কোরাকাগজের খেরোখাতা
জিললুর রহমান
আমাদের বাসার দোতলা ওঠার কর্মযজ্ঞ যখন চলছিল তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। মিস্তিরিদের পরিত্যক্ত ধারা (ধাইয্যা) আর কাঠ দিয়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে আমরা ভাইবোন আর প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি খেলা, পুতুল বিয়ে খেলা এসব খেলতে খেলতে একদিন দোতলার কাজ শেষ হয়ে গেল। এলো ভারাটিয়া পরিবার। ওদের ঘরে আমাদের বয়সী কেউ ছিল না। কিন্তু আমাদের চেয়ে বড় নবম কি দশম শ্রেণীর ছাত্রী একজন ছিলেন। আমরা তখন খেলাধুলার পাট ছাদে স্থানান্তর করেছি। উঠানেও কিছু দৌড়ঝাপ হয়। এর মধ্যে আমার দেখা প্রথম প্রেমের উন্মেষ ঘটলো সেই ভাড়াটিয়া কন্যার সাথে আরও বড় কেউ একজনের। আমরা তাঁর নাম জানতাম না। তিনি দুপুরে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি গান করতেন। হ্যাঁ, একটিই গান করতেন তিনি সবসময়——“আপনা দিল তোয়াবারা...”। সে যুগে হিন্দী গানের সাথে সম্ভবত এভাবেই আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। আমরা আড় চোখে লক্ষ্য করে দেখেছি, রাস্তা থেকে আপনা দিল তোয়াবারা’র গান বেজে উঠলেই দোতলার বারান্দায় কাঁকনের রিনিঝিনি শোনা যেতো। তারপর চেয়ে থাকা——শুধু চেয়ে থাকা। যেন জন্ম-জন্মান্তর তারা চেয়ে থাকতো একে অপরের দিকে। বিকেলে বয়স্করা দিবানিদ্রা সেরে বেরিয়ে আসার আগেই তারাও সটকে পড়তেন। আমরা সেই ভাইয়াটাকে ‘আপনাদিল’ ভাইয়া ডাকতাম। না তিনি আমাদের দিয়ে কোনো চিঠি পাঠাননি। এমনকি সেই আপাটার সাথে তেমন করে কোনো কথাও বলেননি, ঘোরাফেরা হাত-ধরা তো দূরের কথা। কিন্তু এমন বেরসিক প্রেমও মানুষের রসালো বর্ণনার হাত থেকে নিস্তার পেলো না। পাড়ায় বেশ তোলপাড় হয়েছিল এদের নিয়ে। এর মধ্যে আবার বাসা ভাড়া নিয়মিত না দেওয়া ইত্যাদি ব্যাপারও জুটে গেলে একদিন তাদের বাসা ছেড়ে চলে যেতে হয়। আমার এতটুকু জীবনে প্রথম দেখা প্রেমকাহিনী এভাবেই অসমাপ্ত অবস্থায় শেষ হয়ে গেল। আমার মেঝফুফু একবার বলেছিলেন মহৎ প্রেমের মিলন হয় না। তারা বেহেশতে গিয়ে মিলিত হয়। তাই আলিফ লায়লা’র পরিণয় বেহেশতে সম্পন্ন হবে বলেই তাঁর নিশ্চিত ধারণা ছিল। দোতলা’র প্রথম বাসিন্দারা বিদায় নেবার পরে নতুন আরেক পরিবার এসে থাকা শুরু করে। তাদের ছোট্ট ছেলেটি তখনও ভাল করে কথাই বলতে পারে না——নানা রকম ছড়া আওড়াতো। আর মেয়েটি আমার বোন লীনার চেয়ে কিছুটা ছোট হলেও কাছাকাছি বয়সেরই ছিল। তাই আমাদের নিত্য দৌড়ঝাঁপে তারাও সঙ্গী হয়ে গেল একসময়। এই পরিবারটি এই ঘরে ঊনিশ বছর থেকেছে। আর তাদের সাথে আমাদের মধুর প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক চিরকাল অটুট থেকেছে।
এদিকে স্কুল জীবনের পাশাপাশি মসজিদে যাতায়াতের ফলে কিছু কমন বন্ধু জুটে গেল, যারা একই পাড়ার এবং একই স্কুলের ছাত্র। দুয়েক ক্লাস উপরে নীচে নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ তৌহীদী ইনকিলাবের কারণেই হয়তো ঘটেনি। আস্তে আস্তে আমরা বিকেলে আছরের নামাজের পরে আলাপ আড্ডা জমাতে বসে গেলাম মানিক ভুট্টোদের বাসার প্রাঙ্গনে। কামাল মুনিরও আমার সাথে যেতো, তাই আব্বা আম্মার দিক থেকে তেমন বাধা এলো না। মানিক, ভুট্টো ও ছুট্টু — এরা তিন পিঠাপিঠি ভাই। মানিক ও ভুট্টো আমার সহপাঠী, ছুট্টু নীচের ক্লাসে, মানে মুনিরের সহপাঠী। ওদের বাবার গায়ের রং আলকাতরার কাছাকাছি কৃষ্ণবর্ণের এবং সুবিশাল বপু তাঁর মেরুদণ্ড থেকে প্রায় এক দেড় ফুট আগে আগে চলতো। ওনার একটা প্রাইভেট বেবী ট্যাক্সি ছিল। পরে পরে জানতে পেরেছিলাম তিনি রাস্তা নির্মাণের কনট্রাক্টর। একসময় অবাক হয়ে ভাবতাম রাস্তাগুলো কেমন হঠাৎ সুন্দর হয়ে ওঠে আলকাতরার গুণে। আর আজ জানতে পেলাম, মানিকদের বাবা তথা পথে পথে আলকাতরা ছড়ানোর নেপথ্য নায়ক। মেজাজ ছিল চেঙ্গিস খাঁ’র মতো। অবশ্য আমি জানতাম না চেঙ্গিস খান কেমন মেজাজী ছিলেন, তবে তাঁর রাজকীয় মেজাজ দেখে আমার তেমনটাই মনে এসেছিল। মানিকদের কোনো বোন ছিল না, তাই তারা মা’কে গৃহকর্ম ও রান্নার কাজে সহযোগিতা করতো। আর মানিকের বাবার ক্যারেক বেত দেখলে কলজে শুকিয়ে যেত।
একবার মানিকদের বাসায় গিয়ে দেখি পরিবেশ থমথমে। ওদের বাসার কাজের মেয়ে সম্ভবত তার স্বামীর ঘর ছেড়ে এসে এখানে কাজ নিয়েছে। তার স্বামী অনেক চেষ্টা করেও তাকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। পরে সে কোনোভাবে টহল পুলিশ একজনকে ম্যানেজ করে নিয়ে আসে। সেই পুলিশ ভদ্রলোকটি মানিকদের বাসার সামনে এসে হম্বিতম্বি করছিল। মানিকের বাবার তখন দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় একটি ক্যারেক বেত নিয়ে বেরিয়ে আসেন। পুলিশটি তাঁর প্রশ্নের জবাবে গৃহকর্মীকে তার সাথে যেতে দিতে বললে, তিনি সেই পুলিশ ভদ্রলোককে ওয়ারেন্ট দেখাতে বলেন। কিন্তু তা দেখাতে ব্যর্থ হলে মানিকের বাবা সেই লোকটিকে বেত দিয়ে বেদম পেটাতে থাকলে একসময় সে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। আমরা হতভম্ব আড়ষ্ট দর্শক। মানিকদের একজন প্রাইভেট শিক্ষকও সেখানে ছিলেন। তিনি এই কাণ্ড দেখে তাড়াহুড়া করে “ওরে বাবা, তোদের বাবা পুলিশকে পেটায়!”——বলতে বলতে সেই যে পালালেন, আর কোনোদিন ফেরেননি।
মানিকদের বাসা পাহাড় বা টিলার উপরেই বলা যায়। বাসার সামনে বিশাল এক মাঠ, সবুজ ঘাসের মাঠে আমরা ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলতাম। একপাশে অনেকগুলো সিঁড়ির ধাপ নেমে একটি বিশাল পুকুর। সেই পুকুরে সাঁতার দিয়ে অপর পাড়ে চলে যেতাম। ছুটির দিনে সারাদুপুর সাঁতার কেটে ঘাটের ঘুলঘুলি থেকে তেলাপিয়া মাছ ধরা এবং মানিক ভুট্টোদের রান্নাঘরে ভেজে খাওয়ার স্বাদ আজও ভুলতে পারিনি। পুকুরে সাঁতার কাটার জন্যে বাসা থেকে বেরুবার সময় দুটো লুঙ্গি একত্রে পরে বের হতাম। যাতে আব্বা আম্মা টের না পায়। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত লুঙ্গি পরতে ভুলে গেলে গায়ের স্যান্ডো গেন্জিকে জাঙ্গিয়ার মতো পরে নেমে পড়তাম। আর গায়ে স্যান্ডো গেন্জি না থাকলে লুঙ্গিকে উপরের দিকে তুলে ধরতে ধরতে জলের ভেতর নেমে পড়তাম। একসময় কোমর ডুবে গেলে লুঙ্গিটা মাথার ওপর দিয়ে খুলে ছুঁড়ে দিতাম ঘাটে। তারপর সে নগ্ন সাঁতার শেষে, বন্ধুদের কেউ লুঙ্গি ছুঁড়ে দিলে তা মাথা দিয়ে গলিয়ে পরতে পরতে উঠ আসতাম ডাঙায়। তবে মাঝে মধ্যে কেউ কেউ দুষ্টুমি করে লুঙ্গি লুকিয়ে রাখার খেলাও খেলেছে। বর্ষাকালে মাঠে জল ও কাদা জমতো। আমরা তার মধ্যেই ফুটবল খেলতাম। কাদাজলে বলে লাথি মারার চেয়ে বন্ধুদের গায়ে কাদা ছিঁটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমার বেশি ঝোঁক ছিল। খেলা শেষে আমরা সবাই একেকজন মাটির মানুষে পরিণত হতাম। তারপর গিয়ে ঝাঁপ দিতাম পুকুরের জলে। ফুটবল খেলায় যে আমি খুব পারদর্শী ছিলাম তা কিন্তু নয়। ক্ষীণ কৃষকায় শরীরে দৌড়ানোর তেমন স্পৃহা তৈরি হতো না। তবু ‘অংশগ্রহণই বড় কথা’ —— এই সারবাক্য সত্য করার জন্যেই যেন আমার এ ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ। বন্ধুরাও আমাকে ‘দুধভাত’ তুল্য ভেবে গোলপোস্টের সামনে ‘বেগী’ বানিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতো, আর আমার প্রতি নির্দেশনা যে কোনো ভাবে বলটিকে দূরে পাঠিয়ে দেবার। আজকাল ‘বেগী’ শব্দটি তেমন শুনি না। এখন সবাই ‘ডিফেন্স’ বলে থাকে। অথবা হয়তো, এমন পদ এখন বিলুপ্ত হয়েছে। আমি শরীরের সমস্ত শক্তির সাথে সকল ইচ্ছাশক্তিকেও একত্র করে বলটিতে এমন লাথি মারতাম যে, প্রায়শই বল সীমানা পেরিয়ে যেতো। যতোটা স্মরণ করতে পারি, অন্তত একবার গ্যারেজের জংধরা দরজা এবং আরেকবার মানিকদের জমিদার ফেরদৌস মিয়াদের দ্বিতল বাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙার কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছিলাম। ফেরদৌস মিয়াকে আমরা দেখিনি। তাঁর স্ত্রী জীবিত ছিলেন, মানিকদের সাথে সাথে আমরাও নানী ডাকতাম। আমাদের ডেকে বকা তো দিয়েছেন, তবে যে ভেতরে ভেতরে এই মাঠে আমরা যারা খেলি, তাদের প্রতি তাঁর প্রশ্রয়ও ঢের পেয়েছি। তবে, তাঁর ছেলেদের ডাকতাম ভাই। আহাদ ভাই তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মনসুর ভাই ইত্তেফাকের সাংবাদিক, এবং সেলিম ভাই তখনও মাদ্রাসার ছাত্র, পরবর্তীতে ব্যবসায়ী। ওনারাও আমাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। শীতকালে আমাদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলায় এসে অংশ নিতেন নিয়মিত। ওদের খেলা মানে নিত্য নতুন কর্ক পাওয়া। রাতে খেলার জন্যে তাঁরা আলোর ব্যবস্থাও করেছিলেন, তবে আব্বার ভয়ে স্কুল জীবনে কোনদিন রাতে ব্যাডমিন্টন খেলতে সেখানে যেতে পারিনি। এইভাবে পাড়ার আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। তবে মাগরিবের আজানের আগে গৃহপ্রবেশ বাধ্যতামূলক। কোনো কারণে একটু দেরী হলে সরাসরি মসজিদে ঢুকে নামাজে শরিক হতাম, আর বেরুবার সময় আব্বা যাতে দেখতে পায় সেদিকে বেশ লক্ষ্য রাখতাম।
ওদিকে ইশকুলে সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছি কোনোরকমে পাশ দিয়ে। এতে মহান পিতা বেশ রুষ্ট। আম্মা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে, নতুন বিদ্যালয় নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যা হয়েছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। সপ্তম শ্রেণীতে আমাদের ক ও খ বিভাগ একত্রিত হয়ে একই কক্ষে বসতে হতো। শ্রেণীকক্ষের স্বল্পতা, নাকি শিক্ষক স্বল্পতা——জানি না। বিশাল ঘরে দুই সেকশনের শতাধিক ছাত্র গিজগিজ করে বসতাম। কোনো ফাঁকা পথ ছিল না। এমনকি একটা বিড়ালও আমাদের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবার সুযোগ নেই। শিক্ষকদের পক্ষে পেছনের দিকে কি চলছে তা দেখার সুযোগ তেমন নেই। তাই পেছনে বসে জমিয়ে গল্প করা যেতো, গল্পের বই পড়া যেতো——এমনকি কাটাকুটি খেলা থেকে পেছনের দরজা দিয়ে কেটে পড়া পর্যন্ত। একবার টিফিন ছুটির পরে কামালসহ কয়েকজন পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে পাশেই নীচের দিকে থাকা পানির মটরের ঘরটির পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমিও তাদের সাথে বেরিয়ে পড়ি। জানতে পেলাম, তারা গুলজার সিনেমা হলে যাবে। এখন ফেরার পথ বন্ধ। বাসায় গেলেও প্রশ্নের সম্মুখীন হবো। তাই তাদের সঙ্গী হয়ে প্রথম স্বাধীনভাবে সিনেমা দেখলাম —— ‘আসামী হাজির’——আর প্রতিক্ষণেই নিজেকেই আসামী মনে হচ্ছিল। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার এটাই আমার প্রথম ও শেষ ঘটনা। এমনিতে ভাল কোনো সিনেমা এলে আম্মা আর মামীমা’র সাথে আমরা অনেকে মিলে দেখতে যেতাম। যেমন ‘অশিক্ষিত’ বা ‘ছুটির ঘন্টা’ দেখে কতো কেঁদেছি। তবে, আব্বাকে কখনও সিনেমা হলে যেতে দেখিনি। আম্মা বলেন, আমার একান্ত শৈশবে, আড়াই-তিন মাস বয়সে, আমাকে কোলে নিয়ে আব্বা আম্মা সিনেমা প্যালেসে ‘সাত ভাই চম্পা’ দেখতে গিয়েছিলেন। সে যুগে তো আর ডায়াপার ছিল না। আমিও সানন্দে ভিজিয়ে দিয়েছিলাম ন্যাপকিনসহ পিতৃক্রোড়। সেই যে মাঝপথে তাঁরা ঘরে ফিরে এলেন, আমার বাবার জন্যে সিনেমা হল থেকে সেই ফেরা যে শেষ ফেরা হবে ‘তাহা কি জানিত কেউ’?
যাইহোক, সপ্তম শ্রেণীতে এসে দেখা পেলাম বাঘা সিদ্দিক স্যারের সাথে। তাঁকে সিনিয়ররা এই নাম কেন দিয়েছিল তা টের পেলাম সহসা। তিনি বজ্রমুষ্ঠি দিয়ে যেভাবে তেড়ে এসে আঘাত করতেন তা এখনও চোখে ভাসছে। স্যার ছিলেন দীর্ঘদেহ শ্মশ্রুমণ্ডিত পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত। পাজামার ঢিলেঢালা অন্তর্বাস ভেদ করে প্রকট হয়ে থাকতো সম্ভবত হার্ইড্রোসিল সমেত মস্কোর ঘন্টা। এ নামটিই বলতে শুনেছি বন্ধুদের। সিদ্দিক স্যার হাঁটার পথ না থাকায় হাইবেঞ্চের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তেড়ে আসতেন পেছনের বেঞ্চের দিকে। ওদিকে পেছনে পেছনে দুঃসাহসী কামাল মস্কোর ঘন্টা ক্যাচ ধরার ভঙ্গিতে সন্তর্পনে এগুতে থাকতো। স্যার টের পেলে খবর ছিল। কিন্তু স্যার টার্গেট ছাত্রকে দুরমুশ করার ঘোরে এদিকে যে বেঘোরে ইজ্জত টানাটানি চলছে টের পাননি। স্যারের ঘুষির ওজন কতো হবে জানি না, আমি সম্ভবত এই ঘুষির শিকার হইনি, হলে মনে পড়তো। তবে শেরেবাংলা যেভাবে ঘুষি মেরে নারকেল ছিলতেন, সিদ্দিক স্যারও তেমন করেই ছাত্রদের মুখের চামড়া ছিলার দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তবে কেন জানি না, সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে এর বেশি কিছু মনে পড়ছে না। তবে, আব্বা ষান্মাসিক পরীক্ষা থেকেই বেশ উত্তেজিত ছিলেন। প্রতিদিন পরীক্ষার আগে পড়ার খবরাখবর তো নিতেনই, পরীক্ষা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই কেমন হলো তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবর্ণ নিতেন। সব ট্রান্সলেশন, সকল অংক আব্বাকে আবার করে দেখাতে হতো। এসময় আমার আবার হাত বেশ ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে। আসলে আমি আগাগোড়াই ধীরগতির ছিলাম। এবার পরীক্ষার উত্তর দিতে গিয়ে টের পেলাম, সময়ের অভাবে, কখনও কখনও জ্ঞানের অভাবে প্রতিটি পরীক্ষায়েই ১০/১৫ নম্বরের উত্তর লেখা হয় না। ঘরে ঢোকার সময়ই আব্বা উচ্চস্বরে প্রশ্ন করেন——“আজ কত নম্বরের প্রশ্ন বাদ দিয়েছিস?” আমিও মাথা নীচু করে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলি——“দশ নম্বর বাদ পড়েছে”। তখন আব্বার রুদ্রমুরতি দেখে ভয়ে কলজে কেঁপে উঠতো। তিনি বলতেন——“তুই জীবনেও পারবি না”। অবশ্য ভাষাটা ছিল চাটগাঁইয়া। আম্মা পেছন থেকে আমাকে উদ্ধার কল্পে হয়তো বলতেন, “পারবে পারবে। তুমি বাপ হয়ে অভিশাপ দিলে তো সে কোনদিনই পারবে না”। যতটুকু মনে পড়ে, এসএসসি পরীক্ষার আগে পর্যন্ত কোন পরীক্ষাই আমি সম্পূর্ণ উত্তর দিতে পারিনি।
যাই হোক, অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবার সময় রোল নম্বর অল্প হলেও কিছুটা এগিয়ে এলো। আবার আমরা ক ও খ বিভাগে পৃথক হয়ে গেলাম। এর মধ্যে রবিঠাকুরের উপন্যাস বউ ঠাকুরানীর হাট, যোগাযোগ এবং গোরা পাঠ করে ফেললাম। গোরা পাঠের গভীর প্রভাব আমি সম্ভবত আজও কাটাতে পারিনি। সেই কৈশোরে গোরা’র দার্শনিক তর্ক অপেক্ষা বিনয়ের নির্ভেজাল বন্ধুত্ব আমাকে অনেক বেশি করে টেনেছিলো। আমি যেমন অনেক বন্ধুর মধ্যে একা হয়ে থাকতাম, এবং একজন পরম বন্ধুর অভাব নিত্য অনুভব করতাম, গোরা’য় বিনয়ের চরিত্র আমাকে তেমন বন্ধুর অভাব আরও অনেক বেশি করে অনুভূত করলো——বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করতে থাকলো। এদিকে ফেরদৌস মিয়াদের মাঠে, পুকুরঘাটে, মানিকদের বাসার চত্বরে প্রাত্যহিক আড্ডার ফাঁকে একদিন মোদাচ্ছের ভাই (আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী) আমাদের সাথে আলাপে বসলেন। মোদাচ্ছের ভাই আমাদের চেয়ে কয়েক বছরের বড়, মানিকদের পাশের বাসায় থাকতেন। আলাপের বিষয়——আমাদের এই বন্ধুদের দলটির একটি সাংগঠনিক প্রকাশ। সম্ভবত তিনিই নাম দিলেন ‘আমরা সবুজ’। সবাই যেমন লিখে থাকে——একটি ক্রীড়া, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন——নামের নীচে যুক্ত হলো। সভাপতি কাকে বানানো হয়েছিল আজ আর মনে নেই। মোদাচ্ছের ভাই হলেন সাধারণ সম্পাদক।
বাহ্ ! এ তো সবগুলোই পড়ে ফেলতে হবে !
উত্তরমুছুন