বাব্বি
সুবিমল মিশ্র
সুবিমল মিশ্র
বেড নাম্বার নাইন্টিনাইনের পেসেন্টকে কারা দেখতে এসেছেন? পেসেন্ট মারা গেছে ভাের রাতে। ঐ দেখা যায় ডানদিকে লালবাড়ি— মর্গ। মরচে-ধরা। কোলাপসিবল গেট। বডি-টা পাঠানাে হয়েছে ঐ দিকে। এক এক করে সবাই গিয়ে দেখে আসুন। চারদিকে এখন পঁচা লাশের ঠাণ্ডা নীল হাঁ। অন্ধকারে, সেই হাঁ-এর ভেতরে, মােটা থলথলে একটা মাংসপিণ্ড, ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবীতে, গাড়ি থেকে থপথপিয়ে নামে, কাছে এসে গায়ে হাত দেয়, কানে কানে বলে: ম্যাচিস আছে? ওটা কোড়-ল্যাংগােয়েজ। তারপর দুজনে অন্ধকারের দিকে মিশে যায়।
লাঠিতে ভর করে কুঁজো মতন একটা লােক রাস্তা পেরােতে থাকে। সেই মুহূর্তের জন্য পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে পড়ে। লােকটা ঠুক ঠুক লাঠিতে ভর দিয়েই, আস্তে, রাস্তা পেরােতে থাকে, ক্রমশ রাস্তা পেরােতে থাকে। গল্প রাত-পরীদের দিকে ঘুরে যায়। রাত বাড়ার সংগে সংগে ডানা থেকে তারা তাদের সব পালক খসিয়ে ফ্যালে। কবরখানার ভেতর থেকে ফাঁসিকাঠের খট খট শব্দ হয়। অস্পষ্ট কিছু ছায়ামূর্তি সেই শব্দে আকৃষ্ট হয়ে লণ্ঠন দোলাতে দোলাতে জনবসতি ছাড়িয়ে জংলা কবরখানার দিকে চলে যায়। পর্যায়ক্রমিক এইসব অসংলগ্নতা পাঠকের মনে একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। অনুভূতির ওপর প্রভাব বিস্তার করা, তারপর তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া— বিষিয়ে তােলা। এই হচ্ছে শক-ট্রিটমেন্ট। ক্রমশ তাদের মনোেযােগ ঝিঁঝিয়ে ওঠে, সাড়হীন যুক্তি-বিন্যাস নাড়া খায়। রক্তের সংগে জড়িয়ে যায় আপৎকালীন চরাচর। বুড়াে লােকটি এসে হাসতে হাসতে বলে: আমি ফুল চিবিয়ে খাই। তারপর হাসি থামিয়ে জানায় তার গােটা ডানহাতটাই তার নিজের নয়। বহুকাল তার নিজের কোন ডান হাত ছিল না। সে তার হাতখানা খুঁজে পেয়েছে ঘরের পাশে ডাস্টবিনে, এবং পরে সেলাই করে নিয়েছে দেহের সংগে। ডান হাতখানা কোথায় ছিল তবে আপনার? ছেলেবেলায় ওটা আমি হারিয়ে ফেলি। তখন আমি আমার বাবাকে... কোন কিছুর জন্য না, এমনিই। ঘটনাটা ঘটে যায় আর কি ... আর এই ঘটে যাওয়ার ওপর তাে কোন চারা নেই।
বাবার এই মৃতদেহ যখন পােড়ানাে হচ্ছে, তখন, সে, হঠাৎই, উচ্ছ্বসিত, হাসিতে ভেঙে পড়েছিল। বিব্রত হয়ে সে শ্মশান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয় কিন্তু তখনাে তার হাসির বেগ কমেনি। বাবাই তাে সব, এইসব, সব শেখালাে। হাঁ, সে তার বাবাকে খুব ভালবাসতাে। বুড়ােটার দাঁতগুলাে খুব সুন্দর। বলে আমি ফুল চিবিয়ে খাই। বলে আর হাসে। হাসতে হাসতে মন্তব্য করে: চিবিয়ে খাই তাে কি হল— আপত্তি আছে? মাঝরাতে ফ্লাইওভার জুড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে থেঁতলে-যাওয়া এক মনীশের শরীর। রাত ১২টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটে কিন্তু ভাের রাত পর্যন্ত কেউ খবর পায়নি। পাশ দিয়ে অনেক গাড়ি