শামশের আনোয়ার এখন আর নেই?
ঋতো আহমেদ
শামশের আনোয়ার এখন আর নেই। তাঁর কবিতার বইগুলোও বই-বাজারে পাওয়া যায় না। আমাদের জন্য এ এক কষ্টের কথা। ২০২১ এ এসে আমরা যারা তাঁর কবিতা পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। যাঁর গল্প শুনছি—শুনছি মানে পড়ছি প্রিয় কবিদের স্মৃতি-গদ্যে, সেই দুঃসাহসিক কবির তুমুল সব কবিতা পড়ার একাগ্রতায় যখন খুঁজে চলেছি তাঁর বইগুলো ঢাকার পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র কিংবা বাতিঘরের মতো বড়ো বড়ো বইবিতানে, তখন হতাশই হতে হচ্ছে। এমনকি তক্ষশিলাকেও পেয়েছি নিশ্চুপ। মনে হয়েছে এ’তো বড়ো লজ্জার ব্যাপার! আমরা, আজকের দিনের পাঠকেরা কেন খুঁজে পাবো না শামশের আনোয়ারকে? এ দেশে আমরা যারা প্রকাশনা শিল্পে আছি, আমাদের কি কোনও দায় নেই তাঁকে আগামীর পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার!—এইরকম ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়েই শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল একটি বই ইন্টারনেটে, আমারবইডটকম-এ। পিডিএফ ভার্সন নামিয়ে প্রিন্ট করে নিলাম। বইটি কবি দেবারতি মিত্রের অনুরোধে সুধাংশুশেখর দে তাঁর দে’জ পাবলিশিং থেকে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা পুস্তকমেলায় প্রকাশ করেছিলেন ‘শামশের আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামে। তা-ও আজ প্রায় কুড়ি বছর হতে চললো। তারপর, এইযে আমি বইটি হাতে পেয়ে গেলাম, সে’ জন্য, আন্তরিক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাই সেই মানুষটিকে যিনি আমারবইডটকম-এ বইটি আপলোড করে রেখেছেন। সাধুবাদ জানাই তাদেরকে, যারা এইরকম রত্ন বইগুলো ইন্টারনেটের ওই সাইটটিতে সংগৃহীত রাখার ব্যবস্থা রেখেছেন। কেননা, এগুলো আমার মতো অদূর/দূর ভবিষ্যতের অনেক পাঠকেরই খুব কাজে আসবে। আমরা জানতে পারবো, সত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোয় কীভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শামশের আনোয়ার আর তাঁর কবিতা। কী মর্মান্তিক আর ভয়াবহ ছিল সেইসব উচ্চারণ!—
আমার ইচ্ছে হয় কলমটাকে পেটের ভিতর বসিয়েদিই আমূল, বদ্ধ—যেখানে স্ত্রীলোকেরা ধারণকরে ভ্রূণ কিংবা যে হৃদয়ের ভিতরে থাকেস্বামীর প্রতি ভালোবাসা।আমার ইচ্ছে হয় কলমের নিব ঠুকে বসিয়েদিই জিভের ওপর;সংখ্যাহীন যা নাড়িয়ে নাড়িয়ে পৃথিবীর মানুষেরা কথা বলেঅথবা কপালের ভিতর ঢুকিয়ে বিদ্ধ করি মগজ—যে চোখ দিয়ে মানুষ তাকায় ও বিচার করেইচ্ছে হয় সেই চোখের ভিতর মর্মান্তিক, ক্লিপ অবধিঢুকিয়ে দিই আমার কলম।
