কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন গল্পকার অমিতাভ দাস।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
অমিতাভ দাস: প্রথম লেখার কথা বলতে গেলে কলেজ জীবনের কথা আসবে। মনে হয় ৯৮ কিংবা ৯৯ সালে কলেজ জীবনের প্রেম নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। নামটা ছিল ‘বাসীফুল’। ‘সাম্পান’ বলে একটা হাতে লেখা কাগজে বেরোয়। তারপর বেশ কিছু গল্প লিখলেও নিজের কাছেই ভালো লাগছিল না। ফলত ছাপার প্রশ্ন-ই ওঠে না। তখন অবিশ্যি আমি কবিতায় ডুবে ছিলাম। তারপর একটা আড্ডায় একজনের মুখে একটা গল্প শুনি। ভালো লাগল গল্পটা। বললাম, এইটে যদি আমি গল্প লিখি আপনার আপত্তি নেই তো। সে সম্মতি জানালে আমি লিখি একটা গল্প। নাম দিই:
‘বিষ্ণুপুরে একরাত’। ছাপা হয় বিশিষ্ট গল্পকার কালীকুমার চক্রবর্তীর
‘দাবদাহ’ পত্রিকায়। তখন মনে হয় ২০০০ কি ২০০১ সাল হবে। এটাই ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত প্রথম গল্প। সেই শুরু। লেখাটা অনেক গুণীজনের প্রশংসা পায়। অনেক পরে ২০১৭ তে প্রকাশিত ‘গল্প আমার অল্প’-তে গ্রন্থভুক্ত হয়।
২। ‘ছোটগল্প’ আপনার কাছে কী?
অমিতাভ দাস: ছোটগল্প আমার কাছে এক গভীর বিস্ময়। জীবনের সত্যকে উপলব্ধি। ছোটগল্প আমার কাছে একটা আয়না। যে আয়নায় নিজেকে দেখতে পাই, সমাজ ও সমকালকে দেখতে পাই। এমনকী অতীতকেও দেখতে পাই। ছোটগল্প একটা জার্নি। ওই যে আগে বিস্ময় বললাম-- কেন জানেন-- গল্পের মধ্যে কখন যেন পাঠক আমি টুক করে ঢুকে যাই। আবার লেখক আমি নিজেকেই লিখে ফেলি। তবে সব সত্য বা সব ঘটনা গল্প হয়ে ওঠে না। কিছু কিছু ঘটনা গল্প হয়ে ওঠে।
৩। কথাসাহিত্য মানুষকে কী দিতে পারে?
অমিতাভ দাস: এক কথায় আশ্রয়। কথা সাহিত্য জীবনকে চিনতে শিখিয়েছে। মানুষ অন্বেষণে ব্রতী করেছে। লেখক হিসেবে সর্বদাই আমি জীবনকে খুঁজতে চেয়েছি। উপলব্ধির মর্মমূলে যেতে চেয়েছি। কথা সাহিত্য মানুষ ও না-মানুষ তথা প্রকৃতির জীবন-বেদ।
৪। “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”— ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এরকম শর্ত বা নির্মাণ বৈশিষ্ট্যকে কতখানি সমর্থন করেন?
অমিতাভ দাস: এই শর্তকে সর্বদা মানতে পারি না। মানতে ইচ্ছেও করে না। সব গল্পের পরিণতি সব সময় হয় না। কোনো কোনো গল্প শর্ত অনুযায়ী হয়। এখন বিষয়হীনতার সময়। বিষয়হীনতাও সাহিত্যে একটা বিষয়। আমার গল্পে একটা চলা থাকে--বয়ে যাওয়া থাকে। আসলে কোনো শিল্প-ই নির্দিষ্ট ব্যাকরণ বা কিছু বৈশিষ্ট্য মেনে চিরকাল চলতে পারে না। শিল্পের স্বভাব-ই ফল ব্যাকরণকে ভাঙা। প্রচলিত ধারাকে অস্বীকার করা। নতুন