গেছে কিন্তু আজকালকার দিনে কে আর ইচ্ছে করে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায়। লম্বা মতন এক যুবক, আর তার পিঠে জড়িয়ে আছে কালাে-বেলবট্স-আর-লাল-সােয়েটার-পরা-মেয়েটি। এতখানি চওড়া মসৃণ রাস্তা সবাই পায়ের সুখ মিটিয়ে অ্যাকসিলেটর চাপে, মােটর সাইকেলটি চুরমার হয়ে পড়েছিল নতুন ফ্লাইওভারের ওপর। পরে দেখা গেছে একদিকে বেঁকে দুমড়ে উপুড় হয়ে পড়ে-থাকা মনীশের শরীর, অন্যদিকে মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান অবস্থায় রেবেকা চ্যাটার্জী। মনীশের বৌ তখন বাড়িতে পথ চেয়ে। নীলচে কালাে লম্বা ব্যারেলে নিয়তির নিষ্ঠুরতা। ভালবাসা যায় না। অনন্তকাল সংগে থাকলেও না। বাড়ির বাথরুমে এনামেল করা স্নানের টবটা থেকে সুরু করে দরজায় পেতলের হাতল পর্যন্ত, সব, সব ভালবাসি। চারিদিকে গহন বন, নদী। পশ্চিমঘাট পাহাড়ের মধ্যিখানে বিশাল গাছের ঘন ছায়ায় সিমলিজোরা রেস্ট-হাউস। নির্জনতা সেখানে ফিতের মতাে পায়ে পড়ে জড়ায়। বাংলাের পিছনে ঝিরঝিরে ঝর্ণা। রেস্ট-হাউসের সামনে ছাঁটা-ঘাসের মাপা চৌহদ্দিতে দুটি বেতের চেয়ার। একটাতে রেবেকা বসে আছে, এলানাে গা, অদূরে মনীশের মােটরসাইকেল। ঝর্ণা দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাের বারান্দায় শুকনাে পাতা উড়ছে ফরফর। থিরথিরে ছন্দের চেয়ে রুক্ষতার প্রাধান্য থাকলে ঘটনার নির্মমতা আরাে আরাে চারিত্রিক হয়ে ওঠে। আর স্ব-বিরােধিতাই হল কর্মপদ্ধতির একটা অংগ। চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করার একটা দ্বি-মাত্রিক পদ্ধতি। সেটা কখনাে কখনাে ত্রি-মাত্রিকও হতে পারে। সব-সময় সন্দেহজনক এই অনুসন্ধানটা থাকা দরকার। একটা মেয়ে লিখছে, ২৬ বছর আমার বয়স...স্লিম...স্টেট সার্ভিসের জন্য পরীক্ষা দিচ্ছি... নিজের নামের আগে মিস বা মিসেস লিখতে মর্যাদাহীনতা বােধ করি আমি... গত বছরে দিল্লিতে গিয়ে প্রকাশ্যে তােমার সংগে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ৩ দিনের মধ্যে সব টাকা ফুরিয়ে যায়। এই হােল বিরােধিতার একটা দিক। মানে আমার নিজস্ব ভাবে চিন্তা করা। এই পদ্ধতিতে চরিত্ররা এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে থাকে। লেখক খুশি হন। যে চরিত্রটি শুধু নিজের অংশটুকু পড়ে দেখছে না, সমস্ত লেখাটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে তার কৌতুহল স্বাভাবিক ভাবেই লেখককে খুশি করে। উৎসাহ এনে দেয়। চরিত্ররা সকলে মিলে আলােচনায় বসে, তারা প্রতিটি কথার অর্থ জেনে নিতে চায়, তাদের কি কাজ, তারা এসব কেন করছে—'সবই লেখকের সংগে আলােচনা করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেয় তারা। নিজেদের মতামতও জানায়। তর্ক করে। কিন্তু লেখককে অনেক সময় নিরুপায় থাকতে হয়। সবাইকে কি সে ছাই ভাল করে জানে, ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবী পরা থলথলে চেহারার লােকটিকে রাত ৮টার পর