কবিতায় কী অবলীলায় বলে দিলেন তিনি তাঁর এই অদ্ভুত মর্মান্তিক ইচ্ছের কথা! কিন্তু কেন এমন ইচ্ছে হয় তাঁর? আমরা দেখতে পাই বইটির ভূমিকায় কবি ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘শামশেরের সঙ্গে বন্ধুত্বটাই ছিল একটা বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্বের মতো। এতটাই উদ্দামতা, সজীবতা, দুঃসাহসিকতা ছিলো শামশেরের—এতটাই আক্রমণাত্মক, বিষণ্ণ আর ক্ষুব্ধ—এতটাই আন্তরিক ছিলো শামশের—এতটাই আন্তরিক যে, প্রকৃত শামশেরকে খুঁজে পাওয়াই ছিলো মুশকিল।’ যিনি কবিতায় এমন একটা ভয়ংকর ইচ্ছের কথা লিখতে পারেন তিনি যে ক্ষুব্ধ, আক্রমণাত্মক আর দুঃসাহসিক হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেন এতো ক্ষোভ? কার বিরুদ্ধে? এর জন্য আমাদের হয়তো সত্তরের সেই সময়টার গতি প্রকৃতির দিকে তাকাতে হবে। বুঝতে চেষ্টা করতে হবে সময়ের সেই অস্থিরতাকে।
কেমন ছিল সেই সমাজ? বাইরে স্বাধীন ভারতের স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপ, প্রত্যাশার লাশ, চীন-ভারত যুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন, নকশাল আন্দোলন। আর ভেতরে মেধাজীবী মধ্যবিত্তের বিষণ্ণ নিরক্ত একাকিত্ব। এই দশকেই সোমেন নন্দীর নাটকে অ্যাবসার্ড চিন্তাধারার সাথে আমাদের পরিচয়। অন্তঃসার শূন্য ছকে বাঁধা জীবন নিয়ে প্রশ্ন এই প্রথম। এই দশকেই বাদল সরকারের 'এবং ইন্দ্রজিৎ'। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু সংবাদ। কবিতার ক্ষেত্রেও পাল্টে গেল অনেক কিছু। এই দশকেই হাংরি, শ্রুতি আর শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন কবিতার যাবতীয় প্রচলিত নন্দনতত্ত্ব ও মূল্যবোধগুলোকে আক্রমণ করল। শামশের এর কোনোটারই সরাসরি অংশীদার ছিলেন না সেভাবে। সমাজবিপ্লবের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ ছিলনা। কিন্তু সমকাল তাঁকে ভয়ংকর নৈরাজ্যবাদের রাস্তায় ঠেলে দিয়েছিল। “শামশেরের কবিতা যেন এক অনিবার্য কল্পনাতীত থেকে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের দিকে অভিযাত্রা...,” গবেষক অর্ণব সাহা বলছেন, “জীবনানন্দের 'মহাপৃথিবী' বইয়ের 'আমিষাশী তরবার' অংশের 'মৃত মাংস' কবিতার সেই ডানা ভেঙে ঘাসের ওপর পড়ে যাওয়া অন্ধকার হিম নিরুদ্দেশ পাখিটির মতই যেন, যাকে কেড়ে নিয়েছে ঈর্ষা বা হিংসা নয়, বেদনা, যার ক্লান্ত ডানা ঝাড়ার শব্দে মুছে যায় রূপালি বৃষ্টির গান, রৌদ্রের আস্বাদ, বেদনাকে অগ্রাহ্য করার ব্যর্থ চেষ্টা।”
যেই সময়ে একই সাথে তিনি বিষণ্ণ, একই সাথে তিনি খুব আন্তরিকও। ভাস্করদা তাঁর আন্তরিকতার আড়ালের প্রকৃত শামশেরকে যেন খুঁজে পান না কিছুতে। ক’দিন আগেই ভাস্কর চক্রবর্তীর গদ্য সমগ্র পড়ছিলাম। ভাস্করদার ডায়রি দিয়ে যার শুরু। সেখানে এক জায়গায় ভাস্করদা লিখে রেখেছেন ‘আন্তরিকতাও এক প্রাচীন প্রবীণ ছদ্মবেশ।’ কথাটা কি বন্ধু শামশেরকে মনে করে লিখেছিলেন ভাস্করদা? একটা সংযোগ কি রয়েছে এখানে?
