কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন গল্পকার প্রমিথ রায়হান।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
প্রমিথ রায়হান: ২০১২ সালে আমি প্রথম গল্পটি লিখি। আমি মনে করি অন্তত আমাদের পক্ষে গল্প লিখে ফেলা খুব দুঃসাধ্য কোন কাজ নয়। কেনোনা আমরা সচরাচর গল্প লিখে ফেলা বলতে প্রধানত কোন কাহিনীকে অবলম্বন করে তার বিস্তার ঘটিয়ে যাওয়াটাই বুঝি। অন্তত গল্প লিখবার বা লিখতে চাওয়ার যেই ইচ্ছা সেই সময়ের সূচনাপর্বে আমরা সচরাচর এমনটাই ভেবে থাকি।
২। ‘ছোটগল্প’ আপনার কাছে কী?
প্রমিথ রায়হান: ছোটগল্প নিয়ে আমার ধারণা সময়ে সময়ে পাল্টেছে। বর্তমানে যেমনটা ভাবি তা হলো, আমি মনে করি যে বিভিন্ন আবেগ অনুভূতির বা শব্দের মতো ছোটগল্পও আসলে এক ধরণের সেন্স। যেমন ধরুন ঘর বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি বা বুঝে থাকি আমার নিজস্ব বুঝ খুব সম্ভবত তার সাথে যায়না। আমি মনে করি ঘর আসলে প্রধানত এক ধরণের সেন্স। গল্পও তাই। সে কারণে সুবিমল মিশ্রের এন্টি-গল্পও আমাকে গল্পের সেন্সই দিয়ে থাকে।
৩। কথাসাহিত্য মানুষকে কী দিতে পারে?
প্রমিথ রায়হান: আমি এই কথাটি জোর দিয়েই বলতে চাই যে কথাসাহিত্য মানুষকে যেই সত্যটি মনে করিয়ে দিতে সক্ষম বিশেষত উৎকৃষ্ট কথাসাহিত্য তা হলো, আমাদের প্রত্যেকেরই এমন অনেক কথাই আছে যা বলার মতো। তার প্রয়োগ আমরা ঘটাবো কিনা বা ঘটাতে চাই কিনা তার উত্তর ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হয়। কিন্তু কথাসাহিত্যের সাথে সম্পৃক্ততা একবার সামহাউ তৈরী হয়ে গেলে খুব সম্ভবত পাঠক হিসাবে আমরা এমনটা অনুভব করি যে আমাদের সকলেরই আসলে কিছু না কিছু বলার আছে।
৪। “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”— ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এরকম শর্ত বা নির্মাণ বৈশিষ্ট্যকে কতখানি সমর্থন করেন?
প্রমিথ রায়হান: না, আমি এমন কোন শর্ত বা নির্মাণ বৈশিষ্ট্যের প্রতি আস্থাশীল নই। যদি আমার লেখা গল্পে কখনো তেমনটা তেমন দেখা যায় তবে এটুকু বলতে পারি যে তা অবশ্যই সচেতন কোন নির্মাণের ফলাফল হিসাবে আসেনা।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
প্রমিথ রায়হান: আমার ঘনিষ্ঠ মানুষ থেকে শুরু করে, আমার মধ্যম পর্যায়ের পরিচিত মানুষ, স্বল্প পর্যায়ের পরিচিত মানুষ, তাদের সাথে আমার যোগাযোগ বা সম্পর্ক, আমার পারিপার্শ্বিকতা সবকিছুর যোগফলে আমার যেই নিজস্ব যাপন বা চিন্তাপ্রক্রিয়া; সবকিছুই আসলে আমার লেখার ক্ষেত্রে কন্ট্রিবিউট করে। এবং অতি অবশ্যই আমি যাদের গল্প- কবিতা- উপন্যাস পড়ি বা পত্রিকা কিংবা বইয়ে পড়া কোন নন-ফিকশন গদ্যও আমার গল্প লেখার ক্ষেত্রে কন্ট্রিবিউট করে। আমি ঠিক অনুপ্রেরণা শব্দটি ব্যবহার করবোনা বরং বলবো যে এ সবকিছুই আমার গল্প লিখবার জন্য প্রয়োজনীয়।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন৷ সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
প্রমিথ রায়হান: আমি মনে করি যে বর্তমানে আমি লেখক হিসাবে যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাতে আমার লেখার মান নূন্যতম একটা মান পর্যন্ত স্পর্শ করে। আমি যা অনুভব করি তা হলো সময়ের সাথে সাথে লেখক হিসাবে আমার রূপান্তর ঘটেছে। একে আমি ব্যক্তিগত উপলব্ধির জায়গা থেকে উন্নতি বলেই মনে করি কিন্তু ঠিক উত্থান বলতে আমরা সচরাচর যা ডিফাইন করে থাকি বা উত্থানকে আমরা যেভাবে ডিফাইন করে থাকি তা আমার ঘটেনি। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে অন্তত গতো দুই বছরের আগ পর্যন্তও আমি লেখক হিসাবে আলাদা করে প্রশংসা বা নিন্দা কোনটারই যোগ্য ছিলাম না। আমার এই মূল্যায়ন আমার তৎকালীন লেখাসমূহের পাঠকের জায়গা থেকে বলা। আমি নিজের লেখাকে বা লেখক হিসাবে নিজেকে যে জায়গায় দেখি তাতে আমার মনে হয়না যে লেখক হিসাবে আমার বিশেষ কোন উত্থান ঘটেছে। এক ধরণের পরিণতি যদি বলা যায় তবে সেটাও সম্ভবত স্থায়ী কিছু না বরং তার গতিপ্রকৃতি চলমান বলেই মনে হয়।
৭। লেখালিখির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ তত্ত্ব বা রাজনৈতিক দর্শন কতোটা জরুরী বলে আপনি মনে করেন?
