কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় প্রথম লেখা। মূলত একুশ স্মরণে একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ওখানেই প্রকাশের জন্য প্রথম লেখা লিখি। সম্ভবত ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। মনে নেই সময়টা সঠিক। মাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকে বিভিন্ন সময়ে এরকম আরো উদ্যোগে লেখা দিতে থাকি। লেখা দেওয়ার জন্যই লিখি আর কী। এছাড়াও প্রাথমিকে পড়ার সময় থেকেই বিভিন্ন সৃজনশীল সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। সেসব সংগঠনের মুখপত্র বা দিবসভিত্তিক প্রকাশনায় কখনো কখনো লেখা ছাপতে দিয়েছি। এগুলোই প্রথম লেখাকেন্দ্রিক স্মৃতি। তবে, সিরিয়িাস লেখার কথা যদি জানতে চান সে অন্য গল্প। আরো পরিণত বয়সে সিরিয়াস লেখার শুরু। সময়টা ৯৭ কী ৯৮ সালের কথা।
২। কবিতা আপনার কাছে কী? (কবিতা নিয়ে আপনার আইডিয়া/চিন্তার কথা বলুন।)
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: সাহিত্যের অন্যতম একটি ধারা হিসেবে কবিতা আমার কাছে একইভাবে উপলব্ধ, মানুষের অনুভূতির গভীর উপলব্ধি। এবিষয়ক কোনো উত্তরই সম্পূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে না। কারণ আমার কাছে মনে হয়, এর ভিন্ন ভিন্ন বয়ান কবিতা লেখকের কাছে ধরা দিতে পারে। অনেকসময় এই উপলব্ধিটা কবিতা লেখক কাউকে জানতে দেয় না বলেই আমার মনে হয়। কিংবা এমনও হতে পারে ঠিক ভাষায় প্রকাশও সম্ভব হয় না। তবে আমি কবিতায় চিন্তা উদ্রেকের কথা ভাবি। এই সময়, এর স্থিতি বা পরিক্রমা, এর সাথে আমার জীবনবোধ- এগুলোর সামগ্রিক উপস্থাপন আমার কাছে কবিতা হিসেবে ধরা দেয়। আমি যেভাবে বুঝি আর কী।
কবিতা নিয়ে আমার কোনো আইডিয়া কাজ করে না। লিখছি, আরো লিখতে চাই। নির্দিষ্ট আইডিয়া বা চিন্তা, যে অর্থে কন্সেপ্টচ্যুয়াল রাইটিং, ওটা কবিতার জন্য বাধা বলে মনে হয়। আমার কাছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখাটা জরুরী বলে মনে হয়।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: নির্দিষ্ট করে কবিতা কি কিছু দিতে পারে? এটা কি সম্ভব? পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য বলা যায় অনেক কিছুই, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এর উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। কবিতায় লেনদেনের ভাবাদর্শ আছে বরে মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, যিনি কবিতা লেখেন এবং যিনি পড়েন; তাদের দুজনের মধ্যে নতুন দরজা উন্মুক্ত হতে পারে। সেটা-চিন্তার। নিছক ‘দেওয়া’ অর্থে তা বলতে চাই না।
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: আমার কোনো পদ্ধতি নাই। কবিতা লিখি উপলব্ধি থেকে। ফলে যখন লিখি, তখন ওই লেখার মধ্যেই থাকি। আমার লেখা, আমার চারপাশের অভিজ্ঞতাজাত। আমি যেভাবে দেখি, সেভাবেই বলার চেষ্টা করি।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: ছোট বয়সে বাবা’র লেখা কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হই। পরবর্তীতে কবিতার নিমগ্ন পাঠক হিসেবে বাংলা ভাষাভাষি কবিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। প্রিয় কবি বা তাদের লেখা বারবার প্রাণ দিয়েছে না লিখতে পারার সময়টাতে। প্রিয় বন্ধুজন অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। আমার কবিতার পাঠক, যে সামান্য কয়জন আছেন, তাদের অনুপ্রেরণা বড় বেশি।