.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে একগুচ্ছ গদ্য-আলেখ্য

প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে একগুচ্ছ গদ্য-আলেখ্য

লিখেছেন: মাসুদ খান

শুভেচ্ছাশক্তি


মহাবিস্ফোরণের পর ব্রহ্মাণ্ড যখন ছড়িয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে, তখন ওই ছোট্ট শিশুবিশ্বজুড়ে কেবলই বিকিরণ আর বিকিরণ। আর সেই বিকিরণ থেকে মুহুর্মুহু তৈরি হচ্ছিল কণিকা ও প্রতিকণিকা। ছুটছিল দিগবিদিক। আবার তারা যেই মুখোমুখি, অমনি সংঘর্ষ। অমনি পরস্পরে বিলীন হয়ে গিয়ে ফের ফিরে যাওয়া শক্তিতে, বিকিরণে। 

বিশ্ব আরো প্রসারিত হতে থাকল ক্রমে। কমে এল উত্তাপ উষ্ণতা। থেমে গেল শক্তি থেকে কণিকা-প্রতিকণিকা তৈরির যজ্ঞলীলা। তবে কী এক দুর্জ্ঞেয় কারণে, সমান-সমান না হয়ে প্রতিকণিকার চেয়ে কণিকা তৈরি হয়েছিল অনেক বেশি। প্রকৃতি দেখিয়েছিল এক স্পষ্ট প্রগাঢ় পক্ষপাত, কণিকার প্রতি।  

ভাগ্যিস দেখিয়েছিল! ভাগ্যিস প্রকৃতি নিজেই ভেঙেছিল তার স্বঘোষিত প্রতিসাম্যের নিয়ম! তা না হলে এ-বিশ্ব এখন ভরা থাকত শুধুই বিকিরণে।   
 
সে-কোন বিধান-ভাঙা বিধি, সে-কোন পক্ষপাতদুষ্ট একরোখা শুভেচ্ছাশক্তি, প্রকৃতির— যার আবেশে বিশ্ব আজ এমন বস্তূজ্জ্বল, প্রাণ-থইথই? 


অভিব্যক্তি


গাছপালা সব ব্রোঞ্জের, পাখিরা অ্যালুমিনিয়ামের, ঘাসপাতা লতাগুল্ম সব প্লাস্টিকের। আগাগোড়া ধাতু ও কংক্রিটে-মোড়ানো সব নিরেট নির্বিকার উল্লম্ব স্তূপরাশি। মানুষেরা সব পণ্যপর্বত আর ভোগপাহাড়ের মধ্যে আটকে-পড়া, অসুস্থ উদ্ভ্রান্ত গিনিপিগের মতো ক্রমাগত ছুটতে-থাকা।  

হাঁপিয়ে-ওঠা, হাসফাঁস-করা মানুষেরা কোথায় গেলে পাবে একটু নিরাময়, একটু সবুজ, একটু গা-ছমছমে ভাব, কোথায় গিয়ে উগরে দেবে তাদের দিনগত জহরিলা, ঘোচাবে বিভ্রম বিভ্রাট, লঘু পাপেচ্ছা... তা-ও একটু ভেবে রেখেছিলেন মা প্রকৃতি।

দৃষ্টি-ও-শ্রুতিকঠোর এই ধাতুনগরীর মাঝখান দিয়ে, বক্ষবিভাজিকা বরাবর আগে থেকেই বইয়ে রেখেছেন এক চিলতে ধারালো নদী— জংলি ও খরশান। ছোট্ট নদীর দুই ধারে বিচিত্র-প্রাণীপতঙ্গ-অধ্যুষিত জঙ্গলে-ভরা পাহাড়ি অববাহিকা। ঢালের একবার নিচে ওই কৃশকায়া বন্যতোয়ার পাড়ে এসে দাঁড়ালে ঘন জঙ্গলজালের আড়ালে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায় ওই নিষ্করুণ নগরী। কিছুই আর দেখা যায় না তখন ওই স্তূপ-স্তূপ কংক্রিটরাশির।   
 
কোটি কোটি টন ধাতুকংক্রিটের এই দুর্ধর্ষ নগরত্বের বিপরীতে এই এক টুকরো দুর্দান্ত প্রাকৃতিকতা। এক ভয়াল কালাপাহাড়ি জড়ত্বের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইরত এক ফালি সবুজ সজল জৈবিকতা। 


