কোরাকাগজের খেরোখাতা
জিললুর রহমান
সেই উত্তাল ৮১-র ঘটনার মুহুর্মুহু মোড় পরিবর্তনের মধ্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এসএসসি পরীক্ষার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মনটা প্রস্তুত হতে লাগল রাজনীতি সচেতনতার দিকে। আমি দৈনিক সংবাদে নিয়মিত গাছপাথরের লেখা সময় বহিয়া যায় তো পড়তামই, এখন শুরু হলো নানারকম রাজনীতি সংশ্লিষ্ট পুস্তিকা। নতুন করে মুক্তিযুদ্ধ এবং সেসময়ের ঘটনাবলী নিয়েও কিছু লেখা পাঠ করা হয়েছিল। কিছু নাটকের বই পড়ার সুযোগও হয়েছিল। তার মধ্যে একজন লেখকের নাম কল্যাণ মিত্র মনে পড়ছে। এর ফাঁকে ফাঁকে কবিতা লেখার চেষ্টাও চলে। কবিতা পড়ার চেষ্টাও শুরু করেছি। প্রথম থেকেই ভাল লাগত রবিঠাকুরের কবিতা। আমার বাসায় সম্ভবত আমার নানা বা মেজমামার রেখে যাওয়া পকেট আকৃতির গীতাঞ্জলী থেকে একেকটা উল্টে উল্টে বড় বড় করে পড়তাম। আমার মা এটা খুব পছন্দ করতেন। একদিন কিনে আনলাম সোনার তরী। আমার আজীবনের প্রিয় কবিতা ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’ কত শত বার যে পাঠ করেছি তার হিসেব পাওয়া ভার। এই কাব্যগ্রন্থে ছিল দীর্ঘ কবিতা ‘পুরষ্কার’, যেটা পাঠ করে অনুভব করেছিলাম যত রকমের ভাব সম্প্রসারণ সব বুঝি এই কবিতা থেকেই পরীক্ষায় আসে। অথচ পাঠ্যপুস্তকে কবিতাটি অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। পুরষ্কার কবিতার কথা মনে পড়লেই একজন দীনদরিদ্র কবির আত্মমর্যাদা এবং গুনী রাজার কাছ থেকে গলমাল্য ভিন্ন অন্য উপহার না চাওয়া এবং তার প্রিয়তমার জন্যে সেই মালা নিয়ে যাওয়ার ঘটনার ভেতর দিয়ে যে জাগতিক মহাজাগতিক ও আধ্যাত্মিক সারগর্ভ চিন্তার অবতারণা করা হয়েছে তা আমাকে তখন যেমন আকুল করে তুলেছিল, এখনও তেমনি মোহগ্রস্থ করে রাখে। এই করতে করতে এসে গেল এসএসসি পরীক্ষার দিন। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় এই মহা আয়েজন। নাসিরাবাদ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্র। পরীক্ষা ভালই দিয়েছি। সম্ভবত, এই প্রথম পরীক্ষার সব প্রশ্নের উত্তর লিখে আসার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিলাম। হয়ত সচেতন থাকায় তা সম্ভব হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার যে ঘটনাটি আমাকে এখনও অনুতপ্ত করে তা হলো অংক পরীক্ষার দিন আমি একটা হঠাৎ খুঁজে পাওয়া পুরনো শার্ট পরে পরীক্ষার হলে গিয়েছিলাম। আমার ক্ষীণ দেহের তুলনায় শার্টটা অনেক বড় এবং ঢিলেঢালা। কোন রকমে পেন্টের ভেতর গুঁজে দিয়ে ছুটে যাই পরীক্ষার হলে। আমার পেছনের সিটে মোশারফ বসেছিল। সে বারবার আমাকে কোন একটা অংক দেখাতে বলেছিল। কিন্তু আমি তা পারিনি। কারণ আমার সিট ছিল সামনে। স্যারেরা তাকিয়ে থাকেন। অংকের খাতা নিয়ে গেলে তো আমি শেষ। আবার আমার ধীরগতির