আলাপকারী: নয়নদীপ রক্ষিত
অনুবাদ: রাফসান গালিব
আমি এমন একরৈখিক সিনেমা করতে চাই না যা শুধু টাইমপাস ছাড়া কিছুই নয়।
ইরফান খান যখন মারা যান পৃথিবীবাসী তখন ঘরবন্দী। শতাব্দীর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এক মহামারী তখন ঝেঁকে বসেছে এ গ্রহের ওপর। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে অসংখ্য মুখ। হয় কফিনবন্দী নয়তো ঘরবন্দী। এটাই তখন নিয়তি হয়ে পড়েছে মানুষের মধ্যে। এর মধ্যে আমাদের নাড়া দিয়ে গেল ইরফান খানের মৃত্যু। করোনা তাকে কেড়ে না নিলেও হার মেনেছিলেন আরেক মারনব্যাধি ক্যানসারের কাছে। আচমকা এমন মৃত্যু মানুষকে নিস্তব্ধ করে দেয়, কী এক যন্ত্রণা তৈরি করে। তার প্রস্থানের এক বছর পার হয়ে গেল। পৃথিবীজুড়ে মহামারীর আগ্রাসন তীব্র হয়ে উঠেছে আরও। চিতার আগুনে জ্বলছে ইরফানের দেশ ভারত, গোটা বিশ্বের মানুষ স্তব্ধ। এমন সময়ে ইরফানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আসলো।
ইরফানের নাম শুনলেই চোখে ভেসে উঠে একের পর এক-লাইফ অব পাই, স্লামডগ মিলিনিয়র, দ্য লাঞ্চবক্স, হিন্দি মিডিয়াম, দ্য নেমসেক, বিল্লু, মকবুল, হায়দারের দৃশ্যগুলো। এ জাঁদরেল অভিনেতার এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে না পেরে তার ইন্টারভিউগুলো ঘাঁটছিলাম। তার মধ্যে একটা পড়তে পড়তে অনুবাদও করে ফেলি। ভারতের বিনোদন সাংবাদিক নয়নদীপ রক্ষিতকে এ ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন ইরফান। সহজেই তার সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব হতো না। খুব একটা ইন্টারভিউও দিতে চাইতেন না তিনি। এরপরেও নয়নদীপ তাকে রাজি করিয়ে ফেলেন। ঘণ্টা দেড়েকের এ আলাপে ইরফান মূলত তার অভিনয় চিন্তার কথাই বেশি বলেছেন। সিনেমা, অভিনয়, খ্যাতি, দর্শক, ইন্ডাস্ট্রি, বক্স অফিস ইত্যাদি নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ সুস্পষ্ট মন্তব্য পাওয়া যায় এতে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিনোদন বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ডিএনএ এ ইন্টারভিউ প্রকাশ করে।
নয়নদীপ রক্ষিত
আপনি কিংবা টাবুর মতো অভিনেতাদের কাছ থেকে মানুষ যখন মাসালা মুভি আশা করে, সেটাকে চাপ মনে করেন কী না?
ইরফান খান
যেটি আপনি ব্যক্তিগতভাবে চাননা সেটি নিয়ে যদি এমন আশা করা হয় তাহলে চাপ তো তৈরি হবেই। এরকম কিছু আপনি যদি চানও, তাহলে এর প্রতি আপনি আকৃষ্ট হন এবং সেটি খুঁজতে থাকেন। এটি আসলে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে এবং যেটি আপনাকে সফলতা এনে দেয়। যদি আমি শুধুই মাসালা মুভিই খুঁজতাম, তবে সেখানে সমস্য তৈরি হতো, সৌভাগ্যবশত বা দুর্ভাগ্যবশত হোক যদিও আমি কন্টেন্ট নির্ভর সিনেমাই নিই। কিন্তু যেটা আমি চাই না সেটা আবার কোথা থেকে আনবো? আমি এটা বুঝতেই পারি না। এটা ঠিকাছে, এমন সিনেমাও হয়। সেটা কীভাবে আমি জানি না। এখন এই মুহূর্তে এমন সিনেমা নয়, কারণ আমি এমন রোল আমি আশা করি এবং সন্ধান করি যা দর্শক আবারও দেখতে চায়।
নয়নদীপ রক্ষিত
আপনারা যখন কাজ শুরু করেছেন তখন কিন্ত এত এত অপশন ছিল না, বিশেষ করে আপনার মতো অভিনেতার জন্য। গত কয়েক বছরে সেই পরিস্থিতি তো বদলে গেছে...
