কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন কবি রাজীব সিংহ।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
রাজীব সিংহ: আমার প্রথম লেখা হবে এবং কীভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এ কথা বলতে গেলে আমাকে আমার শৈশবে ফিরে যেতে হবে। কারণ যতদূর মনে করতে পারছি আমার যখন আট বছর বয়স তখন আমি একটি কবিতা লিখি এবং সেই কবিতাটি ছাপার হরফে প্রকাশ পেয়েছিল। আসলে আরো ছোটবেলা থেকে আমি আপন খেয়ালে ছবি আঁকতাম, বই পড়তাম এবং ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করতাম, সেগুলো আদৌ কোনো লেখা পদবাচ্য ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেলে মামার বাড়িতে আমরা সমস্ত ভাই-বোন মিলিত হতাম, অর্থাৎ অন্যান্য মাসি ও তাদের সন্তানেরা এবং আমরা এবং আমার মামার সন্তানেরা সকলে একসাথে মিলিত হতাম। প্রায় এক মাস যৌথপরিবারের মতো থাকতাম আমরা। এখানে বলা প্রয়োজন, আমার মামার বাড়ি পাকুড়ে অধুনা ঝাড়খণ্ড কিন্তু তখন তা ভাগলপুর জেলার পাশে সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত ছিল। অর্থাৎ তার অবস্থান ছিল অবিভক্ত বিহারে। বাঙালি অধ্যুষিত বীরভূম ও বিহার বর্ডারের অন্তর্গত একটি আধা মফস্বল শহর ছিল পাকুড়। উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের মধ্যে যে রেলপথ তা পাকুড়-এর মধ্যে দিয়ে অর্থাৎ কিছুটা বিহার হয়ে গেছে। তো আমরা ছোটবেলায় ভাই-বোনেরা সবাই যখন একত্রিত হতাম তখন আমাদের নিজেদের মধ্যে নানা ধরনের খেলা, আড্ডা, চৌকি জোড়া দিয়ে সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান--- প্রায় রোজই দুপুরে রামায়ণ পালা অভিনয় ইত্যাদি হতো। এমনকি গানবাজনা, ছবি আঁকা, নাট্যচর্চা ইত্যাদির পাশাপাশি বিকেলবেলা ক্রিকেট, সকালে ডাংগুলি এবং রাত্রে ব্যাডমিন্টন বা কখনো কখনো ভূতের গল্পের আসর বসে যেত আমাদের মধ্যে। সেখানেই আমার বড়োমাসির ছেলে আমার চেয়ে বয়সে দুই বছরের বড় দাদা সঞ্জীব (নিয়োগী, এই সময়ের একজন পরিচিত গদ্যকার)-এর সঙ্গে আমার হাতে লেখা পত্রিকা চর্চার মধ্য দিয়ে এই লেখালেখির শুরু। মনে আছে তখন ‘বঙ্গলিপি’খাতার বাঁধানো ও পেপারব্যাক দুই-ই পাওয়া যেত। সেরকম কোনো এক খাতায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আমরা দুজনে নিজেদের মনের খেয়ালে যা মনে হতো তা লিখতাম, ইলাসট্রেশন আঁকতাম এমনকি বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের দিয়েও কিছু না কিছু লেখানোর চেষ্টা করতাম। যদিও সে ক্ষেত্রে খুব বেশি যে সাড়া পেতাম তা নয়, তবু এর মধ্যে দিয়েই আমরা আমাদের নিজেদের যাবতীয় প্রতিভার বিকাশ ক্রমাগত ঘটিয়ে চলতাম। বড়োরা সেই খাতার পিছনে নিজেদের মন্তব্য লিখে দিতেন। আমাদের সেই হাতে লেখা খাতা-পত্রিকাতে এমনকি দৈনিক 'যুগান্তর' পত্রিকা থেকেও জেমস বণ্ডেরর কমিক্সের জলছাপ আমরা নিতাম উল্টোদিকে কয়েন ঘষে দিয়ে খাতার পৃষ্ঠায়। কারণ তখন ছাপার কালি সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা থেকে যেখানে গাঢ়ভাবে পড়তো তার হাতে লেগে যেত। আমার সেই দাদা আরেকটু বড় হলে সেই সময় ‘যুগান্তরে’-র রোজনামচা বিভাগে নিজের লেখা একটি ছড়া প্রকাশ করেছিল। আমাদের এই সাহিত্যপ্রয়াসের পিছনে অবশ্য একটা কারণও ছিল। আর তা হল আমাদের মামা, শ্রী শৈলেন্দ্রকুমার মিত্র। মামা ছোটগল্প লিখতেন। আর সেই গল্পগুলি তৎকালীন ‘অমৃত’ পত্রিকায় ছাপাও হত। আমার নিজের লেখার ক্ষেত্রে প্রথম যে লেখাটি প্রকাশিত হয় তাও একটি স্থানীয় পত্রিকায়। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি সেটা ছিল একটা লিটল ম্যাগাজিন। ‘নবারুণ’ পত্রিকায় আমার সেই কবিতাটি যখন প্রকাশ পায় আমার তখন আট বছর বয়স। আমাদের পাড়ায় একটি দোকান ছিল খুব সম্ভবত তার নাম ছিল উদয়ন বুক ডিপো। ওই বইয়ের দোকানে পত্রিকাটি রাখা ছিল। তো সেই পত্রিকার ছোটদের বিভাগের জন্য আমি নিজের লেখাটি পাড়াতেই হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে সেই দোকানে জমা দিয়ে এসেছিলাম। আসলে ওই দোকানটি ছিল আমার জেলা স্কুলে যাওয়ার রাস্তার ওপর। আমি আর আমার বন্ধু শেখর নিয়মিত জেলা স্কুলে যাওয়ার পথে এই দোকানটিতে যেতাম মূলত কমিকস কেনার আগ্রহে।অরণ্যদেব, বাহাদুর, ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশ গর্ডন ছাড়াও চাঁদমামা, কিশোর ভারতী, শুকতারা, সন্দেশ, মৌচাক, আনন্দমেলা ইত্যাদি পত্রিকার খোঁজে প্রায় রোজই ওই দোকানে হানা দিতাম। এরকমই কোনো একদিন সেই দোকানের মালিক, আমি যাঁকে জেঠু বলে ডাকতাম, সেই বয়স্ক মানুষটি আমায় বললেন, তুমি খোকা লেখা দিয়ে গেছিলে। এই দেখো তোমার লেখা এই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমার বয়স তখন আট। আমার এখনও মনে আছে সেই অপটু হাতের লেখাটির নাম ছিল ‘রঙের খেলা’। এই হল আমার প্রথম লেখাপ্রকাশ বৃত্তান্ত। জীবনে প্রথমবার ছাপার হরফে নিজের নাম দেখা। কতোবার যে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের নাম দেখেছি এবং বাড়িতে যিনিই এসেছেন তাঁকেই লজ্জা লজ্জা মুখ করে ওই লেখাটি দেখিয়েছি তা মনে পড়লে এখন খুব মজা পাই। যদিও ওই একই সময়ে জেলা স্কুলের পত্রিকাতে অর্থাৎ বার্ষিক বিদ্যালয় পত্রিকায় আমার লেখা একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। এখন ভাবলে খুব লজ্জা পাই। কারণ ওই গল্পটি ছিল সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ পড়বার বদহজম। কাক ভূশণ্ডিকে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আমি আমার নিজস্ব কল্পনা লিখে ফেলেছিলাম ওই ছোটবেলায়। কিন্তু সেই ‘রঙের খেলা’ কবিতাটি ছিল মৌলিক। সেটা আমার নিজের সেই ছোটবেলার মানসিক গঠন থেকে উৎসারিত হয়েছিল। তাই ওই পত্রিকাটির ছোটদের পাততাড়ি বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিল এবং ছাপা হয়েছিল। পরবর্তীতে স্কুলে পড়াকালীন স্কুল ম্যাগাজিনে নিয়মিতভাবে লিখতে থাকি এবং আমার মনে আছে অনেক বছর খুব সম্ভবত আমি তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি আমার লেখা বাংলা সাহিত্য নিয়ে বেশ কঠিন বিষয় সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ, অনেকগুলো টেক্সটবুক পারমুটেশন কম্বিনেশন করে লেখা, গত তিন বছরের প্রকাশিত লেখাগুলির মধ্যে সেরা নির্বাচিত লেখার জন্য মনোনীত হয় এবং পুরস্কৃত হয়৷ ইণ্টারেস্টিংলি পুরস্কার হিসেবে আমি যে বইটি পাই সেই বইটির নাম ছিল ‘বাংলা নদীবিজ্ঞানের রূপরেখা’। অনেক পরে যখন গঙ্গার ভাঙন নিয়ে আমি একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে যাই তখন এই বইটি সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে আমাকে অনেক উপকৃত করেছে।
২। কবিতা আপনার কাছে কী?
