কোরাকাগজের খেরোখাতা
জিললুর রহমান
১৯৭৯ সাল, আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। চট্টগ্রামের ছেলে, অথচ জীবনে সমুদ্র দেখিনি। আমার আব্বা ভ্রমণে অনাগ্রহী এক কর্মব্যস্ত লোক। তাঁর কাছে জীবন হচ্ছে কাজ, আহার ও প্রার্থনার সমন্বয়। কেবল তাঁর স্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্যে সপ্তাহান্তে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছেন প্রথম জীবনে। ইদানীং আমরা বড় হয়ে ওঠাতে সে কাজেও ছেদ পড়েছে। যাই হোক, আমার আবদার ছিল ৭ম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার পরে আমাকে সাগর দেখাতে হবে। কিতাবে পড়েছি এশিয়ার বৃহত্তম সৈকত হাতের কাছেই কিলবিল করছে, আমাকে দেখবে বলে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। অথচ তার কাছে নগ্নপদ ধীরে হাজির হবার কোনো ফুরসত আমাদের হলো না। তখন ফেব্রুয়ারির শেষদিকে হঠাৎ একদিন বাবা সিদ্ধান্তে এলেন আমরা সমুদ্র দর্শনে যাবো। সে কি হৈ হৈ রৈ রৈ কারবার! সে যুগে একা একা শুধু বৌবাচ্চা নিয়ে বেড়ানো অশোভন ছিল হয়তো। কিংবা একান্নবর্তী পারিবারিক চিন্তার শেষ পিদিমের আলোয় অথবা আম্মার ইশারায় সিদ্ধান্তে আসা গেল আমাদের সাথে মাতৃপক্ষে যাবেন কনিষ্ঠ মাতুল মানে ছোটমামা এবং পিতৃপক্ষে বড় ভাইজান। বড় ভাইজান আমাদের পিতৃপক্ষে সবার বড় ছেলে। আমার জ্যাঠার প্রথম তিন কন্যার পরে চতুর্থ সন্তান হলেও আমাদের চাচাত জেঠাত ভাইদের মধ্যে সবার বড়। তিনি মাহফুজুর রহমান, আমার ৫ বছরের বড়। আর তাঁর ছোটভাই মশিউর রহমান আমার মাত্র ছয় মাসের বড় হলেও আমাদের মেঝ ভাইজান। সে অর্থে আমি বাবা-মা’র বড় সন্তান হয়েও বৃহত্তর পরিবারে সেজ হয়ে যাই। বড় ভাইজান তখন কলেজে পড়েন। আর ছোটমামা সম্ভবত বিএ-র শেষপর্বে। তারা যুক্ত হবার খবরে আমাদের আনন্দ বহুগুন বেড়ে গেল। কারণ, এর মধ্যে আমি ছোটমামার ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। ছোটমামা মহসিন কলেজে (তৎকালীন ইন্টারমিডিয়েট কলেজ) পড়ার সময় আমাদের বাসায় বিভিন্ন ক্যাসেট নিয়ে আসতেন। আমাদের মেঝফুফা দোহা থেকে ফিরে আমাদের একটি টু-ইন-ওয়ান উপহার দিয়েছিলেন, যাতে আমরা তেমন কিছু শুনতে জানতাম না। আব্বা খবর শুনতেন। ছোটমামা নিয়ে আসতেন হেমন্ত-মান্না দে-কিশোর কুমার-মানবেন্দ্র-লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে সহ নানান শিল্পীদের ক্যাসেট। এসেই ছেড়ে দিতেন মাঝারি ভলিউমে এসব অসামান্য সঙ্গীত। তাই ছোটমামা আমার মনোজগতে দখল করে নিলেন এক অসামান্য আসন। ভাল গান শোনার কান তৈরি হয়েছিল এভাবেই। আর তাই যখন বেতারের বিজ্ঞাপন তরঙ্গে ‘চাকভুম চাকভুম’ শুনতাম, তা এই কান কিছুতেই গ্রহণ করতে পারেনি। ছোটমামা হাঁটতেনও বেশ ‘কাপটি’ করে। কাপটি করা বিষয়টা বন্ধুদের কাছে শুনেছি, এর আভিধানিক অর্থ বা ব্যুৎপত্তি কোনটিই তখনো যেমন, এখনও তেমনি আমি জানি না। তবে পায়ের গোড়ালী না ঠেকিয়ে কেমন টেডি সাহেবের মতো হাঁটতেন। এটাও অনুকরণের চেষ্টা করেছিলাম, তবে আমি ল্যাভেন্ডিস মানুষ, আমার এসবে পোষায়নি।
যাই হোক, আমরা ৫ জনের সাথে ছোটমামা ও বড়ভাইজানসহ মোট ৭ জনের দল যাবো কক্সবাজার — এ সিদ্ধান্তে চিত্তে চাঞ্চল্য যেমন এসেছে ঘরে বেশ সাঁঝসাঁঝ রব পড়ে গেল। আরও বিস্ময়ের সাথে জানলাম আমরা বাংলাদেশ বিমানে চড়ে কক্সবাজার যাব। কক্সবাজার তো চট্টগ্রামেরই অংশ, সেখানে বিমানে যাওয়া যায়!!! এই বিস্ময়ের ঘোরে ভুলেই গিয়েছিলাম এর আগে আকাশের ছোট ছোট উড়ন্ত বিমান আর খেলনা বিমান ছাড়া সত্যিকার অর্থে আমি কোনোদিন বিমান দেখিনি। এই হবে আমার / আমাদের প্রথম বিমানে চড়া। এক যাত্রায় এতগুলো নতুন ব্যাপার যুক্ত হচ্ছে দেখে মাথা ঘুরে যায়। আমাদের প্রস্তুতি চলে কাপড় চোপড় গুছানোর। সাত যাত্রীর এই বহর একদিন ঠিকই উড়ে গেল সাগরপাড়ে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে চড়ে। সেসময় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার জন প্রতি বিমান ভাড়া ছিল ৭৫/-টাকা মাত্র। আমরা কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে গেলাম সেসময়ের বিখ্যাত হোটেল সায়মনে। এটাই তখন একমাত্র ব্যক্তিমালিকানার হোটেল। অন্যদিকে মোটেল সৈকত, পূর্বাণী — এসব ছিল সরকারী, পর্যটন কর্পোরেশনের। সায়মন শহরের ভেতরে অবস্থিত। সে তুলনায় মোটেলগুলো সাগরতীরের অনেক কাছে। সে যুগে টমটম বা ব্যাটারিচালিত রিকশা ছিল না। কক্সবাজার শহর ছিল ছিমছাম। পর্যটকের ভীড়ভাট্টা নেই। আমাদের জন্যে সাগরতীরে যাবার উপায় কেবল রিকশা, যার দেখা সহসা মিলতো না, আর হন্টন। যতদূর মনে পড়ে, আমরা সাত জনের দল শেষ পর্যন্ত হন্টনে ব্রতী হয়ে এগিয়ে যাই সাগরতীরের দিকে। তখন একটাই বিচ ছিল। বিচে প্রবেশের আগে ঝিনুকের দোকান ছিল। এদিকে মোটেল লাবনী নির্মাণের পরে বিচের নাম লাবনী পয়েন্ট বলা হয়। কিন্তু ১৯৭৯ সালে তেমন কোন নামের দরকার হতো না। তখন সাকুল্যে এই একটাই বিচ, কিন্তু মানুষের উপস্থিতি থাকলেও ভীড়ভাট্টা ছিল না। জীবনের প্রথম সমূদ্র দর্শনের কি কোন তুলনা হয়? আমরা যখন প্রথম সাগরতীরে উপনীত হলাম তখন জল অনেক দূরে। বিস্তীর্ণ সৈকত বালুতে বালুময়। আমরা স্যান্ডেল হাতে নিয়ে হাল্কা তপ্ত বালু নগ্নপদে মাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে লক্ষ্য করলাম পায়ের