কঙ্কালের ভিতর সাদা ঘুম
ছোটগল্প
বনমালী মাল
বনমালী মাল
হোঠ শালা…
বলে চেনা ছন্দের থেকে একটু গতি বাড়িয়ে স্টোন চিপটা এড়িয়ে গেল সে। সচেতন না থাকলে, বলা ভালো, পেছন দিকে না তাকালে পায়ের হাঁটু থেকে নিচের যেকোনো অংশে লাগতে পারত সেটা।
একসাথে কতগুলো মুখের ছবি পাল্টে যায় নিমেষে। বেশির ভাগ মুখে আলতো হাসি। সেই হাসির আপাত অর্থে কোনো অর্থই হয় না। আবহমান কাল থেকে এমন হাসিকে আমরা সবাই কোনো না কোনো সময় মুখে নিয়ে এসেছি। জানতে। অজান্তে। কারো মুখে দায়সারা বিরক্তির ভাব। প্রশমিত ক্ষোভ। তারা বলতে চায় যেন, কেন তাকে ঢিল ছোঁড়া হচ্ছে! তাদের ভ্রু গেছে কুঁচকে। ভ্রু যায় কুঁচকে। তাদের পা তবু স্থির। স্থাণু তারা।
সে বলে। বলে চলে। একা। ফাঁকা মাঠ। শুধু আকাশমণি গাছের টোপর টোপর ফুল পড়ে। চিৎকার করে বলে। চুপ থাকে। আবার বলে। এবার যখন বলে, তখন সেখানে বাজার। সবাই তাকায়। তার গলার স্বর ঘ্যাসঘ্যাসে। পাথরের ঘানিতে পেষাই হওয়ার পর যখন চোখে দেখা যায়, খোসাগুলো বেরিয়ে আসছে একদিক থেকে, তখন মাথার মধ্যে যে শব্দটার জন্ম কল্পনা করা হয়, তেমন তার স্বর। তার প্রতি কথার জন্ম হয় সপ্তমে। তারপর খাদ বেয়ে নেমে আসে।
—তোদের মাকে লিই শালা। হারামি…
এবার যারা স্টোনচিপ ছুঁড়েছিল, তাদের দিকে মুখ করেছে সে। পথ অতিক্রম করার ভাবনা তখনও তার মাথায়। তাই পেছনের দিকে আস্তে আস্তে পা পেছাতে থাকে। লোকেরা তখনও কাঁচা কৌতূহলী। তারা নিশ্চিত, সে তাদের মা’দেরকে নিতে পারে না। পারবে না।
সে এমনই ছিল। পাগল। নোংরা। পাগল। লোকের কথায় শেয়ান। নোংরা। পাগল। কাঁচা মুখ। পাগল।
পাগল
পাগল
পাগল
প্রথম প্রথম হারু দত্তকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। তার নিজের স্বার্থে। তারপর দত্ত বাড়ির সবাই যখন নিজের নিজের স্বার্থ বুঝতে শুরু করল, তখন বাইরের লোককে, দেখা হলেই, জানতে না চাইলেও তারা বলে বোঝাতে লাগল,
—পায়ে ঘা হয়ে যাচ্ছে, জান ত… উ যা করতে চায়, করু। আর কী বলব বলত!
কেউ কেউ মনে মনে একটু হাসে। কেউ আবার ঠোঁট কাটার স্বভাবে বলে ফেলে,
—তাহলে এতদিন কী মারাতে বেঁধে রাখছিল?
একটু হাসি হেসে বক্তা মনের রাগটা দত্ত বাড়ির শ্রোতার সামনে ভাসিয়ে দেয়। দত্ত বাড়ির প্রতিটা লোক এইসব গোপন ভাব বোঝে। গোপনে কানাকানি অনুভব করে। কিন্তু তারা উদাসীন। হারু দত্তকে নিয়ে এর থেকে বেশী আর কিছুই যেন করার নেই তাদের।
হারু দত্ত আছে ভালো। সংসার নেই। চিন্তা নেই। ভালো থাকার সময় যে যে চিন্তা তাকে কুরে কুরে খেত, তারা আর ভিড় করে না। সুস্থ থাকা যে এই সমাজ আর সংসারের পক্ষে কতটা কষ্টদায়ক, কতখানি সমঝদার হলে এখানে তুমি ঠাঁই পাবে, এইসব তাকে অবাক করেছে। পাগল করেছে। ঝুল কালি ধুলা মাখা ছেঁড়া জামাটা আর এসব নিয়ে তাকে ভাবায় না। বগলের কাছ থেকে একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ কোথা থেকে সে জোগাড় করে ফেলেছে। হারু দত্ত যদিও কবি ছিল না। সে পাগল ছিল। রাস্তায় রাস্তায় কাগজের টুকরো পড়ে থাকলে কুড়িয়ে নিত। পড়ত। জোরে জোরে। হয়তো ভাবত। মনে মনে। পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চলে যেত অন্য প্রসঙ্গে।
“বিরল নজির। অপারেশনে বাদ গেল শিশুর…”
শেষের বাকি অংশটুকু ছেঁড়া। হারু দত্ত নিজের মত করে এখানে একটা শব্দ বসাবেই। বসিয়েও ফেলেছে নিশ্চয়। না হলে এতক্ষণে তার মুখে একটা মুচকি হাসি খেলবে না। হারু দত্তের এমন খুঁটিনাটি কেউ লক্ষ করে না। কারণ অ-পাগলের জগতে ঢের বেশি কাজ। ঢের বেশি লোভ।
হারু ওই ছিঁড়ে যাওয়া জায়গাটায় লেজ বসিয়েছে। তারপর পুরো ব্যাপারটা আর তার নিজের মধ্যে গোপন থাকে না। সবাইকে জানানোর আনন্দে সে উপচে পড়ছে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে হারু। চারপাশের স্থির গাছ আর চলমান লোকজনকে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎই। একপাক ঘুরে নেয়। আবার হাসি শুরু করে। লেজ বসানো আর লেজ অপারেশনের ব্যাপারটা এখন আর তার মাথার কোনো অংশে নেই।
বনেদী বংশের ছেলে হারু। জলজমি আর কালা বাস্তু মিলে দত্তদের সঙ্গে এলাকার কারোরই পেরে ওঠা মুশকিল। বড় দালান বাড়ি। আগেকার দিনের ধাঁচে কাঁথ দেওয়া ঘর দেখলেই ঐতিহ্যের কথা মনে আসে। অম্লান দত্ত। বংশী দত্ত। আর হারাধন দত্ত। তিন ভাইয়ের গড়ন চাল-চলন সবই আলাদা। এদের মধ্যে আবার ছোটভাই হারাধন আরো ভিন্ন। বাবা নেই। গত হয়েছে স্মৃতির অনেক অনেক গভীরে। মা আছে। না থাকার মতই। বিশাল ঘরের এক কোণে সারাদিন বসে থাকে। বোধহয় বাধ্য হয় বসে থাকতে। একটা ঐতিহ্য আর আভিজাত্য মন্ডিত আকাশ আজ স্থির হয়ে সবকিছু দেখছে যেন। গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রঙ বেরঙের মেঘ। মাঝে মাঝে বাজের শব্দে চমকে ওঠা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তার। সেই কবে একসময় আকাশ নেমে এসেছিল দত্ত বাড়ির সবার মাঝে। কতগুলো দাগ আর দাগ নিয়ে এখনও ধৈর্য নিয়ে বসে আছে এক কোণে।
লোকে বলে, মায়ের মতোই হয়েছে হারুটা। একটু উদাসীন কিংবা উদার। কেন আমি নিজের শরীর আর মনটাকে অন্য আজে বাজে ঝামেলায় জড়াতে যাবো! এই হচ্ছে তাদের মা-ছেলের ধরণ। মা আগে সংসার টানত। ছেলেদের টেনে টেনে বড় করেছে। যদিও এখন তার নিজের এমন অবস্থার জন্য সে ছেলেদের দায়ী করে না। যে ছেলেরা তার দিকে বিনা কারণে কোনো নজর দেয়নি, সেও তাদের কাছ থেকে আশা করেনি বার্ধক্য সেবা পাওয়ার।