ইরফান খান
সময়ের পরিবর্তনের কারণেও এমনটা ঘটেছে। বিশ্ব সিনেমার দিকেও ভারতীয় দর্শকরা এখন নিজেদের আগ্রহ প্রকাশ করছে। নিজেদের অভিনেতারাও বিচিত্র সব গল্পের সিনেমা করুক, সেসব দেখতে আগ্রহী এখন ভারতীয়ারা। এই কনটেক্সটে মানুষের চিন্তাশক্তিরও অবশ্যই পরিবর্তন আসে। এটা অবশ্য দারুণ ব্যাপারে এবং আমাদের জন্য বড় পরিবর্তন। উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ যে, দর্শকেরা এমনটাই প্রত্যাশা করে। এখন তাদের চিন্তাই যদি না খুলে, তাহলে নিজেদের নিয়ে আমরা কী করব। বৈচিত্র্য সব বিষয়ের জন্য দর্শকও বাড়ছে। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন এবং আরও সব প্ল্যাটফর্মের জন্য। আপনি আচমকা দেখবেন, পর্দার বাইরে থেকে দুর্দান্ত অনেক অভিনেতা বেরিয়ে এসেছে। এখানে একটি সিনেমা, একটা সিরিজের জন্যও অডিশন হয়, এতে আপনি দেখবেন কোত্থেকে এসব অভিনেতারা আসছেন। এই গণ্ডিটা বাড়ছে এবং এ নিয়ে আমি খুব খুশি।
নয়নদীপ রক্ষিত
তাহলে আপনি স্টার হওয়ার চেয়ে অভিনেতা হিসেবই স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করছেন
ইরফান খান
আমি আসলে এই ধরনের ক্যাটাগরি বিশ্বাস করি না। মিডিয়ার তার প্রয়োজনে অভিনেতাদের এসব তকমা দেয়। অনেক সময় তারা এসব শব্দ বাইর করে আর মানুষের জন্য হ্যাশট্যাগ দেয়। এতে আমার কিছু যায় আসে না। এমনকি মানুষ যদি আমাকে আমার নাম ধরে নাও ডাকে, এতেও আমি ঠিক আছি। নিজের নাম নিয়ে আমার মধ্যে আলাদা কোনো আবেগ নাই। এসব যেহেতু আমার মধ্যে কাজ করে না, তখন মানুষ আমাকে অভিনেতা মনে করে নাকি স্টার মনে করে তাতে কিছু যায় আসে না।
নয়নদীপ রক্ষিত
আগে, কোনো সিনেমার সাফল্যের একমাত্র প্যারামিটার ছিল না বক্সঅফিস। আর এখন বক্স অফিসই শুরু, বক্সঅফিসই শেষ। কোনো সিনেমার সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে আপনার ভাবনাতেও কোনো পরিবর্তন এসেছে কি?
ইরফান খান
এটি আসলে কোনোভাবেই বক্স অফিসের বিষয় না। এবং এটি কখনো হবেও না। আমি যদি বক্স অফিসে এক হাজার কোটি রুপি আয়ের একটি সিনেমা করিও আমি কখনো আমার সিনেমাগুলোকে অঙ্কের মুখোমুখি করব না। আমি অঙ্ক মনে রাখি না। আমি এসবের রেকর্ডও রাখি না। আমরা কি এটা নিয়ে কথা বলি যে, দিলীপ কুমারের কয়টা সিনেমা বক্স অফিসে হিট হয়েছিল? আমি তাকে মনে রাখি এই জন্য তার সিনেমাগুলো আমার মধ্যে কী আবেদন তৈরি করেছিল। এভাবেই আমি কোনো সিনেমাকে মনে রাখি। বক্সঅফিস ঘিরে যত কথাবার্তা সবই মিডিয়ার তৈরি। সিনেমার প্রচার প্রচারণা কর্মকাণ্ড এটিকে ভুল পথে দানব করে তুলেছে। অবশ্যই সিনেমার ব্যবসার জন্য এটা খুবই জরুরি। যাতে আপনি সিনেমা বানিয়ে যেতে পারেন এবং প্রযোজকও যাতে টাকা না হারায়। সিনেমা বানানোর পেছনেও এটাও একটা দিক। একটা সিনেমা আসলে সফল হয়ে উঠে সময়ের কারণে এবং আবেদন ধরে রাখার মধ্য দিয়ে।
movie: Life -f PI |
নয়নদীপ রক্ষিত
এখন প্রচলিত এবং অপ্রচলিত সিনেমার মধ্যে যে দূরত্ব সেটি ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে, এতে কি আপনি খুশি?
