.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

জিললুর রহমানের আত্মজীবনী (পর্ব ১৪)

কোরাকাগজের খেরোখাতা
জিললুর রহমান


শৈশবে আমাদের বেড়ানোর আরেকটি জায়গা আম্মার মামার বাড়ি, মানে আমার নানার বাপের বাড়ি। প্রতি সপ্তায় না গেলেও প্রতিমাসে যেতে হতো। সে এক বনেদী বাড়ি বটে। মনে পড়ে, কাট্টলীর সেই বাড়িটির সদর দরজা দিয়ে ঢোকার পরে যেন একের পরে এক কক্ষ পেরিয়ে যেতাম শেষ দেখার জন্যে, কিন্তু বাড়িটি যেন শেষই হতে চাইতো না। অবশেষে বিশাল রান্নাঘরের জ্বলজ্বলে উনোনের কাছে গিয়ে বাড়িটি শেষ হতো। আম্মা বলতেন কাট্টলী নবী চৌধুরীর বাড়ি, কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনতাম নাজির বাড়ি। শৈশবের কতো বইতে উজির নাজির ইত্যাদি পড়েছি, কিন্তু এই নাজির কোন নাজির তা জানার কোনো চেষ্টা অবশ্য সে সময় করিনি। পরে জেনেছিলাম, আমার মায়ের নানার সবচেয়ে বড় ভাইয়ের নাম ছিল নজির আহাম্মদ চৌধুরী, যাঁর নামে আন্দরকিল্লা থেকে কাটাপাহাড়ের সড়কটির নামকরণ করা হয়েছিল। এই পাড়ার শেষমাথায় বিশাল এবং সুন্দর মনোরম নান্দনিক ও উজ্জ্বল জমিদার বাড়িটিতে তিনি থাকতেন। তবে তাঁদের ছোটভাই নবী চৌধুরী সম্পর্কে অনেক শুনেছি। তিনি পাকিস্তান আমলে এমএলএ জাতীয় কিছু ছিলেন, আমার নানীর চাচা। মুক্তিযুদ্ধে কোন্ পক্ষে ছিলেন আমি জানি না, তবে বিপক্ষে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। নানীর বাবার নাম ছিল ফোরক আহাম্মদ চৌধুরী বা ঐ জাতীয় কিছু। তাঁর একমাত্র মেয়ে জাহানারা বেগম ওরফে জানু হলেন আমার নানী; এবং একমাত্র ছেলে খায়রুল বশর——আমাদের একমাত্র ‘কাট্টলী নানা’। শুনেছি তিনি জগন্নাথ কলেজে ইন্টামিডিয়েট পাঠকালে পিতৃবিয়োগ হেতু বিদ্যালাভে ইস্তফা দিয়ে পৈতৃক জমিজমা তদারকীতে ব্যস্ত হয়ে যান। লেখাপড়াকে চট্টগ্রামের লোক লেয়াপরা বলে উচ্চারণ করতে শুনেছি আশৈশব, কিন্তু অমার এই কাট্টলী নানা বলতেন ‘লোয়াফোঁজা’।

নানীর বাবাকে দেখার সৌভাগ্য আমার না হলেও নানীর মা অর্থাৎ আমার মায়ের নানীকে শৈশবে দেখেছি। থুত্থুরে বুড়ি পিরিচে ঢেলে কাঁপা হাতে চা খেতেন, এই দৃশ্যটা এখনও মনে পড়ে। আমরা ডাকতাম চাঁদের বুড়ি। ছোটবেলায় চাঁদের বুড়ির ছড়া বা গল্প যা কিছু শুনতাম সবগুলোর সাথেই আমি এই বুড়িমাকে মনে মনে কল্পনায় বসিয়ে নিতাম, যদিও কখনও তাঁকে চরকায় সুতো কাটতে দেখিনি। এই কাট্টলী যাব শুনলে একসময় আমি খুব ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তাম। কারণ পুরো গ্রামে যতো লোকজন ছিলেন প্রায় সবাই আমার মায়ের মামা সম্পর্কে দাঁড়িয়ে যেতেন; ফলে এরা সব আমার নানা হয়ে বসতেন। আর কী এক আজগুবি ধারণা তাদের