প্রকৃতি-১


এই গ্রহে প্রাণ বাঁচে প্রাণাহার করে। জীবকোষ বাঁচে, বিকশিত হয়, জীবকোষ খেয়েই। প্রতিদিন অন্য জীব-জীবাংশ গ্রাস করেই বাঁচতে হয় জীবকে। প্ল্যাংক্টন ও শ্যাওলা খাবে ছোট মাছ, ছোট মাছকে খাবে মাঝারি, মাঝারিকে বড়, আর ছোট-বড়-মাঝারি সবাইকে খাবে মহাকায় মাছ। আর ইচ্ছে করলে সবকিছুই গ্রাস করতে পারবে মানুষ। এই যে খাদ্যচক্র, স্তরবিন্যাস, এটাই প্রকৃতির বিধি। খাদ্যশেকলের উঁচু-স্তরে-থাকা বাঘকে তাই ভোর থেকে রাত অবধি ধেয়ে যেতে হয় স্তরান্তরে-থাকা হরিণের ঘ্রাণ অনুসরণ করে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য হরিণকেও ছুটতে হয় বাঘের আগে-আগে, আর প্রাণধারণের জন্য খেতে হয় তৃণগুল্ম।   

কিন্তু যদি এমন হতো, জীবদেহ যদি পারত কার্বন ও অন্যান্য জড়বস্তু সরাসরি আহার ও আত্তীকরণ করতে, তাহলে কি থাকত এই নির্মম জীবসংহারী খাদ্যচক্র, প্রাণসোপানের এই নিষ্করুণ স্তরপরম্পরা?  

জীবকোষের উদ্ভব ও বিকাশের জন্য মা প্রকৃতি কেন যে বেছে নিয়েছিল এমনই এক উপায়বিধি যা নির্ধারণ করে দিয়েছে এই সত্যটিকে যে, জীব-জীবাংশ খেয়েই বাঁচতে হবে জীবকে— সে এক রহস্যই বটে।  

গ্রহের প্রাণীদের ভেতরে এই যে আগ্রাসী, জীবঘাতী নৃশংসতা, এ কি তবে প্রকৃতিনির্ধারিত! প্রকৃতির একেবারে মর্মে নিহিত কি এই নির্মমতা! 

প্রকৃতি এমনই, হায়ারার্কিপন্থি; তার আছে নিজস্ব নির্বাচন আর সমর্থন করে সে যোগ্যতমের উদ্বর্তন। 

অবশ্য সময়ই প্রতিনিয়ত মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে চলেছে এই স্তরবিন্যাস।  


প্রকৃতি-২


প্রকৃতি এমনই। একদিকে প্রাণপালিনী, অন্যদিকে প্রাণবিনাশিনী। প্রাণহরণের মাধ্যমেই হবে প্রাণের পালন— এ-ই তার বিধান। একদিকে সে নিয়ত পরিবর্তনশীল, অন্যদিকে স্থিতিস্থাপক ও অভিযোজনসহায়। 

প্রকৃতিশাস্ত্রের এক অনুচ্ছেদে প্রেমযোগ, অন্যটাতে বলপ্রয়োগ। এক পাতায় চিত্রিত প্রকৃতি-মায়ের মমতাময়ী রূপ, অন্য পাতায় লেখা তার নির্মমতার কথা।

প্রকৃতির বিধিবিধান কেনই-বা এরকম, যেরকম দেখছি আমরা? হতে তো পারত অন্য কিছু— মহাকর্ষের বদলে মহাবিকর্ষ বা মহানিরপেক্ষ, পরিবর্তনশীলতার বদলে চিরস্থবিরতা! কিংবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন না হয়ে অযোগ্যের বা যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে সকলের উদ্বর্তন! 

সমস্ত বিশ্বব্যাপারের মূলে যে চারটি আদি মৌলিক বল, মহাবিস্ফোরণের পরপরই যাদের জন্ম স্থান আর কালের জমজ হিসেবে, কেন তারা সংখ্যায় চার, আর কেনই-বা তারা ওরকম! কিংবা সেই বিস্ফোরণমুহূর্তে নিঃস্থান-নিষ্কাল-নিঃশক্তি-নিষ্পদার্থক এক শূন্যতা, এক পরম শূন্যতা, কেন দ্বিভাজিত হয়েছিল পজিটিভ ও নেগেটিভ এনার্জিতে! কণা থাকলে কেন থাকে প্রতিকণা, ক্রিয়া হলে কেন হয় প্রতিক্রিয়া সমান সমান!      