ভিকটোরিয়ার সামনে গাড়ি থেকে নামতে একদিনই সে দেখেছিল মাত্র। আর তখনি দেশে যে পুরুষ-হিজড়ে রয়েছে, একশ্রেণির কম বয়সি ছেলেরা, এবং তাদের এইসব টিপিক্যাল কাস্টমার, তাদের অস্তিত্বের কথা টের পায়। রেবেকা জানতে চেয়েছিল পাঠকেরা তাকে কীভাবে নেবে। আমার ধারণায় পাঠকদের দৃষ্টি সব সময় তােমার কালাে বেলবটস আর লাল টকটকে ঐ শােয়েটারের ওপর থাকবে...। আসলে একটা চরিত্রের দিকে লেখকের পক্ষে ছুটে যাওয়া খুব খারাপ। ওদের করতে দেওয়া দরকার। দেশজুড়ে হঠাৎ হঠাৎ ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ অঢেল পরিমাণ বে-আইনী আগ্নেয়াস্ত্র ও বহু অস্ত্রনির্মাণ কারখানা আবিষ্কার করে ফ্যালে। উদ্ধার করে অনেক তাজা বােমা ও বােমার মশলা। রাইফেল বন্দুক পিস্তল ও পাইপগান মিলিয়ে এক দিনের তল্লাশীতেই ধরা পড়ে প্রায় ২৫ হাজার বে-আইনী আগ্নেয়াস্ত্র। তখন ছােকরাটি, তাকে সবাই পাড়ার মস্তান বলে জানে, বলতে থাকে: এই দ্যাখাে, বাড়ি থেকে নিয়ে এলুম এগুলাে—মা’র শাল, মেজদার গরদের পাঞ্জাবী, ছােড়দার বিয়ের জুতাে— চোরা বাজারে ঝেড়ে দেবাে। সে এ সব কথা বলছে ঠিকই কিন্তু খুব স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করছে না। দ্বিধা রয়েছে। সে না করেও পারে না, করেও কোনও স্বস্তি নেই। চরিত্রের অন্যতর গড়নে এটা সব সময়ই হয়। ওদের নানা সময়ে নানা রকমের আপত্তি থাকে। বিরােধিতা জিনিসটা একটা চরিত্রের কর্ম-পদ্ধতিরই একটা অংগ। বুড়ােটা, ফুল চিবিয়ে খাওয়া বুড়ােটা অবশ্য স্বীকার করেছে যাকে সে খুন করেছিল তার সংগে তার একটা বিশেষ ধরনের দৈহিক সম্পর্ক ছিল। একটা রােমান্টিক সম্পর্ক। তারপর দুজনেই দুজনকে বদলে নিলাম। রােমান্স চলে গেল। এটা একটা অন্য কিছু যা আমাদের দুজনের বন্ধনের মাঝখানে ছিল। বলে সে হাে হাে করে হাসে: আমি এমন লােক ফুল চিবিয়ে খাই। ক্রমশ পাশ থেকে মেয়েটির মুখ পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠতে থাকে। মানে, ইনিই নতুন ঐ ফ্লাইওভারের ওপর মনীশের সাথে এক মােটরসাইকেলে ছিলেন। বেশ চওড়া এক রাস্তায় রাত্তির এগারােটা ছুটে চলেছে প্রচণ্ড বেগে মনীশকে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে— বাড়িতে স্ত্রী অনুপমা অপেক্ষায়। তারপরেই ঘটনাটা ঘটল। মনীশের মনে অন্য কিছু ছিল না তাে, অন্যরকম..., অদৃশ্য থেকে মনীশ উঠে দাঁড়ায়। ছন্দ মিলিয়ে বক্ততার ঢঙে পড়ে যেতে থাকে: আমি মিথ্যাকে ভালবাসি। ভুল বােঝানােতেই আমার সুখ। যা কিছু অসত্য তাই আমার পছন্দ। যা কিছু নিষিদ্ধ তা আমাকে আনন্দ দেয়। এই এখন রেবেকাকে নিয়ে..., পড়ার মাঝখানে সে ধূমপান করতে থাকে। চেয়ারে ইতস্তত চরিত্রগুলাে বসে, অনড়। সেই ফাঁকে রেবেকার সংগে খােলাখুলি কিছু কথাবার্তা হয়।
লেখক: তুমি কি ছেলেদের সংগে ঘুরে বেড়ানাে একটু বেশি পছন্দ করাে?
রেবেকা: করিই তাে ...ভাল লাগে...
লেখক: ছেলে-বন্ধুদের সংগে কখনাে কোথাও বেড়াতে গিয়েটিয়ে ... মানে রাত-টাত কাটানাে...
