“বাংলা গদ্যে অসাধারণ সুর তৈরি করা যায়”
ঔপন্যাসিক জাহেদ মোতালেবের জন্ম ১৯৭৪ সালের ৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ধলই গ্রামে। বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে ‘রক্তরেখা’ (২০১৭), অন্যজন (২০১৮) ও ধানশি (২০২০)। উপন্যাস ছাড়াও কয়েকটি গল্পের বই আছে তার। সর্বশেষ প্রকাশিত গল্পের বই ‘মারিয়া পালমা’ (২০২১)। এছাড়াও শিশুসাহিত্যের ভুবনে জাহেদ মোতালেবের অবাধ যাতায়াত। বিন্দুর জন্য তাঁর এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গদ্যকার নাজমুস সাকিব রহমান। আসুন, তাদের আলাপে ঢুকে পড়ি-
সা ক্ষা ৎ কা র
নাজমুস সাকিব রহমান
একটা লেখার কথা বলুন, যেটা লেখার পর ‘জাহেদ মোতালেব’ বললে লোকজন আলাদাভাবে নোট করছে। কবে থেকে শুরু হয়েছে এটা?
জাহেদ মোতালেব
‘ধানশি’। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে। এরপর থেকে আলাদা একটা ব্যাপার অনুভব করছি।
সাকিব
আপনি কীসে ভয় পান?
জাহেদ
শারীরিক অক্ষমতায়। স্ট্রোকের পর চার বছর ধরে অচল আমার ছোট ভাই। তাকে দেখে বুঝেছি শারীরিক অক্ষমতা মানুষকে সব দিক থেকে শেষ করে দেয়।
সাকিব
আপনার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অন্যজন’। উপন্যাসের শুরুতে পুকুরপাড় আছে। কিছুদিন আগে বের হলো গুপ্তধন সিরিজের বই। সেখানেও শুরুতে নদীর পাড়। আপনি বারবার পানিতে যান কেন? ছোটবেলায় পানিতে ডুবে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে?
জাহেদ
পানিতে ডুবে যাওয়া নয়, মজে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। সেটা কেমন জানো? গ্রামে আমাদের ঘরের পাশেই আছে পুকুর। উত্তর পুকুর। আমি বলতাম উত্তর মহাসাগর। এই পুকুর আমাকে অনেক কিছু থেকে মুক্তি দিয়েছে। পুকুরে আকাশের ছায়া দেখে, মাছের ঘাঁই দেখে বড় হয়েছি। বাবার জালভর্তি মাছ তোলা, লেজ লাল রুই মাছ কিংবা হাত দিয়ে ভেদা মাছ ধরা-এগুলো এখনো তরতাজা স্মৃতি। তাছাড়া একবার মরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছি এই পুকুরকে। ওটা আমার আপন।
আরো একটা আপন আছে; সে হলো আমাদের হালদা। সে তো বাড়ির পেছনে। এক বিল ফেলেই নদী। বাড়িতে বসেই ওর গন্ধ পেতাম।
সাকিব
বাংলা গদ্য লেখার অনুভূতি কেমন? যে গদ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখেছেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, আপনিও লিখছেন। আপনি কি বাংলা গদ্য নিয়ে প্রাউড ফিল করেন?
জাহেদ
বাংলা গদ্য নিয়ে যে ইচ্ছেমতো খেলা যায়, অসাধারণ সুর তৈরি করা যায়, ‘অন্যজন’ লিখতে লিখতে তা অনুভব করেছি। বাংলা গদ্যকে আমার মেয়ের আকুলতা, তার দুষ্টুমি আর খামচি মেরে মুখ ছিঁড়ে দেওয়ার মতো মনে হয়। বাংলা গদ্য নিয়ে আমি প্রাউড ফিল করি।
আপনি কিছুদিন আগে হারুকি মুরাকামির বই পড়ছিলেন। মুরাকামি কি পাঠক হিসেবে আপনাকে নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে, স্টোরি টেলিংয়ের দিক থেকে আমরা কোন অবস্থানে আছি?
