জীবনানন্দ, তোমার মৃত্যু— মৃত্যু নয় জীবনেরই যাত্রা
প্রিয় কবিতার আলোচনা
হিম ঋতব্রত
হিম ঋতব্রত
চৌদ্দই অক্টোবর ১৯৫৪, বৃহস্পতিবার। সান্ধ্য ভ্রমণের পর বাড়ি ফিরছেন কবি। অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পেরোতে পেরোতে কি জানি কেন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন ট্রাম লাইনের ওপর! আর অদূরেই বাজছে ট্রামের ঘণ্টাধ্বনি— এরপর শান্ত ট্রামটির নিচে— চাপা পড়ে— কিছুটা থ্যাতলে গেলেন! জীবনের সমস্ত অনুভূতি যেখানে জমে থাকে; যেই পাঁজরের কাছাকাছি হৃদয়ে— সেই পাজরের হাঁড় ভেঙে গুঁড়ো হলো। ভাঙা হাঁড়ের গুঁতোয় ক্ষত হলো ফুসফুস ! তারপর শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল। চলছে মুমূর্ষু কবির বিছানাযাত্রা। মাঝে মাঝে কবিকে দেখতে মৃদু কোলাহল জমে হাসপাতালে।পৃথিবীর শান্ত সুরে কবিকে সব সময় সেবা করে চলছেন নার্স। জীবনানন্দের নার্স, সেই শান্তি মুখার্জি— টানা আটদিন— রাতদিন প্রাণভরে ভরে সেবা করে, অবশেষে বাইশে অক্টোবর রাতে কবির মৃত চোখ কোমল হাতে বুজে দিলেন।
তারপর কবির এই পৃথিবীর জীবনপর্ব শেষ করে, বিরতিহীন পথহাঁটা শুরু হলো। জীবনানন্দের এ-ই মৃত্যু— হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার যাত্রা।
আর এই মৃত্যু নিয়ে কত কথা বলে মানুষে—বলবেই— বলতে হয়...
ঘটনা, দূর্ঘটনা অথবা অঘটন ইত্যাদি পেরিয়ে লোকের মাথায় রহস্য ঘোরে—মৃত্যু রহস্য! কবির মৃত্যুর প্রকারভেদ নিয়ে চলে ঘাটাঘাটি, কাটাকুটি।
ধ্যাৎ এসব রহস্য ফহস্য এত আজুরে বিষয় আমরা বুঝি না বাপু- আমরা জীবনবাবুকে চিনি কবিতায়! কবিতাই তো কবির আসল পরিচয়, কথা বলা ও সব— সমস্ত কিছু। আমরা কোনো সুইসাইড নোট চিনি না; কবিতা পড়ি —কবিতা না পড়লে শান্তি আসে না মনে!
ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি : এখন গভীর রাতকবেকার কোন্ সে জীবন যেন টিটকারি দিয়ে যায়‘তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক— ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাইকখন এমন হলে, হায়!’আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারেকবেকার কোন্ সে জীবন ডুবে যায়।কোন্ দিকে যেতে হবে? নিস্তব্ধ শহর কিছু জানে নাকোসে শুধু বিছায়ে আছেবিশ্বাসীর বিধাতার মতো।কোলে তার মুখ রাখি— বিশ্বাস করিতে চাই, তবু মনে হয়শহরের পথ ছেড়ে কোনো দিকে হেঁটে যদি চলে যেত আমার হৃদয়অজস্র গ্যাসের আলো গ্যাসের আলোর পিছে ডাকেবিমর্ষ গলির ফাঁকে ফাঁকেআঁধারের কাতর আকূতি এসে ডেকে লয়তাহাদের চিনি আমি— তারাও আমার মতো; সব জানে ; তাই এতঅন্ধকার ক্লান্ত হিমএই গলিগুলো।তবু তারা পথ চলে নাকো— ঘুমের গভীরে ডুবে নক্ষত্রের তলে একঅবসর পায় তারাআমারে কে অবসর দেবে?স্কোয়ারে ঘুমায় যারা নগ্ন হয়ে শীতরাতে কিংবা ফুটপাথেতাহাদের মতো করে কথা কে ভুলিতে দেবে? কথা কে ভুলিতেদেবে? আমারে ভুলিতে দেবে কথা?গ্যাসের আলোর নদী অবিরল— এঁকেবেঁকে গিয়ে শেষে কোন্ পথেকোনো অভিজ্ঞতাজাগাতে যাবে না আর?[ট্রামের লাইনের পথ ধরে]
হ্যাঁ, “গ্যাসের আলোর নদী অবিরল— এঁকেবেঁকে গিয়ে শেষে কোন্ পথে
কোনো অভিজ্ঞতা
জাগাতে যাবে না আর?”
এ-তো জীবনানন্দের হৃদয়েরই কথা! যা তিনি মৃত্যুর কত পূর্বেই লিখেছেন। তাহলে আমরা কীসের ইঙ্গিত পাই? নাকি এ কেবল আমার মনের প্রশ্ন কিংবা ভ্রান্ত অনুমান। তবুও আমার সকল প্রশ্ন ও অনুমানকে মিথ্যা মনে হয়! যেন ডাহামিথ্যা। এত স্পষ্ট কথার পরেও আমার বারবার কেন মনে হয় জীবনানন্দ তুমি আত্মহত্যা করনি।
তোমার ধ্যান, তোমার কবিতা নিয়ে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছো তুমি, তোমার মৃত্যু— মৃত্যু নয়, জীবনেরই যাত্রা...
এই কবিতাটি কীভাবে আমার হয়ে ওঠে! মনে আছে, ১৫ বছর আগে, নির্দিষ্ট কোনও জীবিকা ছিল না তখন, প্রায় প্রতি রাতেই সিগারেট হাতে হেঁটে বেড়াতাম ঢাকার রাস্তায়। যদিও ট্রামের লাইনের কোনও পথ ছিল না, নেই এখনও, তবু এই মেট্রোপলিটনের রাজপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কবিতাটি আমার হতে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মনে মনে আওড়াতাম --
উত্তরমুছুনআকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে
কবেকার কোন্ সে জীবন ডুবে যায়।
কোন্ দিকে যেতে হবে? নিস্তব্ধ শহর কিছু জানে নাকো
সে শুধু বিছায়ে আছে
বিশ্বাসীর বিধাতার মতো..
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা
মুছুনএই কবিতাটি একটু কম আলোচিত কিন্তু আমার বিশেষ প্রিয়৷ এই কবিতা নিয়ে লেখা আহা বড় মিস্টি
উত্তরমুছুনহ্যাঁ। ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।
মুছুনজাগাতে যাবে না আর?
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুনএই কবিতাটি আমারো ভালো লাগে খুব।
উত্তরমুছুন🌼
মুছুন