শহীদ কাদরী: চেতনা বিন্যাসের প্রেসক্রিপশন
চঞ্চল নাঈমের কবিতাজঙশন
কবিতার অনুভূতির ভাঁটফুল, চিন্তার সুবিন্যাস, অভিজ্ঞতার আবেগ মিশ্রিত সুক্ষ্ণতা ও রূপগত রাত্রির মৌনতা সুস্পষ্ট। শহীদ কাদরী ১৪ আগস্ট ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারতের কলিকাতায় জন্ম এবং ২৮ আগস্ট ২০১৬ (বয়স ৭৪) নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৪৭-পরবর্তীকালের বাংলা কবিতায় নাগরিক ধারা ও নাগরিক জীবন সম্পর্কিত, প্রণয়ের আবেগ মিশ্রিত একাধিক কবিতা লিখেছেন। কাব্যযাপনে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি 'উত্তরাধিকার' প্রকাশিত চট্টগ্রাম বইঘর প্রকাশনী থেকে ১৯৬৭ সালে। একই প্রকাশনী থেকে একই সাথে প্রকাশিত শামসুর রাহমানের 'বিধ্বস্ত নীলিমা', আল মাহমুদের 'কালের কলস'। এই তিন কবির কবিতার বই একই সময়ে, একই প্রকাশনী থেকে প্রকাশের কারণ কি? আর্তচিৎকার আর অস্থির কাতরতার মিলিত কোন সংযোগ? হয়তো না, কিন্তু সময়ের অনুরণনের এক্কা-দোক্কা, ছায়া-ছাপ। তবে জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী সময়ে শহীদ কাদরীর কবিতা কতোটা চিহ্নবাহক হয়ে থাকে? এমন সব মিশ্র প্রশ্ন চেতনায় রেখেই কবিতার কথাবার্তা উৎসারিত করি।
শহীদ কাদরীর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ব্যবধান একটু কম হলেও কিন্তু চতুর্থ কাব্যগ্রন্থটি ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ প্রকাশিত হয় প্রায় ৩০ বছর পর ২০০৯ সালে। এই বইয়ের নামের সাথেই যেন আকাঙ্ক্ষার বার্তাবাহক ও দূরত্ব-ক্রন্দন জড়িত। দেশের মানুষের কাছে তার প্রিয় শব্দগুলো, কবিতাগুচ্ছ পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানালেন।প্রবাস জীবনযাপন করলেও তিনি আপাদমস্তক বাংলাদেশের কবি, তাঁর রচিত ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ চতুর্থ কাব্যগ্রন্থটি প্রকৃত পরিচায়ক। শহীদ কাদরী দেশভাগের ক্ষত-পীড়া, ৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ তৃষ্ণার্ত সকল রাজনীতির সাক্ষী। কিন্তু তার রক্তের রন্ধে-রন্ধে কবিতার উপাদান মৃত্যু অবধি বহমান। বোহেমিয়ান জীবনযাপনে অভ্যস্ত সেহেতু, কোন কাজই কখনোই স্থির ভাবে করেন নি।
শহীদ কাদরী স্বল্প সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনেও চাকরি করেন। শোনা যায়, শহীদ কাদরী একবার ছাপাছাপির ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হন। মূলত, প্রয়াত কবি আবিদ আজাদ ছিলেন ব্যবসা করার উৎসাহ দাতা। আবিদ আজাদ এবং আরো কিছু কবি তার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্তও হন। তিনি যে ব্যবসায়িক মানুষ নন, তা কিছু দিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যায়। কিছু দিনের ভেতর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা না, শহীদ কাদরী সেখানে নিয়মিত আড্ডার আসর বসাতেন। শহীদ কাদরী আড্ডা পাগল মানুষ, সেখানে আড্ডাই প্রধান বিষয়। সমসাময়িক ও তরুণ কবিদের নিয়ে তুমুল আড্ডা হতো। আড্ডা কীভাবে জমাতে হয়, তা তিনি হাড়েহাড়ে জানতেন। এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে দ্রুতই ঢুকে পড়তে পারতেন। আড্ডা জমে উঠতো কবিতা ছাড়াও সেই সময়ের রাজনৈতিক পেক্ষাপটসহ নানান বিষয়-আশয়। সম্ভত, কবি শামীম রেজা আজকের কাগজের সূবর্ণরেখায় শহীদ কাদরীর দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার ছাপেন। সেই