কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: সে তো এক-ইহকাল আগেকার কথা, হয়তো ক্লাস ফাইভে তখন। সেকালে একুশে ফেব্রুয়ারি বিরাট্ বিষয়। পাড়ায়-পাড়ায়, স্কুল-কলেজ-আপিস-আদালতে একুশে সংকলন হ’ত। আমরা বাচ্চারা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তাম, রাস্তার লোকজনের জুতা খুলিয়ে কালো-ব্যাজ পরাতাম, আর তারা, দয়া হ’লে, আমাদের ফুটো-করা ডানোর টিনে পাঁচ-দশ পয়সা, যা দিয়ে আমাদের পরবর্তী ফুটবল বা ক্রিকেট বল কেনা হবে (সে-সময় ক্রিকেট বড়-কেউ খেলত না দেশে)।
তো, তেমন এক একুশে কাগজে পড়লাম সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের কথা। আর, কী-জানি কী-একটা লিখেও ফেললাম তাদের নিয়ে। বাবা খুবই উল্লসিত হয়েছিলেন, যদিও তিনি আজও বোঝেন নি যে ঐ বয়সে “পর্যবসিত” শব্দটা আমি পেয়েছিলাম কোথায়।
সেই থেকে শুরু, হাঁটি-হাঁটি-পা-পা। এক বান্ধবীর উদ্দেশে প্রথম প্রেমের কবিতাও লেখা হ’ল বছর দেড়-দুই পর:
তুমি থাকো দোতলায়, আমি থাকি নীচে,তা ব’লে কি ভালবাসা হ’য়ে যাবে মিছে?
ইত্যাদি। কবিতাটা বান্ধবীর হাতে পড়ল না, পড়ল আমার মায়ের হাতে।
২। কবিতা আপনার কাছে কী?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: কবিতা আমার কাছে কী? কবিতা ছিল আমার প্রথম প্রেম। সে অবশ্য তা কখনও জানতে পারে নি। পারলে, আমার হেনস্থার শেষ থাকত না। বড়ই ডাকু-প্রকৃতির ছিল সে। আর আমি, বিলকুল বেচারা থেরিয়াম।
জোকস অ্যাসাইড। ওভাবে ভাবি নি আসলে। কবিতা একটু বড় হ’য়ে করতে ধরলে কিছু ভাবতে পারা যেত বরং… বাল্যবিবাহের মেরিট তো সে-রোগে মৃত-রা অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারে না ঠিকঠাক। খালি, ভাষার দিক্ থেকে বলতে গেলে বলা যায়, যে, কবিতা, মানব-ভাষার পরাকাষ্ঠা। মানে, মানুষের ভাষা যখন এতটা খুলে যায় যে তা আর তার নিজের থাকে না, প্রায় ঈশ্বরের হ’য়ে পড়ে… মানে, ঈশ্বর ব’লে কেউ থাকত যদি, মানুষ-ভাষার যে-অবস্থাটাকে নিজের ব’লে দাবি ক’রে সে বসত, তা কবিতা। ফলে, কবিতা কদাচ লেখা হয়। আমার নিজের বিষয়ে বলা যায় যে, আমি হয়তো কবি। কিন্তু কবিতা একটাও লিখেছি কিনা তা হলফ ক’রে বলতে পারি না। কবিতা লেখার তাল ক’রে যাওয়াই কবির কাজ… কবিতা লেখা নয়। কবিতা… লেখা… হয়। নিজেই হয়তো। কালে-ভদ্রে। অকালে-অভদ্রে।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ:
“যে-ধন তোমারে দিব, সেই ধন তুমি”– ইতি চণ্ডীদাস।
হুম। ঐটাই।
