কোরাকাগজের খেরোখাতা
জিললুর রহমান
সমুদ্র বক্ষে যখন একটি বিশাল কমলালেবুর মতো সূর্যটা টুপ করে ডুবে যায়, তখনও আসমানে কিছু রং ম্লান বিবর্ণ হয়ে ক্রীড়ামত্ত থাকে। আমরা তখনও একে অপরকে দেখতে পাচ্ছি, অথচ কী অসহায়ের মতো এমন প্রমত্ত প্রতাপশালী সূর্যটার সলিল সমাধি হয়ে গেল! আমরা আরও কিছুক্ষণ বালুকাবেলায় খেলা করলাম। বালির ঘর বানিয়েছি, পুতুল এঁকেছি, তারপর চেয়ে চেয়ে দেখেছি সফেন ঊর্মি সেসব গুঁড়িয়ে মাড়িয়ে দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একসময় আব্বা আমাদের সকলকে জড়ো করে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। সেকালে কক্সবাজার একটি সামান্য ছোট্ট মহকুমা শহর মাত্র। সন্ধ্যায় এ শহর মৃতবৎ, নিষ্প্রাণ। দূর থেকে কখনও কোন মাঝির ভাটিয়ালী গান হয়তো ভেসে আসছে, কখনও অনেক দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল বাঁশীর করুণ সুর। এর মধ্যে আমরা হোটেল সায়মনের আহার কক্ষে নিশিরাশ সমাপ্ত করেছি। করুণ বাঁশির সুরে কখন যে চোখ মুদে এসেছিল টের পাইনি। খুব ভোরবেলা আমাদের তুলে দিলেন আব্বা, যেমন তিনি প্রত্যহ করে থাকেন, তবে সৌভাগ্যক্রমে এখানে নারকেল শলাকার ঝাড়ুটি না থাকায় পৃষ্ঠদেশ নিরাপদ থাকল। আমরাও জানতাম, “খুব ভোর করে উঠিতে হইবে, সূর্য্য ওঠারও আগে”। তবে পায়ের শব্দে কেহ না জাগার ভয় ছিল না। আমরা সাগর পাড়ে পৌঁছতে পৌঁছতে পূবাকাশ লাল হয়ে উঠলে সাগরের ফেনিল ঊর্মিতে তার আভা প্রতিফলিত হতে দেখি। পানি বেশ ঠাণ্ডা। তাই সমুদ্রস্নান করার মতো সময় তখন নয়, কিন্তু কিছু স্থানীয় শিশু অবলীলায় সাঁতরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। কিছু জেলেকেও দেখি মাছ ধরার প্রয়াস করছেন। হাল্কা শীতল সমীরণ মৃদুমন্দ বয়ে যাচ্ছে চুলকে আলুথালু করে দিয়ে, সাথে সাগরের উপর্যুপরি ঊর্মিরাশির গগনবিদারী হুঙ্কার গর্জন। আমরা কিছুক্ষণ ছুটে বেড়ালাম বালুকাবেলায়, পা পা করে হেঁটে পা ডুবালাম জলে। একের পর এক ঢেউ এসে লুটিয়ে পড়লো আমাদের কাছে এসে। এদিকে সূর্য উঠে এল দিগন্তরেখায় লাল বর্তনের মতো। একদিকে পাহাড়ের পেছন থেকে উদিত আলোকোজ্জ্বল রবি অন্যদিকে সাগরের চঞ্চল জলে তার বিচ্ছুরণের খেলা। এসবের মধ্যে সাগরে ভেসে আসা তারামাছ এবং নানা রং এ আকৃতির আমাকে এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা করে তুললো। এক সময় আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হলাম। ফেরার সময় বালুকাবেলায় গড়ে ওঠা ঝিনুক মার্কেটে ঢুঁ মারলাম সবাই। শামুক দিয়ে বানানো চাবির রিঙে আমাদের নামাঙ্কিত করে তারা বেশ দু’পয়সা আয় করে নিল। তারপর নিশ্চয় প্রাতরাশ করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু কোথায় প্রাতরাশ করেছিলাম তা আজ ঠিক মনে করতে পারছি না; সম্ভবত পেনোয়াতে।
প্রাতরাশ শেষে আমরা ঘুরতে যাই পাহাড়ের অনেক উপরে বৌদ্ধ মন্দিরে এবং রাডার স্টেশনে। এখন জানতে পেরেছি কক্সবাজার শহরে বেশ কয়েকটা বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে, ঠিক কোন্ বৌদ্ধ মন্দিরটিতে আমাদের ভ্রমণ ঘটেছিল তা আজ স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছে।
