জার্নাল : মার্চ ২০২১ | মাহফুজুর রহমান লিংকন
হিসাবের গড়মিল
শৈশব-কৈশোর-
‘বেচে থাকতে চাইলেই হবে না, সাথে মেধাবী ছাত্র হতে হবে’- বাবা-মার হুকুম!
যৌবন চলমান-
‘বেচে থাকতে চাইলেই হবে না, সাথে প্রচুর অর্থ কামাবার মেশিনে পরিনত হতে হবে’- স্ত্রী-পুত্রের হুকুম!
আমার মন চায় দুটোই হয়ে উঠি, কিন্তু সাধ আর সাধ্যের দূরত্ব বুঝে না ওঠা জীবনের গতি পথ আমাকে নিয়ে চলেছে শুধুই শুন্যতার দিকে। অবশ্য শুন্যতা বলি ক্যামনে? এই যে ভালোবাসার তুমুল প্রাপ্তি তাকে অস্বীকার করি ক্যামন করে! একদিকে আমার আকাশ ভরা ভালোবাসায় অন্যদিকে অর্থহীনতায় মৃত্যুকে ছুঁয়ে চলেছি অবিরাম। হয়ত ভালো থাকতেই হয়, ভালো আছি বৈকি!
শ্যামলিমার মার্বেল ভর্তি বুক দেখা কিশোর, হাফছা বিবির ঘামমাখা অর্ধাঙ্গ ঢাকা আঁচল দেখে মুগ্ধ হওয়া কিশোর, আজ অট্টালিকার নেশায় নিজেকে খুঁজে ফিরে আপন পর সকলের ছায়ায় কিন্তু পাওয়া না পাওয়ার হিসাব তো এমন নয়। এ হিসাব অতি সরল, ঘর হবে টাকার গুদাম আর ক্ষমতার রেশমি চাদরে ঢাকা থাকবে প্রতিটি মুহূর্ত... আহারে হিসাবে দায়! তুমি ভালোবাসায় ক্যামনে মেতে ওঠো...
গিনিপিক সমাচার-
গত কয়েকদিন আগে এক সাংবাদিক আমাকে বলেছিল- “আপনি রাষ্ট্রের কি বাল ফেলাইতাছেন যে, রাষ্ট্র আপনার দায়িত্ব নিব?” প্রচণ্ড রাগ হবার মত কথা বলেছেন তিনি, কিন্তু কথাটা মন্দ বলে নাই। আসলেই তো... দিন মজুরি করি-খাই-দাই-কবিতা লেখি-মাঝে মাঝে দুইএকখান প্রবন্ধ লেখি- শুই – ঘুমাই - রাজস্ব দেই এর বাইরে আর কিছুই তো করিনা। যারা রাষ্ট্রের বাল ফালাইতে-ফালাইতে রাষ্ট্রের যৌনাংশ ফকফকা করে ফেলেছে, তারাই রাষ্ট্রের প্রকৃত হকদার। আমি কে? প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক!
নির্জীবের মতন তাকিয়ে রইলাম (অ)ভদ্র লোকের পানে...কথা শুন্য আমি! মিন-মিন করে বললাম- “ভাই, রাষ্ট্র ভালোবাসার ভ্যাক্সিন প্রাপ্তি সিরিয়ালের প্রথম কাতারে তাইলে আপনারাই...” এইবার আরও রেগে গেলেন তিনি! আমি অবোধ বুঝতে পাচ্ছিলাম না, ভুলটা কী করলাম! রাষ্ট্রের বাল ফালাইন্নারা কখন যে কোন মর্জিতে থাকেন... টিউবলাইটের মত হঠাৎ আমার মাথার মগজ কাজ করতে শুরু করলো...