রাজীব সিংহ: কবিতা কী কল্পনালতা? আমি একদম বিশ্বাস করি না। তাহলে কবিতা কী শুধুমাত্র স্মৃতির জাবর? না, আমি তাও বিশ্বাস করি না। তাহলে কবিতা কী শুধুমাত্র সত্যকথন? মনে মনে কথা বলা! না, নিজের সাথে নিজে! সেখানেও আমার আস্থা নেই। আমি মনে করি কবিতা একজন ব্যক্তিমানুষের স্বতোৎসারিত উচ্চারণ। অর্থাৎ এক কথায় বলা ভালো যে একজন ব্যক্তিমানুষের মনের ভেতর যে পরিমাণ আবেগ রয়েছে তার সূক্ষ্মতম প্রকাশ কবিতা একথা যেমন বলা যায় তেমনি কোনো একটি ঘটনা বা কোনো একটি আইডিয়া যখন একজন ব্যক্তিমানুষের বা বলা ভাল একজন কবিতার লেখকের মাথার মধ্যে কাজ করে, তখন তিনি সেটিকে একটি সূক্ষ্মতম মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে কখনো প্রকাশ করেন। যা কবিতা৷ আবার কখনো বা গল্প-উপন্যাস এমনকি প্রবন্ধ আকারেও প্রকাশ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, আপনি আপনার চোখের সামনে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দেখলেন বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা মন্বন্তর বা মহামারী ইত্যাদির মুখোমুখি হলেন, তখন আপনি যেভাবে রিয়াক্ট করলেন তা-ই কবিতা। আবার আপনি সারাদিনের কোনও একটি মুহূর্তের কথা লিখলেন, কবিতায় এই মুহূর্তটুকু ধরা থাকলো অ্যালবামে পুরনো ছবি বাঁধিয়ে রাখার মত আপনার কয়েকটি পংক্তির মধ্য দিয়ে। ভবিষ্যৎ পাঠক কিন্তু আপনার কথার মধ্যে যে ইশারা আছে, আছে যে আড়াল, তা সরিয়ে আপনার সেই চেতনার মর্মে গিয়ে পৌঁছাতে পারেন, আবার কখনও না-ও পারেন। সেই সূক্ষ্মতম বহিঃপ্রকাশকেই আবার একটি গল্প বা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আপনি যখন প্রকাশ করছেন অথবা আপনি যখন প্রবন্ধের মাধ্যমে লিখছেন তখন তা মানুষের অনেকটাই বোধগম্য হয়ে ওঠে বলে দাবি করা হয়ে থাকে। যদিও আমি মনে করি কবিতা যদি কবিতা হয় তাহলে তার কোনও আড়াল কোনও ইশারা পাঠকের সঙ্গে কমিউনিকেশন বা অমিয়ভূষণ মজুমদারের ভাষায় ‘সংবিত্তি’ ঘটাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কবিতা নিয়ে আমার আইডিয়া বা চিন্তার কথা জানতে চাওয়া হয়েছে। আমি মনে করলেই যে কথাগুলো একটু আগেই আমি বললাম যে একটি মুহূর্ত নিয়ে আমি যখন গল্প লিখি সেই গল্পটির বিষয় আবার কবিতায় আমি যখন প্রকাশ করি তখন যেভাবে তা চলে আসে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আসে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি একই আইডিয়া নিয়ে কখনো কবিতা লিখেছেন, কখনো উপন্যাস লিখেছেন, আবার সেই উপন্যাস এমনকি চরিত্রগুলোর নাম বদল না করেও নাটকে ব্যবহার করছেন। এখানে নটীর পূজা থেকে বিসর্জন বা রাজর্ষি সবগুলি উল্লেখ হিসেবে আমাদের মনে রাখতে হবে। আজকেও যখন একজন তরুণ লেখকের বা নবীন লেখকের বা আমি নিজের কথা বলি যে যা আমি নিজে লিখতে চাই আমার মধ্যেও সেই একই জারণ ও বিজারণ প্রক্রিয়া ঘটতে থাকে। অর্থাৎ বিষয়ের বহিঃপ্রকাশ মাধ্যমটির উপরেই নির্ভর করে, সেটি কবিতা হবে নাকি গল্প নাকি সাহিত্য বা শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যম।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
রাজীব সিংহ: আমি বিশ্বাস করি কবিতা মানুষকে সব দিতে পারে। সর্বস্ব দিতে পারে। ভাঙা ঘর উজাড় করে দিতে পারে। আবার ঠিক তার উল্টোটাও হতে পারে।
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
রাজীব সিংহ: আমি আগের প্রশ্নের উত্তরে আমার কবিতা লেখার পদ্ধতি বলে ফেলেছি। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে যাওয়ার জন্য আমাকে অন্তত আলাদা করে কোনো রেফারেন্স বা অন্য কোনও আরোপিত অভিজ্ঞতার কাছে নতজানু হতে হয় না। কারণ আমি মনে করি কবিতা সত্য উচ্চারণ। সেটা হৃদয় থেকে আসে। মস্তিষ্ক থেকে নয়। সুতরাং আলাদা করে ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে যাওয়ার সময় আমার পাণ্ডুলিপি, আগে যখন কাগজে-কলমে লিখতাম, এবং এখন যখন ডেস্কটপে লিখি তা একই জায়গায় রয়ে গেছে অর্থাৎ কাটাকুটিটুকু আমার মস্তিষ্কে ঘটে থাকে। কাগজে-কলমে খুব সামান্যই। অনেকেই একটা সময় আমার প্রথম পাণ্ডুলিপি দেখে অবাক হয়েছেন যে আমার পাণ্ডুলিপিতে কোনও কাটাকুটি নেই কেন!
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
রাজীব সিংহ: লেখার অনুপ্রেরণা লেখাই। অর্থাৎ আমি যা দেখছি, আমি যা পড়ছি, আমি যা শুনছি, আমি যা বলতে চাইছি--- এই সমস্তটাই।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
রাজীব সিংহ: উত্থান সময় বলতে আপনারা ঠিক কী বলছেন বুঝতে পারছি না। যদি লিখে তথাকথিত সাফল্য ও উপার্জনের কথা বলেন এবং সেটা যদি এক ধরনের উত্থান হয়ে থাকে, তবে আমি সবিনয়ে জানাই আমি তাহলে এখনো সেই অর্থে উত্থিত নই। কখনো কখনো লিখে টাকাটা পেয়েছি, তখন ভালো লাগে। কিন্তু লেখা আমার পেশা নয়। আর সম্মান/পুরস্কার যেটুকু তা পাঠকের/মানুষের ভালোবাসা ছাড়া আর কী! প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশটা খুব ইন্টারেস্টিং। সেসময়ের অর্থাৎ শুরুর দিনের বন্ধু শত্রু নিন্দুক সমালোচক এঁরা প্রত্যেকেই আমার কাছে নমস্য। আজও এঁদের অভাব নেই আমার জীবনে।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস---মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
রাজীব সিংহ: হ্যাঁ, সাহিত্য দিয়ে আপনারা যা যা উল্লেখ করলেন, আমি বিশ্বাস করি সমস্তগুলি করা যেতে পারে। কারণ গানই হয়ে ওঠে স্লোগান, আর কবিতাই হয়ে ওঠে গান।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
রাজীব সিংহ: যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের মানুষের সাথে তার দেখা হয় প্রত্যহ, প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। মানুষ ছাড়া আর কিছু নেই। মানুষকেই ভালবাসতে হবে। এটি একজন মানুষের অন্যতম কর্তব্য জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
রাজীব সিংহ: এই মহামারী বা এপিডেমিক কোভিড-১৯ বা করোনা সারা পৃথিবীকে ভয়াবহ ভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি তো কোন ছাড়! আমি ওই লকডাউন পর্বে প্রথম প্রথম অনেকদিন লিখতে পারতাম না, পড়তে পারতাম না। মনঃসংযোগে খুব অসুবিধা হতো। তখন আমি ওই ঋত্বিক ঘটকের একটি কথা শিরোধার্য করে নিয়ে নিজে নিজেকে বলেছিলাম, আই ডোন্ট লাভ ফিল্ম। কাল যদি সিনেমার থেকে বেটার মাধ্যম বেরোয় তাহলে আমি সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব। অর্থাৎ করোনা মহামারীকালীন ওই প্রথম ছয়-সাত মাস আমি যখন প্রায় কিছুই লিখতে বা পড়তে পারছিলাম না তখন আমি ঋত্বিক-এর মতই সাহিত্য ছেড়ে গেছিলাম কোনও একটি বিশেষ মাধ্যমের মোহে। ঘরে বসে ফোনে পরিচিতদের কাছ থেকে তাঁদের নিজেদের নানা বিষয়ের ভিডিও ক্লিপিং নিয়ে এবং স্টিল ফটোগ্রাফ দিয়ে আমি বেশ কিছু ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলাম। এ বছর রবীন্দ্রনাথের ১৬০ তম জন্মদিন, কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ১০০ তম জন্মবর্ষ, এই নিয়ে আমি যথাক্রমে সভ্যতার সংকট ও ন্যাংটো ছেলে আকাশে হাত বাড়ায় এই দুই শিরোনামে দু’টি-- তথ্যচিত্র বলবো না, দু’টি কবিতাতথ্যচিত্র বানিয়েছি। এছাড়াও আরও বেশ কিছু কবিতাতথ্যচিত্র আমি বানিয়েছি ওই সময়।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
রাজীব সিংহ: পাঠকদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার আপনারাই সব। আপনারা থাকলে আমরা কবিরা বা লেখকরা আছি। সে আমরা কমার্শিয়াল কাগজে লিখি বাজারি পত্রিকাতেই লিখি আর লিটল ম্যাগাজিনেই, আপনারা ছুঁড়ে ফেলে দিলে আমাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। আবার আপনারা আপন করে নিলে সে ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কারও ম্লান হয়ে যায়। সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। কোনোভাবে এই বিপদজনক সময়টিকে আমরা পেরিয়ে যাবই।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: রাজীব সিংহ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতে। যুক্ত আছেন ‘মাসিক কবিতাপত্র’ ও ‘এবং বিকল্প’ লিটল ম্যাগাজিনের সাথে।
কবিতার বই: শব্দময় পৃৃথিবী, কেরিয়ারগ্রাফ, অনুগত কলকাতা,প্রেম পদাবলী, খোলামকুচি, অন্যান্য ও মালিগাঁওয়ের ডায়েরি, বেহুঁশ সনেটগুচ্ছ, সঙ্গে থাকুন, এই ডিসেম্বর।
দীর্ঘ কবিতার বই: দীর্ঘাঙ্গী পঁচিশ।
কাব্যোপন্যাস: পাখিদের উপকূলে একা।
উপন্যাস: খ্যাপার পাণ্ডুলিপি, অন্ত্যজ অন্ধকার, দ্রোহপর্ব।
গল্প সংকলন: ঘাইহরিণীরা, স্বপ্ন অথবা রাতজাগা ডলারের গল্প।
প্রবন্ধের বই: আবাদভূমির সাহিত্য: উপেক্ষা ও শিরোনাম,জীবনানন্দের অন্ধকারে, ভালো আছো, নয়ের দশক?, অবদমনের সাহিত্য: সাহিত্যের অবদমন।
পুরস্কার ও সম্মান: সম্পাদনার জন্য ‘চট্টগ্রাম লিটল ম্যাগাজিন লাইবেরি ও গবেষণা কেন্দ্র সম্মান’ (২০০৯), ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সম্মান’ (২০১২) এবং লেখার জন্য ‘কবিতা পাক্ষিক সম্মান’ (২০১২), ‘প্রেষণা সাহিত্য সম্মান’ (২০১৬), ‘মল্লার সম্মান’ (২০১৭)।
মন্তব্য