অম্লান দত্ত একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। গণিত কষান। বোর্ডের উপর সমস্ত ছেলে-মেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। চক ধরে রাখলেই যার অঙ্ক গড়গড়িয়ে নেমে যায় সিদ্ধান্ত অব্দি। চোখের চশমা নেমে আসে নাকের খাঁজ পর্যন্ত। কেউ ভয়ে কেউ শ্রদ্ধায় দৃষ্টি মেলায় না। এমনিতেই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ তিনি। এলাকায় তাঁর সম্মান স্যার কিংবা বাবু ব'লে। অথচ মানুষটা মানুষের সাথে ভালোমত মিশতে পারেন না নয়, মেশেন না। একটা পিছুটান কিংবা দ্বিধা বোধ থাকে বোধহয়। তবুও এলাকাতে তাঁর সম্মানে ঘাটতি হয়নি। শুধু কোনো কোনো লোক অম্লান দত্তকে সম্মানের পাশাপাশি একটু সন্দেহের নজরে দেখত। তারা ভাবত, তিনি ঘরের বাইরে আর ঘরে একরকম নন। এমন মানুষ, যিনি নিজের অবস্থান নিয়ে চরম অহংকারী, তাঁকে তাদের সুবিধার লোক মনে হয় না।
বংশী দত্ত বড় ব্যবসায়ী। ইঁট বালি সিমেন্টের দোকান। মাসে লাখ লাখ টাকার ডিলিংস হয়। দাদার কথা অমান্য করার মত সাহস তার কোনোদিনই হয়নি। তবে দু ভাইয়ের মধ্যে বৈষয়িক মিল ভীষণ। জমি জমা আর চাকরি, ব্যবসা থেকে প্রভূত আয়ে তাদের নিরঙ্কুশ অধিকার। ছোটো ভাই হারাধন কোনোদিন সংসারী বা হিসাবী ছিল না। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চায়, লাগিয়েছে অম্লান আর বংশী। ঘরভর্তি লোকের কাছেও মানসিকতার দিক থেকে হারাধন আর তার মা আলাদা হয়ে থাকে। ভাবনার জেরে। সুবিধা ভোগ করতে গিয়ে যখন সমাজ মাঝে আসে তখন ওপরের দুই ভাই মানহানির ভয়ে একটু পিছপা হলেও, শেষ পর্যন্ত কাজটা করে। যেমন হারাধন-কে তারা বঞ্চিত করেছে সবকিছু থেকে। ভাই থেকেও।
মানুষ মানুষকে বঞ্চনা করে, করতে পারে, এমন ধরণের কথা হারাধন পড়ে এসেছে। শুনে এসেছে। সে সমাজ সচেতন। বই পাগল। সারি দেওয়া বইয়ের মাঝে নিজেকে ছোটোবেলা থেকেই হারিয়ে ফেলেছে। সংসারের রেখা বা জমির মাপ সে খুঁজেও দেখেনি কোনোদিন। নিজেকে নিয়ে তার কোনোরকম ভাবনাই ছিল না। ভাবনা তখন এল, যখন তার প্রিয় মাকে দাদারা আর বৌদিরা এক কোণে করে রাখতে লাগল। মা অনেকটা বাধ্যই হল এমনটা করতে। পড়াশোনার মৃত্যু হল হারাধনের। দেশ বিদেশ জগৎ সমাজ বিষয়ে তার আর কোনো আগ্রহ রইল না। সমস্ত ভাবনা সুঁচের মত মা-তে গিয়ে আটকে পড়ল। যেন ঠোঁট গুঁজে পড়ে আছে একটা শামকল। পালকের নিচে তার নরম হৃদয়। চোখগুলোর দৃষ্টি শুকিয়ে গেছে তার।
খাবার এখনও সে পাচ্ছে। তার মা-ও। ওই পরিবার থেকেই। কিন্তু ভাবনা চিন্তা করতে যে মানসিক পুষ্টির দরকার, তা এখন হারুর কাছে নেই। সে জানতে পারল, দু' দাদা তার ভাগের সম্পত্তিটাও হস্তগত করে নিয়েছে। অর্থাৎ খাবার যে দিচ্ছে, এটা দয়া করেই। তখনও হারাধন সুস্থ ছিল। পাগল হয়নি।
যে লোকটা সারাজীবন বিশ্বাস করে এসেছে মানুষের মানুষ হওয়াকে। ক্রম উন্নতির ধারাকে শ্রদ্ধা করে এসেছে। সেই লোকটা এমন ভাবে সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পাবে!