কারণে অবসরও ছিল না যে খাতাটা খুলে রেখে ওকে লিখতে দিয়ে অপেক্ষায় থাকব। সম্ভবত সরল অংকের ব্যাপারেই বন্ধুর তাগাদা ছিল। যাই হোক, সহযোগিতা করতে না পারার মর্মযাতনা তো ছিলই, তার উপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগল যখন বন্ধু আমার ৫৯৫ নম্বর পেল। ৫ নম্বরের জন্যে হাত থেকে ফসকে গেল ফার্স্ট ডিভিশন। মোশারফের অতি ঘনিষ্ট আমাদের মইনুল আমাকে এই জন্যে আজীবন অপবাদ দিয়ে গেছে, অপরাধী সাব্যস্ত করে গেছে যে, আমার জন্যে বন্ধুটি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেবার যোগ্যতা হারাল বলে।
এসএসসি-র লিখিত পরীক্ষা শেষে ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার প্র্যাকটিকাল শেষ করেছি। সেদিন সম্ভবত ২৪ মার্চ ছিল, সকালে প্রস্তুতি নিচ্ছি জীববিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষায় যাওয়ার জন্যে। হঠাৎ আব্বা জানালেন সামরিক শাসন জারি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে অপসারণ করে সেনাপ্রধান লেঃ জেঃ হোঃ মোঃ এরশাদ ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। বাসার বাইরে গিয়ে দেখলাম লোকজন গলির মধ্যে জড়ো হয়ে নানা উৎকন্ঠায় উদগ্রীব হয়ে আছে। নানা শঙ্কা বুকে নিয়ে তাদের উদ্বেগ আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হলো। আমাদের পরীক্ষা হবে কি হবে না, তা নিয়ে দোলাচলে ছিলাম। তারপর সেই অমোঘ বাক্য ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’ অনুসরণ করে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই পরীক্ষার হলের দিকে। আমাদের পরীক্ষা হয়ে গেল ঠিকঠাক মতো, কিন্তু দেশ জুড়ে কেমন যে এক চাপা অস্বস্তি বুকের মধ্যে চাপ তৈরি করছিল।
এসএসসি পরীক্ষা শেষে অখণ্ড অবসর নেমে এল, যার অধিকাংশই কেটেছে উপন্যাস পড়ে। এর ফাঁকে কয়েকটি প্রবন্ধের বইও পাঠ করেছিলাম। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধ পাঠের কথা বেশ মনে আছে। এখানে শান্ত ধীরস্থির রবীন্দ্রনাথকে বেশ বিচলিত ও ক্ষুব্ধ মনে হয়েছিল। হুমায়ুন আহমেদের বেশ কিছু উপন্যাস পড়েছিলাম, এখন আর নাম ধাম মনে নেই। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, বিমল কর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কিছু উপন্যাস এসময়ে আমাকে বেশ আপ্লুত করেছিল। কবিতার বই তখন খুব অল্পই পড়েছি। তবে এই সময়ে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা আমাকে বেশ আকর্ষণ করতো। এই অখণ্ড অবসরের ব্যস্ততা আমার কিছু আত্মীয় স্বজনের তেমন পছন্দ হতো না। তারা আমাকে পরামর্শ দিলেন বসে না থেকে টাইপ ও শর্টহ্যান্ড শিখে নিতে। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, এসব শিখে কি লাভ হবে? তারা আমাকে বিভিন্ন অফিসে চাকরি পেতে সুবিধে হবার কথা জানালেন। আমি বিস্মিত হতাম। এরা আমাকে ভবিষ্যতের কেরাণী হিসেবে দেখছেন! কিন্তু আমি তো কেরাণী হব না! তাই ওসব পরামর্শ আমি এক কান দিয়ে ঢুকলে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম। এমন সময়ে কিছুদিন খালার বাড়ি মোহরায় গিয়ে থেকেছি। খালার বাড়িতে বসবাসের এই পর্বে আমি খালাত ভাই দিদার ভাইজানের পিছু পিছু ঘুরতাম। উনি আমার চেয়ে ৪/৫ বছরের বড় হবেন বয়সে। তাঁর বন্ধুদের একটা দল রাজা খাঁন চৌধুরী বাড়িতে তখন বেশ ডানপিটে হিসেবে পরিচিত। তাঁরা সন্ধ্যার পরেও ঘরের বাইরে থাকতে পারতেন এবং কেউ কেউ ধূম্রশলাকায় অগ্নিসংযোগ করে তা থেকে মুখ দিয়ে ধোঁয়া টেনে নাক দিয়ে ছাড়ার কৌশলও করায়ত্ত করে ফেলেছেন। আমি তাদের আড্ডায় নিয়মিত সদস্য হয়ে গেলাম, তবে অনেকটা ‘দুধভাত’ বা নগন্য হিসেবে গণ্য হতাম। তবে তাদের সাথে পূর্ণিমা রাতে কালুরঘাট ব্রিজের উপরে জ্যোৎস্নামাখা হাওয়া খাবার স্মৃতি কখনও ভুলতে পারিনি। যেন এক অতীন্দ্রীয় অলৌকিক এক জগতে চলে গিয়েছিলাম সেসব রাতে। তার সাথে ছিল সুরে বেসুরে নানারকম গানের কোরাস। এসময়ে দিদার ভাইজানের কাছে তালিম নিলাম সাইকেল চালানোর। ২ দিনেই বেশ পটু হয়ে উঠলাম সাইক্লিংয়ে। সাইকেলের প্রতি আমার আশৈশব দুর্বলতা। আব্বা কথা দিয়েছিলেন এসএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশন পাশ করলে সাইকেল কিনে দেবেন। তাই খুব যত্ন করে তালিম নিলাম। রেজাল্ট ভাল হবে এমন আত্মবিশ্বাস আমার ছিল। টেস্ট পরীক্ষায় আমি স্কুলে নবম স্থানে ছিলাম। তাই সাইকেল হাতে আসা ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু নিয়তি আমাকে নিয়ে যে মশকরা করার পাঁয়তারা করেছে তা কি আর জানতাম।
যাই হোক, খালার বাড়িতে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে গেলাম মামার বাড়িতে। সেখানে ছোটমামা আর লিয়াকত ভাইজানদের বিশাল দলে ভীড়ে গেলাম। তখন তারা সবাই ক্রিকেট নিয়ে মত্ত। ফতেয়াবাদ ইশকুলের মাঠে সারাদিন ধরে ক্রিকেট খেলা চলে। আমাকেও খেলায় নেওয়া হলো। কিন্তু আমি না ব্যাটিংয়ে দক্ষ, না বলিং বা ফিল্ডিং। অগত্যা আমাকে মাঠে বাউন্ডারিতে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো, যদি কোন অলীক পদ্ধতিতে আটকে দিকে পারি বল। ব্যাটিংয়ে আমার সিরিয়াল সবসময় এগার নম্বর। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার ব্যাট থেকে চার ছক্কা বের হয়েছিল, তবে তা এতই আকস্মিক যে, সবাই দুঃস্বপ্ন বলে ভুল করতো। বাউন্ডারিতে চার ঠেকানো এবং ছক্কা আটকে ক্যাচ ধরার সুযোগ দুয়েকবার পেয়েছিলাম। আমাদের এই দলটি সেঞ্চুরি ক্রিকেট ক্লাব নাম ধারণ করলো; এবং শিগগির চালু করলো সেঞ্চুরি ক্রিকেট ক্লাব টুর্নামেন্ট। আমাদের টিমে বিশেনশিং বেদী’র ভূমিকায় ছিলেন আলম বদ্দা, যিনি এখন প্রবাসে সম্ভবত রসায়ন বিষয়ক কোন