কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন কবি শানু চৌধুরী।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
শানু চৌধুরী: আমার প্রথম লেখা বলতে ‘নাম লিখিনি’ নামের একটি জঘন্য কবিতা। ২০১৫ সালে আমি এমন কিছু সমমনষ্ক বন্ধুদের সাহচর্য পাই, যে তাঁরাই আমাকে অজান্তে আজও কবিতা লিখিয়ে নিচ্ছে বলে আমার মনে হয়।
২। কবিতা আপনার কাছে কী?
শানু চৌধুরী: কবিতা আমার কাছে সততা। আমি সবার কাছে অসৎ হতে পারি। কিন্তু কবিতার কাছে নয়। অনেকেই কবিতা সম্পর্কে ইনিয়ে-বিনিয়ে নানান কথা বলেন কিন্তু আমার মনে হয় ওসব ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। নিজেদেরকে এলিট ও মহৎ দেখাবার জন্য কবিরা ‘দৈবশব্দ’, ‘নিজেকে পুড়িয়ে লেখা’ এই সবের ফাঁদ পাতেন।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
শানু চৌধুরী: কবিতা মানুষকে কিছু দিতে পারে না। কবিতা মানুষকে নিতে পারে তার চোরকুঠরিতে। যেখানে শুধু সীমাহীন সম্ভাবনা আর তাকে খনন করে যাওয়া...
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি৷ ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
শানু চৌধুরী: দেখুন, একটা ভাবনা না এলে কবিতা লেখা যায় না তবে সৃজন পর্যায় পৌঁছতে কবিতা কি সত্যিই যেতে চায়? কবিতা যত ন্যাংটো হবে, যত নিরাবরণ হবে তবেই হয়ত তাঁর মাইক্রোস্কপিক এলিমেন্টগুলোকে দেখা যাবে। তাই সৃজন নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। শুধু এটুকু জানি, আমার একটা কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পর সেটাকে ধ্বংস করেই পরের কবিতায় যেতে হবে।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
শানু চৌধুরী: কেউ না। আমি যে সময়ে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে ‘অনুপ্রেরণা’ নিয়ে ‘মন কি বাত’ করাটা নকল ও কৃত্রিম বলে মনে হয়। তবে প্রিয় কবি অনেকেই আছেন।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
শানু চৌধুরী: আমি মনে করি আমার কোনোদিন উত্থান না ঘটুক। কারণ, একজন লেখকের উত্থান ঘটা মানে সে মালটা হয় সিনিয়রদের তেল মারে নয় তরুণদের দিয়ে তাঁর সামনে ব্যারিকেড তৈরি করায়। এসব আমি ২০১৬ থেকে দেখে আসছি তাই উত্থানকে আমি ঘৃণা করি আর উত্থান মানেই কব্জির জোর! সাহিত্যজগতে আমি আর বন্ধুত্ব করতে চাই না। ২০১৯-এ এই বন্ধুত্বই আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমাকে সাহিত্য জগতের ভিতরকার অন্ধকার দেখিয়েছে। সেটা সামলাতে আমাকে একজন মনোবিদের পরামর্শ নিতে হয়েছিল।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস–মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
শানু চৌধুরী: সাহিত্য দিয়ে এই সময়ে আর কিছু করা যায়? চারিদিকে এতো প্রোপাগাণ্ডার সমাহার। ইন্টারনেট এত নানাবিধ অ্যাবরাপশন এসবের মধ্যে দিয়ে পার হওয়া খুব কঠিন! তবে চেষ্টা করতে হবে, রুখতে হবে। তার মাঝেও আবার খেয়োখেয়ির বিবাদ ও মনোমালিন্য দেখি। এসবের মধ্যে নিজের লিখে যাওয়াটাই একরকম বিদ্রোহ। যেখানে টানটান বা চড়া আওয়াজের প্রয়োজন নেই সামান্য ইঙ্গিতই কাফি। এই যে আমি কাফি বললাম এখানেই অনেকের রাগ হতে পারে, কেন আমি এই শব্দটা ব্যবহার করলাম?
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
শানু চৌধুরী: আমাকে জীবন মানুষ চিনতে শেখালো না তার বদলে বারবার বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে। কারণ, ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
শানু চৌধুরী: আমি করোনা তথা এই অতিমারীর পূর্বে যে জীবন কাটাতাম সেটাও একপ্রকার গৃহবন্দী জীবন। অনেকটা হাউস অ্যারেস্টের মতন-- তাই আলাদা করে কিছু অনুভব করিনি। সারাদিন বই পড়ে সিনেমা দেখে কাটাই। করোনাকালীন সময়েও তাই করেছি।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
শানু চৌধুরী: আমার পাঠক কে? আজকাল প্রত্যেক লেখকই তাঁর চাইতে নিম্নস্তরের লেখককে পাঠক বলে ভেবে নেন। এভাবেই শৃঙ্খল অনুযায়ী চলছে এসব কান্ডকারখানা। সবাই ছুটছে নিরঙ্কুশ নিদ্রাহীনভাবে পিঠ চাপড়ানোর খেলায়। তাই আমার কিছু বলার নেই পাঠককে। শুধু এটুকুই বলার বেশি করে বাংলা বই কিনুন ও পড়ুন। জয় বাংলা।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: শানু চৌধুরীর জন্ম ১৯৯২ সালের ৩১শে জানুয়ারি, ভারতে। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক শানুর লেখালেখি শুরু ২০১৫ সাল নাগাদ। এখনও পর্যন্ত একটি কবিতার বই ‘আলো ও আত্মহত্যা’, প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে। তারপর ২০২১ এ ‘পল ক্লির কবিতা’ অনুবাদ করেছেন। কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ ও গল্প লেখার প্র্যাক্টিশনার।
মন্তব্য