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: আমার লেখায় “ভাবনা” ব’লে কোনো পর্যায় নাই। “ভাব” ব’লেও নাই। কখনও একটা আস্ত লাইন নিজে-নিজে নাজেল হয়। যেন। কভু তাকে পত্রপাঠ খালাস করি, বাকি কথাগুলিও তরতর উৎরে যায়। কখনও তাকে নিয়ে খেলি, ঐ একটা লাইনকেই। বা একটা বা কয়েকটা শব্দ, বা একটা ছবি বা সুর… যেমন, সেদিন একটা কবিতা লিখলাম, “দ্বা সুপর্ণা”। কথাটা এসেছে একটা উপনিষদ্ থেকে। মাথায় ঘুরছে কতদিন-যে… মনেও নাই। কেবলই, দ্বা সুপর্ণা… দুই পাখি। আখেরে নামালাম যখন, পাখিদের পা ততদিনে গেছে খ’সে। খালি খি-খি…
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: ট্রিক-কোয়েস্চন। মানে আমাকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া, যে, নারীরা। ঐ শুড়িপথে হাঁটছি না। নারীরা আমার অনুপ্রেরণা নয়। আমি নিজেই কিনা নারী। ফলে আমার কবিতার অনুপূর্বপ্রেরণা পুরুষ। অলক্ষ্মীন্দ্র (আলেক্সাণ্ডার) যেমন বলেছিলেন যে তিনি সহবত শিখেছেন বেয়াদপদের কাছে… তদ্রূপ।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: উত্থান? কীসের! ফণা তোলাটা আজও হয় নি। উত্থান হবার আগেই প্রস্থান-সম্ভাবনা।
তবে, যখন এ-লাইনে কিছু বন্ধু হয়েছে। ধরুন, সৈয়দ তারিক (সহপাঠী), আমানউল্লাহ (শিল্পী), কচি ভাই (ওরফে ইচক দুয়েন্দে), সাজ্জাদ শরিফ, শান্তনু চৌধুরী, বিষ্ণু বিশ্বাস, অসীম (কুমার দাস) দা, স্বদেশবন্ধু সরকার, ফরিদ কবির, সেলিম মোরশেদ, তপন বড়ুয়া, কাজল শাহনেওয়াজ, ফয়জুল সুমন, ফরিদ আহম্মেদ, ব্রাত্য রাইসু, সুমন রহমান (ঈশান জয়দ্রথ), আহমেদ নকিব, প্রমুখ আমার বন্ধু হলেন, কত নানা কথার আন্দোলন হ’ল, কত নেশা, কত গান (যথা “য়ামানব হিবারিণী” ইচক উদ্গীত), মনে হয়েছিল, কী আর। এই তো। সবই।
কতগুলি, প্রায় রক্ত-বেচে-করা কাগজ, একবিংশ, অনিন্দ্য, সংবেদ, গাণ্ডীব, পেঁচা, প্রসূন, প্রান্ত, নদী, ইত্যাদি… আমাদের শাহবাগ… এরশাদশাহি ভুলভুলাইয়া… আমাদের চোখগুলিকে আগুনের গোলা বানিয়ে তোলা, রাত-বারোটার সোডিয়াম বাতি…
ওওওও, সে আর আসিবে না…
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস–মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: আমি চাই… সাহিত্য দিয়ে যারা এই এইসব করতে চায়, তাদের বধ (খারাপ একটা শব্দ বদলে লিখলাম) করতে… কিলবধ। ভেবেই পাই না, সাহিত্য দিয়ে সাহিত্য-ছাড়া কিছু করতে পারার প্রবণতার উৎস কোথায়। সাহিত্য করা কি যথেষ্ট “করা” নয়? যদি কেউ প্রশ্ন করত, ডাক্তারি দিয়ে ডাক্তার কী করতে চায়, কী বলতেন ডাক্তারকুল? বা… করতেন?
