সে সন্ধ্যা করে আসে আমার কাছে। সন্ধ্যা হলেই চুপ করে কাছে বসে থাকে। কথা-টথা বলে না। আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ভেতর ঘূর্ণি ওঠে। অন্ধ ঘূর্ণি। ঘূর্ণির প্রাবল্যে কোথায় ভেসে যাই! যতো অনিঃশেষ দূরেই যাই না কেনো নিজেকে স্বস্থানেই আবিষ্কার করি। সে ওমন চুপ করেই বসে আছে। আমার ভ্রম হয় যেনো প্রস্তরমূর্তি কোনো। প্রাণ নাই, কিন্তু প্রাণের ভঙ্গিটুকু আছে। এবং এই রূপ দেখে বিস্মিত হই। সুদূর অচেনা ঠেকে। এই ‘অচেনা ঠেকা’র ভাবনাটি আমাকে পেয়ে বসে। অনেক্ষণ ধরে তা নিয়ে নাড়াচাড়া করি। চারপাশের সব আলো গুটিয়ে যেতে থাকে। কড়া ভাবের একটা রাতের ভেতর চলতে শুরু করি। সন্তপর্ণে ও একাকী।
bindumag.com
তারপরই একটি ঘটনা সংঘটিত হয়। আশ্চর্য! যদিও প্রথমে এটাকে আশ্চর্য বলে চিহ্নিত করার উপায় নেই। মনে হলো কোথাও একটা নৈমিত্তিক ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে উঠেছে। উচ্চ স্বরগ্রামে, একটানা ও একভাবে। কোথা থেকে একটি ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে এইরকম প্রশ্ন দ্বারা সাধারণত মানুষ আলোড়িত হয় না। মানুষের চৌহদ্দির ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকারা বেজেই যাচ্ছে। কিন্তু এই ঝিঁঝিঁ পোকাটি, মনে হচ্ছে খুব কাছে, একদম নিকটেই কোথাও, আরও স্পষ্ট করে বললে যেনো আমার মাথার ভেতরই। উচ্চ স্বরগ্রামে, একটানা ও একভাবে। এমন উত্তেজক একটি ঘটনার সূত্রপাত ঘটলেও আমার অবসন্ন বোধ হতে থাকে। আলগোছে একবার মাথাটা ঝাঁকিয়ে তার দিকে পলকের জন্য তাকাই। আর তখনই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে সবকিছু। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আসলে তার ভেতর থেকেই আসছে। সে-ই যে এই ডাকের উৎস এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ এখন। আমি কী নিঃসন্দেহ সত্যিই? এমন নয় তো, সে-ই আমার মাথার ভেতর ঢুকে গেছে আর ঝিঁঝিঁ পোকার অবিকল ডেকে যাচ্ছে। কেননা তার মুখ স্থির ও নিষ্কম্প। স্বরযন্ত্র ব্যবহারের লক্ষণমাত্রও নেই। এমনকি তার চোখও কেমন অভিব্যক্তিহীন, একরকম। নিশ্চুপ থাকবার সমস্ত রকম দক্ষতাই একরকম তার আয়ত্তে। ঝিঁঝিঁর গুঞ্জনের দিকে আমি চোখ পেতে বসে আছি। রাত আরও জমাট বাঁধছে, নেশাগ্রস্থের মতো জেগে বসে রয়েছি।
bindumag.com
এই যে বসে আছি, এও অনেকদিনের কথা। মাঝে মাঝে মনে হয় কোনো অজানা চৌহদ্দিতে এসে পড়েছি হয়তোবা। আমি কি করে জানবো, আমি কোথায় আছি? যদিও সে-ই এসে বসে থাকে আমার কাছে, এবং আমার সমস্ত মনোযোগ ন্যাস্ত থাকে তার প্রতি। যখন দূরে কোথাও থাকি, আসলে দূরে কোথাও আছি বলে ভ্রম হয়। মূলত একজন, যে সন্ধ্যা ঘেঁষে এসে বসে থাকে আমার কাছে, আর এই সন্ধ্যাটিও আমার কাছে সমান রহস্যময়। পৃথিবীর আহ্নিক গতির সাথে যার কিছুমাত্র যোগসাজস নেই। যখন যে আসে, তার কিছুমাত্র সময় পূর্বেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে ওঠে পৃথিবীতে। আমি বুঝতে পারি জানালা দিয়ে তাকিয়ে উঠোনের ফুল ও ফলের গাছগুলো রঙ বদলাতে শুরু করলে। গাছের সারি সারি পত্রালি সবুজ থেকে গাঢ় সবুজ হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ গেলে, তারা নাই-সবুজ হয়ে যায়।
bindumag.com