নীচের মাটি শক্ত এবং আর্দ্র হয়ে এসেছে। চলতে চলতে অকস্মাৎ পায়ে কী যেন নরম নরম কিছু ঠেকলো। আব্বাকে ডাক দিতে আব্বা কাছে এসে বললেন, “এটা জেলিফিশ বা জেলিমাছ। একটু পরে জোয়ারের জল এলে আবার সে সাগরে চলে যেতে পারবে। ওকে খুঁচিও না’। আমরাও আর খোঁচালাম না। কেবল ভাবতে লাগলাম আমাদের শরীর যদি এমন জেলির মতো হতো, এমন তুলতুলে অথচ কোন আকার আকৃতির বালাই নেই, হাত পা নেই —— এ কেমন প্রাণ! কেমন জীবন! সেই জেলি জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে কিছুটা উদাস হয়ে এগিয়ে চলেছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম চোখের সামনে ‘বিপুল তরঙ্গ রে’——হরষে গরজে হুঙ্কারে ছটফট করতে করতে এগিয়ে আসছে আমাদের কাছে, তারপর সমস্ত ব্যর্থ আস্ফালন চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ে আমাদের পায়ের গোছার উপরে——ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল পায়ের পাতা।
এই সেই মহাজলধি, যার স্পর্শে পবিত্র হলো পদযুগল! এই বিপন্ন বিস্ময়ের জন্যে জীবনে কখনও কোন প্রস্তুতি না নিয়ে এমন মহাযজ্ঞের সামনে এমন অভব্যের মতো আবির্ভূত হওয়া সমীচীন হয়নি। কিন্তু সমুদ্র তার হৃদয় বিলিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ বা কুণ্ঠাবোধ করেনি। আমিই কেবল স্থানুর মতো হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে রইলাম এই বিপুলের সামনে, যার রূপ বর্ণনা করার মতো বোধ বুদ্ধি কিংবা যোগ্যতা কিছুই আমি অর্জন করিনি সেদিন। সেই সেদিনের মতো আজও সমুদ্রের সামনে উপনীত হলে কেবল মনে পড়ে রবিঠাকুরের চিরস্মরণীয় বাণী—
কীসের অশান্তি এই মহাপারাবারে,সতত ছিঁড়িতে চাহে কিসের বন্ধন!অব্যক্ত অস্ফুট বাণী ব্যক্ত করিবারেশিশুর মতন সিন্ধু করিছে ক্রন্দন।যুগ-যুগান্তর ধরি যোজন যোজনফুলিয়া ফুলিয়া উঠে উত্তাল উচ্ছ্বাস--অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন,নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত আকাশ।আছাড়ি চূর্ণিতে চাহে সমগ্র হৃদয়কঠিন পাষাণময় ধরণীর তীরে,জোয়ারে সাধিতে চায় আপন প্রলয়,ভাঁটায় মিলাতে চায় আপনার নীরে।অন্ধ প্রকৃতির হৃদে মৃত্তিকায় বাঁধাসতত দুলিছে ওই অশ্রুর পাথার,উন্মুখী বাসনা পায় পদে পদে বাধা,কাঁদিয়া ভাসাতে চাহে জগৎ-সংসার।সাগরের কণ্ঠ হতে কেড়ে নিয়ে কথাসাধ যায় ব্যক্ত করি মানবভাষায়--শান্ত করে দিই ওই চির ব্যাকুলতা,সমুদ্রবায়ুর ওই চির হায় হায়।সাধ যায় মোর গীতে দিবস রজনীধ্বনিতে পৃথিবী-ঘেরা সংগীতের ধ্বনি।
তখন তো কৈশোর ছাড়িয়ে বলাইচাঁদ পর্বে পৌঁছেছি। আমার মনের ভেতরের উচ্ছ্বাস মনের ভেতরে তুলে যাচ্ছিল নিরন্তর উর্মিরাশি, কিন্তু সে আবেগ প্রকাশ করে বলবো, তেমন কেউ তখন পাশে নেই, না ভগিনী না ভ্রাতা। তারা কলকল ছলছল করে সমুদ্র বক্ষে ঝাপিয়ে পড়তে গেল পিতৃদেব ও মাতৃদেবীর হাত ধরে। একসময় আমার পদযুগল সমুদ্রে ডুবে গেল। একেকটা ঢেউয়ের সাথে সরু পা কেঁপে কেঁপে উঠছে, পরক্ষণে স্রোতের টানে খালি হয়ে যাচ্ছে পায়ের তলার মাটি। মনে হচ্ছিল, কিছু ধারালো পদার্থে পায়ের পাতা কিচকিচ করে লাগছে। হাত দিয়ে খুঁজে দেখি অসংখ্য ঝিনুকের ভাঙা খোল। এমন সময় সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভেসে এল এক ধরনের বাদামী হলুদ তারার মতো পাতলা কিছু একটা। হাতে নিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। এমন সময় স্বয়ং পিতৃদেব এগিয়ে এলেন কাছে, বললেন — এগুলো হচ্ছে তারামাছ। আমি বললাম, একটা রাখি? আব্বার সম্মতি জুটল না। অগত্যা জলের সন্তানকে জলেই ছেড়ে দিলাম এবং মনের সাধ মিটিয়ে ঝিনুকের নানা রঙের খোল বা খোসা কুড়াতে লাগলাম। একসময় লীনা এবং জিয়াও আমার সাথে ঝিনুক কুড়ানোর খেলায় মেতে উঠলো। তার সাথে সাথে বিচিত্র সব ছোট ছোট পাথর। এর মধ্যে আকাশ কতো রঙের খেলা দেখাতে শুরু করেছে! আমাদের ভারী হয়ে ওঠা পকেটের কথা ভুলে গিয়ে আজানু জলের মধ্যে পা দুটো স্থবির হয়ে চেয়ে রইলাম পশ্চিম দিগন্তপানে। যে সূর্যের দিকে তাকানোর মেলেনি ফুরসত কোনদিন, সেই মহান রবি, সেই অনলবর্ষী সৌরদেব কেমন ম্লান নিস্তেজ হয়ে সামান্য মেঘের আড়াল নিতে নিতে নেমে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ জলের গভীরে। আমার তো আর অতো বেশি ভাবুক মন ছিল না, তাই ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছিল, এ-ও কি সম্ভব! এই বিশাল নক্ষত্র যার উত্তাপে জীবন চঞ্চল হয়েছে সমস্ত সৌরজগতের, সেই তিনিই এই জলধির বুকে সলিল সমাধি নেবেন! মন বলছিল, সকল চোখের দেখার বাইরেও অন্যকোনো দেখা আমাদের অন্তর্লোকের জন্যে প্রতীক্ষায় থাকে। হয়তো সে খবর এখন অচল। এই মাহেন্দ্রক্ষণে সূর্যের ডুবে যাওয়ার সৌন্দর্য অনুভব ও অবলোকন না করে সাতপাঁচ ভাবা অর্থহীন। আমার জীবনে দেখা সেই প্রথম সূর্যাস্ত দৃশ্য, আমি অনেকবার সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে গিয়েছি। কিন্তু প্রথম দিনের সে মহাপুলক সে মহাবিস্ময়ের ধাক্কা জীবনে দ্বিতীয়বার আর অনুভব করিনি। তাই আমার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ যখন নতুন সূর্যাস্ত দেখে আমি তার প্রতি পরম ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ি।
১২ আগস্ট ২০২১ সকাল ৮:১৬
বিএসএমএমইউ কেবিন ৬১৭
অনবদ্য সমুদ্র দর্শন।
উত্তরমুছুন