প্রকৃতির কোন গভীর, জটিল আবেগ কাজ করেছে এসবের পেছনে— অজ্ঞেয়ই কি থেকে যাবে সব? 

প্রকৃতির বিধানগুলি কী কী এবং কীরকম, এ যাবৎ তা-ই আবিষ্কার করে আসছে বিজ্ঞান। কিন্তু কেন তারা সেরকম, তা অনেকটাই অজ্ঞাত। 

ভবিষ্যতের বিজ্ঞান হয়তো আবিষ্কার ও সূত্রবদ্ধ করতে থাকবে অবজেকটিভ ট্রুথের পাশাপাশি প্রকৃতির সেই প্যাশনাল, ইমোশনাল ট্রুথগুলিকেও।    


মা ও পালক মা 


আর কত সন্তানের ভার সামলাতে পারে একা এক মা! কোত্থেকে, কীভাবেই-বা জোটাবে এত-এত পোষ্যের আহার, আবাস, শক্তি, জ্বালানি, গ্যাসোলিন! তার ওপর সন্তানদের এত অত্যাচার, আজগবি সব আবদার— কাঁহাতক আর সহ্য হয় মায়ের!  ক্রমে জ্বর বেড়ে যায় তার, পুড়তে থাকে শরীর। নিরুপায় মা তাই মাঝে-মধ্যে ভীষণ চটে গিয়ে প্রহার করে সন্তানদের, বাঁধিয়ে দেয় হুলুস্থুল দুর্যোগ দুর্বিপাক। 

মা যদি আর না-ই নিতে পারে এত পোষ্যের ভরণপোষণ দায়ভার, পোষ্যরাই-বা কী করবে! তাই তারাও খুঁজছে পাওয়া যায় কিনা কোনো পালকমাতার সন্ধান। শোনা যায়, আছে একজন, দূরে, নিঃসন্তান। তবে বেশ রুক্ষ ও রুদ্র প্রকৃতির, বদরাগী। এবং চরমভাবাপন্ন। 

কিন্তু একবার যদি তার কাছে যেতে পারে, অন্তত কিছু সন্তান, ফেলে তো আর দিতে পারবে না; ক্ষমাঘেন্না করে নিশ্চয়ই আশ্রয় দেবে কোলে। 

তখন সন্তানদের প্রথম কাজ হবে ফল্গু জাগিয়ে তোলা বাৎসল্যরসের, জাগিয়ে তোলা হরিৎ-শ্যামল মায়া, পালক মায়ের রুক্ষ দেহে ও মনে।         


ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া


অরণ্য, আবাদ সব সাবাড় করতে করতে বুশফায়ারের মতো অপ্রতিরোধ্য গতিতে ধেয়ে চলেছে নগরসভ্যতা। অবশ্য ভোগবাদী মানুষের সীমাহীন স্বার্থপরতায়, অবিমৃষ্যকারিতায়, এমনিতেই একদিন থমকে যেতে বাধ্য হবে এই নির্বিচার আগ্রাসন, প্রকৃতির নিয়মেই। তখন অরণ্য শুরু করবে পাল্টা ধাওয়া। গাছপালা পশুপাখি মার্চ করে এগিয়ে যাবে নগরের দিকে।   

এই তো একদিন জঙ্গল ও আবাদিভূমি সাফ করে, পশুপাখিকে তাড়িয়ে দিয়ে গড়া হয়েছিল চেরনোবিল পারমাণবিক নগরী। আজ আবার জঙ্গল ও পশুপাখি দখল নিয়েছে এলাকাটির। এখন সেখানে পাকা সড়ক দিয়ে হাঁটে ধূসর নেকড়ে, বুনো ঘোড়া, রাঙা খেঁকশিয়াল, বনকুকুর...। গজিয়ে-ওঠা সব গাছপালায় আর পরিত্যক্ত সব বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় বাস করে রকমারি পাখি ও পতঙ্গ আর নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী— আরণ্যসমাজে প্রচলিত শ্রেণি-পেশা-আকৃতি-অবস্থান-ও-মর্যাদা মোতাবেক।       