রেবেকা: তা কি খুব দোষের? তবে তা অনেকটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কখনাে কখনাে এসব ঘটে যায় আর কি...
লেখক: গণতন্ত্র সম্বন্ধে তােমার কি ধারণা?
রেবেকা: পলিটিকস নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
লেখক: চারপাশে যে-সব ঘটনা ঘটছে তার খোঁজখবর রাখাে?
রেবেকা: খবরের কাগজে একবার তাে চোখ বুললাই, রাজনীতি একদম ভাল লাগে না। আমার পৃথিবীতে আরাে আরাে অনেক জিনিস আছে। সে সবেই আমার আগ্রহ।
লেখক: যা তােমার ভাল লাগে না তা নিয়ে তুমি আদৌ চিন্তিত নও ?
রেবেকা: ঠিক ধরেছেন।
লেখক: আর একটা কথা তুমি তাে জানাে মনীশ বিবাহিত ... দুটি বড় বড় বাচ্চ আছে ...বিবাহিত জীবনে ও সুখী ...এসব জেনেও কি ...
রেবেকা: হ্যাঁ জানি। ভেবেছি। কিন্তু তাতে কি?...
মস্তান ছেলেটি কথাবার্তার মাঝখানেই উঠে দাঁড়ায়, প্যানটের পকেটে হাত, হাত অদৃশ্য চেম্বারে ঠেকানাে। বলে ওঠে: একটা পাত্তি ছাড়ুন না লেখক মশাই, সাট্টা খেলব। ওল্টানাে খুরিটায় সে সটান একটা লাথি মারে। সবাই দ্যাখে কিন্তু কেউ কিছু বলে না। লেবু-মেশানাে দেশি মদের মতাে সন্ধ্যাগুলাে থেকে খটাখট খটাখট আওয়াজ বেরােয়, দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন। এক-এক-জন বিশ-পঁচিশটা করে ভােট দেয়। কান-ঢাকা চুল রাখে। স্থানীয় গার্লস ইস্কুলের ছুটির মুখে বন্ধুদের সংগে মােড়ে গিয়ে দাঁড়ায়, সিটি দেয়। ক্যামেরা ধীরে ধীরে প্যান করে আসে। দেখা যায় রাস্তার মােড়ে এক বুড়াে ভিখিরি মরে পড়ে আছে। ক্রমে বেলা বাড়ে। বুড়াের শব নিয়ে পাড়ার ছেলেরা গলি দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। হরিধ্বনি শােনা যায়। দোতলা থেকে একজন বৌ কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে। লােকেরা গলা বাড়িয়ে শবযাত্রা দেখতে থাকে। কুয়াশার আলাে-আঁধারিতে ঝাপসা সেই লাল বাড়ি দেখা যায়— মর্গ। মর্গের লাগােয়া ধীরি ধীরি বয়ে যাওয়া নদী। নদীর গায়ে শান্তি-কুটির। মাটি দিয়ে নিকোনাে ছবির ফ্রেম, ভাঙা পাঁচিলের পাশে। বারান্দার কোণে একটা বুড়ি-ছাগল কালাে কুচকুচে বাচ্চাগুলােকে মাই দিচ্ছে, পায়ের তলায় একরাশ টাটকা নাদি। একঝাঁক কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে ধাড়ী একটা মুরগি বারান্দাময় ছুটোছুটি করছে। উঠোনের জবাগাছে ফুল ভর্তি। লাউয়ের মাচায় লাউ ঝুলছে। ডুরে শাড়ি পরে একটা ১১/১২ বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে অনেক দূরে, মাঠের ও প্রান্তে, রেলগাড়ির চলে যাওয়া দেখছে। চারদিক থেকে হৈ-চৈ শুরু হয়। তখন কে কি বলছে তুমুল হট্টগােলের মাঝে চাপা পড়ে। সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন এক টেবিলে বসিয়ে তাদের, চরিত্রগুলােকে, বােঝার চেষ্টা করি। ফুল চিবিয়ে খেতে-চাওয়া বুড়ােটা প্রথমটা কিন্তু কিন্তু করে, কিন্তু আসে, একটা চেয়ার নিয়ে বসে। রেবেকাও এসে বসে একপাশে, খানিকটা বেপরােয়া। গজ গজ করে: মনীশ বিবাহিত হলাে তাে কি হয়েছে...। মনীশও এসে যায়। সিগারেট হাতে, ধরানাে। কখনাে কখনাে অন্যমনস্ক, টানে। বেশিটা তার হাতেই পুড়ে যায়। তখন আবার নতুন করে সিগারেট ধরায়। ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবীতে থলথলে চেহারার অবাঙালি ব্যবসায়ীটিও আসে। ব্যাপারটা কি হচ্ছে সে ঠিকমতাে ধরতে পারে না। কিন্তু ছেলেটি, মস্তান সেই ছেলেটি, কিছুতেই আসতে চায় না। পাড়ার মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর জুয়ােখেলার জন্য এর ওর কাছ থেকে টাকা চাওয়াতেই ওর আনন্দ। বলে: এইসব লােকের সংগে কেউ লেডি কিলার, কেউ বুড়াে হাবড়া, কেউ হাফ-প্রস— এই মারােয়াড়িটা তাে এক নম্বর হােমো, বেটা আমাদের ওয়াগন-ভাঙা মাল-পত্তর জলের দামে কেনে, মানে আমাদের বেঁচে দিতে বাধ্য করে— এক টেবিলে বসা— থােঃ।। সবাইকে সংগে নিয়ে আলােচনা আদৌ ঘটানাে যায় না। মানুষগুলাের মধ্যে কোনও প্রচ্ছন্ন যােগসূত্র আছে কিনা— আলােচনার ভেতর দিয়ে যা বেরিয়ে আসতে পারে, তা বাস্তবে ঘটে না আদৌ। মুখ গােমড়া করে ছেলেটা মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুরে পেটো পড়ার শব্দ হয়। ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার শব্দ হয়। লােক দৌড়তে থাকে, নিরাপত্তার দিকে। রেবেকা উঠে দাঁড়ায়: আমাকে যেতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। মনীশ তুমি কি আমায় পৌঁছে দেবে?
পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে ৭টা ৫৫-র স্থানীয় সংবাদ ভেসে আসে। গজ-কুডি ওপরে ওঠার পর সমতল পাথরের এক বিশাল চত্বর স্পষ্ট হয়। তার পরেই নীচে নামার অন্ধকার সুড়ংগ। কোণাকুণিভাবে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলে, একদম শেষ প্রান্তে, গােপন কফিনঘর। প্রাচীন এই পৃথিবীর প্রাচীনতম এই পাড়া পেচ্ছাব পুলিশ গাড়ির টহলদারি, দিশি ও বিলিতি, গাঁজা, বেলফুল, চাট ও পেঁয়াজের গন্ধে ভােম মেরে থাকে। হঠাৎ সুড়ংগ ফুরিয়ে জীবনযাত্রা শুরু হয়। শহর-নগর খেত-খামার মানুষ গিজগিজ। ঘন সবুজ পাতি-ঘাসের ডগায় ডগায় কালাে ডাঁই পিঁপড়েরা জায়গা বদলাতে বেরিয়ে পড়ে। ভাল করে চেয়ে দেখলে বােঝা যায় ওরা সব উঁচু ডাঙা-জায়গা খুঁজতে বেরিয়েছে। খুব শিগগিরই বৃষ্টি নামবে তাহলে। কেয়া ঝােপে মুরগি-চোর শেয়ালের ডাকাডাকিতে বার বার গৃহস্থ পাড়া গরম হয়ে ওঠে। রক্তের ভেতরে কেমন এক আগ্রাসী ফাটল জমতে সুরু করে। হরিণমারি-বিলের ধারে শ্মশানে মড়ারা পুড়তে থাকে। আমবাগানে ঢুকে ধােপাদের খচ্চরটা ঘাস খেয়ে যায় নিরুত্তাপ। আলসেতে চিড়। ফাটল ক্রমশ বড় হয়, তার ঠাণ্ডা নীল হাঁ। অথচ এইটেই সবচেয়ে কঠিন। এদের সবাইকে আলােচনায় বসানাে। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে এদের সামাজিক দিকটি পরিষ্কার করে আনা। কাজটির তীব্রতা তাতেই, যা আনুষঙ্গিক, আপাত বিরােধিতা ছাপিয়ে উঠবে। অথচ সেইটেই হয় না। নীল হাঁ ক্রমশ বড় হতে থাকে। মস্তান ছেলেটি তেমনি প্যানটের পকেটে হাত, পাড়ার মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রেবেকা চলে যেতে থাকে, সংগে সংগে নিয়ে যায় মনীশকে। থলথলে-ভুঁড়ি অ্যামবাসাডরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বলে ফেলে: বাবুজি, এবার তাে যেতে হােবে। রেবেকা অ্যাবরসনের কথায় হাে হাে করে হেসে ওঠে ...কেন করাবাে? বিয়ে করিনি বলে ? ঝিলিক দিয়ে ওঠে তার লাল সােয়েটার। তার এই স্বীকার করতে ভয়-পাওয়াটা লেখক বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখে। তার এই স্বীকারের স্বাভাবিকতাটিও।
মস্তান ছেলেটি একসময় বলেছে, স্বীকার গিয়েছে: আমাকে কারা তৈরি করেছে জানেন ...আমাদের হাতে পেটো তুলে দেওয়া হয়েছে, কাজের শেষে টাকা যাঃ ফুর্তি করে আয় ... স্বাভাবিক জীবন থেকে কারা আমাদের বিচ্ছিন্ন করল? ... রেল ইয়ার্ডগুলােই তাে এখন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বাস হয় না ? বুড়ােটা বলে: আমার ডান হাতখানা আসল হাত নয়। কুড়িয়ে পাওয়া। আমি ফুল চিবিয়ে খাই। স্বাভাবিক জীবন থেকে আমাকেও ... । রেবেকাও অমনি ফিসফিসিয়ে ওঠে বিশ্বাস করুন আমাকে ... বিশ্বাস করুন ... আমি সত্যকে ভয় পাই না। তখনাে মনীশের আঙুল তার হাতে ধরা। কিছুতেই এদের একসংগে করানাে যায় না, এক টেবিলে বসানাে। সবাই কিন্তু কিন্তু করতে করতে এলেও ছােকরাটি আসে না। প্যানটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গোঁজ হয়ে পাড়ার মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কে আসে কে যায় লক্ষ্য রাখে। নতুন মুখ দেখলে ভাল করে দেখে নেয় খোঁচড় কিনা। রেবেকাকে গটগটিয়ে যেতে দেখে মন্তব্য করে বসে: এসব হাফ-গেরস্ত মেয়েমানুষ এখানে কেন। টেবিলে একটা চেয়ার ফাঁকা থাকে, ঠাণ্ডা হয়ে-যেতে-থাকে এক কাপ চা, নির্ধারিত। ... ঐ দেখা যায় সেই লাল বাড়ি— মর্গ। মরচে-ধরা কোলাপসিবল গেট। বডি-সব পাঠানাে হয়েছে ঐদিকে। রাত বাড়ে, গল্প ক্রমশ রাত-পরীদের দিকে ঘুরে যায়। ঠাণ্ডা নীল সেই হাঁ ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে, দেখা যায়, অ্যাকিলিশ আর কচ্ছপ, কচ্ছপ আর অ্যাকিলিশ দৌড়ে চলেছে। কচ্ছপ অ্যাকিলিশের থেকে হাজার গজ এগিয়ে, এমন অবস্থায় একদা দুজনের দৌড় শুরু হয়েছিল। অ্যাকিলিশ যে সময়ে হাজার গজ যায়, কচ্ছপ সে সময়ে যায় একশাে গজ। কতক্ষণে অ্যাকিলিশ কচ্ছপকে ধরতে পারবে? যখন অ্যাকিলিশ এই হাজার গজের ব্যবধান কমিয়ে দেবে তখন কচ্ছপ আরাে একশাে গজ এগিয়ে থাকছে। অ্যাকিলিশ আবার একশাে গজ যখন যাবে তখন কচ্ছপ দশ গজ এগিয়ে গেছে। ঐ দশ যখন অ্যাকিলিশ দৌড়ে যাবে তখনও কচ্ছপ তার থেকে এক গজ এগিয়ে। আর ঠিক এমনি করে অ্যাকিলিশ আর কচ্ছপের মধ্যে কিছু না কিছু সব সময় সর্বদা ...
(১৯৮১)
এতদিন শুধু নাম শুনেছিলাম৷ আজ এনার গল্প পড়ার সুযোগ হলো৷ ধন্যবাদ ভাই
উত্তরমুছুনপ্রথম পড়লাম
উত্তরমুছুন