কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন কবি আহমেদ মওদুদ।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
আহমেদ মওদুদ: দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় পাখি নিয়ে আট/দশ বাক্যের একটা গল্প লেখি। প্রথম লেখা বলতে ওই গল্পটাই। গল্প-কবিতার বই খুব একটা ছিলোনা বাড়িতে। বিশেষ করে ছোটদের জন্য। তবে বড়দেরকে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস এবং মীর মোশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়তে দেখতাম। আর দাদীর ছিল পুঁথি পাঠের অভ্যাস। গ্রামের নারী-পুরুষদের অনেককেই বিকেল হলে দাদীর পাশে জড়ো হতে দেখতাম পুঁথি শোনার জন্য। কৃষিনির্ভর পরিবার হলেও বাবা নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। এই সবই হয়তো আমার শিশু মনের ভেতরে নিরবে এক লেখক সত্ত্বার আবহ তৈরিতে সাহায্য করেছিল। সপ্তম শেণীতে পড়ার সময় দেখলাম আমার মামাতো ভাই জাহাঙ্গীর ছড়া লিখে দেখাচ্ছে সবাইকে। ওর ছড়া ছিল মূলত অন্তমিল প্রধান এবং ভাব আর ভাষায় যথেষ্ট অসঙ্গতি। তখন মনে হলো আমি ইচ্ছে করলে ওর চেয়ে ভালো লিখতে পারবো। তখন ছড়া লেখতে শুরু করি এবং প্রচুর ছড়া লিখি। এরপর এইচ.এস.সি পাস করার পর একটি কিশোর উপন্যাস লেখি যেটা ২০০৭ সালে ‘নিসর্গ’ থেকে বের হয়। কবিতা মূলত এইচ.এস.সি. পাশের পর লেখা শুরু করি।
২। কবিতা আপনার কাছে কী?
আহমেদ মওদুদ: কবিতা বলতে আমি কবির অর্ন্তদহনের নির্যাসকে বুঝে থাকি, হৃদয়ের ছায়া অথবা যাপনের লিখিত রুপকে বুছে থাকি। কোনকোন ক্ষেত্রে কবিতা বলতে আমি দর্শনের শিল্পিত রূপকে, কাব্যিক উপস্থাপনকেও বুঝে থাকি যার উপস্থাপক, রূপকার মূলত কবি। এবং শেষ পর্যন্ত কবিতা আমার কাছে আশ্রয়।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
আহমেদ মওদুদ: কবিতা মানুষকে নানান মাত্রায় মুক্তি দিতে পারে আর অ-মানুষকে দিতে পারে অন্তর্জ্বালা। জ্বালা থেকে জ্বলে ওঠার সম্ভাবনাও এনে দিতে পারে কবিতা। অবশ্য কবিতা মানুষকে যা এনে দিতে চায় তা নিতে চায় কি মানুষ অথবা তা নেওয়ার আগ্রহ রয়েছে কি মানুষের? এটাও একটা বড় প্রশ্ন।
৪। আপনার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
আহমেদ মওদুদ: লিটল ম্যাগাজিন এবং ওয়েবজিন সম্পাদকগণই আপাতত আমার লেখার প্রেরণা। সম্পাদকগণ মূলত লেখক আর পাঠকের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনের কাজটি করে থাকেন। তাই সম্পাদকের তাড়নাকে পাঠকের তাড়না হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ফলে কোন সম্পাদক লেখা চাইলে অনুপ্রাণিত হই। সময় সুযোগ বের করে চেষ্টা করি কবিতা লেখার। এছাড়া ফেসবুককেন্দ্রীক যে সমান্য পাঠক রয়েছেন আমার কবিতার তাদের দ্বারাও অনুপ্রাণিত হচ্ছি আজকাল।
৫। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পকের্ত জানতে চাচ্ছি। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
আহমেদ মওদুদ: কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আমি মূলত বড় ক্যানভাসকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি যেটা ইতোপূর্বে অনেকেই করেছেন। অর্থাৎ ক্যানভাস বড় হলে যেমন ইচ্ছে মতো তুলি চালানো যায় অনেকটা তেমন আরকি। ২১শে বইমেলায় প্রকাশিত কবিতার বই “দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে”র কথা বলতে পারি এক্ষেত্রে। এই বইয়ে নানান মাত্রার দুঃস্বপ্নকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছি আমি। ক্যানভাস বড় হওয়াতেই আমি এই সুবিধাটি পেয়েছি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই আট বছর মূলত আমি এই সিরিজের বাইরে একটি কবিতাও লিখেছি বলে মনে পড়ে না। এরপর ২০১৯ সাল থেকে ‘ধানসূত্র’ নামে আরও একটি বড় ক্যানভাস নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছি। এখানে আমি কৃষক জীবনের ঐতিহ্য আনন্দ-বেদনা আর হতাশাকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছি।
তুলনামূলকভাবে কবিতা কম লেখার কারণে অনেক ভাবনাই ভেতরে জাত হতে থাকে। ফলে কবিতা লেখার জন্য আমার পূর্বপ্রস্তুতির খুব একটা দরকার হয় না, বা ভাবতে হয় না। লেখার টেবিলে বসার মতো সময় বা সুযোগের দরকার হয় মাত্র। তবে এক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজটি করে থাকেন লিটল ম্যাগাজিনের প্রিয় সম্পদকগণ, যা আমি আগেই বলেছি।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক-এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
আহমেদ মওদুদ: উত্থান না বলে পুনরুত্থান বলা যেতে পারে। ২০১০ সাল পর্যন্ত আমি মূলত দৈনিকের সাময়িকী এবং দৈনিকঘেঁষা লিটল ম্যাগাজিনগুলোর লেখক ছিলাম। একপর্যায়ে নানান কারণে এসব পত্রিকা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনি এবং লেখালেখির প্রতি একধরনের অনীহাও চলে আসে এসময়। আর এ পর্বেই ওই যে বললাম পুনরুত্থানের কথা, সেটাই ঘটে আমার লেখার জগতের। এবং সেটা ২০১১ সালে ‘বিন্দু’ সম্পাদক কবি সাম্য রাইয়ানের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমেই ঘটে মূলত। এসময় থেকেই আমি বিন্দুর নিয়মিত লেখকে পরিণত হই বলা যায়। ‘বিন্দু’ আমার লেখক জীবনের পুনরুত্থান ঘটায়। সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই ‘দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে’র আশি ভাগ কবিতাই বিন্দুতে প্রকাশিত। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বিন্দুই আমার পরম বন্ধু বা সুহৃদ। দুঃস্বপ্নের বাকী কবিতাগুলোও সমমনা অন্যান্য লিটলম্যাগেই প্রকাশিত।
কবি বা শিল্পীর অভিধানে শত্রু শব্দটা থাকা উচিৎ নয় বলে মনে করি। ‘শত্রু’ শব্দটা মূলত সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ আর মাফিয়াদের অভিধানে থাকে। কারণ এদের মাঝে লোভ লালসা খুব বেশি পরিমাণে কাজ করে এবং এরাই মূলত অন্যদেরকে শত্রু জ্ঞান করে থাকে। ফলে এক কবি আর এক কবির বা এক শিল্পী আর এক শিল্পীর কেবল বন্ধুই হতে পারে, শত্রু নয়। সৃজনশীলরা যখন একে অন্যকে শত্রু বা প্রতিযোগী মনে করে তখন শিল্প তার মাধুর্য হারায়। নোংরা হৃদয় থেকে কেবল নোংরামির সৃষ্টিই হতে পারে শিল্পের নয়। যে হৃদয়ে ঘৃণা আর ক্রোধ থাকে তার থেকে শিল্প সৃষ্টি হলেও তা দীর্ঘমেয়াদে সুবাস ছড়ানোর বদলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। তবে শিল্প-সাহিত্যে নিন্দুক বা সামলোচক রয়েছে এবং এদের সংখ্যা এত বেশি যে জীবনে এরা কৈয়ের ঝাঁকের মতো আসে আবার কালের স্রোতে হারিয়ে যায়। নাম ধরে গুনে এদের তালিকা করা প্রায় অসম্ভব। তাই এদেরকে সামলানোর দায়িত্ব মহাকালের। মহাকাল সামলে নিক এদের। আর শিল্পীর দায়িত্ব শিল্পকে এবং নিজেকে সামলানো।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দূর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ সন্ত্রাস-মৌলবাদ ঠেকাতে, আরো নানা কিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
আহমেদ মওদুদ: দূর্নীতি-সন্ত্রাস-মৌলবাদ, এসব ঠেকানোর জন্য পাঠাগার পরোক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য আমি অনেক আগে থেকেই বলে আসছি, পাড়ায় পাড়ায় পুলিশ ফাঁড়ির বদলে পাঠাগার গড়ে তোলা দরকার। যেহেতু পাঠাগার সাহিত্যের আধার সেহেতু এসব অনাচার দূর করতে সাহিত্যের পরোক্ষ ভূমিকা অস্বীকার করবার নয়। তবে সাহিত্য দিয়ে আমি আপাতত দুঃস্বপ্নই দেখাতে চাই। কারণ স্বপ্ন দেখালে স্বপ্নভঙ্গের বিষয়টিও থেকে যায়। কিন্তু দুঃস্বপ্ন দেখালে স্বপ্ন ভঙ্গের ভয় আর থাকে না। যেহেতু মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখতে আরাম বোধ করে সেহেতু তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় বার বার। আর দুঃস্বপ্ন অনেকটাই বাস্তবের কাছাকাছি। দুঃস্বপ্ন মানুষকে মোহ থেকে মুক্ত করে স্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়ে দেখার সাহস যোগায়। ফলে কবিতায় আমি অনেকটা চাঁচাছেলা, মেদহীন, আর মরুর মতো রুক্ষ, যা পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় বাস্তবতার সামনে, দুঃস্বপ্নের সামনে। ফলে প্রতারিত হতে হয়না পাঠককে।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে কী শিক্ষা দিল?
আহমেদ মওদুদ: যাপিত জীবন মোটামুটি আমাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে। ফলে আমি একা থাকার যোগ্যতা অর্জন করেছি। আর একটা বিষয় আমি বুঝে ফেলেছি যে, মানুষ ব্ল্যাকহোল থেকে এসে ব্ল্যাকহোলে নেচেকুঁদে আবার ব্ল্যাকহোলে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। অর্থাৎ মানুষ অন্ধকারকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়। এবং মানুষ পোকামাকড়ের চেয়ে অধম কারণ পোকা-মাকড় আলো দেখলে ছুটে আসে আর মানুষ অন্ধকারে ছুঁড়ে দিতে পছন্দ করে নিজেকে।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালেখিতে কোন প্রভাব রেখেছে কি?
আহমেদ মওদুদ: আমার লেখালেখিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে করোনা। নানা রকম হতাশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র আট মাসে আমি ‘ধানসূত্র’ সিরিজের ২৫টি কবিতা লিখেছি। এক্ষেত্রে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩টি কবিতা লেখা হয় যা আমার লেখালেখির জীবনে বিষ্ময় বলা যেতে পারে। এত অল্প সময়ে এত বেশি কবিতা ইতোপূর্বে লেখা হয়নি আর। এর বাইরে কবিতা বিষয়ক ৩টি প্রবন্ধও লিখেছি এসময়ে। করোনাকালীন অর্থহীন অবসরকে অর্থবহ করে তুলতে যারা নানাভাবে আমার পাশে থেকেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলেন?
আহমেদ মওদুদ: পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবো, স্নায়ু আর হৃদয়ের সম্মিলনে অনেক ভালো কবিতা লিখছেন এসময়ের কবিরা। একটু খোঁজ-খবর রাখলেই ভালো কবিতার বইয়ের খোঁজ পাওয়া আগের যে কোন সময়ের চেয়ে সহজ এখন। কবিতার সাথে থাকুন, কবির সাথে থাকার চেষ্টাও করুন খানিকটা। কারন এই মরার দেশে পাঠকই কবির বড় ভরসা, আত্মিক বন্ধু।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: কবি আহমেদ মওদুদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮১ খিস্টাব্দে। মহিন্দ্রাফতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আফানউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে মাহিগঞ্জ কলেজ ও কারমাইকেল কলেজে একাডেমিক পাঠের সমাপ্তি ঘটে। পেশাঃ শিক্ষকতা। প্রধানত কবিতা, গদ্য, কিশোর উপন্যাস লিখেন।
প্রকাশিত কবিতার বই: দেহের আড়ালে থাকে প্রকৃত স্বজন (২০০৯), দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানের খন্ডচিত্র (২০০২), দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে (২০২১)
কিশোর উপন্যাস: কিশোর (২০০৭), কবি (২০১৭)
গবেষণা: রংপুরের লোকছড়া (২০১৭)
জীবনী গ্রন্থ: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২০২০)
জীবন কবিকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে৷ এই বক্তব্য আমার সাময়িক হাসির উদ্রেক করলেও পরমুহূর্তেই এর গভীর মর্মার্থ উপলব্ধি করলাম৷ কবি ও বিন্দুর জন্য এক বুক ভালোবাসা৷
উত্তরমুছুনভাল্লাগছে মওদুদ ভাই৷
উত্তরমুছুন