জীবাণু

        
আদি এককোষী থেকে ক্রমে ক্রমে এই যে পূর্ণবিকশিত মানবপ্রজাতি, তার হৃৎপদ্ম, মৌচাকমণ্ডিত ফুসফুস, নিউরনসজ্জিত গোলার্ধচিহ্নিত মগজপিণ্ড...অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্পন্দমান স্থাপত্য আর তাদের অত্যাধুনিক ক্রিয়াবিধি, জটিল অ্যালগরিদম— সবই কোটি-কোটি বছরের ধীর-অথচ-নিরবচ্ছিন্ন বিবর্তনের ফসল। 

সমস্ত গ্রহের ওপর, গ্রহের আকাশ বাতাস সাগর পাহাড় অরণ্য, সমস্ত জড় জীব অণুজীবের ওপর মানবের একচ্ছত্র আধিপত্য, এমনকি অন্য গ্রহ-উপগ্রহের দিকেও ধাবমান তার দাপট। 

অথচ কী আশ্চর্য! না-জড়-না-জীব, এমনকি অণুজীবও নয়, এমনই এক ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র জীবাণু হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হয়ে মুহূর্তে বহুগুণিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সর্বোচ্চ বিকশিত এই জীবদেহে, লাফিয়ে লাফিয়ে দেহ থেকে দেহান্তরে। উন্নত জ্ঞানবুদ্ধি কৃৎকৌশল জারিজুরি বাহাদুরি কোনো কিছু দিয়েই ঠেকানো যাচ্ছে না অদৃশ্য জীবাণুবাহিনীকে। দেহকে করে দিচ্ছে বিদেহনগর পার।     

কী এক ভয়ংকর অসহায় অবস্থায় পড়েছে মানুষ এই আধুনিক বিশ্বে!  
  
 

অভিসমাজ, অভিসভ্যতা


আরণ্যসমাজ থেকে ধীরে ধীরে উঠে এসে, প্রাণপণ প্রয়াসে, মানুষ গড়েছে মানবসমাজ। গড়ে তুলেছে ইট-কাঠ-লোহা-পাথর-প্রযুক্তি-ও-আন্তর্জালের অত্যাধুনিক সভ্যতা। কিন্তু পরকলার ভেতর দিয়ে যেমন তৈরি হয় বস্তুর ওল্টানো প্রতিবিম্ব, তেমনই সমাজ-সভ্যতার বিপরীতে গড়ে উঠেছে এক নিষ্করুণ ওল্টানো অভিসমাজ, অভিসভ্যতা। এক ছালছাড়ানো দগদগে বাস্তবতা। মানুষই মানুষকে প্রতিনিয়ত ধাক্কাতে ধাক্কাতে নির্দয়ভাবে ফেলে দিচ্ছে একদম নিচে, গহ্বরে। অতল, বিতল, তলাতল পার করে সরাসরি রসাতলে। মানুষই মানুষকে করেছে মানবেতর, বাধ্য করেছে এমন জীবন যাপনে যা প্রাণিজীবনেরও অধম। 

ফলে মানবসমাজের পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে অভিনব এক সমাজ— মানবেতর-সমাজ, যে সমাজের সদস্যরা না-মানব-না-প্রাণী...স্পষ্টত এক মাঝামাঝি স্তরের।  

বিশ্ব এখন এমন এক সময়ে এসে উপনীত হয়েছে যখন মানবেতরেরা আর না-পারছে থাকতে মানবজীবনে, না-পারছে ফিরে যেতে জঙ্গলে, প্রাণীর জীবনে। অসহায়ের মতো, ভাষাহীনের মতো, মরিয়া হয়ে তাই তারা কায়মনে কামনা করে— মানুষ হিসেবে না হোক, অন্তত মানবেতর হিসেবে যেন বেঁচে থাকতে পারে তারা। মানবাধিকার নয়, অন্তত টিকে থাকে যেন তাদের মানবেতর-অধিকারটুকু।  


মায়া


মরুভূমিতে গাছপালা নেই, অক্সিজেনের কারখানাও নেই। কী হবে তাহলে, সেখানকার আগুনরঙা মানুষ ও প্রাণীদের? ওরা তো মারা যাবে নির্ঘাৎ দমবন্ধ হয়ে— এই শ্বাসরুদ্ধকর ভাবনায় শিউরে শিউরে উঠছে স্নেহে-ভেজা আমাজন বন, দূরের দ্রাঘিমায়। আর অবিরাম রান্না করে চলেছে অক্সিজেন... সেই কবে থেকে... মায়ের মমতায়।


