কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন কবি মোশতাক আহমদ।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
মোশতাক আহমদ: প্রথম লিখেছিলাম চুয়াত্তর সালে- ‘চাষীরা কাটিছে ধান
কেহ বলে যে খাবার আন!’
প্রথম লেখা বলতে যদি ছাপা হওয়া লেখা বুঝায়, তবে সেটা নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় সাইক্লোস্টাইল করা স্কুল ম্যাগাজিন ডাহুকের পাতায় প্রকাশিত দুটি লিমেরিক- পাবলোর ফড়িং আর হবুচন্দ্র আসছে দেখে। পত্রিকাটি তখন থেকে এই বয়স পর্যন্ত হাজার বার উল্টিয়েছি। এই লেখা প্রকাশিত হবার আগেও আমার কবিতা লেখার প্রচেষ্টা ছিল, ক্লাস সেভেনেই দীপ্ত প্রভা নাম দিয়ে একটা পাণ্ডুলিপিও দাঁড় করিয়েছিলাম। একদিন আমাদের ভূগোলের শিক্ষক সেই খাতা নিয়ে গিয়ে কিছু ছড়া আর কবিতায় পেনসিল দিয়ে টিক চিন্হ দিয়ে পত্রিকায় পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু কোথাও আর পাঠানো হয়নি। ডাহুকই প্রথম।
২। কবিতা আপনার কাছে কী?
মোশতাক আহমদ: কবিতা প্রথমতঃ আমার নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম - এই নিজ কিন্তু আমি একা নই- আমার চারপাশ আর আমার যাপিত ও অধীত অভিজ্ঞতা।
কবিতা আমার অভ্যাসেও পরিণত হয়েছে। শৈশব থেকেই আত্মমুখী মানুষদের মুক্তির একটা জানালা হয়তোবা কবিতাই। দ্বিতীয়তঃ, কবিরা আমার নায়ক ছিলেন, তাই তাঁদেরকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। তৃতীয়তঃ, যখন থেকে বুঝলাম আমি যে কবিতা চর্চা করছি, তা সবচেয়ে শিল্পিত শিল্প মাধ্যম - তখন থেকে এক ধরনের পরিমিতি বোধ রপ্ত করার চেষ্টা করছি, শামসুর রাহমানের ‘সংহত করো বাক, থামাও প্রগলভতা’ -আমার মূল মন্ত্র। এছাড়াও জীবনদাশের ‘উপমাই কবিতা’ মন্ত্রটিও আমাকে প্রভাবিত করেছে। আর একটা চাবিশব্দ সেই চুরানব্বই সাল থেকে আমাকে চালিত করে, সেটা হচ্ছে ‘আন্তর্বয়ন’। কবিতায় আন্তর্বয়ন ব্যবহার করাকে আমি নিজের জন্য একটি অন্যতম শর্ত হিসেবে ঠিক করে নিয়েছি।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
মোশতাক আহমদ: আনন্দ, বেদনা, ক্ষোভ, উল্লাস, মুক্তি, পথের দিশা, প্রার্থনার ভাষা, নির্বেদ, মাথায় হাতুড়ির আঘাত, চূড়ান্ত শিল্পের দর্শন - যাহার জন্য যাহা প্রযোজ্য - টু হুম ইট মে কনসার্ন।
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
মোশতাক আহমদ: একটা বা দু’টো জাদুশব্দ থেকে ভাবনাটা এসে যায়। শব্দ পাই উপন্যাস থেকে, অগ্রজের কবিতায়, ভিন্নভাষী কবিতায়, চিত্রকলা প্রদর্শনীর রিভিউ থেকে। জাদুশব্দগুলো আমাকে আপনা হতে বাইরে নিয়ে আসে। কবিতা লেখা শেষ না করে আর নিজের কাছে ফিরতে পারি না। লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত একটা গর্ভ যন্ত্রণা চলতে থাকে। এক বসায় লেখাটা হয়ে না উঠলে কবি মোশতাকের খবর আছে! তার কাজে ভুল হয়ে যায়, বাজারের ফর্দ অসমাপ্ত থাকে, বাতি জ্বালাতে গিয়ে শীতের সন্ধ্যায় পাখা ঘুরিয়ে দেয়, ঘরে ফেরার সময় গলি ভুল না করলেও নিজের বাসা পার হয়ে যায়!
লেখাটা দাঁড়িয়ে গেলে শব্দ আর বাক্যের মেরামতি চলে। ছন্দে লেখা হয়ে থাকলে সুবিধা হয়, লেখার সময়েই মেরামতি হয়ে যায়, এর পরে থাকে শুধু আনন্দ নিয়ে নিজেই নিজের কবিতা পাঠে মুগ্ধ হতে থাকা, এই আচ্ছন্নতা কেটে গেলে সাধারণ পাঠক হিসেবে সেই কবিতা পড়া। যুতসই একটা শিরোনাম দেয়া।
এটা উত্তরের একটা ভার্সন। অন্য সময় জিজ্ঞেস করলে অন্য রকম ভাবেও উত্তর দিতে পারি!