ওদেরকে এমনভাবে নিঃশর্ত বিশ্বাস করার জন্য নাকি নিজেকে ওদের মত করে গড়ে তুলতে না পারার জন্য, হারাধন বুঝতে পারে না, মাথার মধ্যে অবিরাম কারো পায়ের শব্দ শুনতে পায়। ধীর। মৃদু।
এইসবের ঘুনাক্ষরও জানতে পারেনি বাইরের লোক। একটা কৃত্রিম ছাঁচে গড়া পৃথিবীর নিজস্ব রঙ খুব বাধ্যতামূলক। দত্তবাড়ির রঙ ছিল আকাশ আর মাটির রঙের। হঠাৎ করে আলাদা করে চিনে নেওয়া সম্ভব নয়। মাটি আর আকাশের রঙ দিয়ে অন্তত মাটি আর আকাশকে ফাঁকি দেওয়া যায় না, অম্লান বাবু চিন্তিত হয়ে পড়েন। কান পেতে থাকেন। তাঁকে অনুসরণ করে আরেকটি ছায়া।
পরিষ্কার সান্ধ্য আকাশের নীচে বসে তখন কথা বলেই চলেছে হারাধন দত্ত। খালি গা। চিরুনি হারিয়ে যাওয়া চুল। প্রসাধন শেখেনি যে শরীর, জটিলতা শেখেনি যে মন, আবরণ তাকে মানায় না। দুটি ছায়া তখন এসে দাঁড়িয়েছে হারাধনের পেছনে। জ্বলজ্বলে একটা তারার উল্টোদিকে মুখ করে কথা বলছে সে। অন্ধকারে ছায়াদের চোখ ভিজেছিল কিনা স্পষ্ট বোঝা যায় না। চার হাত যখন হারাধনের শরীরের নানা অংশে সোহাগের সুর তোলে, চমকে ওঠে সে।
—কাল তোকে আমরা ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবো।
পৃথিবীর বাঁধাই করা বইগুলোর সমস্ত পৃষ্ঠা তখন ফড়ফড়িয়ে শব্দ তোলে। সমীকরণ না মিললে পায়চারি যখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, হারাধনের এখন সেটাও করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। পারছে না। নিরুপায় হারাধন ছায়া আর ভাইদের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। তারপরের সময়গুলো কীভাবে বয়ে যায়, কাটে, সে জানে না। এতদিন সমাজ সংসার আর বই থেকে সে যে নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল, বৃথা মনে হয়।
অবিবাহিত একজনের কাছে তার মা ভাই খুব কাছের। হারাধন বইপ্রিয় মানুষ। বই থেকে ভাবনা থেকে যতটুকু মুখ তোলার সময় পায়, দাদা আর মা-কে দেখে। স্নেহ করে। এই অবলম্বনগুলো যে ভেতরে ভেতরে ঘুণ পোকাগ্রস্ত এটাই তাকে সবথেকে বেশি পীড়া দিচ্ছে।
—every man is a lighthouse itself, shows you the path to morning.
চিৎকার করে সে কখনো বলছে,
—মহাশয়, আপনাকে বৃত্তের বাইরে এনে নগ্ন করতে গেলে যেভাবে ঘুঁটি চালাতে হয়, আমি তা শিখিনি।
—হারুকে একটা ডাক্তার দেখানো উচিত।
—ছেলেটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে।
এসবের উত্তর দেওয়া বাধ্যতামূলক মনে করেন না অম্লান বাবু। কিন্তু হারুকে অন্তত লোক দেখানো হলেও একটা ডাক্তার দেখানো উচিত।
ডাক্তার মনোরম ব্যানার্জি দেখলেন হারু-কে। হারু ডাক্তারকে দেখল। কেমন ফ্যালফেলিয়ে। ডাক্তার খুব অভিজ্ঞ। কাঁচা পাকা চুল আর আধুনিক দাড়ি নিয়ে অনেক সময় ধরে হারু-কে পর্যবেক্ষণ করছেন। ফোন সার্চ করছেন। সার্চ করতে করতে হারুর অলক্ষে তার ভঙ্গি আর চোখের মণির ঘোরাফেরা দেখছেন। চেম্বারের বাইরে বসে আছেন অম্লান বাবু। ভাই পরিচয় দিয়ে যিনি চেম্বারের মধ্যেই থাকতে চেয়েছিলেন। ডাক্তার বাবুর সখ্ত মানা। হারুর একটা করুণ চাউনি অনেকক্ষণ থেকেই ডাক্তার ব্যানার্জীকে নানা প্রশ্নের সামনে উতলা আছাড় দিচ্ছে। যেসব রোগী তাঁর কাছে আসে, তাদের চাউনি এমন নয়। অনেক অনুনয়ে হারুর মুখ থেকে ব্যানার্জি বাবু কিছুই বের করতে পারলেন না, শুধু কয়েকটা অসংলগ্ন প্রলাপ ছাড়া।