ইরফান খান
একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা আমরা করেছিলাম, আমি যখন ‘হাসিল’ নামে সিনেমাটা করছিলাম। আমরা তখন বলছিলাম যে, একটি সিনেমাকে আর্ট সিনেমা বা প্যারালাল সিনেমা হিসেবে গ্রহণ করা মানুষের উচিত নয়। আমাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, কখন আপনি কর্মাশিয়াল সিনেমায় অভিনয় করবেন, তখন সবসময় আমার উত্তর ছিল এমনকি এখনও বলি-‘হাসিল’, ‘মকবুল’ এবং ‘পান সিং তোমার’, আমার জন্য সবসময় কর্মাশিয়াল সিনেমা। সিনেমার ধরন নিয়ে এসব ডেফিনেশন এবং পারসেফশন বদলাতেই আমি এখানে এসেছি, সেটি নিজের জন্যও এবং অন্যের জন্যও। যেটা এখন আমি করে যাচ্ছি। এটাই আমি করে যাব। কোনো ক্যাটাগরি এবং ডেফিনেশনের মধ্যে আমি পড়ব না।
movie: Qarib Qarib Single |
নয়নদীপ রক্ষিত
‘হিন্দি মিডিয়াম’ তো দুর্দান্ত হিট হলো, ‘ক্বারিব ক্বারিব সিঙ্গেল’ও এমন জায়গায় আছে। দর্শকেরা যে এগুলো গ্রহণ করল, সেটি একটি ভাল ব্যাপার হতে পারে...
ইরফান খান
দেখেন এটি আসলে নির্ভর করে যে সিনেমাটি কীভাবে আসলে কাজ করে। এটি এমন কোনো অনুভূতি দিল যে, যাতে মনে হতে পারে এটি একটি ভাল সিনেমা। কিন্তু দর্শকেরা দেখে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আপনি সেটি জানছেন না। হ্যা, উৎসবকেন্দ্রিক সিনেমা দেখার দিকেই আমাদের দর্শকদের ঝোঁক বেশি, যেটি আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে না। দর্শকদের বিশাল একটি অংশ কিন্তু এরকমই-শুধু টাইমপাস করে। কিন্তু আমার সিনেমাগুলো তাদের কাছে টাইমপাস হলেও ফাঁফা কিছু নয়। সিনেমাগুলো তাদের মধ্যে প্রভাব ফেলবে। বিশ্বাস করেন, ক্বারিব ক্বারিব সিঙ্গেল আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে অনুরণন তৈরি করবে। আমি এমন একরৈখিক সিনেমা করতে চাই না যা শুধু টাইমপাস ছাড়া কিছুই নয়।
নয়নদীপ রক্ষিত
গত দুই বছরে সিনেমা নিয়ে আপনার পছন্দ-অপছন্দে কীভাবে পরিবর্তন আসল?
ইরফান খান
সত্যি বলতে কি, গত কয়েকটা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া আমাকে অনেক বেশি স্পষ্টতা আর আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছে- আমাকে আসলে কী করতে হবে। এটা কিন্তু হালকা কিছু না। একটা জিনিস জীবন থেকে শিখেছি, শুধু টাকার পেছনে ছুটা এসব আমি পারি না। খ্যাতির জন্য যদি সিনেমা করি, তাহলে আমি এমন ভান করি না যে অন্য কারণে আমি সিনেমা করছি। বিষয়গুলোকে সরাসরি আমি এভাবেই নিই। আমি যে ধরনের সিনেমা করি সেগুলো নিয়ে আমি আরও বেশি সচেতন হয়েছি। যেটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ আর এটা শুধু টিকে থাকার বিষয়ের মতোও নয়। এটি এমন না যে, আমি এমন সিনেমা করব যেটি বক্স অফিস ফাটিয়ে দেবে এবং আমাকে তারকা খ্যাতি এনে দেবে। আমি এমন পরিস্থিতিতে থাকতে চাই না। কীভাবে আমার মধ্যে এই পরিবর্তন এসেছে? এখন আমি মনে করি খ্যাতি আর টাকা হচ্ছে শুধু বাইপ্রোডাক্ট। একটা সময় এগুলো অনেক বড় বিষয় ছিল, যখন আমি টিকে থাকার লড়াই করছিলাম। এখন যেসব অভিনেতা টিকে থাকার লড়াইয়ে আছে তাদের সবার প্রতি বলতে চাই, হ্যা, টাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কিন্তু সেটাকেই প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে নেয়া উচিত নয়। যাই হোক এটি অনুসরণ করবে। যেটা তোমার শোনা উচিত, তোমার ভেতরের আওয়াজটা এবং তোমার প্যাশন কি সেটা বুঝতে পারা। এটাই হবে তোমার আসল অর্জন।
নয়নদীপ রক্ষিত
কখনো কি মনে হয়েছে, আপনার মতো ক্ষুরদার অভিনেতার আরও কমেডি সিনেমার প্রস্তাব পাওয়া উচিত?