প্রমিথ রায়হান: আমি মনে করি কোন লেখকের কথাসাহিত্য শক্তিশালী হবার পূর্বশর্ত তার দেখার চোখ বা দৃষ্টিভঙ্গির সবলতা। তো সেই সবল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য স্পেসিফিক বা নির্দিষ্ট একটা রাজনৈতিক দর্শন বা তত্ত্বে লেখকের প্রথাগত অর্থে আস্থা থাকতেই হবে এমনটা এককালে মনে হলেও এখন আর মনে করিনা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহীদুল জহিরের সাহিত্যে মার্ক্সবাদের বিবিধ ডাইমেনশনের যতোটা সবল প্রতিফলন দেখি এবং যতোটা অর্গানিক ওয়েতে দেখি, অনেক কথিত মার্ক্সবাদী লেখকের লেখাতে কিন্তু সেই সেন্সটা নেই। আমি মনে করি এক্ষেত্রে পার্থক্যটা গড়ে দিয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির সবলতা।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
প্রমিথ রায়হান: আমি ভালো করেই জানি এই প্রশ্নের উত্তরে যা বলতে যাচ্ছি তা আমার নিজেরই সময়ে সময়ে মনে থাকবেনা। প্রাণীগত বা জৈবিকতার প্রেক্ষিত এবং আবেগীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে সময়ে সময়ে ডিরেইল্ড হয়ে যাওয়াটা অনিবার্য হয়ে উঠবে। তারপরেও যেহেতু প্রশ্নটা আমাকে করাই হয়েছে তাই সাধারণ নিঃস্তরঙ্গ সময়ে যা অনুভব করি তাই বলিঃ যেই জীবন এত বছর যাপন করলাম, তাতে আমার কাছে জীবনকে কম বেশী ওভাররেটেডই মনে হয়েছে। জীবনের অন্তর্গত সকল সৌন্দর্য, রহস্য এবং দুঃখ-বেদনা ইত্যাদি মিলিয়েই তাকে নিয়ে আমরা অহেতুক বেশী মাতামাতি করি বা করতে বাধ্য হই এমনটাই মনে হয় সময়ে সময়ে।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
প্রমিথ রায়হান: প্রথমদিকে বেশ প্রভাবিত করেছিলো। পুরোটাই নেতিবাচকভাবে। এখন তা তেমনটা অনুভব করিনা কারণ মহামারীর যেই অনুভূতি তা আর আমার মধ্যে কাজ করেনা। আমরা এখন যেই নিউ নরমাল অর্ডারের মধ্যে বসবাস করছি তাকে আমি ওল্ড নরমাল অর্ডারেরই এক ধরণের ডাইমেনশন বলে মনে করি।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
প্রমিথ রায়হান: শিল্পসাহিত্যের যে কোন ফর্মেই পাঠক বা দর্শকেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিলো, আছে, থাকবে। এর মানে হলো শিল্পী বা সাহিত্যিকের মতো দর্শক বা পাঠকেরও শ্রম বা নিষ্ঠার জায়গাটি রয়েছে। পাঠকের যেই ওউনারশিপ রয়েছে তার খাতিরেই তার পরিশ্রমের বিষয়টিও তাই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ব্যাপারে পাঠকেরা সচেতন থাকতে চেষ্টা করবেন তাদের কাছে এমনটাই প্রত্যাশা করি।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: প্রমিথ রায়হান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারী, ঢাকায়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রকাশিত গল্পের বইঃ এসকেপিস্ট (২০১৪), এপিটাফ (২০১৫, ই-বুক)।
প্রকাশিতব্য গল্পের বইঃ অন্ধকারের আয়না (২০২১)।
সাক্ষাৎকার সিরিজটা দারুণ হচ্ছে৷ লেখকের চোখ দিয়ে তাঁর মনের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে৷ এটা ভাল৷
উত্তরমুছুনপ্রমিথ রায়হানের গল্প পড়িনি কখনো৷ ইনফ্যাক্ট, প্রথমবার তার নাম জানলাম৷ পড়ার ইচ্ছে হলো৷ স্মার্ট রাইটার মনে হচ্ছে তার উত্তরগুলো পড়ে৷ শুভকামনা…
উত্তরমুছুনPromith raihan , total inner sence of your interview is very excellent…
উত্তরমুছুন