সাক্ষাৎকারে তাঁর ঢাকার লাইফ, কবিতা জীবন-যাপনসহ নানান প্রসঙ্গের স্মৃতি চারণ করেন। কবিতায় ফেরার আকুতি প্রকাশ পায় তার সেসব কথপকথনে। প্রবাস-জীবনে তিনি বিভিন্ন লাইব্রেরীতে যেতেন এবং নানাধরনের বই পড়তেন। একদিন এক লাইব্রেরীতে যেয়ে বই দেখছেন, হঠাৎ দেখেন শামসুর রাহমানের একটি বই ফ্যাল-ফ্যাল তাকিয়ে আছে। বইটি দেখে আবেগ তাড়িত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য কবিতার স্মৃতিতে ফিরে এসেছিলেন। নতুন কবিতা লেখার আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল তখন। কবিতায় অপ্রত্যাশার ক্রন্দনে চির-আকাঙ্ক্ষার বাহ্যিকতায় বছরের পর বছর বা মৃত্যু অবধি বিদেশে থাকেন। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার আগেই লিখে গেছেন 'কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই'। তবে তাঁর ভিতরে ভিতরে ক্রন্দন থেকে গেছে কবিতার জন্য, দেশের জন্য, ঢাকার আড্ডার জন্য, পথের দূরত্বে। শহীদ কাদরীর কবিতা সম্পর্কে বলতে গেলে শামসুর রাহমানের কবিতা আর আল মাহমুদের কবিতার প্রসঙ্গ এসে দাঁড়ায়। শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে ঢাকা শহেরর নাগরিক বিবর্তন সহজেই দেখা যায়। আর আল মাহমুদ ঢাকায় বসবাস করেও লোকোজ ও গ্রামীণ জীবনবোধ তাঁর কবিতার অনুসঙ্গ করেন।শহীদ কাদরীর কবিতায় প্রণয়, আনন্দ-আড্ডা, বিষাদ-বেদনা, সময়ের রাজনীতি, জীবনের নিঃসঙ্গতা পীড়াযুক্ত বিষয়-আশয় বিবেচিত প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা। বৃষ্টি কবিতার অবিরল চলন দেখি, কবিতার কিছু পঙক্তি নিয়ে—
বৃষ্টির বিপুল জলে ভ্রমণ-পথের চিহ্নধুয়ে গেছে, মুছে গেছেকেবল করুণ ক’টাবিমর্ষ স্মৃতির ভার নিয়ে সহর্ষে সদলবলেবয়ে চলে জল পৌরসমিতির মিছিলের মতোনর্দমার ফোয়ারার দিকে,ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো বেজে সিগারেট-টিনভাঙা কাঁচ, সন্ধ্যার পত্রিকা আর রঙিন বেলুনমৃসণ সিল্কের স্কার্ফ, ছেঁড়া তার, খাম, নীল চিঠিলন্ড্রির হলুদ বিল, প্রেসক্রিপশন, সাদা বাক্স ওধুষের,সৌখিন শাটের ছিন্ন বোতাম ইত্যাদি সভ্যতারভবিতব্যহীন নানা স্মৃতি আর রঙবেরঙের দিনগুলি[ বৃষ্টি, বৃষ্টি/ উত্তরাধিকার ]
শহীদ কাদরী নিজস্ব কবি সত্তা নিয়ে অনিশ্চিত যাত্রা করেন। সেই সাথে নাগরিক রুচি ও জীবনের নিঃসঙ্গতা কবিতার অনুসঙ্গ করেন। কিন্তু এক বোহেমিয়ান জীবনের খাম ছন্নছাড়া সেই নীল চিঠিকে ঘিরে লক্ষহীন হেঁটে চলে। নিজস্ব চলনে কবিতার বক্তব্যটিও স্বতন্ত্র দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বৃষ্টিতে নাগরিক হৃদয় ভেসে যায়।এমনকি ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো কালো সংকেতময় স্মৃতিতে ঝরে পড়ে। সভ্যতার নানা মাত্রিক বিভাজন স্মৃতিতে আসে—
কে দ্যাখে নি? আজীবন নন্দিত রবীন্দ্রনাথ থেকেশুরু করে তিরিশ ও তিরিশোত্তর অনেকেই,এমন কি কোন-কোন অনুজ পর্যন্ত। আর তোমার নিবিড়নীলাকাশ, যার নিচে ভাঁটফুলের ঘুঙুর শুনেএকদা জীবনানন্দ বসবাসযোগ্য ভেবেআমরণ থেকেই গেলেন বাঙলাদেশের শহরতলীর কোনস্বল্প-পাওয়া ময়লা-ধোঁয়াশা-ঢাকা বৃক্ষের মতন।[ নিসর্গের নুন/ উত্তরাধিকার ]
কবিতাটি প্রয়াত কবি রফিক আজাদকে উৎসর্গ করা,প্রচণ্ড ইঙ্গিতমূলক সচেতন দৃষ্টি আকর্ষন করে।সোজাসাপটা অনুভূতির প্রকাশ। তার চোখে ধরা পড়ে আজীবন বটবৃক্ষের মতো এখনো বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ।তবে তিরিশোত্তর জীবনানন্দকেও ছাড় দেননি।এমনকি কোন কোন অনুজ কবি যেন সমকালে উজ্জ্বল, এই সকল বিষয় সমূহ তাকে মৌন ভাবে পীড়া দেয়। কবিতার শেষ পঙক্তিতে নিসর্গের ধোঁয়াশায় নুন ঢেলে দেন। তিনি হয়তো, নতুন কোন কবি খুঁজে না পাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বোঝাতে চেয়েছেন এরাও আর তেমন কি? যেভাবে আজীবন রয়েছে দাঁড়িয়ে-
ভয় নেইআমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনীগোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়েমার্চপাস্ট ক’রে চলে যাবেএবং স্যাল্যুট করবেকেবল তোমাকে প্রিয়তমা।[ তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা/ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ]
নাগরিক বাস্তবতায় প্রেমচেতনার ভিন্ন ধরনের উদাহরণ এই কবিতা।সংগ্রাম-অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরহ আর্তচিৎকার কবিতাটির বিষয়বস্তু।বলে রাখা ভালো, কবি বোদলেয়ারও অল্প সংখ্যক কবিতা লিখে অধিক পরিচিতি পেয়েছিলেন। প্রায় সেইরকম ভাবে শহীদ কাদরীও স্বল্প সংখ্যক কবিতা লিখে সহজেই সকলের নিকট নিজের সক্রিয়তার পরিচয় দেন। তবে আমার মনে হয়, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’উত্তরাধিকার’ পর বাকি কাব্যগ্রন্থের কিছু কিছু কবিতা ভালো লাগলেও, প্রথম বইয়ের কবিতাগুলো অতিক্রম করে নি। তার কারণ হয়তো প্রথম বইয়ে, প্রথম যৌবনের ঠাসা অনুভূতি আর অজস্র ঘন চিত্রকল্পে ভরা। তবে নিম্নে গুঞ্জন প্রসারিত ছন্নছাড়া বোধগুলো প্রেমের পরিণতি জেনেও অনুযোগে আসে। কবিতার চলন-বলন লক্ষনীয়—
ফুস্ফুসের ভিতরে যদি পোকা মাকড় গুঞ্জন করে ওঠেনা, প্রেম তখন আর শুশ্রুষাও নয়; সর্বদা, সর্বত্রপরাস্ত সে; মৃত প্রেমিকের ঠাণ্ডা হাত ধরেসে বড়ো বিহ্বল, হাঁটু ভেঙে-পড়া কাতর মানুষ।মাথার খুলির মধ্যে যখন গভীর গুঢ় বেদনারচোরাস্রোত হীরকের ধারালো ছটার মতোবয়ে যায়, বড়ো তাৎপর্যহীন হয়ে ওঠে আমাদেরঊরুর উত্থান, উদ্যত শিল্পের লাফ, স্তনের গঠন।[ প্রেম / কোথাও কোন ক্রন্দন নেই ]
জীবনের দ্বন্দ্বের দূরত্বে প্রকাশিত কম্পমান মনের বিহ্বলতা। বাস্তবের অসহায়তার ইঙ্গিতে সংঘাত-সমস্যা ও জটিলতার স্রোত আর্ত প্রয়াসে ক্রমাগত ধারালো। এখানে বেদনা জড়ানো অভিজ্ঞতা অধিক আবেগ ব্যক্ত করেন। জীবনের পরিব্যপ্ত পারিপার্শ্বিক সামাজিক ঘটনা সরল ভাবে দেখা যায়। যৌনতার মৌন প্রকাশ উঠে আসে সাধারণ বর্ণনার সম্মোহনে।
শহীদ কাদরী বাংলাদেশের কবিতার আধুনিক মনন-চেতনার ও জীবন-অভিজ্ঞতার নান্দনিক শক্তি। তাই তাঁর কবিতা পাঠকের নিকট বাংলা কাব্যে স্বতন্ত্র কণ্ঠে স্বকীয়তায় এখনো আলোচিত আর্তি।
''শহীদ কাদরী বাংলাদেশের কবিতার আধুনিক মনন-চেতনার ও জীবন-অভিজ্ঞতার নান্দনিক শক্তি।''--
উত্তরমুছুনভালো লেগেছে আপনার সুলেখনীর মাধ্যমে কবি শহীদ কাদরীর এই কবি-জীবন ও কবিতার বিশ্লেষণ প্রয়াস। যখনই তাঁকে পড়তে যাই, কাদরীর স্বতন্ত্র স্মার্ট স্বর আমাকে অভিভূত করে। তবে, এও মনে আসে, ৭৪ বছরের জীবনে এতো কম কেন লিখলেন! একটা অতৃপ্তি তাড়া করে।
এই বিভাগ সুন্দর আয়োজন৷ চলুক৷ বিন্দু সত্যিকার কাজটা করছে৷ �� এরকম আরো নিয়মিত প্রবন্ধ পড়তে চাই
উত্তরমুছুনশহীদ কাদরীকে নিয়ে লেখা বিন্দু প্রকাশ করবে এটা অপ্রত্যাশিত৷ ভালো লাগলো৷ বিন্দু এদেশের লিটলম্যাগ আন্দোলনে ডিফরেন্ট কালচারের ভ্যানগার্ড
উত্তরমুছুনকী দারুণ বিশ্লেষণ। পড়ে খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনভালো লেগেছে কবিতার আলোচনা
উত্তরমুছুন