ইরফান খান
আমি কমেডি সিনেমা মিস করি। আমি কমেডি সিনেমা খুঁজি। আমি বেশ কিছু কমেডির প্রস্তাবও পেয়েছিলাম, এমনকি আনিস বাজমির কিছু সিনেমাতেও। কিন্তু এই ধরনের কমেডি আমি আগেই করে ফেলেছি। আমি অপেক্ষা করছিলাম, আমি যা করে ফেলেছি তার থেকে আলাদা কিছুর জন্য। যার কারণে হিন্দি মিডিয়ামকে আমি বেছে নিয়েছি। হ্যাঁ, আমি অনেক অনেক কমেডি সিনেমা করতে চাই কিন্তু আমি আবার নিজেই নিজেকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে যাই। ফলে একই জিনিস বারবার করতে ভালো লাগে না। আমি নিজেকে চমকে দিতে চাই।
নয়নদীপ রক্ষিত
স্ত্রী আর ছেলের সঙ্গে কি আপনার সিনেমা নিয়ে আলোচনা করেন?
movie: Maqbool |
ইরফান খান
আমি তাদের থেকে কোনো পরামর্শ নিই না। পরে যখন তারা কোনো সিনেমা দেখে বা ট্রেইলার দেখে তখন তারা মতামত জানায়। কখনো এটি আমার যা আশা করি তার থেকে পুরোপুরি বিপরীত হয় (হাসি)। তাদের মতামত অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি মনে করি তাদের এত বেশি সময় নাই যে, তাদের কাছে গিয়ে বসে আমার স্ক্রিপ্ট পড়াবো। তারা আমার থেকেও বেশি ব্যস্ত । তাদের সময় পাওয়াটাই আমি সৌভাগ্যবান মনে করি। এটা ঠিক নয় যে তাদের জন্য আমার কাছে সময় নেই। এটা আরেকভাবে ঘটে আর কি (হাসি)।
নয়নদীপ রক্ষিত
তারা কি কখনো বলেছে, তোমার এমন কিছু সিনেমা করা উচিত হয়নি?
ইরফান খান
কিছু সিনেমা নিয়ে মন্তব্য করেছিল, কেন সেগুলো আমি করেছি। কিন্তু সেই সিনেমাগুলোর নাম বলতে চাই না (হাসি)।
সিনেমা নিয়ে আলোচনা দেখে ভালো লাগলো। বিন্দু'র চারিত্রিক পরিবর্তনের আভাষ পাচ্ছি। ইরফান খান আমার প্রিয় মুসলিম নায়ক। তাকে প্রসঙ্গ নির্বাচন করায় সম্পাদককে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনদারুণ
উত্তরমুছুনসুপার ওয়ার্ক
পছন্দের একজন মানুষ। পড়ে ভালো লাগলো 💝
উত্তরমুছুনপছন্দের একজন মানুষ। পড়ে ভালো লাগলো 💝
উত্তরমুছুনবা! শিল্পসাহিত্যজগতের এরকম বিখ্যাত মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে আপনাদের আরও আয়োজন প্রত্যাশা করি। খাস দেলে দোয়া করছি। https://uploads.disquscdn.com/images/ba41cfc8f2337e125032c8fe2019c61618bb5a3ad96a579fe8ef4dd1abe3ad02.png
উত্তরমুছুন