তবে রাডার স্টেশন দর্শনের স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউজের দক্ষিণ পাশের পাহাড় চূড়ায় রাডার স্টেশনটি অবস্থিত। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, দেশব্যাপী ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, শৈতপ্রবাহসহ যাবতীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয় এখান থেকেই। সুইডিশ শিশু কল্যাণ সংস্থা ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহযোগিতায় এই রাডার ১৯৬৮ সালে স্থাপন করা হয়। পরে জাপানের সহায়তায় ১৯৮৭ সালে রাডারটিকে অত্যাধুনিক এস-ব্যান্ড রাডারের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করে। খেপুপাড়ায়ও একটি রাডার বসানো হয়। ২০০৪ সালে দুটি রাডারই অকেজো হয়ে পরায় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের পক্ষে সমুদ্রে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে জাপান সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় রাডার সিস্টেমের উন্নয়ন সাধন করে আবার চালু করা হয়। ৪০০ কিঃমিঃ ব্যাসার্ধের মধ্যে এ রাডার স্টেশনটি কার্যকর থাকে। রাডার স্টেশনটির উচ্চতা ৯৯ ফুট। তখন তো আর এত কিছু বুঝিনি, কেবল বিশাল গোলকের পরিধি মাপার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়ে ক্ষান্ত হয়েছি। এর পরে আমরা হোটেলে ফিরে প্রস্তুতি নিই সমুদ্রস্নানে যাবার। তখন প্রায় মধ্যাহ্ন হয়ে এসেছে, আমরা রিকশা চড়ে আবার সেই বালুকাবেলায় এসে পৌঁছলাম। সারাজীবন তো পুকুরে লুঙ্গি গোছ্ মেরে সাঁতার কেটেছি। দেখলাম আশেপাশে অনেকেই হাফপ্যান্ট পরে সাগরে নেমেছে। এখানে এই সাগরে স্নান করার জন্যে চাই হাফপ্যান্ট (তখন জানতাম না এগুলোকে শর্টস বলে), তা আমার ছিল না। আব্বাও কিনে দিলেন না। অগত্যা ফুল প্যান্ট পরেই সাগরের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি, আমার মতো মানুষের অভাব নেই। জেলেরা তো লুঙ্গি পরেই সাগরে মাছ ধরতে নেমেছেন। ছোটমামা, বড় ভাইজান এবং আব্বাও ফুলপ্যান্ট পরিহিত। কেবল আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা জিয়া তখন ২য় শ্রেণীর ছাত্র হবার সুবাদে স্বভাববশত হাফপ্যান্টের অধিকারী। আম্মা শাড়ী পরিহিত এবং লীনা সম্ভবত স্যালোয়ার কামিজ পরেই সমুদ্র স্নানে গিয়েছিল। প্রথমে বালুময় সৈকতের কাছে এসে ভাবলাম, স্যান্ডেলে বালি ঢুকিয়ে লাভ নেই। তাই স্যান্ডেল হাতে নিয়ে বালুতে পা রাখলাম। সাথে সাথে তপ্ত বালুতে যেন পুড়ে গেল পায়ের পাতা। তড়িঘড়ি করে আবার স্যান্ডেল পায়ে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। আর্দ্র সৈকতের শুরু যেখানটায় সেখানে কয়েকটা বিছানার মতো আছে। কিন্তু আজকের মতো রঙিন ছাতা এবং নরম ফোমে সাজানো শয্যা তখন সাগরপাড়ে ছিল না। আমরা আমাদের স্যান্ডেলগুলো ঢেউ থেকে নিরাপদ দূরত্বে খুলে তার ওপর তাওয়েল জামা রেখে এগিয়ে যাই প্রমত্ত সাগরের দিকে। তখন জোয়ারের সময়। সাগর যেন রৌদ্রতাপে রুদ্ররোষে ফুঁসে ফুঁসে উঠছিল। প্রতিটি ঢেউয়ের সাথে সাথে সাগর একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছে ভূ-ভাগ। আমরা যখন কোমর পানিতে নামলাম, উপলব্ধি করলাম সূর্যালোকের উত্তাপে পানি কুসুম-গরম, মানে ঈষদুষ্ণ হয়ে আছে। অনেক লম্ফঝম্প করলাম ঢেউয়ের উপরে লাফাতে গিয়ে উল্টে পড়ে নাকেমুখে জল তো ঢুকেছেই, হাঁটুর সামনের দিকের চামড়া ছড়ে গিয়ে সাগরের লোনাজলের স্পর্শে ‘ছিল্লা লবণ লাগিয়ে দেয়া’র মতো অবস্থা। তবুও ঝাঁপানোয় কোন ক্লান্তি নেই। একসময় পানি অনেক বেড়ে গেল। দুইবার গিয়ে স্যান্ডেল ও জামাকাপড় কিছুটা পেছনে রেখে এসেছি। এদিকে সাগরবক্ষের একেকটা ঢেউ এসে আমাদের বুকে লাগছে, একেক ধাক্কায় অনেকটা পিছিয়ে পড়ছি। কখনওবা উলটপালট হয়ে খাবি খাচ্ছি; কিন্তু এমন আনন্দ জীবনে এর আগে এবং এর পরেও কখনও পেয়েছি বলে মনে তো পড়ে না। অনেক জলকেলি শেষে চক্ষু রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে বলে আমাদের জানিয়ে সমুদ্রবক্ষ থেকে ডেকে তুললেন আব্বা। তা-ও বেশ কয়েকবার ডাকার পরে আমরা উঠলাম। হোটেলে ফিরে পুনরায় স্নান করে লবণ ও বালু দূর করে দিবারাশের প্রস্তুতি নিলাম। বিকেলে সদলবলে যেতে হলো কক্সবাজার শহরের কেন্দ্রে বার্মিজ মার্কেট। রাখাইনদের সারি সারি দোকানে নানারকম জামা, চন্দন এবং অন্যান্য সাজসজ্জার সামগ্রী সাজানো। সারাজীবন ভর মার্কেটের নাম শুনলেই আমার পা ভারী হয়ে যায়, পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা হতে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু তা নিয়ে আম্মাকে কোনদিন ভাবতে দেখিনি। রাখাইন রমনীগণ কপোলে চন্দন মেখে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পোষাক পরিধান করে মনোমুগ্ধকর হয়ে বসে আছে দোকানে দোকানে। অনেক যুবককে দেখেছি শুধু তাদের দুদণ্ড দেখার লোভে বারবার বার্মিজ মার্কেটের দোকানে দোকানে ঘুরছে। পরেও এরকম দৃশ্য প্রায়শই দেখেছি। উইকিপিডিয়ার সূত্র মতে, রাখাইন শব্দটির উৎস পলি ভাষা। প্রথমে একে বলা হত রক্ষাইন যার অর্থ রক্ষণশীল জাতি। রাখাইন জাতির আবির্ভাব হয় খৃষ্টপূর্ব ৩৩১৫ বছর আগে। ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে, ১৭৮৪ সালে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে রাখাইনদের আগমন ঘটে। মূলত সেসময় বার্মিজ রাজা 'বোদোপয়া' আরাকান রাজ্য জয় করে। তার জয়লাভে ভয় পেয়ে বিপুল সংখ্যক রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এখন যেমন রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে এই দেশে, ঠিক তেমনি। তবে, রোহিঙ্গাদের নেই কোন নিজস্ব মৌলিক সংস্কৃতি, নেই তেমন রূপলাবণ্য। আমরা দীর্ঘক্ষণ আম্মার পেছন পেছন দোকানে দোকানে ঢু মেরে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে একসময় হোটেলে ফিরলাম।
আমার মনে পড়ে না, এর আগে বা পরে কেবল ভ্রমণের জন্যে আব্বা আমাকে কিংবা আমাদের আর কোথাও নিয়ে গিয়েছিল। এমনকি বিশেষ কোন কাজে আব্বার সাথে ভ্রমণ, সেটাও হাতে গোনা। তবে মনে আছে, আব্বার সাথে ঢাকায় গিয়েছিলাম এইচএসসি’র পরে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। আব্বা রাজী ছিল না। আমাকে তো উনি ডাক্তার বানাবেন, বুয়েটে অযথা পরীক্ষা দেবার কি দরকার! তবু আমার পীড়াপীড়িতে যদি মেডিকেলে না টিকি, তার বিকল্প ভাবনায় নিমরাজি হয়ে আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। তখন তোপখানা রোডে একটি হোটেলে উঠেছিলাম। নাম মনে নেই। কাছেই সচিবালয় ছিল, হাইকোর্টের মাজারও বেশ নিকটেই। আশেপাশে বেশ ক’টি খাবার হোটেল ছিল। কিন্তু আব্বা ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন ফজরের আজানের সাথে সাথে। অগত্যা জেগে উঠে ওনার সাথে “আসসালাতু খায়রুম মিনান নাওম” পালন করলাম। কিন্তু তাতেই নিস্তার পেলাম না। জামা কাপড় পরে বের হতে হলো। পিতাশ্রী জানালেন, স্টেডিয়াম মার্কেটে ‘প্রিন্স’ নামে একটি রেঁস্তোরা আছে, ওখানে নানরুটি দিয়ে খাসীর পায়া খেতে অসাধারণ। আমরা যখন পৌঁছাই, তখন কেবল দোকানের ঝাঁপি তোলা হচ্ছে। আব্বা কেবল রেঁস্তোরার কর্মচারীদের তাগাদা দিতে থাকলেন আর এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলেন। আমিও তাঁর সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে নলার মগজ (মজ্জা) শুকিয়ে ফেলছি। অবশেষে যখন পায়া ও নান আমরা পেলাম তখন সকাল ৭টা। পরম আনন্দ আর তৃপ্তির সাথে আব্বা পায়া খেলেন নান দিয়ে। আব্বাকে জীবনে প্রথম কোন খাবারের জন্যে এতটা উদগ্র হতে দেখলাম।
মন্তব্য