‘কৃত্তিবাস’ যখন খ্যাতির চূড়ায়, সেই সময়, প্রথম ‘কৃত্তিবাস’ পুরস্কার পেয়েছিলেন কবি শামশের আনোয়ার। আমরা জানতে পারি সত্তরের সেই মহাসময়ে তাঁর জীবন ছিল যেমন বেপরোয়া, তেমনি তাঁর কবিতাও। তাঁর ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে ওঠে মানুষের বিরুদ্ধে, মানুষের মিথ্যের বিরুদ্ধে। যে জিভ দিয়ে অনবরত মিথ্যে বলে যাচ্ছে মানুষ, অন্যের বিরুদ্ধে বাজে/নোংরা বলে যাচ্ছে, সেই জিভ তিনি ছিঁড়ে ফেলতে চান। তাঁর ক্ষোভ কপট ভালোবাসার বিরুদ্ধে। তিনি সেইসব প্রেমিকার হৃদয় চিরে ফেলতে চান। তিনি সেইসব মানুষের মগজ ফুটো করে দিতে চান যাদের মাথায় কুচিন্তা ঘোরে। গেলে দিতে চান সেইসব চোখ, যে চোখ ভালো-কে দেখতে পায় না, আলো-কে দেখতে পায় না। সত্তরের সেই সমাজ পরিবর্তনের ঢেউ কার গায়ে লাগে নি সে দিন। নকশাল আন্দোলনের কথা, হাংরি জেনারেশনের কথা আমরা তো সব জেনেছি একে একে। সেইসাথে জানছি সেই সময়ের ক্ষুব্ধ কবিদের সেইসব উচ্চারণও। অন্যদিকে সেই সময়েই বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। এ’দেশের কবিরা লিখে চলেছেন মুক্তির কবিতা, যুদ্ধের কবিতা, স্বাধীনতার কবিতা। আর আল মাহমুদ লিখলেন তাঁর আশ্চর্য কবিতাগুচ্ছ ‘সোনালি কাবিন।’
হ্যাঁ, ভাস্করদা যেই ছদ্মবেশের কথা বলেছেন তাঁর ডায়রিতে, কিংবা যে আন্তরিকতার কথা বলেছেন বইটির ভূমিকায়, যার জন্য বন্ধু শামশেরকে কোথাও সত্যিকার অর্থে পাওয়াই যাচ্ছিল না—শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাওয়া গেল তাঁর কবিতায়। সম্পূর্ণ ভাবে ধরা গেল তাঁকে। তাঁর কবিতাগুলো পাঠ করতে করতে আমরা দেখতে পাবো, মা আর প্রেমিকার ভালোবাসায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন তিনি জীবনের অনেকটা সময়।
তোমাদের বাড়িতে ছিলো না সীমান্তপ্রদেশকাঁটাতার, গুর্খা কিংবা গোলাবারুদপ্রসূতিসদনের দ্বার খোলা ছিলো রাত দুটো অবধিতোমার মা সেদিন স্নেহে পাগলিনী প্রায়ব্যাকুল বাঘিনীর মতো সাহসে তেজে আমায় স্তন্যপান করিয়েছিলেনআমার তৃষ্ণার কান্না তাঁর শুকনো বুকেরদুকূল ছাপিয়ে দুধের বান ডেকেছিলোঅফুরন্ত হৃদয় ঝরেছিলো দুচোখের পাতা বেয়েতোমরা যা পাওনি আমি পেয়েছি সে সবইআমি তাঁর গর্ভের চোরাকুঠুরিতে ভ্রূণের মতো লুকিয়ে বেঁচেছি।তোমার শরীরের পাতায় পাতায় আমি খুঁজেছি তারই রক্তের দাগবুকের মধ্যহ্ন আকাশে যৌবনের দীপ্ত জ্বালাআমি তোমার সবুজ তলপেট জরায়ু আর হৃদয় খুঁড়ে-খুঁড়েফিরে পেতে ছেয়েছিলাম স্মৃতির ধ্বংসাবশেষ।[ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে ]
হ্যাঁ, ছোট্ট জীবনে(১৯৪৪-১৯৯৩) মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশ হতে পেরেছিল তাঁর। মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে (১৯৭৩), মূর্খ স্বপ্নের গান, শিকল আমার গায়ের গন্ধে (১৯৯১) এই তিনটি কাব্য আর কিছু প্রবন্ধ। আর এই দিয়েই বাংলা কবিতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছেন নিজের। ছোট্ট জীবনে অনেক বন্ধুই পেয়েছিলেন তিনি। তেমনই একজন ছিলেন কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ইন্ডিয়াটাইমস-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আমরা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে বলতে শুনি –
Shamsher Anwar was my friend. We used to spend a lot of time together. He was an eminent poet. We started writing around the same time. But Shamsher, at one point of time, thought he wasn’t contributing much and got very upset. I tried pulling him out of that state. Creativity makes you very difficult. I know I too can get very difficult at times. Having lost his mental balance, Anwar tried to commit suicide. No, he didn’t die. For one month, he was lying like a log on the hospital bed. I would sit by his bedside and the doctors gave up hope. We lost him eventually. But I’m still very fond of the name. Whenever I hear Anwar, I look around, there’s a happy feeling inside me.
