কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন গল্পকার তিতাস অধিকারী।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
তিতাস অধিকারী: প্রথম লেখার সঠিক তারিখ হুবহু মনে নেই। তবে যেটুকু মনে পড়ে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’ আবৃত্তি করব বলে নাম লিখিয়ে মহড়া শুরু করি। সেই সময় স্কুলে এমন একটি অনুষ্ঠান ঘিরে এলাকাজুড়ে ছিলো ব্যাপক উৎসব,উত্তেজনা। সাধারণত অনুষ্ঠানের সময় ছিলো ফাল্গুন, চৈত্র মাস। দুই দিন ব্যাপী বিভিন্ন খেলাধুলা শেষ দ্বিতীয় দিন দুপুরের পর থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়, কবিতা পাঠ শেষ হলে অনুষ্ঠানের শেষের দিকে বরাদ্দ থাকত কৌতুক ও নাটক। তো সেবার ঝোড়ো আবহাওয়া হঠাৎ মুখ গোমরা করলে কবিতা আবৃত্তি বাদ দিয়ে কৌতুক এবং নাটক শুরু করা হয়। আমার কবিতা পড়া হয় না, তারপর থেকে একপ্রকার অভিমানের বশে লেখালিখির শুরু। যদ্দুর মনে পড়ে স্থানীয় একটি ‘ছোট কাগজ’ আমার প্রথম লেখা ছাপে।
২। ‘ছোটগল্প’ আপনার কাছে কী?
তিতাস অধিকারী: আমি প্রায়ই বলি-মানুষ আসলে কুণ্ডলী পাকানো এক গল্প, মানুষ মারা গেলে গল্পটুকু থেকে যায় যুগ যুগ। সমস্ত বিশ্বসংসার গল্প বন্ধনে আবদ্ধ। পৃথিবীতে আজ যা ইতিহাস তা তো গল্পই এবং প্রত্যেকটা ইতিহাসের আগে পড়ে কাঁড়ি কাঁড়ি পাকা গল্প আছে, থাকে এবং থাকবে। কিন্তু দুঃখ গল্পশক্তির উৎস সন্ধানের জায়গায় আজকাল অনেকেই বড্ড অমনোযোগী। সমস্ত মানুষজনের প্রয়োজনবোধ থেকে একটা যোগাযোগ, সেতুবন্ধন দরকার। গল্প সমস্ত সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, উত্থান-পতন, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনবোধ ঠিক রেখে সেই সেতুবন্ধনের কাজ চালিয়ে যায় সন্দেহ নেই। সেই দৃষ্টিতে ছোটগল্পকে আমি যুত্সই সামগ্রিক একটা ব্যাপার মনে করি। আমার কাছে ছোট গল্প মানে-শক্তি!
৩। কথাসাহিত্য মানুষকে কী দিতে পারে?
তিতাস অধিকারী: ‘কী দিতে পারে’ এই প্রশ্ন আসার সাথে সাথে সাহিত্যের সীমা-পরিসীমা মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে। এই মস্তবড় পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে। অগণিত মানুষ নতুন পুরাতন কথাসাহিত্যে পাঠ করে নিজেদের মধ্যে নিজেদের নতুন করে স্থাপণ করে পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া থেকে। সিগারেট পান করলে তার প্রতিক্রিয়া যেমন শরীরে কাজ করে তেমনি সাহিত্যকর্ম মানবিক মন থেকে সমাজে প্রতিফলিত হয়। আবার অনেক অনেক ক্ষেত্রে আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে মহৎ কিছু কিছু কথাসাহিত্য সভ্যতার দিক নির্দেশনা করে।
৪। “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”— ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এরকম শর্ত বা নির্মাণ বৈশিষ্ট্যকে কতখানি সমর্থন করেন?
তিতাস অধিকারী: শৈশবে মা, বাবা, কাকি, মাসী, পিসী, দিদি, দাদু কিংবা দীদা একটার পর একটা গল্প বলে যাচ্ছেন আর আমি আবদার করেই যাচ্ছি, গল্প শেষ হলেও আবদার যেন শেষ হয় না! আমার যেটা মনে হয় এভাবে মানুষ জন্মগতভাবে গল্প শোনার একটা দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। যুক্তির বাইরে গিয়ে মনে হয় সেই ধারাবাহিকতা গল্প ও গল্পপাঠকের মধ্যে কিছুটা রয়ে গেছে। আমার বেশিরভাগ গল্প “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”-এ বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষ্য বহন করে যদিও কিন্তু আমি যখন লেখা শুরু করি তখন এসব থিওরি মনেই থাকে না। কিন্তু লেখা শেষ করার পর দেখি এমনটাই বর্তমান। যদিও এমনটা হতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
তিতাস অধিকারী: প্রথম দিকে আমি কিছু মহৎ লেখকের লেখা পড়ে গল্প লেখা শুরু করি তথাপিও সমস্ত লেখকের প্রতি সম্মান জানিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার গল্পের চরিত্রগুলো আমার লেখার অনুপ্রেরণা। সামাজিক অনেক অসঙ্গতির কথা মুখে বলতে পারিনি কিন্তু গল্পে তাদেরকে সর্তক করার চেষ্টা করছি। ‘বনযাত্রা’ গল্পটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অপরদিকে ‘নীলমণি আইচ’ গল্প বিশেষ একটি চরিত্রকে সন্মানপ্রদর্শনের নামান্তর। তাছাড়া বহু লেখকের বহু ভালো লেখা আমার অনুপ্রেরণা দেয়। উপরন্তু চিন্ময় বন্ধু ও স্বজনদের থেকেও বেশ অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
তিতাস অধিকারী: আমার কোন শত্রু আছে এমনটা জানা নেই তবে নিন্দুক বা সমালোচক সব মানুষের মত আমারও আছে এবং এটা একটি পজিটিভ ব্যাপার। ছোটকাগজ কেন্দ্রিক লেখালেখির যে প্রতিযোগিতা সে প্রতিযোগিতা যখন ব্যক্তি বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিযোগিতাকে সমালোচনায় রূপ দেয় তখন সেখান থেকে কিছু আক্রমণ আসে,
সেটা বুঝে শুনে টিকে থাকতে হবে। কাজের চাপে যদিও আমার আড্ডা দেওয়া হয়ে উঠে না তবুও আমার বন্ধুভাগ্য খুবই ভালো বলতে হবে কারণ ইতিমধ্যে আমি সমসাময়িক অনেকের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
৭। লেখালিখির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ তত্ত্ব বা রাজনৈতিক দর্শন কতোটা জরুরী বলে আপনি মনে করেন?
তিতাস অধিকারী: আসলে আমরা সবাই কোন না কোনভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। কে কীভাবে জড়িত সেটা কারো কারো প্রকাশভঙ্গির মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠে, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে গোপনও থাকতে পারে।বলতে দ্বিধা নেই আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ জনের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব ফুটে উঠে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ফলে আমরা যে একধরনের ক্রাইসিসের মধ্যে আছন্ন সেটা বোঝা যায়। আসলে আমরা রাজনীতি বলতে যে ব্যাপারটা বুঝি সেই বোঝাবুঝির একটু পরিবর্তন দরকার সেহেতু অবশ্যই লেখায় সামাজিক তত্ত্ব কিংবা রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
তিতাস অধিকারী: আসলে এভাবে কখনো ভেবে দেখা হয়নি। তবে ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন সব চিন্তা করার শক্তি ভিতরে চলে এলে একটু অবাকই হই। জগৎ ও জীবন বুঝে ওঠার এই ব্যাপারটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
তিতাস অধিকারী: প্রকৃতিগতভাবে আমি প্রথম থেকে অলস প্রকৃতির মানুষ। এ কথা বলছি কারণ করোনার মধ্যে আমি যে সময় পেয়েছিলাম তার সদ্ব্যবহার করা উচিত ছিলো। কিন্তু অলসতা করে শুয়ে বসে ঘরবন্দি অবস্থায় সময়টা কেটে গেল। তার মধ্যে মোটামুটি কিছু লিখেছি, সেই সব লেখার মধ্যে করোনার বেশ প্রভাব আছে, মানে করোনা ব্যাপারটা বেশ উপস্থিত।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
তিতাস অধিকারী: সংখ্যা যত নগণ্য হোক না কেন পাঠক আসলে লেখকের প্রাণ। অনেক ভাগ্যবান হলেই তবে পাঠক হওয়া সম্ভব। ঐশ্বরিক চিন্তা থেকে লেখা শুরু হয়ে মুদ্রণ, সেলাই, বাঁধাই, কাটিং এরকম অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে যে নতুন গ্রন্থ তৈরী হয় তা তো পাঠকেরই জন্য। সুতরাং হে পাঠক, হে মহাভাগ্যবাণ আপনাকে প্রণাম।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: তিতাস অধিকারীর জন্ম ৯ জুলাই ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বাঙলাদেশের যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার দূর্গাপুর গ্রামে। পরবর্তীতে নাগোর ঘোপ গ্রামে পরিবারের সাথে স্থায়ী বসবাস। এখন কর্মসূত্রে ঢাকায়।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: ১। মুদ্রামিতি ২। কসাইটুলী ৩। চক্রভাত
প্রকাশিতব্য উপন্যাস: ১। গাঙ শ্রীজল ২। চিকনকালা
❤️❤️❤️
উত্তরমুছুনজঙশন পত্রিকায় একটা উপন্যাস পড়া হইছিলো সাম্য ভাইয়ের কল্যাণে৷ উপন্যাসটা ভালো লাগে নাই৷ আর কিছু অবশ্য পড়া হয় নাই৷ তাই এই লেখকের ছোটগল্প পড়তে চাই৷ বিন্দুতে থাকলে লিংক দিয়ে সহযোগিতা করবেন প্লিজ৷
উত্তরমুছুন