সমান্তরাল


চারদিকে লোনা জলের সাহারা। মাঝখানটায় বহির্বিশ্ব-থেকে-পুরোপুরি-বিচ্ছিন্ন ছোট্ট একটি দ্বীপ। একদিক থেকে মনে হবে ওই দ্বীপদেশ যেন এই রূপসী গ্রহের সজল মুখমণ্ডলে এক অপরূপ তিলচিহ্ন। আবার অন্যদিক থেকে মনে হবে, ওই ছোট্ট নিভৃত ভূভাগ যেন মহাসাগরের বুকে এক উচ্ছল কৌতুকের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দেশ। 

কালাপানি-পারের ওই অত্তোটুকু দ্বীপে রয়েছে প্রায় সবকিছুই— মিঠাপানি-বয়ে-নিয়ে-চলা ঝরনা ও নদী, শস্য- ও সবজি-ফলানো উর্বর সমতল, ফলফুল-ফলানো রকমারি গাছপালা, অরণ্য, পাহাড়, খনি ও খনিজ, বিল, ঝিল, জলা, জঙ্গল, মেঘ, বায়ু, ঝিকিয়ে-ওঠা রোদ, চাঁদের গোল গামলা থেকে ছলকে-ছলকে-পড়া জ্যোৎস্না, ক্যামোফ্লাজ-জানা-ও-না-জানা নানা পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, কীটাণু-জীবাণু, মাকড়-মাকড়শা, মাছ ও অপরাপর জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ...। 

কোন প্রজাতির কতগুলি করে জীব, অজীব ও অণুজীব ধারণ করতে পারবে ওই ক্ষুদ্র দ্বীপদেশ, নিখুঁতভাবে তা ডিজাইন করেছেন মা প্রকৃতি— জগতের এক দুর্জ্ঞেয়, দুরূহতম ডিজাইন। মানবপ্রজাতির বেশ কিছু সদস্যেরও সংস্থান রেখেছেন মা সেখানে, সেই ডিজাইনে। আর সেটাই হচ্ছে ওই উজ্জ্বল কৌতুকের দুর্দান্ত পাঞ্চ লাইন। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, অন্য কোথাও থেকে আসেনি ওইসব মানুষ। স্রেফে, স্রেফে ওই দ্বীপেই অঙ্কুরিত ও বিবর্তিত হয়েছে তারা, ঠিক যেভাবে সেখানে আপনাআপনি গজিয়ে উঠেছে গাছপালা, ঠিক যেভাবে ঘটেছে বিচিত্র সব পশুপাখিপতঙ্গের সূচনা ও ক্রমবিবর্তন।  

ওইসব মানুষ, পাখি, পতঙ্গ, গাছপালা, নিসর্গ... সবাই মিলে গড়ে তুলছে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বনির্ভর জৈবপ্রাকৃতিক সভ্যতা, কথিত এই ‘আধুনিক’ সভ্যতার আড়ালে আড়ালে। নিভৃতে, কিন্তু সমান্তরালে। ‘আধুনিক’কে প্রতিনিয়ত ঠাট্টা করে করে গড়ে উঠছে সেই জৈব সভ্যতা...   


বহুরূপিণী


সেই ঠাট্টার জবাব দেবার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে তামাম দুনিয়া। কিন্তু ঠিক বাগে পাচ্ছে না দ্বীপটিকে। পাবে কীভাবে? দ্বীপটি যে কেবল ভ্রাম্যমাণ তা-ই নয়, নিমজ্জনক্ষমও বটে। এই এখনই এখানে তো পরক্ষণেই সেখানে, এই ডুবন্ত তো পরমুহূর্তেই ভাসমান। 

একবার যদি তাকে ধরে ফেলতে পারে পৃথিবীর ‘সুসভ্য’ মানুষ, একবার যদি গিয়ে উঠতে পারে ওই অক্ষতযোনি দ্বীপদেশে, ক্ষতবিক্ষত করে ফেলবে একদম। প্রথমেই গড়ে তুলবে বামদিকে কারাগার, ডানদিকে গোরস্তান, এবং মাঝখানে ল্যাবরেটরি। তারপর সমান তালে চলবে ভোগদখল আর গবেষণা একটানা। কারাগার থেকে গবেষণাগার হয়ে কবরাগার।