ওহ! ওস্তাদতো রাগ হবার কথা! ছোট রাষ্ট্র যেমন বড় রাষ্ট্ররে গিনিপিক ভাবে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের বড়-বড় বাল ফালাইন্নারা ছোটখাট বাসিন্দাদের গিনিপিক ভাবে। ঠিক এমন জটিল সময়ের বৃত্তে তোমাকেই মনে পরে গেল, আর নিজেকে গিনিপিক ভাবতে আমার ভালো লাগছে... ভালোবাসায় হউক অথবা ঘৃণায় হউক,আমি তোমার ঘরে বন্দি হতে চাই! তোমার নির্জিব হাতের ছোঁয়ায় ধুয়ে দিতে চাই আমার গিনিপিকজীবনের ব্যথিত সমাচার!
প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য একটা প্রচলিত গল্প বলি...
সংযমের মাস আসার আগেই অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ বাঙ্গালী জাতি ক্যামনে যেন অধিক মুনাফা লোভী বনিক শ্রেণীর কাছে জিম্মি হয়ে যায়... পুরা সংযমের মাসে চলে শোষণের যাঁতাকল... রাজা থেকে শুরু করে সিপাহির দরবার পর্যন্ত বিচারের বানী ঘুরে-ফিরে...সুকথা - কুকথার তোড়ে বিচারের বানী ভেসে চলে যায়, অধিক মুনাফা লোভী বনিক শ্রেণীর সাথে অবশেষে পুরা জাতি লুঙ্গি কাচা মেরে বেঁধে একসাথে একযোগে নেমে পরে, কে-কারে শোষণের যাঁতাকলে পিষে মেরে ফেলতে পারে সেই প্রতিযোগিতায়। এই সব দেখে আমার ক্যাবলি একটা গল্প মনে পরে যায়...
এক রাজ্যে চোর ধরা পরলো। বিচার প্রক্রিয়া শেষে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী চোর কে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো! মৃত্যুদণ্ডের দিন ঠিক করা হলো পরের সপ্তাহের প্রথম দিন!
শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে আসামি (চোর) কে জিজ্ঞাসা করা হলো -‘তোমার শেষ ইচ্ছা কি?’
চোর খুব মলিন কণ্ঠে জানালো, সে রাজার সাথে একান্ত গোপনে দেখা করতে চায়।
রাজাকে সাথে সাথে জানানো হলো চোরের শেষ ইচ্ছা। রাজা মশাই রাজি হয়ে দ্যাখা করতে গেলেন চোরের সাথে। গিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন- বলো তোমার কি বলার আছে...
চোর গলার স্বর নিচু করে রাজামশাইয়ের কানের কাছে গিয়ে বললো- হুজুর, আমি একটা গাছ চিনি, যে গাছের বীজ রোপণের ঠিক তিনদিন পর চারা হয়ে ওঠে এবং সেই চারা যদি কেউ খায় তাহলে সে অমরত্ব লাভ করবে। আমি নিজে সেই বীজ রোপণ করে চারা বানিয়ে আপনাকে খাওয়াতে চাই।
মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামির শেষ ইচ্ছা পুরন করা রাজ ধর্ম কাজেই রাজামশাই রাজি হয়ে গেলেন। ভিতরে যে অমরত্বের লোভ কাজ করছে সেটা এখানে গৌণ বলেই বিবেচিত।
যথারীতি গাছের বীজ রোপিত হলো, তিনদিন চলে যায় কিন্তু রোপিত বীজ থেকে চারা না হওয়ায় রাজামাশাই ভীষণ রকম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। চোরের কাছে তিনি একা গেলেন না, মন্ত্রীবর্গের প্রায় সকলকে নিয়ে গেলেন। চারা গাছের খবর জানতে চাইলেন চোরের কাছে। চোর আগের মতই গলার স্বর নিচু করে রাজামশাইয়ের কাছে গিয়ে ধীর লয়ে বললো- হুজুর, ক্ষমা করবেন। আমি গতরাতে স্মরণে আনতে পেরেছি, আমাকে যিনি এই গাছ চিনিয়ে ছিলেন তিনি বলেছিলেন , যে ব্যক্তি চুরি করবে অর্থাৎ চোর তার হাতে এই বীজ রোপণ করা হলে কোন চারা জন্মাবে না। আমি যেহেতু এই বীজ রোপণ করেছি তাই চারা হয়ে উঠতে পারে নাই। হুজুর, আপনার মন্ত্রীপরিষদের কেউ কি আছে অথবা আপনি নিজে এই বীজ রোপণ করেন , চারা হলে আপনি খাবেন, আমি শুধু দেখে যেতে চাই আপনি অমরত্বের সাধ নিয়েছেন, মাত্র তিনদিন আমার প্রান ভিক্ষা চাচ্ছি হুজুর!
