কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন সাহিত্যপত্র ‘তবুও প্রয়াস’ এর সম্পাদক কবি সেলিম মণ্ডল।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
সেলিম মণ্ডল: সবে কলেজে উঠেছি। ভরদুপুর। পাশের ঘরে বন্ধুরা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আমি, একা সারা মেস পায়চারি করছি। মেসের উলটো দিকে ছিল ছোটো একটা পুকুর। পুকুরে পাড়ে ছিল একটা পেঁপে গাছ। বাড়িতে দুই বুড়োবুড়ি থাকেন। গাছে পেঁপে পেকে হলুদ হয়ে গেছে। পাড়ার লোক নেই। একটি বিষাদগ্রস্ত কালো পাখি ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। ওই পাখিটি কিছুক্ষণ আগে আমার জানালায় ঠোঁট রেখে জিজ্ঞাসা করে গেছে, তুমি কি একা? তুমি কি উড়তে চাও আমার সঙ্গে? তুমি না ঘুমিয়ে পায়চারি করছ কেন? তোমার কি মনখারাপ? পাখিটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ফিজিক্স খাতার ইকোয়্যুশনের মাঝে কয়েক লাইন আবার লিখলাম। সেটাই আমার প্রথম লেখা বলা যায়। সালটা ২০১০। তার আগে ছোটোবেলায় অন্তমিল দিয়ে দু-চার লাইন কয়েকবার খাতার ফাঁকা জায়গায় লিখেছি। তবে তা নতুন সিলেবাস আর নতুন পাঠ্যক্রমে বিলীন হয়ে গেছে।
২। কবিতা আপনার কাছে কী?
সেলিম মণ্ডল: যদিও কবিতার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা হয় না। সেজন্য এত রহস্যময় ও সৌন্দর্যপূর্ণ। যুগ যুগ ধরে এই তর্ক চলবে কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়৷ রাবীন্দ্রিক থেকে জীবানানন্দীয় ভাষা পেরিয়ে আমরা এমন একটা সময়ে এসে পৌঁছে গেছি যেখানে গল্প-কবিতা-গদ্য উপন্যাস কেবল একটা Text. এ দায় কবির না, সময়ের। সময়ের দাবিতে কবিতা তার আঙ্গিক বা গঠন আনে।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
সেলিম মণ্ডল: আসলে প্রশ্নটা হল মানুষ কবিতার থেকে কী চায়? কবিতাকে মানুষ যেভাবে চাইবে সেভাবেই পাবে। চাওয়াটাই মূখ্য।
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি৷ ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
সেলিম মণ্ডল: কবিতা লেখার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে কিনা জানা নেই। কবিতা অনেকটা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মতো। লিখতে বসলেই লেখা হয়ে যাবে বা অমুক ছকে ফেলে দেব— তা হয় না। অনেকে পারলে পারতেও পারেন। তবে আমার ক্ষেত্রে, কবিতার একটা ঘোর আসে। বিশেষ করে নিজের ভিতর যখন চরম অস্থিরতা কাজ করে। ওই ঘোরের মধ্যে পরপর লিখি। হয়ত দিন চারে ২০-২৫ টা কবিতা লিখে ফেললাম। আবার এক-মাস দু-মাস লিখলাম না… ট্রেনে বাসে, রাস্তায়, পার্কে আমার অধিকাংশ কবিতা আমি লিখেছি। কাব্যগ্রন্থ করার সময় ওই লেখাগুলো নিয়ে বারবার বসি। একটি কাব্যগ্রন্থ থেকে আরেকটি কাব্যগ্রন্থ পৌঁছানোর জন্য নিজের সৎ শ্রমটুকু রাখার চেষ্টা করি। জীবনের মতো আমাদের কবিতার যাত্রাপথ দ্রুত পরিবর্তন হয় না। তবে যে বাঁক থাকে তা পাঠককে বোঝানোর চেষ্টা করি।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
সেলিম মণ্ডল: আমার বেড়ে ওঠা। যে জীবনের সঙ্গে ওঠবোস করতে করতে অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি তাই কবিতায় বারবার এসেছে। আমার প্রকৃতি, আমার যাপন, সমস্ত সম্পর্কের ভাঙা-গড়ার নির্যাস আমার লেখার অনুপ্রেরণা।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
সেলিম মণ্ডল: আমার মনে হয়, লেখালেখির জগতে সত্যিকারের বন্ধু কেউ হয় না। হয় শুভাকাঙ্ক্ষী বা শক্র। তবে এরা কেউই Constant নয়, Variable. সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরা বদলাতে থাকে।