ছিল, তা হলো নাতির সাথে খোঁচা মেরে মেরে মশকরা করা। আমার বাবার গায়ের রংটা একটু শ্রীকৃষ্ণের মতো কিনা, তা নিয়ে আশৈশব কতো জনই যে কতো কথা শুনিয়ে দিয়েছেন! পড়ালেখায় আমার বাবা এম কম। এম কেন কম পড়লো তা নিয়েও বেশ রসবোধসম্পন্ন গল্প তারা আমাকে বলতেন। আর ছিল জাতের খোঁচা। আমাদের খোনকার পরিবার বিষয়ে খোঁচা। মোট কথা, তাদের হাসির হল্লার সাথে আমি কখনও তাল মিলিয়ে হাসতে পারিনি। আমি টের পেতাম এই রসিকতায় রস যতোটুকু ছিল তার চেয়ে অপমানের পরিমাণ কোনো অংশেই কম ছিল না। তাদের এই জমিদারী জাত্যাভিমান রক্তের ফোটার সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে আমার নানী এবং তার কন্যার কাছেও পৌঁছেছিল। আমার এই নানাগণ খোঁচাবাচক রসিকতা এবং জাত্যাভিমানে ভুগলেও মানুষ হিসেবে নিতান্ত মন্দ ছিলেন না। পরবর্তীতে তাঁদের হৃদয়ের ছোঁয়া অনেক পেয়েছি বটে। কিন্তু মানুষ সে যতো ছোটই হোক অপমান তো ভোলে না, আমিও তাই ভুলতে পারিনি। এক নানার নাম ছিল চিকন নানা। আমার মা তাকে ডাকতেন চিকন মামা (চিঁউন মামু)। ওনার স্ত্রীর নামও তাই হয়ে গেল চিকন  নানী। চিকন নানী বয়সে আমার মায়েদেরই সমান হবেন হয়তো। অসম্ভব দুষ্টু ছিল। নাতি সম্পর্কের মজা নিতে তিনি আমাদের খুব জ্বালাতেন। আমি কাট্টলী গেলে তাই মুখ গোমরা করে বিশাল বৈঠকখানার এক কোণে বসে থাকতাম।

কাট্টলীর স্মৃতির সাথে আরেকটা বিষয় খুব জড়িয়ে আছে—তা হলো ঐতিহ্যবাহী মেজ্জান (বাঙালের ভাষায় মেজবান)। কেউ মারা গেলে তার ৪ দিনের দিন মাছ ফাতেহা, ৪০ দিনের দিন চল্লিশা এবং তারপর থেকে প্রতিবছর অর্থাৎ বছরী, সামর্থ্য ও মৃতের প্রতি উত্তরসূরিদের কর্তব্যবোধের তীব্রতা অনুযায়ী বছরে বছরে চলমান থাকে। ইদানীং স্বচ্ছলতা ম্রিয়মান হয়ে এসেছে বলে উৎসবও কিছুটা কমে এসেছে। তবে, আমার শৈশবে যেন এই মেজ্জান খাওয়া একটা নিয়মিত জীবনযাত্রার অংশে পরিণত হয়েছিল। কাট্টলীর মেজ্জানের অনেকগুলো শুরু হতো সকালবেলা ফজরের পর থেকে। সারারাত্র উৎসবমুখর পরিবেশে রান্নার আয়োজন সমাপ্ত হলে দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজন গ্রামবাসীরা ফজরের নামাজ পড়েই রওনা দিতেন মেজ্জাইন্না বাড়ির দিকে। আশরাফদের জন্যে চেয়ার টেবিলে আসন পাতা থাকতো, আতরাফদের জন্যে ধারা বিছানো থাকতো। তাতে মাটির সানকিতে করে খাবার পরিবেশন করা হতো। আমার এই ধারায় বসে খেতে খুব আনন্দ হতো। তবে একটু বড় হবার পরে যখন আমি অন্যদের চোখে আলাদা করে নজরে পড়তে শুরু করেছি, তখন থেকে চেয়ার টেবিলেই বসতে হয়েছে। সম্ভবত অষ্টম শ্রেণী থেকে আমি কিছুটা গুরুত্বপূর্ণরূপে আত্মীয় স্বজনের কাছে প্রতিভাত হলাম—এর পেছনে আমার আকস্মিক উচ্চতা