জেলখানার মাঝেই মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক বসে গেল, রাজামাশাই জানালেন পুর্বের বিস্তারিত ঘটনা। এবং সাথে জানতে চাইলেন, মন্ত্রীপরিষদে এমন কেউ কি আছে যে চুরি করে নাই। তাকে দিয়ে বীজ বপন করা হবে...
মন্ত্রীবর্গের সদস্যরা একে অপরের মুখ দেখতে লাগলো... কেউ কেউ লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলেন...রাজা খুব উদগ্রীব হয়ে সকলের মুখের দিকে চেয়ে যা বোঝার বুঝে নিলেন, এমন সময় একমন্ত্রী বলেই ফেললেন, রাজামশাইয়ের জয় হউক! আমরা সকলেই লজ্জিত কিন্তু আপনি নিজেইতো এই বীজ রোপণ করতে পারেন!
এবার রাজার মুখ রাগে-ক্ষোভে লাল হয়ে উঠলো, গরগর করে তিনি বলে উঠলেন- আমি তোমাদের মধ্যমণি! তোমরা যদি সকলেই চোর হয়ে থাক তাহলে সে অর্থে আমি চোরেদের সর্দার বৈকি!
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, সবকিছু গোপন রেখে রাজ্যের ধর্মপরায়ণ কোন ব্যক্তি কে আনা হবে... সকলেই একমত হলেন এই সিদ্ধান্তে...
তিনদিন পরের ঘটনা...
কোন চারা গজায়নি...ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিকে তিরস্কার করলেন রাজা মশাই নানা কটু কথা বলে... এইদিকে ওই চোর মুচকি-মুচকি হাসছে দেখে রাজামশাই মহা বিরক্ত হয়ে উঠলেন... হাজত খানা থেকে বের করে চোরকে রাজা মশাইয়ের সামনে আনা হলো। সামনে এসেই চোর বলে বসলো,
“হুজুর, আপনার রাজ্যে একজন সাধুও পাওয়া গেল না অথচ ওই একি অপরাধে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিবেন...”
রাজা সামান্য চিন্তিত হয়ে বললেন, মহামন্ত্রী একে কি করা যায়?
মহামন্ত্রী খুব সরল গলায় বললেন- হুজুর, একে মুক্ত করে দেয়া হোক...
পাশেই ছিলেন রঙ্গমন্ত্রী, তিনি বললেন- হুজুর মার্জনা করবেন, একে মুক্ত করে দিলে সকলেই জেনে যাবে আমাদের অক্ষমতাকে!
রাজামশাই আরো গভীর ভাবনায় পরে গেলেন...
সত্যি তো! একে মুক্ত করলেও বিপদ, মুক্ত না করলে শেষ বিচারের দিনে অন্যায় বিচার করার জন্য তাকে যে আরো কঠিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে...
এমন সময় মহামন্ত্রী সমাধান খুঁজে পেলেন...
তিনি রাজা মশাইকে জানালেন- হুজুর, একে রাজ্যের মন্ত্রীপরিষদে নিয়ে নেয়া হোক, এতে সে আর বাহিরে গিয়ে আমাদের অক্ষমতাকে বলে বেরাতে পারবে না আবার তাকে মুক্ত করে দেওয়াও হবে...
রাজামশাই এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আহা! মহামন্ত্রী সঠিক সমাধান দিয়ে দিয়েছে...চোরের ঠাই হলো মন্ত্রীপরিষদে... রাজা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন...
মন্তব্য