আর, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আনোয়ার কা আজিব কিসসা রিলিজ করেন ২০১৩ সালে। বন্ধু আনোয়ারকে নিয়ে তাঁর এই ফিল্মে অভিনয় করেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। The film about a detective in search of himself. ছবিটি বাংলায় করার ইচ্ছে ছিল বুদ্ধদেবের। এমনকি script প্রথমে বাংলায়ই করা ছিল। কিন্তু বাংলায় আনোয়ার চরিত্রের জন্য উপযুক্ত অভিনেতা পাচ্ছিলেন না। তাঁর পছন্দ হয়ে উঠলো নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। তাই, পরে সিদ্ধান্ত নিলেন ছবিটি হিন্দিতে করবেন। নওয়াজের অসাধারণ অভিনয়ে আমরা দেখতে পাই সেই আনোয়ারকে যিনি একজন তুখোড় গোয়েন্দার মতোই ঢুকে যাচ্ছেন নিজের জীবনের পরতে পরতে। অনুসন্ধান করে চলেছেন জীবনের গূঢ় সত্যকে।
কিন্তু আমরা, বাংলা কাব্য সমাজ, সাহিত্য সমাজ কী করতে পেরেছি শামশের আনোয়ারকে নিয়ে? তাঁর কবিতা প্রকাশ হতে শুরু করে গত শতাব্দীর সেই ষাটের দশকে। প্রথম বইটি বেরোয় ১৯৭৩ সালে। তারপর দীর্ঘ বিরতির পর আবারও ১৯৯১-এ। তিনি হাংরি কবি ছিলেন বলে, কৃত্তিবাসের কবি ছিলেন বলে, নাকি অন্য কোনো রহস্যের কারণে অবহেলিত থেকে গেলেন?
সেই ’৭৪ এ ‘কৃত্তিবাস’ পুরস্কারের পর ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যান তিনি। সুনীলদা বলেন, ‘প্রত্যেক প্রকৃত কবিই আস্তে আস্তে নিজের চারপাশে একটা অস্বচ্ছ বৃত্ত তৈরি করে নেন, স্বেচ্ছায় কখনো তার থেকে বেরিয়ে আসেন, আবার অনেক সময় অগোচর থাকতেই পছন্দ করেন।.. কোনো কবিকেই সম্পূর্ণভাবে চেনা যায় না। মানুষ হিশেবে, কবি হিশেবে।’ –এই জন্যই কি শামশের আনোয়ারকে কোনো কাব্য-সমাজের বৃত্তে ধরা যায় নি আর। তাঁর কবিতা কোনো প্যাটার্নে পড়ে না। অনুসৃতও হয় না। তিনি বিশুদ্ধ শব্দ নির্মাণের কবি? যদিও নক্ষত্র হওয়ার জন্য যতটা জ্বলজ্বল করা দরকার শামশের আনোয়ার-এর বেলায় সেটা জোটে নি। যদিও তাঁর কবিতা, বাংলা কাব্য জগতে নিয়ে আসে নতুন ভাবনা আর শব্দের সন্তরণ। নিয়ে আসে অভিনব প্রকাশ ভঙ্গি। যা আমাদের, পুরো একটা শতাব্দী পেরিয়ে এই শতাব্দীতে এসেও বিস্মিত করে তোলে। আমরা অস্থির হয়ে উঠি আর উন্মুখ থাকি তাঁর কবিতা পড়ার জন্য। সচেষ্ট হই অগোচরকে গোচরীভূত করতে।
ভাস্কর চক্রবর্তী তাঁকে দুর্লভ সশস্ত্র, আধুনিক কবি হিসেবে অভিহিত করেছেন। শামশের আনোয়ারের নিজেরই ভাষায় আমরা জানতে পারি, একজন খুনির সাথে একজন কবির এক জায়গায় সূক্ষ্ম মিল আছে। আসলে, খুনির মতো রাগ না থাকলে কবিতার টুটি চিপে ধরা যায় না। এই জন্যেই হয়তো তাঁর চরিত্র ক্ষুব্ধ, আক্রমণাত্মক আর দুঃসাহসিক। তেমনই তাঁর কবিতাও। সময়ের প্রবাহে শামশের আনোয়ারের কবিতা আরও রাগী ভাষা নিয়ে হাজির হয়েছে পরবর্তীতে। প্রথম কবিতাবই মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে থেকে মূর্খ স্বপ্নের গান তারপর শিকল আমার গায়ের গন্ধে নামগুলোর মধ্যেই সেই ক্রোধের আভাস পাওয়া যায়। শামশের ভাইয়ের কবিতা যেন তাঁর বেপরোয়া জীবনের মতোই ছটফট করে।