লেখালেখির ক্ষেত্রে আমি বিশ্বাস করি, আত্মবিশ্বাস খুব জরুরি। একজন লেখকের Ups and Downs লেখালেখির জীবনে বারবার আসে। আর সেখান থেকে উত্তীর্ণ হওয়া নিজের কাছে বারবার চ্যালেঞ্জের। এমন সব প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসে আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। লেখককে নিজেই সবার আগে ক্লিয়ার হওয়া দরকার, তিনি যে পথ অনুসরণ করতে চাইছেন, সেই পথে তিনি পা ফেলতে পারছেন কিনা।
দাঁড়াতে শেখা~ হামাগুড়ি দেওয়া~ হাঁটতে শেখা~ দৌড়াতে পারা
কবিতার ক্ষেত্রেও এই Stepsগুলো আমাদের তৈরী, অনবরত চক্রিত হয়। এই চক্রাকার পথ গোলকধাঁধার। প্রতিটা ধাঁধার উত্তর থাকে। একজন লেখক নিজে জানেন সে উত্তর।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস–মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
সেলিম মণ্ডল: শব্দের মারাত্মক শক্তি। তীব্র শব্দে যে Vibration তৈরী হয় তা অনেককিছু ভেঙেচুরে দিতে পারে। একজন লেখকের সর্বদা স্বাধীন ও নির্ভীক হওয়ার জরুরি। রাষ্ট্রনীতি একজন লেখকের নীতি হলে মুশকিল। রাষ্ট্র যদি কলমকে ভয় না পায়, তাহলে কলমের জোর টের পাবে কীভাবে? একজন লেখকের কলম তখনই জ্বলে উঠবে যখন তাঁর ভিতর দায়বদ্ধতা থাকে। দলগত রাজনীতির বর্ম পরে কবিরা লিখতে বসলে অন্ধ হয়ে যায়। তখন নিজেই বুঝতে পারেন না লাইনটি বক্র না সরল। দায়বদ্ধতাও ক্ষীন হয়। আমি নিজের সরলপথে একটা সহজ সমীকরণে চলতে চাই। যা বাঁধা তাই আমার বিরুদ্ধ। তাঁকেই কলমে শানতে চাই। সে সাহিত্য দুর্নীতি হোক, স্বৈরাচারী শাসক হোক বা সন্ত্রাস-মৌলবাদ…
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
সেলিম মণ্ডল: লেখালেখি করতে এসে বুঝেছি, আশেপাশের লোকজন কেবল একটা রঙিন ছাতা। দূর থেকে বড়ো বেশি ঝলমল করে। হালকা রোদ বা বৃষ্টিতে প্রতিরক্ষা করতে পারে; তবে ঝড় বা বজ্র-বিদ্যুৎ-এ ওই ছাতাটা নিয়ে সবার আগে তারাই পালিয়ে যাবে।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
সেলিম মণ্ডল: করোনা লেখালেখিতে কী প্রভাব ফেলেছে সেটা এখুনি বলতে পারব না। কিন্তু করোনা না হলে হয়ত টের পেতাম না, মানুষের বেঁচে থাকা কী গুরুত্বপূর্ণ। করোনাকালীন সময়ে এমনিতেই লেখালেখি কম করেছি। ভেবেছি। পরিকল্পনা করেছি। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সেগুলো করব।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
সেলিম মণ্ডল: আমার বিশ্বাস, যুগ যুগ ধরে ভরসাযোগ্য পাঠক আছেন। থাকবেন। ভালো বই পাঠক খোঁজেন। আমি পেশাসূত্রে এবং পুরোনো বই মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে দেখেছি একটি বইয়ের জন্য পাঠকের কী তীব্র আর্তি। হয়ত প্রয়োজনীয় বই কোনো সিন্দুকে লুকিয়ে রাখলে তা ভাঙতেও পিছু পা হবেন না কোনো কোনো পাঠক।
একটা ঘটনা বলি— আমাদের গোপাল ভাঁড় সংখ্যা বেরিয়েছে। একজন পাঠক আমায় কল করে জানতে চান, আমি সংখ্যাটি সংগ্রহ করতে চাই। প্রাপ্তিস্থান জানাতে, উনি বলেন— যদি আপনার থেকে সংগ্রহ করি সমস্যা আছে? খড়দা স্টেশনে আসতে বলি। তখন গ্রীষ্মকাল। চারিদিকে ঠাঁ ঠাঁ রোদ। গায়ে জামা রাখাটাই দুঃসাধ্যের।
আমি অবাক হয়ে যাই। একহাত গলায় ঝুলিয়ে। সাদা ব্যান্ডেজে বাঁধা অবস্থায় লোকটি লোকাল ট্রেনে চেপে পত্রিকার সংখ্যা কিনতে এসেছে! শুধু ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আর সংখ্যাটি যত দ্রুত সম্ভব হাতে পাওয়ার লোভে। নিজেকে অপরাধী মনে হলেও, ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। এমন পাঠকও আছে!
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
জন্ম ৭ জুন ১৯৯০। নদিয়ার চাপড়ায় বাড়ি। পড়াশোনাসূত্রে কলকাতায় আসা। এখন কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
মায়াজন্ম (২০১৮)
লবণ খেতের জোনাকি (২০১৯)
কাঁচা মাংসের বাড়ি (২০২১)
সম্পাদিত গ্রন্থ
ছাদ পেটানোর গান (২০২০)
খুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনঅনেক কিছু জানলাম। শুভেচ্ছা রইল
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগল
উত্তরমুছুন