মাসখানেক ওষুধ খেয়ে হারু রোগা আর জীর্ণ হয়। কিন্তু নজরে পড়ার মত তার হারু থেকে হারাধন দত্ত হয়ে ওঠা। তবে সেটা মাত্র এক বছরের কাছাকাছি কয়েকটা মাসের জন্য। এই কয়েকটা মাস সে অম্লান বদনে বংশীর সুর ভেঁজে ভেঁজে দিন রাত কাটাতে পারত। কিন্তু ক্রমে আগের মতই অনুভূতি জন্ম নিতে থাকে। আগের মতই জল গড়িয়ে চলা আর তার কিছু চিহ্ন ফেলে রেখে বাষ্পে মিলিয়ে যাওয়া।
হারু দত্ত এবার সত্যি সত্যিই আরো বেশি পাগল হয়ে গেল। যেখানে সেখানে চলে যায়। কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করে না। পরিচিত কেউ ধরে আনে। ধরে আনার পর বাড়িতে মারধর চলে। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা চলে। বাঁধা হয়। ব্যানার্জি বাবুর ওষুধ আর কোনো কাজ করে না। হারু গান ধরে -- যেকোনো গান। কোনো ভিত্তি ছাড়াই--
“ও বলি শ্যাম সায়রে নাইতে যাবি
গায়ের বসন ভিজবে কেনে”
ডানহাতের মুঠোকে মুখের সামনে এনে হারু ঘোষণার সুরে বলে—
“আজ বিকাল তিন ঘটিকায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে…
মাননীয় লোকেরা উপস্থিত থাকবেন।”
আগাগোড়া এলোমেলো একটা ঘোষণা। শুধু মাননীয় শব্দটা উচ্চারণের সময় তাকে বিশেষ জোর দিতে শোনা গেছে। মাথায় বড় বড় নোংরা চুল এদিক ওদিক ঝাঁকিয়ে হারু এগিয়ে চলেছে। কাউকে পাত্তা না দিয়ে। তাকে দেখলে মনে হয়, এই মুহূর্তে এই জগতে তার মত সুখী আর কেউ নেই। লোভ নেই। প্রয়োজন নেই। কোনোকিছু হতেই হবে, এমন উদগ্র বাসনা নেই।
ঘর গ্রাম ছেড়ে চেনা পথ পেছনে ফেলে হারু হাঁটছে। সব রাস্তা আর মানুষ একরকমের। একদিন হারুর চলার পথে ডাক্তার ব্যানার্জি এসে পড়ে। হারু চিনতে পারে না। কিন্তু ব্যানার্জি বাবু চিনতে পারেন। তাঁর মনে পড়ে সেদিন চেম্বারে হারুর সপ্রশ্ন করুণ চাউনির কথা। ব্যানার্জি বাবুকে পেরিয়ে এগিয়ে যায় হারু। কিন্তু ব্যানার্জি বাবু হারু-কে পেরিয়েও এগিয়ে যেতে পারছেন না। হারুর সেদিনের প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য খসড়া তিনি আজ এই মুহূর্তে রচনা করতে পেরেছেন। যানবাহন আর অজস্র মাংসপিন্ডের ঘোঁত ঘোঁত শব্দ এড়িয়ে তাঁর কানে বাজছে হারুর কাল্পনিক সংলাপ,
—ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে ওষুধ দিয়ে সুস্থ করবেন। সুস্থ করে আমাকে আবার সেই পরিবেশে পাঠাতে চান, যেখানে থেকে আমি অসুস্থ হয়েছি!
ডাক্তার বাবুর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন খসে পড়ার উপক্রম।
হারু হাঁটে। গান গায়। চিৎকার করে বলে। মনে মনে বলে। হিসেবের বাইরে বছর কাটে। হারু কয়েক বছর ভোট দেয়নি। কারো সাতে পাঁচে মাথা ঘামায়নি। হারুর তাহলে এই সমাজে কী কাজ! হারুকে জোর করে মরতে দেওয়া পাপের হবে। হারু বেঁচে থাকুক। যেমন ভাবে পারে, বেঁচে থাকুক। হারুর নামটা ভুলে যাওয়া যাক। তখন থেকে কেউ ওকে বেশি ভালোবেসে পাগলাচোদা বলে। কেউ একটু কম ভালোবেসে শেয়ান পাগলা বলে।
পাগলের খুব দরকার
উত্তরমুছুনবাহ্ গল্প ভালো লাগলো৷
উত্তরমুছুন