গবেষণায় মগ্ন। গ্যারি সোবার্সের ভূমিকায় ছিলেন লোকমান বদ্দা, লিয়াকত ভাইজানের নাম কালীচরণ, জামাল মামা ছিলেন গাভাস্কার, যিনি পরে অতিরিক্ত সচিব হয়ে রিটায়ার করেন এবং বর্তমানে একজন খ্যাতিমান অনুবাদক। তাঁর অনূদিত ‘দি কাইট রানার’ একটি অনবদ্য উপন্যাস, যার ভাষান্তরও হয়েছে তেমনি সাবলীল ও ঝরঝরে। আমার ছোটমামা সেলিম খান ছিলেন ওয়াসিম বারী’র ভূমিকায়। এরকম সকলেই বিশ্ব ক্রিকেটের কোন একজনের নাম ধারণ করে খেলা চলতো। কেবল আমার কোন নাম দেওয়া সম্ভব হয়নি — আমাকে সবাই ডাকতো ‘আলসিয়া’ (আলস্যময়)। কি করা, বল আমার চেয়ে জোরে দৌড়াতে পারে। আমি তাদের কিছুতেই বুঝাতে পারতাম না যে, বলটা গোলাকার, আমি লম্বা এবং দুই ঠ্যাং ম্যানেজ করে দৌড়াতে হয়। তারা কেবল হাসে।
এদিকে একদিন আক্তার ভাই, আমার দূর-সম্পর্কের কাজিন, মামার বাড়ি বেড়াতে আসেন। তিনি ছোটমামাদের বয়সী, তাদের বন্ধুসম। আক্তার ভাইয়ের তখন নতুন নেশা হাত দেখা। সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হাত ধরার উদ্দেশ্যে এই সখ জেগেছে তার। সবার হাত দেখছেন, আর শটাশট ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন। যাদের হাত দেখছেন সকলেই তার পরিচিত, অতীত ও বর্তমান তার জানাই আছে। ভবিষ্যৎ ইচ্ছে মতো বলে দিলেই হয়। নিজেই আগ্রহভরে আমাকে ডেকে নিয়ে হাত দেখতে লাগলেন। আমার অতীত বর্তমান নিয়ে কিছু না বলে বরং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলার অনুরোধ করলাম। তিনি অনেকক্ষণ রেখা দর্শন শেষ করে একসময় আমাকে বললেন আমার ভবিষ্যৎ ভাল না। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললেন, রেজাল্ট ভাল হবে না। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার আত্মবিশ্বাসে চিড় বা ফাটল দেখা দিল। আমি কিছুটা শঙ্কিত ও দ্বিধান্বিত হলাম। পরে অবশ্য রেজাল্ট বেরোলে আমি প্রথম বিভাগেই উত্তীর্ণ হলাম। তারপর দীর্ঘদিন এই আক্তার ভাই আমাদের বাসা বা সাক্ষাতে আসেননি। অনেক পরে দেখা হলে লক্ষ্য করলাম ওনার চাপার জোর যথেষ্ট বিদ্যমান থাকলেও আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ১৯৮২ সালেই কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই। সে যুগেও ভর্তির ব্যাপারে উৎকন্ঠা ছিল, তবে বোধ হয় তাকে ভর্তি যুদ্ধ বলা যাবে না। চট্টগ্রাম কলেজে তো ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, সাথে মহসিন কলেজেরও ফর্ম পুরণ করেছি। আব্বার অজান্তেই তার কলেজ সিটি কলেজের ফরমও পুরণ এবং পরীক্ষায় উপস্থিতির ব্যাপারে আমি বেশ উদগ্র ছিলাম। চট্টগ্রাম কলেজে আমার মেধাক্রম প্রথম দিকেই ছিল। প্রথম দিনেই আমার মৌখিক পরীক্ষা হলো, এবং আমি ভর্তি হলাম রোল নম্বর ৭৪ পরিচয়ে।
২৬-১০-২১ পূর্বাহ্ণ ১২:৫২ ঢাকা
বেশ আনন্দ পাচ্ছি
উত্তরমুছুনঝরঝরে ভাষায় সুখপাঠ্য বিবরণ
উত্তরমুছুন