এসব আঁচ করতে পেরে আস্ত দ্বীপটিই তাই ধারণ করতে শিখেছে অভিনব সব কূটবেশ, স্বয়ংক্রিয়ভাবে। রূপদক্ষ সে-দ্বীপ কখনো ধারণ করে ক্ষণেই-শান্ত-ক্ষণেই-উত্তাল মহাসাগরের রং, কখনো তা হয়ে ওঠে রোদঝলমলে জলরঙের প্রচ্ছদ, আবার কখনো-বা ধারণ করে জ্যোৎস্নাশাসিত, কুয়াশাত্রাসিত রুপালি জলের রূপ।       


পরলোকগমন


দুনিয়াজুড়ে চলছে তখন জলযুদ্ধ। তার আগে ঘটেছিল পানীয় জলের জঙ্গ। তারও বহু আগে ছিল খালি গ্রিন-গ্রিন আওয়াজ— গ্রিন হাউজ, গ্রিন হাউজ ইফেক্ট, গ্রিন পার্টি, গ্রিন ইকোনমি, গ্রিন জব, গ্রিন মার্ক্স, গ্রিন ক্ষুধা, গ্রিন দারিদ্র্য, গ্রিন বৈষম্য, গ্রিন চিৎকার...। ওইসব গ্রিনিশ কোলাহলের পর শুরু হয়েছিল পানীয় জলের যুদ্ধের ডামাডোল। পরে আবার সাগরের লোনা পানিকে সুপেয় পানিতে রূপান্তরের সুলভ বাণিজ্যিক পদ্ধতি আবিষ্কারের পর পানীয় জলের যুদ্ধ থেমে গিয়ে শুরু হয়ে গেল দরিয়াজলের জঙ্গ। উত্তর গোলার্ধ সজোরে জল শুষে নিতে থাকলে টান পড়ে দক্ষিণে। পশ্চিম জল টানলে অভাব পড়ে পূর্বে। এর মধ্যে আবার পানি থেকে পাওয়া উদজান ও ভারী-উদজান পরমাণুতে গণ্ডগোল ঘটিয়ে শক্তি উৎপাদনের সহজ সুলভ প্রক্রিয়া বের করে ফেলেছে মানুষ। তাতে আরো অমূল্য হয়ে উঠেছে পানি। জলযুদ্ধের ঝাঁজ ও ঝাপটা দিনে দিনে হয়ে উঠেছে তীব্রতর।  

এরপর এল নতুন এক বিপদ। এক মহাগজব। সূর্যদেবের শরীর-স্বাস্থ্যটা খারাপ হয়ে পড়েছে খুব। অচেনা অসুখ ও অভিশাপের মতো শরীর থেকে তার বিকীর্ণ হচ্ছে ভয়ংকর সব রশ্মি। আতঙ্কিত, উদ্ভ্রান্ত মানবজাতি জলযুদ্ধ ভুলে গিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টায়। পৃথিবীকে ফেলে রেখে নয়, গ্রহটিকে নিয়েই সৌরজগৎ থেকে পালিয়ে যাবার ছক আঁটছে মানুষ। এর জন্য যে অকল্পনীয় শক্তির দরকার তা পাওয়া যেতে পারে কেবল বিপুল পরিমাণ উদজান কিংবা ভারী-উদজানের নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমেই। মহাসাগরের কোটি কোটি ঘনফুট পানিই তাই একমাত্র ভরসা। 

মাধ্যাকর্ষণের মায়া কাটিয়ে ধরিত্রীকে নিয়ে সৌর পরিবার থেকে ছুটে বেরুতেই দরকার হবে সমস্ত সাগরজলের চার ভাগের একভাগ। তারপর বহু-বহু-বছর-দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বহুদূরের এক পরজগতে, পরজ্যোতিষ্কলোকে, নবীন কোনো নক্ষত্রের কক্ষপথে পৃথিবীটাকে নিয়ে ঠিকঠাক বসাতেই লেগে যাবে বাকি জলের প্রায় সবটুকু। লাগলে কী আর করা! 