কিন্তু এও সত্য, যে, আজকাল বাঙালি (পুং) লেখকেরা লেখা দিয়ে কিছু করতে চায়, পয়সা-জাতীয়… বা, নারীজাতীয়…
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: শিক্ষা দিল যে এত বছর যে-জীবন যাপন করলাম, সেটা একটা …-এর জীবন। আরেকবার পয়দা হ’য়ে বরং চেহারায় মন দিয়ে মিডিয়ায় ঢুকব। বাকিটা ইতিহাস।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: জি। লেখালিখি বন্ধ হয়েছে। সুভানাল্লাহ। কেউ লেখা চাইলেই বলি, “টিকা লইয়া লই, খাড়ান।“ খুশ-কিসমতি এই যে, অজ-সরকার টিকা পিছিয়ে চলেছে লাগাতার।
অন্যদের কথা, গোটা দুনিয়ার কথা বললে বলতে হয় যে পৃথিবী, সাহিত্য, শিল্প, বাণিজ্য, যুদ্ধও, আর এক থাকবে না। বা, এরই মধ্যে নাই। সেন্সিবিলিটির ধরনই গেছে বদলে। এই-যে আমার যমজ ভাইয়ের মতো খালাত ভাই, মঞ্জু, ম’রে গেল। করোনার আগে হ’লে আমি ম’রেই যেতাম হয়তো… এখন বড়জোর “ওহো”।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: আমার নিজের কোনো পাঠক নাই। বাল্যবন্ধুরাও আমার কোনো লেখা কখনও পড়ে নাই (বাড়ি ব’য়ে শোনাতে গেলে “নাটকির পো” কিসিমের গালি কপালে জুটত)। অন্যেপরে কা কথা। অন্যের পাঠকদেরকে আমি কী বলব। তারা পথভ্রান্ত। সত্য ধর্মের সন্ধান না-পাওয়া জাহেলের দল। তারা নিপাত হোক। মানে পুং-তারা। নারীদের মাফ করা যায়। নিশ্চয় তারা আলো দর্শন করবে, আমার পরজন্মে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের জন্ম ঢাকায়, ১৯৬৫ সনে। ১৯৯৫ থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : তনুমধ্যা (১৯৯০), পুলিপোলাও (২০০৩), কবিতাসংগ্রহ (২০০৬), ঝালিয়া (২০০৯), মর্নিং গ্লোরি (২০১০), ভেরোনিকার রুমাল (২০১১), হাওয়া-হরিণের চাঁদমারি (২০১১), আমাকে ধারণ করো অগ্নিপুচ্ছ মেঘ (২০১২), Ragatime (২০১৬), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৮), ইশকনামা (২০১৯), দশ মহাবিদ্যা (২০২০), ছুরিতে ঠিকরানো আঁধিয়ার (২০২০), ডাকা ঢাকে (২০২১)।
গদ্যগ্রন্থ : কালকেতু ও ফুল্লরা (উপন্যাস ২০০২, পুনঃ ২০১৯), মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল (গল্প ২০০৪, পুনঃ ২০১৯), চণ্ডীদাস দ্যাখে যুগ যুগ (প্রবন্ধ, প্রকাশিতব্য)।
অনুবাদ : অন্তউড়ি (চর্যাপদের পদ্য-রূপান্তর, ১৯৮৯), নির্বাচিত ইয়েটস (ডব্ল্যু বি ইয়েটসের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ, ১৯৯৬) এলিয়টের প’ড়ো জমি (টি এস এলিয়টের ‘দ্য লাভ সং অব জে. অ্যালফ্রেড প্রুফ্রক’ এবং ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর অনুবাদ, ১৯৯৮) কবিতা ডাউন আন্ডার (নির্বাচিত অস্ট্রেলিয় কবিতার অনুবাদ, অংকুর সাহা ও সৌম্য দাশগুপ্ত-র সাথে, ২০১০), স্বর্ণদ্বীপিতা (বিশ্ব-কবিতার অনুবাদ ২০১১)।
সম্পাদনা : প্রসূন (যৌথ), অগ্রবীজ (যৌথ)।
প্রিয় কবি আমার৷ Love Love Love
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ :)
মুছুন