নতুন ধারা বা পথ তৈরী করা। আমার অনেক গল্প-ই প্রচলিত রীতিকে মান্যতা দিয়ে লেখা নয় বলে বহু বার সমালোচিত। কেউ কেউ গল্প বলতে অস্বীকারও করেন। মজার ব্যাপার হল, যাঁরা পূর্বে সমালোচনা করতেন , গল্প বলতে অস্বীকার করতেন তাঁদের কেউ কেউ বিষয়হীন গল্পের দিকে ঝুঁকেছেন। আমি বিশ্বাস করি গল্প লেখা যেহেতু একটি মগ্ন শিল্পকর্ম, সে সময় নিরিখে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যে নিজেকে আটকে রাখবে না। সে ভাঙবে-- পুনর্নির্মাণ করবে।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
অমিতাভ দাস: ‘অনুপ্রেরণা’ শব্দটা পশ্চিমবঙ্গে বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে। যাইহোক, সে দিকে যাচ্ছি না। বিশেষ কেউ বা কোনো ব্যক্তি অনেকের কাছে অণুপ্রেরণা হন। আমার ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। অনুপ্রেরণা সময়-- চলমান ঘটনা, পরিস্থিতি। আমার পরাজয়, এই বেঁচে থাকা, লড়াই করা, ক্রমাগত হেরে যাওয়া, অতৃপ্তি, ব্যর্থপ্রেম--- কিছু না হতে পারার যন্ত্রণা-- এই সিস্টেম--মানুষের মুখ আর মুখোশ-- ভণ্ডামি...এইসব-ই অনুপ্রেরণার কাজ করে। এমনকী নদীর তীরে বসে থাকা প্রেমিকযুগল, শ্মশানের ডোম, নির্জন স্টেশান ঝরে থাকা পাতা-- একটা সবুজ কাঠের বেঞ্চ, রাস্তার কুকুর, পালিত বিড়াল, হঠাৎ দেখা একটি মেয়ের চোখটান, একটা হলুদ শাড়ি বা একটা লাল ওড়না, পীচরাস্তায় ঝরে থাকা পলাশগুচ্ছ আমার অনুপ্রেরণা। আসল কথা হল ভালো ভাবে বেঁচে থাকার খিদেটাই আমার গল্পের অণুপ্রেরণা।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
অমিতাভ দাস: কেবল শুরুর দিন নয় বর্তমান কালেও নিন্দুক, বন্ধু, শত্রু, সমালোচক সবাইকে নিয়েই চলতে হচ্ছে। লেখার শুরুর দিকে এত সমস্যা হয়নি। এত শত্রু ও নিন্দুক ছিল না। সমালোচক সমসময়-ই ছিল। শুনুন, আপনি যদি ভালো লেখেন আপনার শত্রু এমনিই তৈরী হয়ে যাবে। লেখার সমালোচনা না করে আপনার নামে ব্যক্তি কুৎসা করবে। এসব হল অক্ষমের প্রলাপ। এসব ছিল, আছে এবং থাকবে। এগুলো মানুষের রিপুদোষ। তবে ইদানীংকালে দু-চারজন বন্ধু আছেন সত্য। নিন্দুকের সংখ্যাই বেশি। আমি কাউকেই আমার শত্রু বলে মনে করি না, তাই কে আমার শত্রু বলতে পারব না। সমালোচক তো আমার পাঠক। সব সময় তাঁদের পাশে পাই। মনে রাখবেন, একজন প্রকৃত লেখক খুব একা--বান্ধববর্জিত। আর আপনি যত একা হবেন বুঝবেন সঠিক পথেই এগোচ্ছেন। লেখাটা একটা সাধনার ব্যাপার। সে গভীর নির্জন পথে একাকী চলাই শ্রেয়।
৭। লেখালিখির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ তত্ত্ব বা রাজনৈতিক দর্শন কতোটা জরুরী বলে আপনি মনে করেন?