বৃদ্ধি কোনো ভূমিকা রেখেছিল কিনা ভেবে দেখার অবকাশ মেলেনি। এ সময় থেকে কাট্টলীতে মেজ্জান খাবার নেমন্তন্ন থাকলে ফতেয়াবাদ থেকে বড়মামা সকাল সকাল আমাদের চন্দনপুরার বাসায় একটা বড় সড় টিফিন ক্যারিয়ারসহ হাজির হয়ে যেতেন। এসেই আমাকে হাঁক দিয়ে বলতেন “টিটুমিয়া চল”। আমি জামা পাল্টে আসতে আসতে আম্মা আমাদের টিফিন ক্যারিয়ার ধুয়ে মুছে প্রস্তুত করে ফেলতেন। আগে শুনেছিলাম, মামা ভাগ্নে যেখানে আপদ নাই সেখানে। এই মামা ভাগ্নের মেজ্জান খাবার টিমের মধ্যে দিয়ে টের পেলাম, সাথে মামা থাকলে আর বাইরের আপদের দরকারই পড়ে না।

আমার বড় মামা ভোজন রসিক হিসেবে এর মধ্যে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। আমি আগেও দেখেছি, বড় মামা মেজ্জান খেতে বসলে মামার খাওয়া দেখার জন্যেও বেশ লোকজন জড়ো হতেন। সেই বড়মামার সাথে একত্রে যখন মেজ্জান খাবার জন্যে উপস্থিত হতাম, আমাদের জন্যে বিশেষ টেবিলের ব্যবস্থা হতো। ঢুকেই আমাদের দু’জনের টিফিন ক্যারিয়ার ধরিয়ে দিতেন নির্ভরযোগ্য কাউকে। বলা থাকতো—এক তাকে ভাত, এক তাকে চনার ডাল, আর বাকি দুই তাকে বেছে বেছে গোশত নিতে হবে। পুরানো জমিদারবাড়ির সামনে বিশাল তেপান্তরের মাঠ। সারা মাঠ জুড়ে খাবারের আয়োজন, তারই এক জায়গায় আমরা মামাভাগ্নে একটা টেবিলে বসতাম। পাশের আসনে লোক থাকলেও মূল আকর্ষণ থাকতো বড়মামার আহার পর্ব। তাই টেবিলে পর্যাপ্ত মাংসের যোগান যাতে থাকে সেদিকে সবার সতর্ক নজর থাকতো। বড়মামা পাতে অল্প ভাত নিয়ে মাংসের বাটির দিকে হাত বাড়াতেন। পুরো বাটি হাতে নিয়ে অর্ধেক নিজের পাতে ঢেলে বাকি অর্ধেক ঢেলে দিতেন আমার পাতে। আমি হাঁ হাঁ করে উঠতাম প্রথম দিকে, বলতাম আমি এত খেতে পারব না। বড়মামা কোনো কর্ণপাত করতেন না। বলতেন, খেতে না পারলে আমার ভাগ্নে হলে কেমনে! বাটি খালি হতেই আরেক বাটি হাজির আশেপাশের আসনে যারা থাকতেন তারা অল্পসল্প নেবার পরে বাকিটা আবার মামা ভাগ্নের পাতে চলে আসতো। মামা একটা টেকনিক আমাকে শিখিয়ে দিলেন, চর্বিটা বাদ দিয়ে খেতে। তা হলে সহসা মুখ মেরে আসবে না। এভাবে তিন চার বাটি মাংস যখন প্রায় শেষ, কেউ হয়তো অনুচ্চস্বরে বলতেন, “এবার তাহলে গরম পানি নিয়ে আসি?” অথবা কেউ হয়তো বললেন “আর আনতে হবে?” এমন প্রশ্নে মামার স্পষ্ট উক্তি —— “তুমি না পারলে এখানে দাঁড়িয়েছ কেন? যে পারবে তাকে দাঁড়াতে বলো, সে নিয়ে আসবে।” এমন করে হৈহুল্লোড়ের মধ্যে আমিও মেজ্জান খাবারে পটু হয়ে উঠেছিলাম। পরে পরে আমার মামার যখন বহুমূত্র দেখা দিল, তিনি এমন সাত্বিক হয়ে গেলেন যে, খাবারে তাঁর এমন অরুচি আনলেন যে জীবনটাই পানসে হয়ে গেল মনে হয়। অন্যদিকে আমাদের আত্মীয়দের নানারকম অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আয়োজিত মেজ্জানে মেহমানগণ বেশ পেরেশান বোধ করতে লাগলেন। একবার জুলু নানার বিয়ের পরে তাঁর শ্বশুর বাড়ি দাওয়াত খেতে গেলে উপায়ান্তর না দেখে আমাকেই বড়মামার প্রক্সি দিকে হয়েছিল। মাশাল্লাহ্ সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিলাম। আশপাশ থেকে নানা মামাদের অনেককেই বলতে শুনেছি, টিটুমিয়া আহম্মদুল্লা’র মান রাখতে পারবে। এই দাওয়াতে আমাদেরকে হালদা নদীতে নৌকা চড়ে দূরের এক গ্রামে যেতে হয়েছিল। পথিমধ্যে আমাদের দলের একটি নৌকা ডুবে যায়। খুব মজার সাথে দেখেছিলাম দাওয়াতীগণ জীবন পণ করে সাঁতরে পাড়ে ফেরে এবং ভেজা জামায় আরেক নৌকায় উঠে আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। কারও কারও টাকা চিরুনি পকেট থেকে বেরিয়ে স্রোতে ভেসে যায়, কিন্তু কেউ দাওয়াত ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে যাননি। চাঁটগাঁইয়ারা এমন খাদক জাত!

যাই হোক, আমারও বহুমুত্র নিদান লাভের আগে পর্যন্ত এই মেজ্জান খাওয়া আমারও একটা সুখকর ব্রতে পরিণত হয়েছিল। একবার যেমন পাঁচলাইশ সমাজ কল্যাণ পরিষদের মিলাদুন্নবীর মেজ্জানে আমি ও সোহেল রাববি ভাই প্রতিযোগিতায় বসলাম। মাংসের বাটি আসতে লাগল বেশ ক’বার। সম্ভবত ৪র্থ কি ৫ম বারের সময় দেখি মাংসের বাটির পরিবর্তে দুই বাটি গরম পানি এনে দিয়েছে হাত ধোয়ার জন্যে। অগত্যা ড্র ঘোষণা করে উঠে পড়তে হয়েছিল। আরেকবার ফটোগ্রাফার ইব্রাহিম মুহম্মদ ইকবালের দাদীর মৃত্যু উপলক্ষে মেজ্জানের দাওয়াতে গেলে বেশ ক’বার মাংস আনার পরে একসময় ইকবালের ছোট দুলাভাই এসে কানে কানে বললেন, “ জিললুর ভাই চলেন, আপনাকে বাবুর্চির পাশে বসিয়ে দিই, এখানে নতুন ব্যাচের খাবার পরিবেশন করতে হবে”।

দাওয়াত খাওয়ার প্রসঙ্গ যখন এলো, তখন আমাদের চম্দনপুরা এলাকার দাওয়াত খাবার কেচ্ছাটাই বা বাদ যাবে কেন। আমাদের সামনে হাজী মহম্মদ বকশ ও তৎপুত্র হাজী মকবুল সওদাগরের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান নিত্য লেগে থাকতো। মকবুল সওদাগর আমাদের নানা। আমার আম্মাকে তিনি কন্যাবৎ স্নেহ করেন। সবার বড় মেয়ে বলে অভিহিত করেছেন। তাই এই পরিবারে তরিতরকারী যা-ই রান্না হতো একবাটি আমার মায়ের জন্যে অবশ্যই আসতো। অতএব বিবাহ অনুষ্ঠান থাকলে তো আমাদের সে বাড়িতেই পড়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। নানার ৬ কন্যা এবং ৬ পুত্র। অতএব হাজী মহম্মদ বক্সের একান্নবর্তী পরিবারের এই বাড়িতে বিয়ে একটি সংবাৎসরিক উৎসব বলা যায়——নিত্য লেগে থাকতো। অন্তত সেকালে আমার তেমনই মনে হতো। তাছাড়া মেজ্জানের আয়োজন তো