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: উত্থান বলতে যা বোঝা হয় সে অর্থে আমার কোনো উত্থান নেই। গত ২২-২৩ বছর ধরে কবিতা লিখছি। ভালো-মন্দের কথা খুব বেশি লোক বলেনি। সহ-লেখকরাও নন। কাউকে জিজ্ঞেস করে প্রায়ই উত্তর পাইনি। খোদ আমার শহরেও, খুববেশি মানুষ আমার লেখক সত্ত্বার প্রতি সংবেদনশীল নয়। কোনো সমালোচক আমার লেখার সমালোচনা করেছেন বলে মনে পড়ে না। ফলে, এই বিষয়গুলো আমার কাছে কখনোই সামলানোর প্রয়োজন হয়নি। লিখে যাচ্ছি, এই তো। যতদিন পারবো, লিখবো।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস–মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: সাহিত্য আমার কাছে সমসাময়িকতার বিষয়। যে সময়ে আমি বাস করি, সে সময়ের কথা সাহিত্যে থাকবে এটাই কাম্য। সে অর্থে-লেখক যদি তার লেখায় সময়ের কোনো বঞ্চনা-বেদনা তুলে ধরে তা বন্ধ করতে বলেন, তা আমার কাছে অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয় না।
কবিতা লেখা আমার কাছে অত্যন্ত সংবেদনশীল অনুভূতিলগ্ন একটি বিষয় বরে মনে হয়। দৃশ্যের বাস্তবতাকে দেখার ভিন্নতর উপলব্ধি বলে মনে হয়। তোই আমি ওই লেখাটাই লিখতে চাই, যেটা অন্যের ভেতর সংবেনশীলতা তৈরী করে। আমি কিছু পাল্টাতে চাই কি না লৈতে পারবো না, তদবে এই কথাটা বলতে চাই-যা আমার দৃষ্টিতে বলা প্রয়োজন।
৮। যে জীবন আপনি এতবছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: শিক্ষা তো আর কম নয়। একক কোনো শিক্ষা বলতে পারছি না এই মুহূর্তে।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: রেখেছে। ওই সময়ের গৃহবন্দী জীবন দারুণ এক টানাপোড়েনের। ওই সময়ের অভিজ্ঞতা আমার লেখায় আছে। ওরকম একটা সময়-মানুষের দৈনন্দিন জীবন একেবারে ভেঙে পড়োছলো। কত মানুষ যে চাকরি-বাকরি হারিয়ে না-মানুষ জীবন কাটাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। লক ডাউনে আমি পরিবারসহ চট্টগ্রামে চলে আসি। কিন্তু প্রতিদিন খবরে দেখতে পেতাম ঢাকা শহরের মানুষ বাসা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গেছে। কিংবা আরো কম ভাড়ায় অন্য কোন এলাকায় যাচ্ছে। এই যে একটা চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়, এর একটা নীরব ক্ষয় উপলব্ধি হচ্ছিলো। আবার ঢাকায় ফিরে আসি পেশাগত কাজে যোগ দেই। কিন্তু অনেক মানুষ এই যে একটা চরম দুঃসময় কাটাচ্ছে এটা একেবারে হাওয়া। মনে হচ্ছে খুব স্বাভাবিক। মানুষ কাজে যাচ্ছে, বাজার করছে, রেস্তোরাগুলোতে হুলস্থুল। আদতে কি তা? এগুলো খুবই পীড়াদায়ক। আমার এই সময়ের লেখাগুলোতে এই কথাগুলো এসেছে।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
সৈয়দ সাখাওয়াৎ: পাঠকই তো বক্তা।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: সৈয়দ সাখাওয়াৎ ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।
প্রকাশিত কবিতাবই: খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ (২০১৩), পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে (২০১৭), নিহিলের বনে (২০২১)।
মন্তব্য