এতক্ষণে আমার সমস্ত মনোযোগ উঠোন থেকে সরে এসে ঘরের ভেতর কেন্দ্রিভূত হয়। একহারা গড়নের একটি ঘর। ফ্লোরে একটি বিছানা পাতা। এই ঘটনাটিই বেশি করে আমার চোখে পড়ে, এই যে বিছানা পাতা এখানেই সে তার লম্বাদৈর্ঘ্য সময় জুড়ে বসে থাকে। কতো লম্বাদৈর্ঘ সময়! সময় প্রহেলিকা মাত্র। এই ঘর, আমি ও সে ছাড়া সবই এখানে কুহক। যেমন আমি এখন জানালাটির কথা ভাবছি। বিছানা লাগোয়া এই জানালা দিয়েই ঘরের ভেতর সন্ধ্যাচুর্ণ আলো প্রবেশ করে এবং একরকম আলো-আঁধারি তৈরী হয়। তারপর সময় গড়াতে থাকে, আধাঁর ততো ঘনীভূত হয়। ছাতিম ফুলের গন্ধ মেশানো এক রকম মিহিন আঁধার। মাথার ভেতর ঝিমঝিম করতে থাকে। তার বসে থাকায় কোনোরূপ ব্যত্যয় ঘটে না। একবার ভাবি, জিজ্ঞেস করি কেনো সে কোনো কথা বলছে না? কেনই বা একটানা ঝিঁঝিঁধ্বণি ছড়িয়ে চলেছে? কিন্তু আমার ভয় করে, চলেও তো যেতে পারে। একভাবে মূর্তিসদৃশ তো আর চিরকাল বসে থাকা যায় না। তার মুখের দিকে তাকাই, সেখানে কোনো পরির্তন ঘটেছে কীনা লক্ষ্য করি। না, ওমনিই বসে আছে দেখে একটি পরম স্বস্তির নিঃশ্বাস আমার বুক থেকে বেরিয়ে আসে।
bindumag.com
কাছে গিয়ে, একটা সময় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসি। চোখের পাতাগুলো স্পর্শ করি। হালকাভাবে। যেনো ছুঁইনি। ঘনঘন কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে। কিন্তু একটুও লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে না। যেভাবে তাকিয়ে ছিলো, ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে আছে। চোখের নিচে অঘুম রাত্রির চিহ্ন দেখতে পাই। আরো একবার তার চোখের পাতা নড়ে উঠে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরি, টের পাই ছাতিম ফুলের গন্ধ তীব্রতর হয়ে উঠছে। এমন সময় জানালা দিয়ে এক লহমা বাতাস আসে ঘরের ভেতর। চলন্ত গাড়িতে যেমন করে হানা দেয়, তেমনি এক লহমা এসে চুলগুলোকে অগোছালো করে দিয়ে যায়। ভাবতে থাকি এমনি একটি চলন্ত গাড়ির কথা, আমার অগোছালো চুলের ভেতর তার আঙ্গুলগুলোর গতিময়তার কথা। এমনিধারা কথা মনে হয় আমার, যেনো জীবন একটি চলন্ত গাড়িতে বয়ে চলা। কখনও দূর কারও সঙ্গে দেখার করার উদ্দেশ্য। কখনও কারও সাথে দূর দূর কোথাও চলে যাওয়া। এমনি অন্তহীন। যেনো অনেক গাছগাছালির একটি গ্রামের ভেতর দিয়ে চলেছি। এমন সুন্দর গ্রাম, মনে হয়েছিলো জীবনভর রয়ে যাই। এখন ভাবি আরও একবার অন্তত যদি ওই গ্রামের পথে যাওয়া যায়। কথা না বলুক, পাশে থাকু্ক। এমনওতো ঘটতে পারে, যেতে যেতেই সে কথা বলে উঠলো আর তখন একটি দুপুর, অনেক রোদ ভীড় করে আছে গাছগাছালির আনাচে কানাচে। একটু দূরে একটা পুকুর পাড়ে লম্বা একটি তালগাছে বাবুই পাখিরা উড়াউড়ি করছে।
bindumag.com
অনির্দিষ্ট রাত এখন। আগের যে এক লহমা বাতাস ছিলো, সেই বাতাসই এখন ভিড় করে আছে ঘরজুড়ে, থৈ থৈ। মনে হচ্ছে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছাতিম ফুলের গন্ধ, ঝিঁঝির ডাক। অমোঘ তার দিকে তাকাই। একটু কি কাঁপছে? এতো বাতাস, শীতে পাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। তার গা’য়ে যত্ন করে একটা কাঁথা জড়িয়ে দিই, তারপর দু’হাতে জড়িয়ে ধরি শক্ত করে। সে অবলীলায় তাকিয়ে আছে। বাড়িটি ডুবে আছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ও নিরন্তর হাওয়ার গহবরে। সারা বাড়ি? আমি জানি না। সত্যিই জানি না। এই ঘর ছেড়ে কখনও বের হয়নি আমি। মূহুর্তের জন্যেও তাকে ছেড়ে যাওয়া হয়নি কখনও। একটা চিরকালীন সন্ধ্যার মধ্য দিয়ে অনির্দিষ্ট রাতের প্রকোষ্ঠে অনন্তকাল ধরে বয়ে চলেছি আমরা। আমি ও সে। অনন্ত মহাবিশ্বের অনন্ত যাত্রারাশির ভেতর। এই বাড়িটি আমাদের যাত্রাসঙ্গি এবং এই ঘরই আমাদের অস্তিত্বের একমাত্র বলয়। যদিও রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে এই বাড়িটিতে অলকানন্দারা ফুটে থাকে। আর উজ্জ্বল হলুদ অলকানন্দায় চিলরোদ এসে গোত্তা খেয়ে ঢুকে পড়ে এই ঘরের ভেতর।
মন্তব্য