আমরা সব বিচিত্র বর্ণের, বিচিত্র উচ্চতা ও পিঠেপিঠি বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের নতুন উদ্দীপনার নাম ‘আমরা সবুজ’——একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান। মোটামুটি ১০/১৫ জনের একটি দল মোদাচ্ছের ভাইয়ের নেতৃত্বে নানারকম আইডিয়া মাথায় নিয়ে আড্ডাবাজি করে যাচ্ছিলাম। সম্ভবত কামালকে ক্রীড়া সম্পাদক বানানো হয়েছিল, কারণ সে খেলাধুলায় মারাত্মক পারদর্শী। আর অন্যান্যরা কে কোন পদ পেয়েছিল আজ মনে নেই, তবে একমাত্র আমিই ছিলাম আপদ বা বিপদ—মানে পদহীন। তবে সবকিছু সহজভাবে দেখার একটা অভ্যেস হয়েছিল এবং না পাওয়ার অভ্যস্ততাও ছিল, তাই তেমন তেমন করে কোন ভাবনা আমাকে তাড়িত করেনি। আমি নিয়মিত আড্ডা ও খেলায় হাজির হতাম, সকল ব্যর্থতাকেই আপন করে নিয়ে। কারণ, আমি দৌড়ের সময় শেষদিকে, সাঁতারে শেষদিকে, ক্যারমে শেষদিকে, এমনকি ক্রিকেটে ব্যাটিং-এ নিত্য শূন্য, আর ফিল্ডিং-এ হাতের ফাঁক দিয়ে ক্যাচ পড়ে যেত। বল করার সৌভাগ্য কখনো হলে প্রায় সব বলেই চার ছক্কা পেটাতো ব্যাটসম্যান। সাপলুডু খেলতে বসলে বারবার সাপের পেটে ঢুকে যেত আমার গুটি। ব্যাডমিন্টনে ডাবল খেলায় কেউ সাথে নিতে চাইত না। মাঝেমধ্যে মামার বাড়িতে ধান কাটা হয়ে গেলে জোছনা রাতে বিলের মধ্যে গর্ত করে ‘পর’ খেলার আয়োজন হতো। অনেকটা হাডুডু ধরনের খেলা। সেখানেও ডাহা ফেইল। এই মনের মধ্যে এই ব্যর্থতাগুলো কেমন করে গুনগুন করে বাজতো, কেমন কাঁটার মতো বিঁধে থেকে ক্রমাগত খুঁচিয়ে যেতো তা’ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। খেলার সঙ্গীদের প্রচ্ছন্ন টিটকারি মশকরাগুলো অপমানের মতো মুখমণ্ডল মেদুর করে রাখতো। আমি যেন সকল ভীড়ের মধ্যে একা, জনারণ্যে কিংবা পরিবারের জমানো হুলুস্থুলের ভেতরও আমি থেকে যেতাম নিতান্ত একা। এই একাকিত্বের মধ্যে আমি একজন একান্ত বন্ধুর অভাব অনুভব করতে থাকি। এই নিঃসঙ্গতা, এই একাকিত্বের অনুভূতি এখনও আমাকে কুঁরে কুঁরে খায়।সেই ভেতরের একাকিত্ব কাটানোর জন্যে আমি ক্রমাগত বইয়ের ভেতরে মুখ গুঁজে পাঠে মনোযোগী হতে চেষ্টা করি। আম্মার জন্যে রাখা বেগম পত্রিকার গল্প কবিতা ও ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রতিদিন সকালে আসা দৈনিক সংবাদের খবরের পাশাপাশি গাছপাথরের লেখা সময় বহিয়া যায় সহ বিভিন্ন সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয় পড়তে পড়তে এক ধরনের মানসিক স্থিতির ছায়া নেমে আসতো বুকের গহীনে। গাছপাথর কারও নাম হতে পারে তা আমার ভাবনায় আসতো না। আব্বাকে প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর পেলাম না। আম্মা তাঁর সহজাত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বলে ফেলেন ছদ্মনাম হবে। কিন্তু এর পেছনের আসল মানুষটিকে চেনার জন্যে মন উতলা হয়ে থাকতো।
আমার হাতে চলে আসে রুশ সাহিত্যের নানান অনুবাদ। মালাকাইটের ঝাঁপি, উভচর মানুষ —— এখনও আমার স্মৃতির ভেতর কথা বলে। ননী ভৌমিক আর রাদুগা প্রকাশনীর বইয়ের জন্যে সবসময় মন আইঢাঁই করতে থাকতো। এর মধ্যে মামার বাড়িতে গেলে ছোটমামার সংগ্রহে থাকা বিচিত্রা, সন্ধানী আর তারকালোকের দিকে আমার দৃষ্টি ও মন নিবদ্ধ থাকতো। এরকম সময়ে “আমরা সবুজ” সিদ্ধান্তে পৌঁছালো, একটি লাইব্রেরি তৈরি করা হবে। আপাতত কিছু বই কিনে মোদাচ্ছের ভাইয়ের বাসায় থাকবে, তারপর সবাই সেখান থেকে বই ধার নিয়ে পড়বে। অতঃপর আন্দরকিল্লা থেকে কেনা হলো বই। বই কেনার সময় মোদাচ্ছের ভাই-ই ঠিক করলেন কেমন বই কি কি বই কিনবেন। অন্য বন্ধুদের তেমন বিশেষ পছন্দ ছিল কিনা মনে নেই। তবে আমি কিছু কিছু বইয়ের নাম বলেছিলাম। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, স্কুলে কপোট্রনিক সুখ দুঃখ পড়ার পর থেকে মনের ভেতরে এক ধরনের বিস্ময়ানুভূতির উদ্রেক করেছিলো। আমরা সবুজের লাইব্রেরির জন্যে কেনা হলো বেশ কিছু রম্য গল্প এবং বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। এ-যাত্রায় নতুন ভাল লাগা হলো স্বপন কুমার গায়েন নামে একজনের বিজ্ঞান ক্লিপ এবং বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা। ‘কাঠিমামার এডভেঞ্চার’ নামে একটি রম্য গল্পের বইও পেলাম। এই বই সে বয়সে এমন আকর্ষণ করেছিল যে, কাঠিমামা সিরিজের আরও অনেক বই নিজে কিনে পড়েছি। বন্ধুদের মধ্যে আমিই সাহিত্যপাঠে আগ্রহের দিকে এগিয়ে ছিলাম বলেই হয়তো একদিন আমাকে সাহিত্য সম্পাদকের পদে অভিষিক্ত করা হলো। হয়তো এই সিদ্ধান্তই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। আমার কর্তব্যজ্ঞান আমাকে সংকেত দিয়েছিল, সব কাজের ব্যর্থতার পরে অন্তত এই কাজে সাফল্য আনতে হবে। আমি তাই কাজ দেখানোর রাস্তা খুঁজে ফিরছিলাম। এদিকে শীতকাল এসে গেলে ব্যাডমিনিটনের কোর্ট তৈরি হয়ে গেল। তখন কী যেন একটা নিয়ম ছিল——ফুটবল খেলতে হতো গরম আর বর্ষা কালে। শীতকালের খেলা ছিল ব্যাডমিন্টন এবং ক্রিকেট। বেশ কিছুদিন ব্যাডমিন্টন খেলার পরে কার বুদ্ধি মনে নেই, সিদ্ধান্ত হলো টুর্নামেন্ট হবে। সবাই খুব খুশী হলেও আমি বেশ পেরেশান। ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে সিঙ্গলস খেললে তো পারবই না, ডাবলসেও কেউ সঙ্গী করতে রাজী না। সকলেই জিততে চায়, যতোই বইতে পড়ুক——অংশগ্রহণই বড় কথা। অতএব সকলেই যার যার সঙ্গী ভাল খেলোয়াড়দের রাখতে চায়। কামাল ছিল খেলাধুলায় সবচেয়ে তুখোড়, তাই কামালের সঙ্গী হবার জন্যে সবাই আগ্রহী। আর আমার কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করলো সকলে। মজা হলো, কামাল আমাকে তার সঙ্গী নির্বাচন করলো। হয়তো অতিরিক্ত মনোবল, নয়তো আমার দুরবস্থার প্রতি অনুকম্পা তাকে এই সিদ্ধান্তে আসতে উস্কানি দিয়েছে। এবার অন্যরা আরও সাহসী হয়ে পড়লো। তারা নিশ্চিত হয়ে গেলো, এবার আর কামাল জিততে পারবে না। যাই হোক, টুর্নামেন্ট শুরু হলে কামাল আমাকে বুদ্ধি দিলো, সার্ভ করার সময় সার্ভ করেই বসে পড়তে? আর ও পক্ষের সার্ভ ফিরিয়ে দেবার বেলায় প্রথম বার কোনোমতে ঠেকাতে পারলেই হলো, তারপর একপাশে সরে দাঁড়াতে হবে। চার এই পরামর্শ মতো খেলতে শুরু করলাম। সারা মাঠ দাবড়ে বেড়ালো কামাল। একাই ঘায়েল করলো প্রতিপক্ষকে। আমি কেবল দ্বৈত টুর্মামেন্টের পুতুল সঙ্গী। আমাদের দুজনের দল চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম। একটা সুন্দর সার্টিফিকেটও পেলাম যা এখনও সাক্ষ্য দেয় আমি একদা ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। কিন্তু এমন চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় কোনো আনন্দ নেই——কেবল বুঁদ হয়ে বসে থাকার অনুভূতি। এদিকে একদিন মোদাচ্ছের ভাইয়ের প্রস্তাব এবং অন্যদের সম্মতিতে আমি সাহিত্য সম্পাদকের পদে অভিষিক্ত হলাম। কিন্তু আমি জানতাম না সাহিত্য সম্পাদকের কি কাজ। প্রথম দিকে ভেবেছিলাম পাঠাগার উন্নয়ন। তাই বই ক্রয় করার দিকে নজর দিলাম। কিন্তু তেমন একটা ১৯/২০ কিছুই হলো না। বই যা ছিল অল্প সময়ের মধ্যে পড়ে শেষ করে ফেললাম। বন্ধুদেরও আগ্রহ কমে এসেছে। এমন সময় শীত শেষ হয়ে বসন্তের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি। মোদাচ্ছের ভাই আমাকে প্রস্তাব করলেন একটি দেয়াল পত্রিকা / দেয়ালিকা বের করতে। আমার তেমন কোন ধারণা ছিল না এই দেয়ালিকা কেমন করে বের করে। তবে মনে পড়ে, আর্ট পেপারে সুন্দর করে কবিতা ছোটগদ্য কৌতুক ইত্যাদি লিখে কিছু পেইন্ট ডিজাইন করে সাজিয়ে কোন এক দেওয়ালে লটকে দেওয়া হয়। আমি বন্ধুদের বললাম কিছু লেখা জমা দিতে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম লেখা জমা দেয়——কেউ ছড়া কাটলো ৪/৬ লাইনের, কেউবা কোন শোনা কৌতুক টুকে নিয়ে এসেছে। আর কিছু একুশে স্মরণে কবিতা। এই কবিতাগুলো যে কেউ যখন তখন লিখে নিয়ে আসতে পারে, যেমন——“একুশ মানে …” কিংবা “একুশ আমার…” এমন শত সহস্র পংক্তিতে দৈনিকের পাতা, ম্যাগাজিন ভরে ছিল। অতএব, বন্ধুরা যে সব কবিতা বা ছড়া নিয়ে এলো সেসব ছিল এমন লেখার ব্যর্থ অনুকরণ। কৌতুক যে বানায় সে অবশ্যই অসামান্য সৃজনশীল, কিন্তু পরে তা যারা ছড়িয়ে দেয় তারা নিতান্ত প্রচারকর্মী ছাড়া কিছু নয়। আমরা সবুজের সদস্যরা এমন কিছু ছড়া কবিতা জমা দিল। কিছু নীতিকথা ধরনের লেখা এবং কয়েকটি কৌতুকও হাতে এলো। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তো আমারও কিছু লেখা দরকার। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। এর মধ্যে খেলাচ্ছলে দু’চার চরণ লিখিনি তা বলা যাবে না, তাই মাথায় এলো, আমিও কবিতা লিখব। তবে আমি সচেতন ছিলাম প্রচলিত “একুশ মানে” কিংবা “একুশ তুমি” জাতীয় কিছু যাতে না লিখি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেয়ালিকা তৈরি হয়ে গেল, কার হস্তাক্ষরে দেয়ালিকাটি লেখা হলো আর কে অলঙ্করণ করলো তা আজ আর মনে নেই, তবে সেই আমার প্রথম প্রকাশ মানুষের কাছে লেখক হিসেবে। এর পরে দুয়েকজনের প্রশংসা আমার বুকটাকে একটু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দিলো এবং ভেতরে ভেতরে নিজেকে কবি মনে হতে লাগলো। সম্ভবত আমরা সবুজের পক্ষে সেটাই প্রথম এবং শেষ দেয়ালিকা। কিন্তু আমার তো আর শেষ লেখা নয়, তাই আমি খাতার পৃষ্ঠা ভরাতে লাগলাম। আগ্রহী হয়ে উঠলাম কবিতার প্রতি। পাঠ করতে শুরু করলাম রবিঠাকুরের কবিতা। প্রথম যে কবিতার বইটি পড়ি তার নাম সোনার তরী, এবং এখনও আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতাগুলোর একটি ‘সোনার তরী’। আমি মুখস্ত করায় অত্যন্ত দুর্বল। কোনোদিন কোনো পড়া বা রচনা আমি মুখস্ত করতে পারিনি। সমাজ বিজ্ঞান পরীক্ষায় এই মুখস্ত না করতে পারায় সবসময় টেনেটুনে পাশ করতাম, তা’ও ইতিহাসের কল্যাণে। ভুগোল এবং পৌরনীতি মুখস্ত করতে হয় বলে তাতে আমি ৬ /৭ করে পেতাম। বাকিটা ইতিহাস থেকে যুক্ত করে ৩৩/৩৪ হতো। ইতিহাসে গল্প থাকে, সেই গল্পটা মাথায় থেকে যেতো। আমি গল্পটা লিখতাম, সন তারিখ বাদ দিয়ে। তাতেই দয়া করে যা স্যারেরা দিতেন তা দিয়ে জীবন যাপন। এমন মেধার মানুষ যে কিনা ভোর হল দের খোল মুখস্ত বলতে পারি না, সেই আমি সশব্দ উচ্চারণে মুখস্ত বলতে পারি——“গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, / কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা…”
০৪ জুলাই ২০২১ রাত ৯:১৯ ঢাকা
মজা পেলাম৷ পরবর্তী সংখ্যা পড়তে চাই তাড়াতাড়ি৷
উত্তরমুছুনভাল লাগছে৷ অনেকদিন পর নতুন পর্ব এলো! দ্রুত লিখেন কবি
উত্তরমুছুন