেটাফিজিকসেরও বিরাট গুরুত্ব এইখানে। এখানে বলতে ভারতবর্ষে। এখানকার শিল্পচর্চার মেটাফিজিকাল বোধ ইন্দ্রিয় চেতনায় বরাবর খুবই কেন্দ্রে থেকেছে। মেটাফিজিকসের চর্চা ভারতবর্ষীয়রা বারংবার করেছে। স্থাপত্য, ভাস্কর্য থেকে শুরু করে মহাকাব্যেও। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্যামলবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। আমি ওনাকে বলছিলাম ভারতীয় মন্দির শিল্পে এত কিছু আছে। কামকলা আছে, শিকার আছে অথচ কৃষি নেই। এগুলিই হচ্ছে ব্যাপার। যামিনী রায় বলতেন সারা পৃথিবী দুভাগে ভাগ ভারত এবং অ-ভারত। এখানে আমার একটা সংযোজন আছে। ভারতবর্ষীরা কখনই এটা ভারত ওটা অ-ভারত এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ভারতবর্ষ একটা বিচিত্র দেশ। আমরা নতুন কিছু দেখলে বিস্মৃতি হয়েছি। নতুন কিছু কিভাবে আত্মস্থ করা যাবে, ভেবেছি যেহেতু আমাদের চিন্তা অরগ্যানিক। ইন্দ্রিয়চেতনা আমাদের স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা আরোহণ করতে পারি আর তাই আমাদের ভাবনা বিস্তর। এই যে এতোসব কথাবার্তা তুলে আনলাম। তার কারণ উৎপলকুমার বসুর সমকালীন অভিজ্ঞতা আর চিরন্তন অনুভূতিকে বোঝার জন্য। বুঝতে পারি, বাংলা কবিতায় সহজ-সরল অনন্য রচনাশৈলী তৈরীতে তাঁর ভ‚মিকা অন্যতম। চিন্তার ভাঙচুর আর কবিতার ভাষা নিয়ে তাঁর নিবিড় ভাঙাগড়ার খেলা, কবিতাকে অন্যরকম স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাইতো কোনও নির্দিষ্ট প্রজন্মের চাহিদায় আবদ্ধ না হয়ে তাঁর কবিতা ও গদ্যসমূহ, প্রজন্মোত্তর সৃষ্টিশীল মননের রসদ যোগায় সব পাঠকেরই। তাই চিরকালীন কবিতা প্রেমী আপামর বাঙালিরা তাঁর কবিতার স্বর শুনেছেন- ‘ডুবো নদীর তীরে জলের অধিকারে আঙুল ছোঁয়ার স্পর্ধা পেয়েছে’। এমন সব অনুভ‚তি সাবলীল ভাবে জগৎকে-জীবনকে গ্রহণ বর্জনের প্রকাশভঙ্গিতে দেখার ভিন্নতায় আনয়ন করেন। চিরচেনা প্রকরণ ভেঙে তাঁর কবিতাগুলো নানান অভিজ্ঞতার অবয়বে ভাসে-
রূপনগরেতে চলো।সে-দেশে ধুলোয় সবার নিভৃত নাম লেখা আছে।যে-নামে তোমায় পুরনো বন্ধুরা চেনে এখনি বাতাসসেই নাম ডেকে গেল। রূপনগরের পাঁচিলে না হয় বসোকিছুক্ষণ- দুটি পায়রার পাশাপাশি।[প্রান্তর থেকে]
রূপনগরে কার নাম লেখা আছে? আর কে সেই বাতাস যে নাম ধরে ডেকে গেল? তারই কি উদ্দেশ্য ছিল? এমন বহুরূপ প্রশ্ন রূপনগরের পাঁচিলে বসে। হয়তো কিছুক্ষণ কথা হয়, হৃদয়ের নিভৃতে যেন কাছাকাছি বসে। উৎপলকুমার বসু এমনই এক কবি যিনি পাঠকের চেনা জগৎকে পুনরায় উসকে দিতে পারেন স্মৃতির স্পষ্টতায়, চিরন্তন মানবিক সংবেদনশীলতায়। পাঠক নিজস্ব অনুভব খুঁজতে থাকেন কবিতার নানাবিধ পঙক্তিতে-