প্রভূত উত্তেজনা ও টানাপড়েন শেষে, অতঃপর একদিন পৃথিবীটাকে নিয়ে একটির পর একটি যমজাঙাল পার হয়ে হয়ে কুল-মখলুকাত যাত্রা করল এক অজানা অনিশ্চিত পরলোকের উদ্দেশে। 
     

পুনর্জন্ম


কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে বেশ কিছু মানুষকে নিয়ে, যারা ধরিত্রী ছেড়ে চলে গেছে বহু আলোকবর্ষ দূরে, নানা গ্রহে, গ্রহান্তরে। কেউ গেছে প্রমোদসফরে, কেউ গেছে প্রাণ ও প্রাণীর সন্ধানে, কেউ-বা দূরের জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের বাড়িতে বেড়াতে। আবার কেউ গেছে মরতে, ভার্চুয়াল মরণ। মহাকাশযানগুলির গতি এতটাই যে, ওগুলিকে ব্যবহার করা হয় টাইম-ট্রাভেলের জন্য। ভ্রমণের আগে ভ্রমিকের দেহটা এমনভাবে হিমায়িত করে ফেলা হয় যাতে তার সমস্ত কোষের ক্রিয়া স্থগিত হয়ে ঘটে যায় ভার্চুয়াল ডেথ। তারপর প্রোগ্রামিং করে পরিব্রাজকের হিমায়িত দেহটি তুলে দেওয়া হয় সময়যানে। আর সেই মরণঘুমের কালে শতবছর ধরে চলতে থাকে তার টাইম-ট্রাভেল। গন্তব্যে পৌঁছার পর কালনিদ্রা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেগে ওঠে পথিক, পুনর্জন্মের মতো ক’রে। প্রায় সব স্মৃতিই মুছে যায় তার স্মৃতিকোষ থেকে। অবশ্য কোনো কোনো জাতিস্মর মুসাফির স্মরণ করতে পারে অনেক কিছুই।  

দূরের ওই গ্রহগুলির কোনোটিতে তারা ভোগ করে স্বর্গসুখ, কোনোটিতে নরকযন্ত্রণা। ভোগ ও দুর্ভোগ শেষে তারা ফিরে আসবে যখন, ধরাধামে ফের পা ফেলার জন্য পুনর্জন্ম নেবে যখন, তখন, সেই বহুপ্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রমুহূর্তে, যেই তারা চোখ মেলবে, দেখবে পৃথিবীটা নেই। উধাও। 

ধরণী তরণিরূপে ভেসে চলে গেছে দূর পরলোকে। 

পুনর্জন্ম-পাওয়া পথিকেরা তখন নামবে কোথায়!?

মন্তব্য

BLOGGER: 3
  1. বা! মুগ্ধ হলাম। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এক অনাবিল স্বপ্নজগতে অবগাহন সম্পন্ন হল। কবি ও সম্পাদক দু'জনকেই ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. মোহাম্মদ রফিকুল আলম সরকার২২ জুলাই, ২০২১ এ ৯:০০ PM

    খুব ভাল্লাগলো মুক্তগদ্যগুলো

    উত্তরমুছুন
  3. ভিন্ন রকম এই ভাবনাগুলো কোথাও যেন একে অপরের সাথে নিবিড় সম্পর্কিত। ছোট ছোট গদ্যে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। গদ্যে শব্দের কারুকাজও লক্ষণীয়। ভালো লেগেছে। শুভ কামনা।

    উত্তরমুছুন
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে একগুচ্ছ গদ্য-আলেখ্য
প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে একগুচ্ছ গদ্য-আলেখ্য
প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে মাসুদ খানের একগুচ্ছ গদ্য-আলেখ্য বা মুক্তগদ্য।
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhmboyqZu9SyJ1rXomf2e3-eY8CFI8gJA-3TQqwvJZGocWthzGWBjAx_N1aSoMb8MXuFx68Ln-2ldIiTkiiSIWhk1xDyDNs1MiNRFZ0SYeXGh1jLlfdI5oW8D8paG4d8RA8wSJbU64YVFU/w320-h181/%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A3-%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%2583%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BF-%25E0%25A6%2593-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B7-%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%259F%25E0%25A7%2587-%25E0%25A6%258F%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%2597%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%259A%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%259B-%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25A6%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AF-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%2596%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AF.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhmboyqZu9SyJ1rXomf2e3-eY8CFI8gJA-3TQqwvJZGocWthzGWBjAx_N1aSoMb8MXuFx68Ln-2ldIiTkiiSIWhk1xDyDNs1MiNRFZ0SYeXGh1jLlfdI5oW8D8paG4d8RA8wSJbU64YVFU/s72-w320-c-h181/%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A3-%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%2583%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BF-%25E0%25A6%2593-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B7-%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%259F%25E0%25A7%2587-%25E0%25A6%258F%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%2597%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%259A%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%259B-%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25A6%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AF-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%2596%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AF.jpg
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/07/blog-post_20.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/07/blog-post_20.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy