মুনকে খুঁজে পাওয়ার পর
আহমেদ মওদুদ
মুন। আমাদের বন্ধু। ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন নাম্বার, ফেসবুক আইডি সব ইনএ্যাক্টিভ। সম্ভাব্য সকল জায়গায় খুঁজে খুঁজে প্রায় দু’সপ্তাহ অতিক্রান্ত। কিন্তু কোন খবর নেই। এর মধ্যে মুনের বাবা থানায় গিয়ে জিডি করে এসেছে। স্থানীয় পত্রিকায় পুত্রের হারিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছে। সেও প্রায় এক সপ্তাহ আগের কথা। অথচ মুনের কোন হদিস মিলছে না। এদিকে আমরা যারা মুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যারা পরিবার ও প্রতিবেশে বেকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তারা এই সময়ে একটা চাকুরীর সন্ধান পাওয়ার চেয়ে মুনকে খুঁজে পাওয়াটাই শ্রেয় মনে করছি।
তো মুনকে খুঁজে খুঁজে আমরা যখন অস্থির তখন আমাদেরকে স্থির হওয়ার পরামর্শ দিলেন আমাদের স্থানীয় পরামর্শক, বড় ভাই আনিস রায়হান বললেন ‘মুনকে খুঁজতে গিয়ে তোমরা নিজেরাই তো হারায়া যাচ্ছো।’ আমরা আনিস ভাইয়ের কথার মাথামুন্ডু খুঁজে পাই না। আমরা কীভাবে হারায়া যাচ্ছি জানতে চাইলে বলেন, ‘শোন, মুনকে খুঁজতে গিয়ে তোমরা আর নিজেদের মধ্যে নাই, নিজেদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছো তোমরা। তোমাদের দেহ পড়ে আছে এখানে কিন্তু মনটা ছড়িয়ে পড়েছে দেশময়। আবার কারোটা হয়তো বিশ্বময়, কেবলই মুনের খোঁজে। অথচ মুন যেখানেই থাকুকনা কেন নিজের মধ্যেই আছে আর ঘোরাফেরাও করছে নিজের সাথে।’ আমাদের অবয়বে হতাশা ও বিস্ময়, ‘আনিস ভাই আপনি এসব কি বলেন?’ আনিস ভাই বুকভরে নিশ্বাস নেন, তারপর বলেন, জানো মানুষ কখন হারায় যায়?’ ‘কখন?’ জানতে চাই আমরা। মানুষ যখন নিজেকে খুঁজে পায় কেবল তখনই সে হারায়া যায়, একা হয়ে যায়।’ আনিস ভাই তথ্যের দিকে না গিয়ে তত্ত্বের দিকে যাচ্ছেন দেখে আমরা চুপ মেরে যাই। পাছে তিনি আরও তত্ত্ব হাজির করে ফেলেন এই আশঙ্কায় আমরা কথার মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করি। মুনের কথা বাদ দিয়ে আনিস ভাইয়ের ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করি।
আনিস রায়হান মফস্বলের একটা কলেজে শিক্ষকতা করেন। দর্শন বিষয়ে পড়ান।পাশের হার সন্তোষজনক না হওয়ায় কলেজের সব শিক্ষকের বেতন বন্ধ, সেও প্রায় বছর দু’য়েক আগে থেকে। চলেন বউয়ের বেতনে । বউও শিক্ষক। প্রাইমারি স্কুলের। থাকেন কুড়িগ্রামে। সেখানেই স্কুল। আনিস রায়হান থাকেন রংপুরে। থাকেন একা আর রান্নাবান্নাও করেন নিজেই। সকালের নাস্তাটা অবশ্য হোটেলেই সারেন। তা না হলে ট্রেন ফেল করার সম্ভাবনা থেকে যায়। কলেজে পৌঁছার জন্য তাকে প্রতিদিন ভোর ছয়টার লোকাল ট্রেনটা ধরতে হয়। ইচ্ছে করলে যেতে পারেন বাসেও। সেক্ষেত্রে তাকে ট্রেনের চার গুণ ভাড়া গুনতে হয়। বেতন বন্ধ থাকায় সবদিক হিসেব করে চলতে হয় আনিস রায়হানকে। অবশ্য ট্রেন ভ্রমনটাও বেশ উপভোগ করেন তিনি আর সুযোগ পেলেইা ট্রেন ভ্রমনের নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনান আমাদের।ট্রেনকে উপজীব্য করে একটা উপণ্যস লেখারও ইচ্ছে আছে তার। সে কথাও মাঝে মধ্যেই পাড়েন। বলেন, ‘ট্রেইন হচ্ছে একটা চলন্ত উপন্যাস, যার চরিত্রগুলো স্থির অথচ উপন্যাস নিজে গতিশীল।’ আমরা বলি, ‘খোলাসা করেন।’ গল্পে আমাদের আগ্রহ আছে দেখে আনিস ভাই স্মৃতিকার হন, ‘দেখ, ট্রেন প্রতিদিন তার পেটে পুরে কত কিসিমের মানুষকে যে বহন করে তার কোন হিসাব নেই। প্রতিটা মানুষের স্বভাব চরিত্র আলাদা আর তারা তাদের বিচিত্র রকমের ভাবনা সুখ-দুঃখ, অনেন্দ-বেদনাকে ট্রেনের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দুলতে দুলতে গন্তব্যে পৌছায়। অথচ ট্রেন! ট্রেন তার পেটভর্তি সুখ দুঃখ নিয়ে রাত দিন ছুটে চলে। তো সেই ট্রেইনকে তোমারা কি বলবা?’ ‘চলন্ত উপন্যাস’ বলি আমরা। আনিস রায়হানের পর আমরা তিন বন্ধু আরিফ, ওলি এবং আমি দেখা করি হিরন মুহিতের সাথে। হিরন মুহিত আমাদের বয়োজ্যোষ্ঠ বন্ধু। ইনিও দর্শনের শিক্ষক। টুকটাক কবিতা লেখেন আর উদ্ধুদ্ধ করেন অন্যদেরও। অনিয়মিত প্রকাশ করেন একটা লিটল ম্যাগাজিন। যেহেতু আমাদের বন্ধু মুনেরও গল্প-কবিতা লেখার বাতিক আছে আর সে নিজেও সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করে তাই হিরন মুহিতের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সর্ম্পক। তো আমরা সেই যোগসূত্র ধরেই হিরন মুহিতের কাছে জানতে চাই যে,তিনি মুনের কোন খোঁজ খবর জানেন কিনা । হিরন মুহিত যে মুনের ব্যপারে কিছুই জানেন না তা সোজা সাপটা জানিয়ে দেন। এবং আরও জানান ,মুনের নিখোঁজ সংবাদটা তিনি আমাদের কাছেই প্রথম শুনলেন। এরপর মেজাজে একটা ফুরফুরে ভাব এনে বলেন, ‘কুষ্টিয়া থেকে এক লেখক একটা গল্প পাঠাইছে, মারত্মক গল্প। ভাবতেছি পত্রিকার আগামী সংখ্যায় ছাপায়া দিব। গল্পটা শুনবা তোমরা?’ হিরন মুহিতের কথায় আমাদেরতো টাস্কি লাগার অবস্থা। আমরা ওনারে কী বলি আর উনি শোনান কী! মুন কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ আছে নাকি কেউ ওকে চৌষট্টি টুকরা করে চৌষট্টি জেলায় ছড়িয়ে দিয়েছে- এমন আশঙ্কায় যখন আমাদের দিনরাত একাকার তখন কিনা হিরন মুহিত আমাদের গল্প শোনাতে চাচ্ছেন। কিন্তু অবস্থা বেগতিক। গল্পটা না শুনলে তিনি কয়েক সপ্তাহ আর আমাদের দর্শন দেবেন না। পাছে মুনের মতো হিরন মুহিতকেও হারিয়ে ফেলি এই শঙ্কায় আমরা হিরন মুহিতকে বলি, ‘শুরু করেন গুরু।’
হিরন মুহিত গল্পের গা ঝাড়েন, ‘গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রবাল মাহবুব। পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে। কিন্তু চাকুরির বয়স শেষ হয় হয় তবুও বেচারার চাকুরি হয়না। এদিকে চাকুরি পাচ্ছেনা দেখে তার প্রেমিকাও অন্যের দরজায় খিল লাগায়। তো এই যখন অবস্থা তখন প্রবাল মাহবুব কি করে জানো?’ ‘কী করে?’ জানতে চাই আমরা। ‘তখন প্রবাল আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।’ আমাদের চোখে মুখে বিষ্ময়, ‘আত্মহত্যা!’ হিরন মুহিতের চোখে-মুখে আরো বিষ্ময় ‘হ্যাঁ আত্মহত্যা। যেদিন রাতে আত্মহত্যা করবে বলে ঠিক করে সেদিন বিকেলে কাকতালীয়ভাবে আত্মহত্যাকে উপজীব্য করে লেখা একটা উপন্যাস হাতে পায় প্রবাল। উপন্যাসে লেখক আত্মহত্যার বিপক্ষে অসংখ্য যুক্তি দাঁড় করান। যাতে কেউ কখনো আত্মহত্যা করার কথা না ভাবে সেদিকেও ইঙ্গিত করেন। তো উপন্যাসটা প্রবাল এত গভীর মনযোগে পড়ে যে ওটা শেষ করতে রাতের যে সময়টার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সেই সময়টা পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়। উপন্যাসটা পড়ে ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে প্রবাল। সে সিদ্ধান্ত নেয় জীবনে কোনদিন আর আত্মহত্যার কথা ভাববে না। প্রবাল ভাবে, সে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে এবং এটা সম্ভব হয়েছে সেই লেখকের জন্য যার বই তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে।’ আরিফ বললো, ‘গল্পের কাহিনীটা কেন জানি চেনা চেনা মনে হচ্ছে।’
‘গল্প শেষ?’ জানতে চায় ওলি। ‘আরে না, এখনো তো আসল ঘটনাই বলা হয়নি।’ হিরন মুহিত আবার শুরু করেন, ‘এরপর প্রবাল কি করে শোন, প্রবাল সেই লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে লেখকের সাথে দেখা করার সিদান্ত নেয়। ঠিকানা জানার জন্য বইয়ের ফ্ল্যাপে গিয়ে লেখকের জীবনী পড়তে শুরু করে। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে থমকে যায় প্রবাল। সেখানে লেখা বইটা প্রকাশের আগেই লেখক আত্মহত্যা করে।’ ‘বিষয়টা কেমন ঘোলা হয়ে গেলনা হিরনদা!’ ওলির কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন হিরন মুহিত, ‘দেখ, যে লোকটা লেখনির মধ্যেমে মানুষকে আত্মহত্যা না করার আহবান জানালো সে নিজে কি না শেষ পযর্ন্ত...। মানুষের মন বোঝা বড় দায়। তবে একটা বিষয় ভেবে ভালো লাগলো, প্রবাল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর আত্মহত্যা করেনি।’
হিরন মুহিতের কাছ থেকে গল্পটা শোনার পর কিছুক্ষন থ মেরে ছিলাম আমরা। এর মধ্যে আরিফ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে, ‘ইউরেকা, ইউরেকা...পায়া গেছি।’ আমি আর ওলি আরিফের পাগলামো দেখে হতভম্ব। হঠাৎ ও আবার কি পাইলো! ‘হিরনদা, কুষ্টিয়ার সেই লেখকই আমাদের মুন। যে গল্পটা বললেন এর থিম মুন আমাকে অনেকদিন আগেই বলছে। তাইতো বলি কাহিনীটা চেনা চেনা লাগছে কেন?’ এবার হিরন মুহিতের চোখে মুখেও বিষ্ময়, ‘কুষ্টিয়ার সেই লেখক মুন হতে যাবে কেন? তাছাড়া গল্পের লেখক হিসেবে তো মুনের নাম থাকতে পারতো। লেখকের নামতো দেয়া আছে আনন্দ জানু।’ ওলি গলা ঝাড়ে এসময়, ‘হয়তো ওটাই মুনের ছদ্মনাম।’ তাছাড়া আপনাদের কবি-সাহিত্যিকদেরতো আবার ছদ্মনাম না হলে চলেনা। আপনার নিজের নামটাওতো কেটে-ছেঁটে...।’ ওলির কথায় নড়ে চড়ে বসেন হিরন মুহিত । আরিফ ভেবে চিন্তে উপায় একটা বের করে, ‘হিরনদা, গল্পটা মেইলে পাঠাইছে নাকি কুরিয়ারে?’ ‘কুরিয়ারে’ জানান হিরনদা। তাহলে যে খামে করে কুষ্টিয়া থেকে গল্পটা এসেছে সেই খামটা নিয়া আসেন। ওই খামের মধ্যেই মুনের ঠিকানা পাওয়া যাবে। ব্যাটাকে আমরা খুঁজে খুঁজে পাঁড় আর ও কিনা ছদ্মনামে গল্প পাঠাচ্ছে লালনের আখড়ায় বসে!’
হিরন মুহিত ঠিকানা সমেত খামটা নিয়ে এলে সেদিন রাতেই আমরা তিন বন্ধু কুষ্টিয়া গামি গাড়িতে চড়ে বসি। গাড়িটা এগিয়ে যায় লালনের গানের সুর ধরে... বাড়ির পাশে আড়শি নগর...
গল্প বলার স্টাইল সরল৷ মোটামুটি লাগল
উত্তরমুছুনসুন্দর
উত্তরমুছুন