ফিরে এসো লেখার টেবিলে। এইখানে জন্মেছিলে।এখানেই শেষ দেখে যেও।যারা বোধি নিয়ে কথা বলে, বোধবুদ্ধি নিয়েহাসিঠাট্টা করে, তারা হে কেমন লোক?যে-প্রাণ নিভৃত হয় তাকে সখা আমিও দেখছি।লেখার টেবিল যেন, পড়ে আছে ভাঙাচোরা সন্ধ্যার বাগানে।[সৌরলতা]
কবিতার পঙক্তিসমূহ ইঙ্গিতপূর্ণ। যেন কবিতাকেই ফিরে আসার আহ্বান করেন। সচেতনভাবেই বিস্তীর্ণ করেন কবিতা-সম্পর্ক। প্রকরণগত কবিতার ধারণা দুর্বোধ্য বা রহস্যময় না করে বলে গেলেন সমসাময়িক নিজের আখ্যান। আর সেইসাথে পাঠকের নিকটে শাশ্বত সম্ভাবনার পথ মেলে ধরেন এবং তাঁর কবিতার স্বপ্ন-পথে ধু ধু বিন্যাসের একাধিক আবহ থাকে-
সমস্ত সন্ধ্যা ভরে লুব্ধকের পিছু পিছু দেখা যায় সমুদ্রমন্দিরটানো তুমি, এখন সন্ধ্যা ভরে অদ্ভুত জোয়ার এল, বসন্তও সমাগত ঐতোমার বিশাল বাড়ি ভেঙে ফেলে লাখো লাখো জানালা উঠেছেবসন্তকর্ণিক হাতে কারিগর পুরুষ এনেছি।[পুরী সিরিজ]
নিজস্ব ঢঙ আর শব্দের মনোরঞ্জনে কবিতার সমাগত পথে একা একা হেঁটে চলেন। কবিতার শব্দগুলো সচেতনভাবে প্রেমময় বসন্তের কারিগর হয়ে ওঠে। এভাবেই কবিতার প্রতিটি ইঙ্গিত স্পন্দনে চুরমার করে সুহৃদ-আকুতি। আর দ্বন্দ থেকে বেড়িয়ে আসে লাখো লাখো দৃশ্য। প্রতিটি দৃশ্য যেন কবিতার পরম্পরা। তাই দৃশ্যমান সরল লিখনভঙ্গিমায়, উৎপলকুমার বসু অন্যের থেকে পাঠকের নিকট আগ্রহের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। তবে বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা উৎসব-এর আমন্ত্রণে উৎপলকুমার বসু ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় এসেছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি জহির হাসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জাহিদ হাসান মাহমুদ যৌথভাবে উৎপলকুমার বসুর এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজের লেখার অনুসঙ্গ নিয়ে বলেন- ‘আমার লেখায় খুব চিন্তা-টিন্তা কিছু নেই। উচ্চচিন্তা কিচ্চু নেই। আমার হচ্ছে সাধারণ-যাকে বলে স্ট্রিট রিয়ালিটি। সেসব চিন্তাই আমার লেখায় আছে। উচ্চমার্গীয় কোনো চিন্তা আমার লেখায় নেই’। কিন্তু আমরা তাঁর লেখায় চলমান জীবনের নানাবিধ বিষয়-আশয় দেখি যা জীবনানন্দ পরবর্তী কবিতাতে এমন সহজভাবে উপস্থাপন কমই আছে। তবে কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে তাঁর কবিতা ও গদ্য সমূহ দিনদিন পাঠকের চলমান মুখরতার সম্ভাবনা।
কবি মাত্রই নেপথ্যে একা একা হেঁটে চলেন। আর সে যদি হন উৎপলকুমার বসু, বলতে হয় তাঁর সেই হেঁটে চলা আজ বাংলা কবিতার ইতিহাসে, অনেকটা সন্তর্পণেই, ভিন্ন এক ধারার সৃষ্টি করেছে। সে ধারায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার আছে আমাদের।
উত্তরমুছুনগদ্য ভালো লেগেছে। আপনার লেখনী সবসময়ই অনন্য।