কোরাকাগজের খেরোখাতা
জিললুর রহমান
আমাদের সহপাঠী কানাইয়ের বাবার বেকারী রেস্টুরেন্ট থেকে ইশকুলে দুপুরের টিফিন আসতো শক্ত শক্ত লাঠি বিস্কুট, প্যারা-মিষ্টান্ন ইত্যাদি। শিরা-দেওয়া মিষ্টি পরটাকে আমরা চট্টগ্রামের লোকেরা বাকরখানি বলি।
এই টিফিনটা অতি উপাদেয় ছিল। ক্লাস ক্যাপ্টেন উপস্থিতির সংখ্যা ২/৩ জন বাড়িয়ে দিলে নাস্তা বেশি আসতো, আর সে নাস্তা নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারি আজ বড় মধুর মনে হয়। মনে পড়ে একবার আমরা টিফিন বিদ্রোহ করেছিলাম। আবার কখনো গণি বেকারী থেকেও টিফিন আসতো। তবে প্রায় সময়ই দেওয়া হতো ২টি করে লাঠিবিস্কুট। শালার বিস্কুটে কামড় দিলে দাঁত ভেঙে যেত, কিন্তু মরার বিস্কুট ভাঙতো না। একদিন সব ছাত্র টিফিন বয়কট করে এসেম্বলির মাঠে জড়ো করে রেখে দিলাম। পরের দিন থেকে লাঠি বিস্কুট বন্ধ হয়েছিল। আমার দেখা প্রথম বিদ্রোহ সফল হলো।
আরেকটি মারাত্মক ঘটনার কথা বলতেই হয়। আমাদের গ্রীষ্মের ছুটির আগের দিন আর রোজার ছুটির আগের দিন ক্লাসরুম সাজিয়ে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করার একটা রীতি ছিল। তবে এটা কিছুটা ক্লাস টিচাররা চাপিয়ে দিতেন। ক্লাস এইটে যখন পড়ি তখন বয়সের কারণেই হয়তো মন কিছুটা প্রতিবাদী। তার উপরে ইউনুস স্যারের মতো স্পষ্টভাষী শিক্ষকের কাছ থেকে অসন্তোষমূলক বক্তব্য আমাদের কিছু বন্ধুদের মধ্যে উষ্মা সৃষ্টি করে। আমরা ঠিক করেছিলাম ক্লাস এইটের ছাত্ররা কোনো ক্লাসসজ্জা বা খাবারের আয়োজন করবো না। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু সকালে স্কুলে গিয়ে দেখি সব ক্লাস সুন্দর সজ্জিত আমাদের ক্লাস বাদে। আজ মনে নেই কে কিভাবে ঘটালো, কারা ছিল, হঠাৎ উপস্থিত ক'জনের জুতা স্যান্ডেল নিয়ে মালা বানিয়ে তারা লটকে দিল। আমার স্যান্ডেলও সেখানে দিতে হয়েছিল। এর মধ্যে একজন বললো, শুধু জুতায় হবে না। দুইটা বিড়িও সাথে লটকে দিলে সুন্দর হয়। আমার পকেটে কিছু খুচরাছিল তাও ওরা নিল। সব আয়োজন করে মাত্র ২ মিনিট মতো মালাটি ক্লাসের দরজায় লটকানো ছিল। এর মধ্যেই কেউ বললো, স্যাররা আসার আগে নামা। সবাই আবার সুবোধ বালকের মত ক্লাসে বসে গেলাম। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানে মেটেনি। আমাদের মতিনের ছোটভাই ২ ক্লাস নিচের, এসে দেখিয়ে দিল আমাদের। স্যারেরা তদন্ত করে গার্ডিয়ান ডেকে কাউকে টিসি, কাউকে শাস্তিও দেন। আমার পিতৃদেবকে হেডমাস্টার মশাই ডেকে পাঠান এবং তাঁর সামনে আমাকে জেরা করা হয়। যাই হোক, কড়া ডোজের বকা এবং সর্বশেষ সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আমাকে স্কুলে থাকার সুযোগ দেওয়া হলো। আর সে অপমানের খেসারত বাবা তোলেন ঘরে এসে। আমি আজীবন এই অপকর্মটার জন্যে আফসোস করে গেছি। যে বন্ধুরা টিসি খেল তাদের জন্যেও খুব আফসোস হতো। এমন হঠকারিতা তো প্রতিবাদ নয়। এসব থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু সে বোধ বা বুদ্ধি তখন ছিল না।
সম্ভবত এই ঘটনার পরে আমি আগের চেয়েও অনেক বেশী অন্তর্মুখী হয়ে পড়ি, আত্মমগ্ন হয়ে যাই। এ সময় আমি সন্ধান পেয়েছিলাম, রাইফেল ক্লাবের বিপরীতে একটি পুস্তক ভাড়া দেওয়ার ক্ষুদ্র দোকানের। এতে আমার নতুন বই পড়ার মাত্রা বাড়ল বটে, তবে পেপারব্যাক বই বিশেষতঃ মাসুদ রানা সিরিজের সন্ধান পেয়ে গেলাম এখানে। মাসুদ রানা সিরিজের রোমহর্ষক কাহিনীতে যেমন পরবর্তী পৃষ্ঠার দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতাম, তেমনি সোহানার সাথে খুনশুটি