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
মোশতাক আহমদ: এখন আর কেউ আমার লেখার অনুপ্রেরণা নন। একসময় অগ্রজ কবিরা অনুপ্রেরণা ছিলেন। এখন প্রশংসা পেলে প্রেরণা পাই না, সমালোচনা পেলে অনুপ্রাণিত হই।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
মোশতাক আহমদ: আমার উত্থান সময় বলতে কিছু আছে কিনা নিশ্চিত নই। তবে ইতিহাসের খাতিরে বলা যায় ১৯৮৭ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়, ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসেই সাপ্তাহিক রোববারে দু’টি কবিতা আর চট্টগ্রামে অবস্থান হেতু দৈনিক পূর্বকোণে বছর পাঁচেক ধরে প্রায় প্রতি মাসেই কবিতা প্রকাশিত হওয়া আর (খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত) ‘একবিংশ’ কিংবা (এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত) ‘লিরিক’ পত্রিকায় ১৯৯২ সালে গুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে হয়তো আমার ‘উত্থান’। সবচেয়ে আনন্দ হয়েছিল ‘দিকচিহ্ন’ পত্রিকায় ১৯৮৮ সালের দিকে আমার পরিচিতি আর শংসাপত্রসহ একগুচ্ছ কবিতার প্রকাশ হওয়া। ‘পূর্বকোণ’ আর ‘লিরিক’ ছাড়া আর কোনো পত্রিকাতেই আমি সশরীরে যাইনি বা সম্পাদকগণ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেনও না। এই কারণে লেখা প্রকাশিত হওয়া আমার জন্য দুর্দান্ত এক স্বীকৃতি ছিল। আমি ভেসে গিয়েছিলাম সেই আনন্দে।
যাদের তালিকা পেশ করেছেন তাদের মধ্য থেকে- আশ্চর্যজনকভাবে- আমি সে সময়ে বন্ধু ছাড়া আর কাউকেই টেবিলের উলটো দিকে পাইনি।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস–মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
মোশতাক আহমদ: নিজের লেখাটা লিখে যেতে চাই। নিজের বিভিন্ন অনুভূতিগুলোকে প্রশমিত করতে চাই। জীবন ও জগৎ আর মানুষের সাথে আমার সম্পর্কগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখে যেতে চাই। লেখার মাধ্যমে প্রার্থনার যে আনন্দ সেটা পাই, বেদনা আর ক্ষতগুলোর শুশ্রূষা পাই, নিরাময় পাই। কেউ যদি পড়ে জানায়, তাহলে আনন্দিত হই, কৃতজ্ঞ হই।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
মোশতাক আহমদ: ‘মানুষ মূলত একা’।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
মোশতাক আহমদ: মহামারির শুরুতেই প্রিয় বন্ধু বিয়োগ আমাকে শোকার্ত করে, আশংকিতও করে। পেশাগত কারণে মহামারি নিয়েও কাজ করতে হয়। একটা ওয়েবিনারের জন্য প্রবন্ধ পাঠ করতে হবে বলে করোনার মানসিক প্রভাব নিয়ে কিছু পড়াশুনাও করি। প্রবন্ধটি লিখি, পড়িও। প্রয়াত বন্ধু আর করোনাকালিন জীবন ও পৃথিবী নিয়ে লেখা কবিতাগুলো ‘অন্ধ ঝরোকায়, সখার শিথানে’ নামে বই আকারেও প্রকাশিত হয়। আমি এই সময়ে প্রচুর পড়ি, একটি স্মৃতিকথা লিখি, কবি আবুল হাসানকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে আরম্ভ করি, বিশ্বকবিতার অনুবাদের পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে ‘যাই ভেসে দূর দেশে’ নামে বইটিও করোনারই আশীর্বাদ। কিংবা ৮টি কবিতার বই থেকে বাছাই করে স্বনির্বাচিত কবিতার বই ‘পদ্যাবধি’ -সেটাও করোনারই অবদান!
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
মোশতাক আহমদ: পাঠকই তো লেখকের গন্তব্য। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদেরকে নিয়ে আমি গর্ব করি। নিজেও একজন পাঠক হেতু এই গর্বের আমিও অংশীদার!
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মোশতাক আহমদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি, বাঙলাদেশের টাংগাইল জেলায়।
প্রকাশিত বই:
কবিতা: সড়ক নম্বর দুঃখ বাড়ি নম্বর কষ্ট, মেঘপুরাণ, ভেবেছিলাম চড়ুইভাতি, বুকপকেটে পাথরকুচি, ডুবোজাহাজের ডানা
গল্প: স্বপ্ন মায়া কিংবা মতিভ্রমের গল্প
প্রবন্ধ: তিন ভুবনের যাত্রী
স্মৃতিপাঠ: অক্ষরবন্দি জীবন
অনুবাদ: যাই ভেসে দূর দেশে (সকল মহাদেশের কবিতা)
সম্পাদনা: তৃতীয় নয়ন, মোহনা, শানিত
মন্তব্য