ছিলই। আমাদের বাসার পূর্বপার্শ্বের বাড়ির দিলুর বাপকে আমরা ডাকতাম দাদা। আমার আব্বা ছিলেন তাঁদের কাছে পুত্রবৎ। তিনি প্রতিবছর মিলাদুন্নবীতে মেজ্জান তো দিতেনই, এমনকি দিলুর মুসলমানী, মানে খৎনা করা উপলক্ষেও, বিশাল খাবারের আয়োজন করেছিলেন। পশ্চিমে গোলাম রাসুলদের পরিবারেও বেশ বিয়ে হতো। অন্যান্য পরিবারেও তো আর বিয়ে না হয়ে যায় না। তাই দেখা যেত আমাদের মনুমিয়াজী লেইনের গলির মুখে প্রায় সবসময় বিয়ের গেট সাজানো থাকতো। এরা সবাই এখানের আদি বাসিন্দা। তাদের বিয়ের আসরে ঢুকার মুখে তারা সুন্দর করে টেবিল সাজিয়ে একজন লোককে বসিয়ে দিতেন। এই ভদ্রলোকের সামনে থাকতো দুটি খাতা। আর টেবিলে একে একে জমতো থাকতো নানারকম উপহার। একটা খাতায় টাকার হিসেব লিখতেন। উপহার দাতার নাম ও ঠিকানা লিখে টাকা গুনে বুঝে নিয়ে দেরাজে ঢুকিয়ে রাখতেন। আর উপহার সামগ্রী এলে নাম ঠিকানার পরে ভেতরে কি আছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়ে লিখে রাখতেন খাতায়। এবং উপহারের প্যাকেটে সিরিয়াল নম্বর টুকে রাখতেন। আমরা ছোটরা ভীড় করে দেখতাম কে কত টাকা দেয়। বিয়ে যদি বরপক্ষের হয়, তবে এই উপহার নেওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বর কিন্তু কনের বাড়ি যেতে পারতো না। সে যুগে কমিউনিটি সেন্টারের চল ছিল না। বিয়ের খাওয়া দাওয়া, আকদ পড়া এবং কন্যাদান পর্ব সবকিছু কনের বাড়িতে একই রাত্রে অনুষ্ঠিত হতো। শহুরে আদিবাসীরা দিনে বিয়ে করতো না। বরকে উপহার গ্রহণ শেষ হবার জন্যে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত প্রতীক্ষা করতে হতো। আমি শৈশবে কোনদিন শহুরেদের কনের বিয়েতে বর দেখতে পারিনি মকবুল নানার বাড়িতে বিয়ের খাবার খেয়ে জিদ ধরে বসে থাকতাম বরের জন্যে সাজানো স্টেজে। বর এলে দেখে তবে ঘরে যাব। পরে কখন যে সেই স্টেজেই ঘুমিয়ে পড়েছি জানতাম না। ঘুম ভাঙলে দেখতাম আমি নিজ বিছানায়। ভোরের সূর্য্য জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আমার চোখে মুখে খেলা করে যাচ্ছে। আব্বার ওপর খুব রাগ হতো। নিশ্চয় আব্বা কোলে করে নিয়ে এসেছে। পরে আম্মার কাছে জানতাম বর খুব বিশ্রী ছিল, দেখিনি ভালই হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও বড় হয়ে লক্ষ্য করলাম আব্বা আমাকে সাথে নিয়ে বিয়েবাড়ি যান। এই রীতি এখনও বলবৎ। তখন আমি ছোট বলে আমাকে হাত ধরে নিয়ে যেতেন, পরে আব্বাকে আমি হাতে ধরে নিয়ে যাই। তখন আব্বার সাথে পাড়ার বিয়ে বাড়ি গেলে প্রথমে টেবিলে ‘মাইন’ মানে উপহার দিতেন। পাড়ার গরীব পরিবারগুলোর বিয়েতে আব্বা সবসময় টাকা দিতেন। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, এই গরীব পরিবারগুলো এই বিয়ের আসরে তোলা টাকা দিয়েই বিয়ের খরচ মেটাত। তাই বর মধ্যরাত পর্যন্ত বসে থেকে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রতীক্ষা করতো। কিন্তু আম্মার বহু বকবক সত্বেও আমার আব্বা তাঁর নির্ধারিত রেট থেকে একটাকাও বেশি উপহার দিতেন না। এজন্যে আম্মা তাঁকে তো কিপটে বলে খোঁচাতেনই আমাকেও কিপটের ছেলে হিসেবে দু’কথা শুনিয়ে দিতেন। বর পক্ষের বিয়ে হলে আব্বা মিনিট পাঁচেক বসে প্রতিবেশীদের সাথে আলাপ সালাপ সেরে আস্তে করে আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসতেন। কোন্ সুদূরে বরযাত্রী হয়ে বাসে চড়ে যাবার সৌভাগ্য সাধারণত আমার হতো না। খুব মন খারাপ করে ঘরের খাবার খেতে হতো। আর কনেপক্ষের বিয়েতে আব্বা উপহার দিয়েই খাবার পরিবেশনস্থলে চলে যেতেন। সিটি কলেজের অধ্যাপক হবার সুবাদে সমাজে আব্বার বিশেষ সম্মান ছিল, তাই সহসা আমাদের আহারের ব্যবস্থা হয়ে যেতো। ভীড় বেশি থাকলেও আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো না। আর খাওয়া শেষ হলে সোজা বাসায় চলে আসতেন। অনেক সময় এঁটোহাতে বাসায় এসে সাবান দিয়ে হাত ধুতেন। তাই শহুরেদের বিয়ের পুরো ব্যাপারটাকে আমি তেমন অর্থে কখনোই ভালভাবে দেখিনি। এদের রেওয়াজটা বেশ সুন্দর। রাত্রির মধ্যযাম পার করে বর আসতো কনের বাড়িতে। তারপর আকদ হতো। আকদের পরে খাওয়া দাওয়া করে আলাপ আড্ডায় রাতটা পার করে দিত। খুব ভোরে কন্যা সম্প্রদান এবং কান্নাকাটির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বরবধূ চলে যেত বরের বাড়ি। কিন্তু বিয়ের পরদিনও খাওয়া দাওয়ার রেশ লেগে থাকতো। এখন সেই প্রশস্ত উঠোন নেই। আতিথেয়তা করার যে ঝকমারী তা হজম করার মানসিকতা উবে গেছে। এখন অনেক আগেই আকদ হয়ে যায়। এখন বিয়ের অনুষ্ঠান কেবলই আনুষ্ঠনিকতা। মানুষকে ভরপেট খাওয়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। সমাজের যে কনের বাবা বা মেয়ের বাবাকে আর্থিক উপহার দিয়ে খরচ তুলে দেওয়ার দায়িত্ববোধ, তা’ও যেন কোথায় বিদূরিত।

আমি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন হঠাৎ করে তিনটি বিয়ে খুব ঘনিষ্টজনের ঘটতে দেখলাম। এর আগে আমার ফুফুদের বিয়ের কথা তেমন মনে নেই। শুধু মনে আছে সেজ ফুফুর বিয়ের একটা দৃশ্য। আমাদের গহিরার বাড়িতে তখন প্রধান সড়ক থেকে হেঁটেছেন আসা ছাড়া কোন গতি ছিল না। চিকন আলপথ দিয়ে আমরা বাড়ি পৌঁছাতাম। সেজফুফুর বিয়ের দিন ভর দুপুরে আমরা খেলায় ব্যস্ত এমন সময় লক্ষ্য করলাম দূর থেকে আলপথে হেঁটে আসছেন শেরোয়ানি ও পাগড়ি পড়া বর। বাতাস মৃদুমন্দ বইছে। কিন্তু তেমন ধূলাবালি নেই। তবু তিনি কেন মুখে রুমাল ধরে রেখেছেন বুঝতে পারছিলাম না। পরে অবশ্য টের পাই সে যুগে বরকে লাজুক ভাব ধরার জন্যে মুখে রুমাল চেপে ধরে রাখতে হতো। এটা কত সালের ঘটনা মনে নেই। এছাড়া এমনকি ছোটফুফুর বিয়ের কথাও ভুলে গিয়েছি। কিন্তু প্রায় ক’দিনের মধ্যে বড়বাবা ( মানে ৪র্থ চাচা), বড় আপা (জ্যাঠাত বোন) এবং রুবি আপা (খালাত বোন)——এই তিনজনের বিবাহ অনুষ্ঠিত হলো খুব অল্প ব্যবধানের মধ্যেই। এরা সবসময় আমাদের সাথে সাথে ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ যেন ভিন্ন জগতে পা দিয়েছেন, এটা আমাকে খুব চমকে দেয়। তার মধ্যে রুবি আপার শ্বশুর বাড়ি কাট্টলী। তবে পুকুরের অপর পাড়ে তাদের বাড়ি। এরপর থেকে কাট্টলী গেলে দুই বাড়িতে বেড়াতে হতো। এদিকে আমাদের কাট্টলী নানীর শিরবজা এবং সোনামুখীর লোভের জন্যে হোক বা পুরনো স্মৃতিকে হাতড়ে ফেরার জন্যে হোক, আমি তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অন্তত প্রতি ঈদে কাট্টলী গিয়ে হাজির হয়েছি। গত ৪/৫ বছর যাওয়া হয়নি সেদিকে। এখন অনেক নতুন নতুন বাড়িঘর হয়েছে সেখানে। জানি না সেই বিশাল পুরনো জমিদারবাড়িটি এখনও তেমন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিনা।
 
১৭ জুলাই ২০২১ রাত ৯:৪৯ ঢাকা
পরিমার্জন ০৯ আগস্ট ২০২১ দুপুর ১২:১১

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: জিললুর রহমানের আত্মজীবনী (পর্ব ১৪)
জিললুর রহমানের আত্মজীবনী (পর্ব ১৪)
জিললুর রহমান। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। জন্ম, নিবাস, কর্ম বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায়। পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষক। আশির দশকের শেষদিক থেকে লেখালিখি।
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEgVf1frynr6WpOW1R7tXvdTPsTUv7QwPBXeFmAUn9lLTH7W4GiPX5ruY54O3KMzrc1xCFUhSzTbnO2uqKoakR8epPNXu_bGpuqyH_O_c6w_6NZZhjAVI2loCRZAoushtXNsAwGLqAP5AuGP_pM6j_iZdbhWvQddUXugGyuEcQ-xPaval6dwTGc-4Cl6=s320
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEgVf1frynr6WpOW1R7tXvdTPsTUv7QwPBXeFmAUn9lLTH7W4GiPX5ruY54O3KMzrc1xCFUhSzTbnO2uqKoakR8epPNXu_bGpuqyH_O_c6w_6NZZhjAVI2loCRZAoushtXNsAwGLqAP5AuGP_pM6j_iZdbhWvQddUXugGyuEcQ-xPaval6dwTGc-4Cl6=s72-c
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/08/Autobiography-of-Zillur-Rahman_01201058143.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/08/Autobiography-of-Zillur-Rahman_01201058143.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy