জার্নাল : নভেম্বর ২০২১
মাহফুজুর রহমান লিংকন
এক শ্রেণীর মানুষ আমার কাছে বড়ই বিরক্তকর… এরা না বুঝে, না জেনে সবজান্তার ভাব ধরে নিজেকে ‘পণ্ডিত’ রূপে হাজির করতে লিখতে বসে যান। এই শ্রেণী অত্যন্ত ক্ষতিকর! আমি এই শ্রেণীকে এড়িয়ে চলি… এমনিতেই গলাগলি-দলাদলি আমার পছন্দের না, তবে এই এড়িয়ে চলা; গলাগলি-দলাদলির বাহিরেও আর এক আমি, বরাবর আড্ডা প্রিয় মানুষ…
সে আড্ডা কখনো শিল্পী-সাহিত্যিকের সাথে- কখনো নিজের সাথে… কখনো কবিতার সাথে… অনেক কবির কবিতাই আমাকে টানে, আমার রক্তের সঞ্চালন প্রকৃয়া ঠিক রাখতেই আমি কবিতার প্রেমে মাতি… প্রশ্ন আসতেই পারে- ‘এই যে মাতামাতি সেটা কোন টাইপের?’ খুব সরলভাবেই বলি- সকল কবিতাই আমাকে টানে তবে, কিছু-কিছু কবিতা একটু বেশিই মহামায়ার রূপে আমাকে মাতিয়ে রাখে…
উপমার ভারে ভারাক্রান্ত কবিতার শরীর আমার পছন্দের না! যখন কেউ উপমা দিয়ে কবিতার শরীরকে ভারী করে তোলে তখন আমার কাছে বড় ক্লান্ত লাগে।
বাবা, কবরের পাশ থেকে এক পা দু’পা করে এসেছি যেমনিঠিক সেইভাবে তোমার আমার দূরত্বও কি বেড়েছে?(শব্দস্নাত/চঞ্চল নাঈম)
এই যে সরল স্বীকারোক্তি, এই যে নিজের সাথে নিজের দূরত্ব মেপে দ্যাখার প্রশ্নবোধক কথার শরীর, এটাই আমাকে মুগ্ধ করে…
আমি এর আগে আমার একটি লেখায় বলেছিলাম- পাঠক এখন নিজেই অনেক বোদ্ধা! আপনি ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ’ বলতে চান, কিন্তু পাঠককে চাঁদ না দেখিয়ে (তাঁর মস্তিষ্কের ভিতরে) যদি বাঁশ বাগানের মাথার উপর সুতাকাঁটা একটি ঘুড়ির ছবি দেখান। তাহলে পাঠক এতো বোকা নয় যে আপনাকে মেনে নেবে। কবিতায় বহুমাত্রিকতা থাকতে হয়, এটা সত্য, তাই বলে- উপমা দিতে-দিতে, কবিতার গভীরতার দোহাই দিয়ে, আপনি কবিতার শরীর ভারী করে শুইয়ে দিবেন আর আমার/পাঠকের পছন্দ না হলে, সব দোষ আমার/পাঠকের এটা কামনা নয়!
পরের কথা, আধুনিক কবিতার নামে কবিতার শরীর ক্যামন হবে না বুঝে- শব্দের অযাচিত ব্যবহার করে ; খালি গালি; খালি কয়টা সমার্থক শব্দ দিয়ে কবিতাকে সাজালেন! এটা পাঠকের প্রতি অবিচার করলেন না? নাকি আপনার যেটা মনে চায় লিখে দিলেন, সেটাই কবিতা? কেউ-কেউ মেনে নিতেই পারে (মনে রাখা ভালো,মেনে নেয়া আর মনে নেয়ার মধ্যে বিস্তর দূরত্ব) আমি মেনে নিতে পারিনা।
অন্যদিকে কথার বাঁক নিয়ে বলা যায় বিপরীতমুখী কথা- জীবনব্যাপী কবিতা লিখলেন, কবিতায় নতুন-নতুন এক্সপেরিমেন্ট করলেন, আপনার শব্দের ব্যবহার শৈলীতে অনেকেই মুগ্ধ, কিন্তু আপনি কবিতারে ভালবাসেন না। সেই গন্ধ আমি ক্যামনে যেন পেয়ে যাই। আমার কাছে কেবলি মনে হয়, কবিতাকে ভালো না বাসলে কবিতা কবির কাছে ধরা দিয়েও ছুঁতে দেয় না। কবি চঞ্চল নাঈম কিছুদিন আগে এসেছিলেন, কবিতার প্রতি তার কি তুমুল ভালোবাসা…কবিদের কবিতার প্রতি এই নির্মোহ ভালোবাসা তার কবিতাকে আরও সুপুষ্ট করে তোলে বলেই আমার বিশ্বাস। কবির শ্রম-সাধনা-শাস্ত্রবিধি -ভালোবাসা মিশে একাকার হয়ে যায় কবিতায় তখনি কবিতার শরীর পাঠককে জড়িয়ে ধরে…সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় প্রয়োজন ছাড়া দ্বিতীয়বার পাঠক ঢুঁ মারেন না কিন্তু কবিতায় সম্মোহন কাজ করে তাই কবিতার শরীর যখন পাঠককে জড়িয়ে রাখে তখন পাঠক জীবনদর্শনের রং খুঁজে পেতে বারবার কবিতার দিকে ছুটে যান। খুব মনে পরছে প্রয়াত কবি মিজান খন্দকারের কথা, আমাকে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- “আধুনিক বিশ্বে রোবটিক মানুষের সময়ের ব্যয়ে যে নতুনত্ব চিন্তাবোধ জন্মাচ্ছে, সেখানে সাহিত্য মাধ্যমের আর কিছু টিকে থাকবে না, শুধু কবিতা টিকে থাকবে”। বলেছিলাম, কেন? উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন, সেটা নিয়ে কথা হবে অন্যদিন! আজ বরং বলি- জয়তু কবিতা! জয়তু কবি!
একটা গল্প বলি। রাজার ছেলে হয়েছে, রাজপুত্রের জন্ম উৎসব উপলক্ষে রাজ্যের প্রজারা যার যতটুকু সামর্থ্য আছে সেটাই নিয়ে হাজির রাজ দরবারে…
সারি বেধে একে-একে প্রজারা রাজার সামনে গিয়ে উপহার সামগ্রী দিয়ে রাজাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, এমন সময় হঠাৎ রাজার চোখে মুখে বিরক্তির সাথে ক্রোধ দ্যাখা গেলো। সকলেই দেখতে পেলেন রাজার ক্রোধের কারণ এক দরিদ্র প্রজা তার গাছের সুপারি নিয়ে এসেছেন… রাজার ক্রোধ হবারই কথা, রাজাকে অভিনন্দন জানাতে এসে শেষে কিনা সুপারি নিয়ে আসা!?
রাজা কিছু বলার আগেই মন্ত্রীবর বলে উঠলেন- এই ব্যাটার পাছা দিয়ে সুপারি ঢুকিয়ে করে দাও, ব্যাটা বজ্জাত, সুপারি নিয়ে আসা হয়েছে…ইজ্জত আর থাকে না…
সিপাহিরা সেই দরিদ্র প্রজাকে ধরে সকলের সামনে পাছা দিয়ে সুপারি ঢুকিয়ে দিলেন… আবার শুরু হলো উপহার আনন্দের পালা, আবার ইজ্জত ধোয়ার পালা… এবার এক প্রজা এসেছে বেল হাতে… একই আদেশ হুকুম করলেন মন্ত্রিবর… সিপাহিরা এই প্রজাকেও ধরে সকলের সামনে পাছা দিয়ে বেল ঢুকিয়ে দিতে উদ্যত হলেন যখন, তখন প্রজাটি মুচকি-মুচকি হাসছেন, রাজা আরও বিরক্ত হয়ে উঠলেন। মন্ত্রীকে ডেকে কানে-কানে কি যেন বললেন। মন্ত্রী এবার সাংঘাতিক রেগে উঠে প্রজাটিকে বললেন- কি সমস্যা তোর হাসছিস ক্যান? ব্যাটা পাছা দিয়ে বেল ঢুকছে তাও তোর হাসি পাচ্ছে…
প্রজা এবার বিনীত ভঙ্গিতে বললেন- মন্ত্রিবর হাসি কি আর সাধে, ঐ যে দ্যাখেন অজিমল নারকেল নিয়া আসছে! ওর কী হবে তা-ই ভেবে হাসি আটকাতে পারছি না হুজুর।
এই গল্পগুলো শুনে কেবলি মনে হয়, নিজের কষ্টের ব্যথা ভুলতে অন্যের কষ্টকে উপভোগ করতে শিখে গ্যাছি এই আমরা, অথচ মানুষ হিসাবে এমন চারিত্রিক গুণাবলি হবার কি কথা ছিলো? ক্যানো জানিনা সকলে মিলে আমরা ভুলে যাই, এ পৃথিবীতে মানুষরূপেই এসেছি আমরা বাকি আবরণগুলো লেগেছে ধীরে-ধীরে… কিন্তু পারিবারিক, উত্তারাধিকারী ভাবে- ভৌগলিক গণ্ডির ভিতরে থেকে যে আবরণগুলো আমাদের রাঙ্গিয়ে তুলেছে সেটাকেই প্রাধান্যতা দিতে শিখে গ্যাছি আমরা…সীমাহীন ব্যর্থতায় পিতার বুক আর কাঁপেনা, সময়ের এই চলমানতায় আমি পিতারূপে শঙ্কিত হয়ে উঠি…পুত্রকে বলি, মানুষ হতে হবে, অন্য কিছু নয়…
মন্তব্য