অমিতাভ দাস: না। লেখালিখির ক্ষেত্রে কোনো তত্ত্ব বা দর্শনে আমি বিশ্বাসী নই। যখন যেমন মনে হয় লিখি। যা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি তাই লিখি। জ্ঞানত কোনো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাইনি। আর সেটা মনে হয় ঠিকও নয়। লেখক স্রষ্টা। কোনো তত্ত্ব বা মতবাদ বা ইজমে আটকে গেলে লেখার ব্যপ্তি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। লেখকও তখন একটা গন্ডীর মধ্যে আটকে পড়েন। অথচ সেটা তো হবার কথা নয়।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
অমিতাভ দাস: জীবন তো প্রতিনিয়ত শিক্ষা দিয়েই চলেছে। ওই যে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন না ‘যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি’। সেভাবেই তো শিখে চলেছি। শিখছি এখন কেবল ভালো লিখলেই হবে না আরো অনেক গুণ থাকা দরকার। সেসব গুণ না থাকলে আপনি ডাক পাবেন না, আলোচিত হবেন না। এইসব। তবে কী জানেন, ভালো লেখা থেকে যায়। থেকে যাবে। ওই যে সাধনায় বৃত থাকা--- তবে তা খুব কঠিন এই সময়ের নিরিখে। বারবার আসন টলে যায়-- মন খারাপের মেঘ জমে। অযোগ্য মানুষ যখন শ্রেষ্ঠতম আসন পায়--- ফাঁপা কোলাহলে মঞ্চ কাঁপায়-- হাততালি ও মিথ্যে প্রশংসা পায় তখন সামান্য হলেও মনখারাপ হয়। অনেক যোগ্য মানুষ আড়ালেই থেকে গেলেন। সব চাইতে বেশি যেটা বুঝলাম, তা হল সাহিত্য এখন সিণ্ডিকেটের দখলে।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
অমিতাভ দাস: প্রভাব ফেলবে না! অবশ্য-ই প্রভাব ফেলেছে। লেখক একজন সামাজিক মানুষ। তিনি সমাজেই তো বাস করেন। সমাজে ঘটে চলা ঘটনার প্রভাব তাঁর ব্যক্তিজীবন ও লেখক জীবনে পড়তে বাধ্য। সেভাবেই করোনার প্রভাব আমার ব্যক্তিজীবন ও লেখকজীবনে পড়েছে। পেশার সংকট ও আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। মানসিক সংকট কম দেখা দেয়নি। আসলে কী জানেন, মানুষ মানুষকে ছাড়া বাঁচতে পারে না-- এই প্রকৃতিই হল ঈশ্বর। তাঁকে বাদ দিয়ে বা অবহেলা করে বা নষ্ট করে আমরা কখনোই একা একা বাঁচতে পারি না। করোনা আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। সেসব বারবার আমার গল্প-কবিতায় উঠে এসেছে। লকডাউনের সময় কালে ডায়রি লিখেছি। সেগুলিতে ওই সময়কালের যন্ত্রণা, অভিজ্ঞতা ও যাপন লেখা আছে। শীঘ্র বই হিসেবে আসছে। নাম: নির্জনবাসের দিনগুলি। এছাড়া অনেকগুলো গল্প, অণুগল্প লিখেছি।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
অমিতাভ দাস: পাঠকরাই আমার সমালোচক। আমার লেখার বিচারক। তাঁরা পড়েন বলেই আমি এখনো লিখতে পারছি। উৎসাহ পাই। বই বিক্রি হয়। তবে একটা কথাই বলার, তা হল বিখ্যাত বা বানিজ্যিক পত্রিকার আড়ালেও অনেক ভালো ভালো লেখক-কবি আছেন। যাঁরা নিরন্তর ফেসবুকে বা বিভিন্ন ছোট পত্রিকায় লিখছেন। তাঁদের লেখাও পড়ুন। ছোট পত্রিকার পাশে থাকুন। এইটুকুই পাঠকের কাছে আমার বিনীত আবেদন।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: অমিতাভ দাস মূলত কবি। তবে কবিতার পাশাপাশি তিনি অণুগল্প, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লেখেন। প্রকাশিত বই ২৭টি।
অবগুণ্ঠন সাহিত্য পত্রটির সম্পাদনা করে আসছেন ১৯৯৬ সাল থেকে। উল্লেখযোগ্য কবিতার বই- রাধিকা অথবা কুসুম, রাতের জার্নাল, সব ধুলো হয়ে আছে, শরীর শরীর আলো, সেতার ভিজছে জলে, অ্যাকোয়ারিয়াম, অমিতাভ উবাচ, নির্বাচিত ১০০। ছোটদের জন্য লেখা গল্পের বই ‘গাছবন্ধু’। ‘গল্প আমার অল্প’, ‘বিষাদসুন্দরী’ ও ‘লালপদ্ম’ তাঁর দু’টি ছোটগল্পের সংকলন। দেশ, যুগশঙ্খ, নন্দন, কথা সাহিত্য, সুখবর, উৎসব, তথ্যকেন্দ্র, উদ্বোধন, রক্তমাংস, কবি সম্মেলন, কৌরব, ইসক্রা সহ নানা কাগজে লেখা প্রকাশিত হয়।
পেয়েছেন ‘বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ পুরস্কার’, ‘সুতরাং সাহিত্য সম্মান’, ‘কলম সাহিত্য সম্মান’, ‘কালদর্পন সাহিত্য সম্মান’, ‘টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার’, ‘অনিলা দেবী সাহিত্য পুরস্কার’।
ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ।
মুছুনখুব ভাল বললে অমিতাভ। সম্পূর্ণ সহমত তোমার সঙ্গে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ জানাই।
মুছুনপড়ে ফেললাম। ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ জানাই।
মুছুনঅনেক না জানা কথা জানলাম, কিছু অবশ্য জানা কথা ও আছে , ভালো লাগলো। (পূজা বিশ্বাস)
উত্তরমুছুন