জাহেদ
মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ পড়েছি। ওই উপন্যাসের কথা বলতে গেলে গতির কথাই বলতে হবে। গতির পাশাপাশি সরল বয়ান ভালো লেগেছে। পাশাপাশি পড়েছিলাম অমিতাভ ঘোষের ‘ভাটির দেশ’। এটায় গতি একটু কম। পরে দেখলাম কম গতিতে অনুভব শক্তি বেশি, চিন্তার বিস্তার বেশি। স্বাভাবিকভাবেই ওটা বেশি ভালো লেগেছে।
আরেকটা বিষয় কি জানো? গল্প বলায়, লেখায় আমাদের লেখকরাও ভালো। তবে পৃথিবীতে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান, পাঠকের কাছে বই পৌঁছাতে প্রকাশকের ব্যর্থতা, লেখকের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা, অনুবাদ না থাকায় আমাদের লেখা দেশ-বিদেশের পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারছে না।
সাকিব
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে লেখকদের জন্য কি কি সুবিধা দিতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
জাহেদ
একটা লেখা সারা দেশে আর অনুবাদের মাধ্যমে দেশের বাইরে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে রাষ্ট্র সহযোগিতা করতে পারে। পাঠাগারের সংখ্যা বাড়িয়ে আরো বেশি বই কিনতে পারে। বই নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আয়োজন করতে পারে। এতে করে বইয়ের বাজারটা বড় হবে। বাজার বড় হলে লেখকের সম্মানীর পরিমাণও বাড়বে।
সাকিব
এমন কোনো প্রসঙ্গ কি রয়েছে, যেটা লেখায় এলে লেখক হিসেবে আপনি অস্বস্তি বোধ করেন?
জাহেদ
অনেক ক্ষেত্রেই তো আড়াল-আবঢাল রাখতে হয়। ধর্মীয় আর যৌনতার বিষয় তো আছে; আরো বিষয় আছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে লেখার ওপর প্রলেপ দিতে হয়। বলতে পারো, শব্দের ওপর কাপড় পরাতে হয়।
সাকিব
কোন ধরনের লেখা আপনি কখনো লিখবেন না?
জাহেদ
দেখা গেল, যা লিখতে চাইছি তা লিখতে পারছি না। আর যা লিখতে চাই না তা-ই লিখে ফেললাম। লেখা এক অদ্ভুত প্রক্রিয়া। আগে থেকে কিছু বলার সুযোগ নেই।
সাকিব
‘সক্রেটিস’ নামে একটা চরিত্র আছে আপনার। এটা কীভাবে এল?
জাহেদ
হঠাৎ এসে গেছে। এর পেছনে আমার মেয়েরও হয়ত ভূমিকা আছে। তুমি তো চরিত্রটাকে খুব পছন্দ করেছ। এখন মনে হচ্ছে এই ভূতটা আসলেই মজার।
আপনি শিশু সাহিত্য লিখছেন দীর্ঘদিন। শিশুদের জন্য লিখতে গেলে কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়?
জাহেদ
ছোটকাল থেকেই রূপকথার গল্প শুনে বড় হয়েছি। বড় হতে হতে কিংবা লিখতে লিখতে মনে হয়েছে, শিশুদের জন্য প্রচুর ফ্যান্টাসি সৃষ্টি করতে হবে। শিশুদের লেখার ক্ষেত্রে লেখায় বেশি মজা আনা, সরল ছোট ছোট বাক্যে শুদ্ধ করে লেখা, আশ্চর্য জগৎ তৈরি করা-এসব তো আছেই।
সাকিব
সম্প্রতি ‘মারিয়া পালমা’ নামে একটা ছোটগল্পের বই এল আপনার। এই বইয়ের পা-ুলিপি তৈরি হলো কীভাবে?
জাহেদ
গল্প ছিল পঁচিশ থেকে ত্রিশটা। কোনটা রেখে কোনটা ফেলব, এ ছিল বড় সমস্যা। ওখান থেকে বাছাই করেছি চৌদ্দটা। প্রথমে ছিল দুটো পর্ব। এক পর্বে সাধারণ গল্প। আরেক পর্বে চট্টগ্রামের ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট গল্প। দুটো ভূমিকাও ছিল।
পরে শোয়ায়েব মুহামদ, স্বরূপ সুপান্থ ও আহমেদ মুনিরকে দেখিয়েছি, আলোচনা করেছি। শেষে পর্বের বিষয় বাদ দিয়ে নয়টা গল্প বাছাই করলাম।
‘দৈত্য’ নামে একটা গল্প আছে। বড় ভাইকে খুন করেছে ছোট ভাই। এখন আফসোস হচ্ছে, সংকলনে ওটা কেন রাখলাম না?
সাকিব
তৃতীয় পুরুষে জাহেদ মোতালেবের একটা বর্ণনা চাই। চরিত্রটা আপনি কীভাবে তৈরি করবেন?
জাহেদ
তৃতীয় পুরুষে লেখা কার্লোস ফুয়েন্তেসের উপন্যাস ‘আউরা’ পড়েছিলাম। অসাধারণ রহস্যময় এক উপন্যাস। তার ভাষা, বিষয় পুরোটাই অন্যরকম।
গত বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে ‘হলুদ চশমা ও না দেখা বীজ’ নামে একটা গল্প লিখেছি। তৃতীয় পুরুষে প্রথম কোনো লেখা। মনিরুল মনিরের ‘খড়িমাটি’র জন্য দিয়েছি। একটু ঢিলেঢালা গল্প। ইচ্ছেমতো ছেড়ে দিয়েছি।
* কভারে ব্যবহৃত লেখকের ছবি : ওমর ফারুক
মন্তব্য