আমি নিবৃত্ত নয় কিংবা সৈনিকচাকার গর্জনে ঝ’রে পড়ে না স্ফুরিত আলোকগভীর কোকিল ডেকে ওঠে না চোখের ভারি পাতায়আমার নয় দ্রুততার থেকে আরো দ্রুততার দিকে স’রে যাওয়াযেমন সুঁচের স’রে যাওয়া রক্তের ভিতর হৃদয়ের দিকেহুঁকো হাতে ব’সে থাকবো প্রাচীন অন্ধকারে ত্রিকালদর্শী প্যাঁচাউপায় নেই তারওকেননা এখনো আছে লোভএখনো তৃষ্ণা আছে যদিও শরীরে নেই সে রকম উত্থাননিবৃত্ত নয় কেননা এখনো জীবনের দু-কস বেয়ে ঝ’রে পড়ে লালাএখনো নিইনি ছিঁড়ে সমবায় সুতোসুতরাং সৈনিক নয়তীর ও তরণীর পাশে আমার শরীর গভীর আলস্যে শুয়ে থাকেযেরকম তৃষ্ণার পাশে শুয়ে থাকে মাতালের হাতআমি ঘৃণা কারি স্রোতের চঞ্চলতাওতবে কি আমি জন্ম-অন্ধ তীরদু-চোখে বাঁধা জীবনের গাঢ় লাল সর্বনাশআমি কোন লক্ষ্যের দিকেআমি কোন লক্ষ্যের দিকে।[আমি কোন লক্ষ্যের দিকে]
কবিতায় প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙেন তিনি। ভেঙে ভেঙেই এগিয়ে যান। তারপর একসময় কোথাও যেতে না-পারার বিষাদ এসে ভর করে। কিছুই লিখতে না-পারার অবসাদ। কিছুই দিতে না-পারার যন্ত্রণায় নিজেকে শেষ করে দিতে চান। কবি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়রি থেকে জানতে পারি তিনি শামশেরকে নিয়ে লিখেছেন, ‘আজ সকাল ৮ টায় শামশের আনোয়ার শামশেরকে মেরে ফেলল। আত্মহত্যা করার কথা থাকে, অনেকেই করে না। প্রয়োজনও থাকে না। কারণ মৃত্যু তো আগেই হয়ে গেছে, শামশের ভীষণভাবে বেঁচে ছিল। তাই কলকাতার সাহিত্য-সংসারে সে ছিল একজন প্রকৃত একঘরে কবি।’ শামশেরকে মেরে ফেলা হয়েছিল। অত্যন্ত কুৎসিত ভাবে হৃদয় যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে করে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁকে। কবিতার কাছেই খুন হলেন তিনি। সেটা ছিল ১২ই জুন, ১৯৯৩।
৩১শে জুলাই, ২০২১
কৃতজ্ঞতাঃ আমারবইডটকম, ইন্ডিয়াটাইমস, মাসুদ পারভেজ, আহ্নিক বসু।
আপনার প্রবন্ধটি পড়লাম। খুব সাবলীল ভাবে কবি শামশের আনোয়ার’কে খুঁজেছেন। তবে শামশের আনোয়ার এখনো আছেন কোন স্তনের গহীনে। ভালো লাগলো আপনার আলোচনা।
উত্তরমুছুননাঈম ভাই,, আপনার মূল্যবান মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগলো। আমার মনে হয়, শামশের আনোয়ার যে মেদহীন, তীক্ষ্ণ, তেজোদ্দীপ্ত কাব্যভাষা সৃষ্টি করেছেন বাংলায়, তাকে নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়ার আছে আমাদের। তাঁর অনেক কবিতাই উদ্দীপিত বাস্তবতায় (augmented reality) আলোড়িত। যেটা অন্য একটি গদ্যে কিছুটা বলার চেষ্টা করেছি। ভালো থাকবেন।
মুছুনশামশের আনোয়ারের নাম শুনিনি কুনোদিন৷ পাঠক হিসেবে আমার ব্যর্থতা৷ আজ গুগল সার্চ করে তার অনেকগুলো কবিতা পড়লাম৷ ভাল্লাগলো৷ প্রবন্ধ রচনা করে আমার মত পাঠককে কবির সাথে পরিচয় করানোর জন্য থ্যাঙ্কস৷
উত্তরমুছুনধন্যবাদ মনোময় দাদা। এই গদ্যটির এটাও এক ধরনের সার্থকতা, যে একজন পাঠককে শামশের আনোয়ারের কবিতা পাঠে আগ্রহী করা গেছে। শুভ কামনা জানবেন।
মুছুনখুব মনযোগ দিয়ে দুইবার পড়লাম৷ আগে কোন এক লেখায় এনার সম্পর্কে একটু জেনেছিলাম৷ আজ বিস্তারিত জেনে আরো কৌতুহল বেড়ে গেল৷ বইয়ের লিংক থাকলে দিয়েন প্লিজ
উত্তরমুছুনhttp://www.amarboi.com/2019/10/shamsher-anowar-kobita.html
মুছুনread/download option এ গিয়ে নামিয়ে নিন। তারপর পড়ুন। ধন্যবাদ।