পড়ার জন্যে বারবার পুরনো পৃষ্ঠাগুলো ফিরে ফিরে পড়তাম। মাসুদ রানার বীরত্ব যেমন আমাকে আকৃষ্ট করতো তেমনি তার প্রেমিক চরিত্রও আমাকে উদগ্র বাসনায় চঞ্চল করে তুলতো। আর এই প্রেম তো সবসময় প্লেটোনিক পর্যায়ে থাকতো না। বয়ঃসন্ধিক্ষণে এমন বই আমাকে দ্রুত জসীম উদদীনের বাঙালির হাসির গল্প, মোহাম্মদ নাসির আলীর ভিনদেশী এক বীরবল, রাহাত খানের দিলুর গল্প কিংবা খান মোহাম্মদ ফারাবীর মামার বিয়ের বরযাত্রী থেকে সরিয়ে রহস্য রোমাঞ্চ বইয়ের দিকে দ্রুত ধাবিত করলো। আমি পড়া শুরু করলাম কুয়াশা সিরিজ এবং দস্যু বনহুর সিরিজও। এর মধ্যে পত্রিকার কাগজে মুড়িয়ে ভিন্নতর বইও মাঝেমধ্যে সেই দোকান থেকে পেয়েছিলাম ক্বচিৎ-কদাচিৎ। তবে, আন্দরকিল্লার তাজ লাইব্রেরীর আকর্ষণ একেবারেই কমে যায়নি। মাধে মাঝে গিয়ে কিনে আনতাম সংগ্রহে রাখার জন্যে বই। এর মধ্যে আবু রুশদ এবং তাসাদ্দুক হোসেনের বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করি। দুয়েকটা ডেল কার্নেগীর বই এক ফাঁকে পড়া হয়ে যায়। হঠাৎ নওরোজ কিতাবিস্তানে পেয়ে যাই অনেকগুলো জীবনী গ্রন্থ, যার মধ্যে ইসলামের নবী ও বুজুর্গদের একটা চমৎকার সিরিজ মিলে গেল। মূল্যও বেশ কম। কোনটা ৫টাকা, কোনটা হয়তোবা ৬টাকা। আমি একাধারে কেনা শুরু করলাম। প্রতিদিন একটা করে কিনতাম আর রাতের মধ্যেই তা শেষ করতাম। এভাবে একদিন নবম শ্রেণীতে উঠে পড়েছি। আবু হেনা নিজেকে অঙ্কে দুর্বল ঘোষণা দিয়ে মানবিক বিভাগে চলে গেল। আর আমি ভুগোল ইতিহাসে দুর্বল বলেই বিজ্ঞান বিভাগে ঢুকে পড়লাম। কিছুদিন পার হতে, একদিন আব্বা নিয়ে গেলেন নতুন আসা শিক্ষক বি বি দত্ত স্যারের কাছে। বাসা চন্দনপুরায় আমাদের এক গলি পরেই। সব বন্ধুরা অজিত স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, আর আমি একা গেলাম দত্ত স্যারের বাসায়। নামটাও বিচিত্র বিবি দত্ত। আমি জানতাম মহিলাদের বিবি ডাকে, এখন দেখি পুরুষ বিবিও আছে! স্যারের কাছে তখন একজন ছাত্র ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। আমার ২ বছরের বড়। অসীম দা অসীম ধৈর্যের সাথে স্যারের বাসার নির্জন বারান্দা পাহারা দিয়ে যাচ্ছিলেন। স্যার বাজারে যান, স্যার ভেতরে যান, স্যার দোকানে যান, অসীম দা আছেন একের পর এক অংক কষে যাচ্ছেন টেস্ট পেপার থেকে। এখন আমি এসেছি যেন, অসীম দা দু’দিন পরে চলে গেলে এই দহলিজের নতুন পাহারাদার। মজার ব্যাপার ছিল, এখানে অজিত স্যারের বাসার মত ভীড় ছিল না বলে মনের মত করে পড়া লেখা করা যেত। ইচ্ছে মত প্রশ্ন করা যেত, যতক্ষণ ইচ্ছা থাকা যেত। সকাল ৭টায় ঢুকলে একেবারে ইশকুলের সময় বেরিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের ভেতর দিয়ে অথবা গুলজার স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম ড. এনামুল হক সড়ক তথা কলেজ রোডে আমাদের ভাঙ্গাচোরা হাইস্কুলে। পরে জেনেছিলাম দত্ত স্যারের আসল নাম বিমলেন্দু বিকাশ দত্ত। স্যারের বাড়ি আমাদের গ্রামের কাছাকাছি, তাই আব্বা আগে থেকেই জানতেন। অংক স্যার সত্যিই ভাল জানতেন। আমাকে এমন করে অংকের মূলনীতি শিখাতেন যে কয়েক মাস পরের পরীক্ষায় আমার অংক, ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রির রেজাল্ট খুব ভাল হয়ে যায়। বিশেষ করে অংক। আর তার প্রতিক্রিয়ায় আমার সহপাঠীদের কয়েকজন স্যারের কাছে পড়তে শুরু করে। স্যারের বারান্দায় আমাকে আর একাকী কাটাতে হলো না।
নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীতে ওঠার সময় আমি মোটামুটি দশজনের মধ্যে চলে আসি। এদিকে ১৯৮১ সালে দশম শ্রেণীতে পড়ছি। একদিন জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন। ঘরে বাইরে কত আলোচনা — ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে ফিরে এলেন আমাদের নেত্রী। আব্বার কাছে জেনেছিলাম আগেই, ১৯৭৫ সালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে যেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন, সেদিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুই বোন প্রবাসে ছিলেন বলে ঘাতকের গুলি থেকে বেঁচে যান। ১৯৮১-র ১৭ মে ছিল এক অবিস্মরণীয় দিন। বাংলার মানুষ যেন নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল। স্কুলের সামনেই ছিল চট্টগ্রাম কলেজ। সেখান থেকে প্রতিদিন মিছিলের ছন্দোবদ্ধ শোর ভেসে আসতো। দশম শ্রেণীতে আমাদের ক্লাস হতো পাহাড় বক্ষে একটি আলাদা টিনের চালা ঘরে, যেখান থেকে পূর্বদিকে রাস্তার ওপারে চট্টগ্রাম কলেজ এবং দক্ষিণ পাশে একই পাহাড়ে মহসিন কলেজ পরিষ্কার দেখা যেত। মিছিল যত জোরালো হতো, আমাদের রক্ত চনমন করে উঠত। মাঝে মাঝে কলেজের ছাত্ররা আমাদের স্কুলে এসে মিছিলে ডেকে নিয়ে যেত। মিছিলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সময় পৌঁছে যেতাম বাসার কাছে। খররৌদ্রে পিপাসায় কাতর হয়ে ফিরতাম ঘরে। এমনটা চলেছিল বেশ কিছুদিন—উত্তাল আন্দোলনমুখর। তারপর একদিন জানতে পেলাম, রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া চট্টগ্রামে আসবেন এবং চন্দনপুরা মসজিদে জুমার নামাজ পড়বেন। বাস্তবিক ঘটলও তাই। সেদিন মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে গেল। আমি মসজিদের দোতলায় নামাজে শরিক হয়েছিলাম। সেদিন জুমার সময় হঠাৎ একটি বিকট শব্দে ভেঙে যায় আয়না বাঁধানো দোয়ার পোস্টারের কাঁচ। বেশ হৈচৈ হলেও পরে জেনেছিলাম একজন মৃগীরোগী আকস্মিক পড়ে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু নামাজের পরে কুসংষ্কারাচ্ছন্ন বয়স্কদের অমঙ্গল আশঙ্কা করতে শুনলাম। আর ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস — ৩০মে রাতে সার্কিট হাউজেই নিহত হলেন সেদিনের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া। মরলেন নিজের বাহিনীর মানুষেরই হাতে। পরদিন সকালে সংবাদ শুনে চারিদিকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। তারপর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন আবদুস সাত্তার। তার সন্তান না থাকা নিয়ে বাঙালির কতো কথা সেদিন শুনেছিলাম। এই সময়ে আমাদের এলাকায় ক্রমশ জামাত শিবিরের কর্মীদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হতে দেখি।১৯৮১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শিবির কর্মীরা হত্যা করেছিল সিটি কলেজের এজিএস তবারককে। ১৯৭৫ সালের পরে সম্ভবত এটা প্রথম ছাত্রনেতা হত্যার ঘটনা। আমার স্পষ্ট মনে আছে সিরাজদৌল্লা রোড সেদিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। শিবিরের কর্মীরাছুরি চাপাতি হকিস্টিক ইত্যাদি নিয়ে লুকিয়ে থাকা ছাত্রলীগ কর্মীদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধু চন্দনপুরা মসজিদের সুউচ্চ মিনারের অনেক উঁচুতে উঠে থর-কম্পমান অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ বসেছিলাম। পুলিশ এলে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিলে তারপর নেমে সুরসুর করে ঘরে চলে যাই।
পূর্বাহ্ণ ১২:৩৫
০১ অক্টোবর ২০২১
চট্টগ্রাম
দ্রুত ফুরিয়ে গেল এ পর্ব৷
উত্তরমুছুন